প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ

প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ
প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ

এক সপ্তাহ আগে ও পরে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন গোল্ড কোস্টের দুটো অনুষ্ঠান হয়ে গেল। গত সপ্তাহে হলো শীতের পিঠা উৎসব। এ সপ্তাহে বার্ষিক বনভোজন।

আমি শীতের পিঠা উৎসবের কথাই আগে বলি। বাংলাদেশের ঠিক উল্টো ঋতু এখানে। এখানে এখন শীতকাল। এবারের শীতটা সত্যি জেঁকে পড়েছে। যদিও নিউজিল্যান্ড ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডে আসার পর প্রথম দুই বছর শীত কী বুঝিনি। নিউজিল্যান্ডে শীতকাল মানে তুষারপাত বা বরফ পড়া। সেখানে অস্ট্রেলিয়াতে ৯-১০ ডিগ্রি তো কিছুই না। কিন্তু এবার কুইন্সল্যান্ডে শীতটা সত্যি সত্যি অনুভূত হয়েছে। গোল্ড কোস্টে নিউজিল্যান্ড থেকে অভিবাসী হয়ে আসা প্রচুর মানুষ বসবাস করে। ওরাও এবারে শীত নিয়ে বেশ কথা বলেছে। এবারের হাড় কাঁপানো শৈত্যপ্রবাহ ছিল মনে রাখার মতো।

প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ
প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ

শীতের পিঠা উৎসব নিয়ে বলছিলাম। ছোট ছোট আয়োজনে ল্যাব্রেডর কমিউনিটি হলে আমাদের পিঠা উৎসবটা ছিল অতি চমৎকার। আমি অতি চমৎকার এ জন্য বলছি, গোল্ড কোস্টে এসে একটা বিষয় দেখেছি, এখানে যে অনুষ্ঠানই করা হোক, করা হয় খুব ঘরোয়াভাবে। এতে সবার মনে নির্মল আনন্দ বয়ে আনে। শো অফ বলে একটা কথা আছে, গত চার বছর এখানকার কোনো অনুষ্ঠানে তা দেখিনি। ছোট-বড় সবাই সব অনুষ্ঠান সমানভাবে উপভোগ করে।

এবারের পিঠা উৎসবের আয়োজনে খুব যে আহামরি কিছু ছিল, তা নয়। ওই যে বলেছি, ঘরোয়া আয়োজন ছিল। ওটাতেই আমরা নির্মল আনন্দটুকু খুঁজে পেয়েছি। আমাদের সহধর্মিণীরা যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন নিজেদের মতো করে পিঠা বানিয়ে আনতে। পাটিসাপটা, চিতই, মুঠো, ভাপা পিঠা বা পাকান পিঠা। সঙ্গে ফুল পিঠাও ছিল। আর ছিল ঘরে বানানো নানান ধরনের কেক ও পায়েস। পিঠা বানানোতে তাঁদের হাতের কাজ দেখে সত্যি অবাক না হয়ে পারিনি। অথচ আমাদের সহধর্মিণীদের বেশির ভাগই বিয়ের আগে দেশে রান্না ঘরে পর্যন্ত যাননি। বিদেশে এসে রান্না শিখেছেন।

প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ
প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ

আমি আমার সহধর্মিণী জলির কথাই বলি। সে ছিল পরিবারে নয় ভাইবোনের মধ্যে সবার ছোট। তাকে রান্নাঘরে যেতে হয়নি। একবার নাকি তার স্যুপ বানানোর ইচ্ছে হয়েছিল। অনেক কসরত করে স্যুপ বানিয়েছিল। বাসার কাজের মেয়ে সেই স্যুপ দেখে বলেছিল, ‘আফা, আপনেরটা তো স্যুপ হয় নাই, চুপ হইছে!’ নিউজিল্যান্ডে এসে জলি প্রথম দিন যখন রান্নাঘরে যায়, তার হাতে আমি দুই কেজি চিকেন, গোল আলু, পেঁয়াজ, রসুন, আদা ও মসলাপাতি দিয়ে বলেছিলাম, যাও, রান্না করো তো দেখি...। সে রান্না করার সময় তার ধারে-কাছে থাকিনি। কাজের বাহানা ধরে বাইরে চলে গিয়েছিলাম। ফিরে এসে দেখি, ডেকচিতে সে চিকেন নাড়ছে তো নাড়ছেই। নাড়তে নাড়তে গোল আলু গলে ঝোল হয়ে গেছে। আমাকে আসতে দেখেই সে মন খারাপ করে বলে, এত বড় পেঁয়াজ, বাপের জন্মে দেখিনি...! আলু সিদ্ধ হয়ে গলে গেছে, মাংস তো সিদ্ধ হচ্ছে না...! অথচ সেই জলি এখন সেরা রাঁধুনি।

প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ
প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ

পিঠা নিয়ে আমার কত স্মৃতি। আমার মা খুব গুণী নারী হলেও তিনি রান্না-বাড়া বা পিঠা-পায়েস বানানোর ব্যাপারে একেবারেই অপরিপক্ব ছিলেন। তাঁর রান্না মুখ তুলতে না পারলেও ভয়ে আমাদের খেতে হতো। সকালের নাশতায় রুটি বানাতেন একেকটা বিশাল করে। আলু ভাজি করতেন মোটা মোটা করে। এক রুটিতেই আমাদের পেট ভরে যেত। অন্যের খুব সুন্দর রুটি বানানো বা কুচিকুচি আলু ভাজি দেখে অভিযোগ করলে তিনি বলতেন, ‘সব তো এক পেটেই যাবে। যা খা গিয়ে। একদম কথা না...।’ একবার মা ডিমের পুডিং বানাবেন বলে পুরো দুই দিন কসরত করলেন। আমাদের কী অধীর আগ্রহ, মার হাতে পুডিং খাব। কিন্তু মার এত কসরতের পর দেখা গেল ডিমের পুডিং কালো হয়ে চটা হয়ে গেছে! তবে আমার মা ছিলেন পৃথিবীর অন্যতম সেরা মা। সারাটা জীবন আমাদের কাজী বাড়ির সামন্ত প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে আমাদের মানুষ করিয়েছিলেন। আমাদের পাঁচটা ভাইবোনকে এমএ পাস করিয়েছিলেন।

প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ
প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ

আমার নানার বাড়িতে যেন পিঠার উৎসব বসত। কী সুন্দর সুন্দর পাকান পিঠা আর ফুল পিঠা। ফুল পিঠাগুলো বানানোর পর যখন রোদে শুকোতে দেওয়া হতো, তখন সোনালি রোদের মধ্যে সাদা ফুল পিঠাগুলোকে মনে হতো একেকটা সত্যিকারের সাদা ফুল। আমি হা করে তাকিয়ে থাকতাম। আহা, সেই সৌন্দর্য! কতকাল আগের কথা। আজকাল দেশে গেলে এ দৃশ্য মোটেও চোখে পড়ে না। কিন্তু প্রবাসে আমাদের সহধর্মিণীরা ঠিকই পিঠার সেই সৌন্দর্য লালন করছেন।

এবার আসি এ সপ্তাহের বার্ষিক বনভোজন নিয়ে। এখানকার বনভোজন মানেই দূরে কোথাও যাওয়া। কোনো নদীর তীরে, হ্রদের ধারে, পাহাড়ের পাদদেশে বা উঁচুনিচু ভ্যালিতে দল বেঁধে রান্না করা ও আনন্দ ফুর্তি করা। এবার আমরা গিয়েছিলাম হিঞ্জ ড্যামে। হিঞ্জ ড্যামের সৌন্দর্য বর্ণনা করতে গেলে আমাকে আলাদা করে বিশাল-বিস্তৃতভাবে বলতে হবে। এটা আমি পরবর্তী লেখায় লিখব। এখন আমি আমাদের এবারের বার্ষিক বনভোজনের কথাই বলি।

প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ
প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ

আমাদের এই বার্ষিক বনভোজনে কী ছিল না? হিঞ্জ ড্যামের পাশে বিস্তৃত পিকনিক স্পটের একপাশের একটা শেডে আমরা স্থান নির্বাচন করে নিলাম। আশপাশে ছোটখাটো আয়োজন করে আরও অনেকেই এসেছে। কেউ পরিবার নিয়ে, কেউ দল বেঁধে। কিন্তু এত মানুষজনের মধ্যেই কোনো শোরগোল নেই, কোনো উচ্চবাচ্য নেই। সবার মধ্যে শুধুই আনন্দ আর আনন্দ।

প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ
প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ

আমাদের মেন্যু শুরু হয় সকালের নাশতা দিয়ে। হালুয়া-রুটি আর সবজি। সকালের নাশতা শেষে সবাই গোল হয়ে বড় বড় ডেকচিতে রান্না করতে বসি। বাসায় আমাদের সহধর্মিণীরা রান্নাবান্না করলেও এসব বনভোজন বা আউটডোর পটলাক পার্টিতে তাঁরা থাকেন মুক্ত বিহঙ্গের মতো। নিজেদের মতো ছবি তোলেন, আনন্দ করেন ও নিজেদের মতো ঘুরে বেড়ান। ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে দল বেঁধে খেলাধুলা করে। রান্নাবান্নার দায়িত্ব এসে পড়ে আমাদের পুরুষদের কাঁধে। আমরা সানন্দেই কাজটা করি। প্রবাসে আমাদের সহধর্মিণীরা যেমন সেরা রাঁধুনি, তেমনই আমরা স্বামীরাও বড় রাঁধুনে। অনেক সময় আমরা আমাদের সহধর্মিণীদের রান্নার গুরুও নিজেদের দাবি করতে পারি।

প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ
প্রবাসে আমাদের ছোট ছোট আনন্দ

আমার মনে আছে, প্রবাসে এসে নিউজিল্যান্ডের অকল্যান্ডে প্রথম যেদিন রান্না করি সেদিন এক বাঙালি ভদ্রলোক বলেছিলেন, এক কেজি মাংসে একটা বড় পেঁয়াজ ও এক চামচ করে সব মসলা আর দুই কেজি মাংসে দুটো পেঁয়াজ ও দুই চামচ করে মসলা দিতে। আমরা সেই পন্থা অবলম্বন করে আজ বিরাট রাঁধুনে হয়ে উঠেছি। অথচ মনে হয় না বাংলাদেশে আমরা রান্নাবাড়া থাক দূরের কথা, রান্না ঘরে কেউ পা দিয়েছি।

সেদিনের বনভোজনে আরও অনেক কিছুই যোগ হয়েছিল। ক্রিকেট বিশ্বকাপের কুইজ নিয়ে প্রতিযোগিতা, র‍্যাফেল ড্র, বাচ্চাদের ফুটবল আর সারি সারি ছবি তোলার উচ্ছ্বাস। দিনের শেষে হিঞ্জ ড্যামের ওপর পড়ন্ত বিকেলের সোনালি রোদ দেখতে দেখতে দল বেঁধে সময় কাটিয়ে সবাই যার যার মতো ঘরে ফিরে আসি।
---

মহিবুল আলম: ইমেইল <[email protected]>