তোমার ওই বাদল-বায়ে

বাংলার অপরূপ বর্ষা। ছবি: প্রথম আলো
বাংলার অপরূপ বর্ষা। ছবি: প্রথম আলো

কয়েক দিন আগে ডরমিটরির তুর্কি রুমমেটের গাওয়া একটা গানে ঘুম ভাঙল সকালে। ভোর থেকেই ঝিরিঝিরি বৃষ্টি হচ্ছিল। এটা ইস্তাম্বুলের খুব নিয়মিত ঘটনা।

গানগুলোর ভাষা ভিন্ন। আবেদন এক। যেমন সকাল সকাল শোনা এই টার্কিশ গানটায় আমি কদম ফুলের গন্ধ পাই। একদম প্রথম আষাঢ় আর প্রথম কদম ফোটার গন্ধ। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। মোহাম্মদপুরের খুব অলস একটা গলি। শান্ত সকাল। বাসনকোসনের শব্দ। আদা-মসলার ঘ্রাণ মানে গরম-গরম খিচুড়ির আয়োজন। সারেগামা রেওয়াজ। অনেক আগে কেনা রং ওঠা হালকা কালো পাঞ্জাবিতে আমার কোথায় যেন একটা হাঁটতে থাকা।

তারপর কোন কোন পথ ধরে যেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসরুমে চলে এলাম। কতশত দেশের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ইস্তাম্বুল শহরটার এ গলি, ও গলি ধরে ঘুরে বেড়ানো। আড্ডা দেওয়া। একসঙ্গে থিয়েটারে যাওয়া। তারপর সন্ধ্যা গড়াতেই ডরমিটরিতে ফিরে আসা। ছবি, ভিডিও, জার্নালে ফিরে ফিরে পেতে থাকা দূরের সবটাকে। বাংলা দিনপঞ্জির হিসাবে আবার আসে আষাঢ়। রিক্ত ফুলের ডাল, নোটবুকের স্পিকার থেকে একের পর এক রবীন্দ্রনাথ, আবার-কাছের সুরে দূরের ধ্বনি যত...।

আষাঢ়-শ্রাবণ আমার পছন্দের সময়গুচ্ছ। খুব পছন্দের। দেশ থেকে এত হাজার মাইল দূরে থেকেও ভেতরে বৃষ্টির ছন্দ ঠিক বুঝতে পারি। এর আগে এমন দুই বর্ষায় আমি অল্প কয়েক দিনের জন্য দেশের বাইরে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল জীবনেরও কটা দিন অপচয়। বর্ষায় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা হয়ে ওঠে বাংলাদেশ। আর তাই বাঙালির কর্তব্য এই সময়টায় দেশে থাকা। কাজ, পড়াশোনা আরও কতশত কারণে কর্তব্যটা পালন করা হয়ে ওঠে না আমাদের অনেকের। তারপরও, বর্ষা বাঙালির চোখে না থাকলেও বক্ষে ঠিক থাকে।

কয়েক দিন হলো মাহবুবা আপু ছুটিতে বাংলাদেশে গেছেন। তিনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর করেন। ক্লাস শেষে প্রায়ই আপুর সঙ্গে দেখা হয়। ক্যাম্পাসের ক্যাফেতে বসে বাংলায় আড্ডা দিয়ে বেশ সময় কেটে যায়। দূর দেশে এমন সঙ্গ পাওয়াটা সত্যিই খুব দুরূহ ব্যাপার। একদম বাঙালি আড্ডা বলতে যেটা বোঝায়, আপুর সঙ্গে তেমনই একটা কিছু হয় আমার। আপুর বেশির ভাগ চিন্তা-ভাবনার সঙ্গে আমার খুব দ্বিমত। এর পরও আমাদের আড্ডা চলে।

বাংলার অপরূপ বর্ষা। ছবি: প্রথম আলো
বাংলার অপরূপ বর্ষা। ছবি: প্রথম আলো

খুব সম্ভবত, ভিন্নমতের দুজনের মধ্যেই আড্ডা সবচেয়ে বেশি জমে। সব সময় ইংরেজি আর তুর্কি ভাষায় সবার সঙ্গে কথা বলে একটু সামান্য বাংলা বলার অক্সিজেন-অবকাশ ক্যাম্পাসের দোস্তান ক্যাফের সবুজ ঘেরা খোলা ছাদের পশ্চিম কোণের ২৪ নম্বর টেবিলটা, মাহবুবা আপু, আমি আর আমাদের আড্ডা। শেষের কটা দিন অবশ্য সাইফও যুক্ত হতো আমাদের সঙ্গে।

কিন্তু সাইফ কেন যেন আপুর আর আমার কোরাসের মাঝখানে এসে অন্য স্কেলের সুর বাঁধতে চাইত। আমার খুব বিরক্ত লাগত শুরুতে। পরে অবশ্য মানিয়ে নিয়েছি। আমাদের আলোচনার সুন্দর শান্ত প্যাটার্নটাই যেন কীভাবে কীভাবে পাল্টে গেল সাইফের জন্য।

আড্ডাই তো, এর চেয়ে খুব বেশি বড় কিছু তো আর না! তাই খুব একটা আমলে নিই না, ছেড়ে দিতে শিখেছি। জোর করে আসলে কোনো সৌন্দর্যকে টিকিয়ে রাখা যায় না। তাকে ছেড়ে দিতে হয়। তারপর সেই সৌন্দর্য নিজের মতো করে গড়ে তোলে নিজেকে। একদম রুক্ষ কুৎসিতের মাঝেও সৌন্দর্য স্থান করে নিতে পারে। সৌন্দর্যের অবস্থান সর্বত্র। কখনো আশায়, কখনো দুঃখে, শোকে, অপেক্ষায়, কখনো ভালোবাসায়, কখনো আবার বিচ্ছেদে। একেবারে ফুল-ফল না ধরা শাখা যদি না থাকত পৃথিবীতে, রবীন্দ্রনাথের বর্ষার ওই গানের চরণ দুটো রচিত হতো কীভাবে—

‘যে শাখায় ফুল ফোটে না, ফল ধরে না একেবারে
তোমার ওই বাদল-বায়ে দিক জাগায়ে সেই শাখারে।’

অঝোর বৃষ্টি ব্যাপারটা ইস্তাম্বুলে নেই। এখানে বৃষ্টিতে ইচ্ছা করে ভেজার সংস্কৃতি নেই। আমাদের মতো ছাদ কিংবা উঠোনের খুব একটা আবেগময় গুরুত্ব এদের কাছে নেই। এখানে রাস্তায় রাস্তায় আছে অজস্র কনসেপচুয়াল ক্যাফে। হালকা বৃষ্টি শুরু হলে হয়তো ক্যাফের স্পিকার থেকে হালকা চালের কিছু তুর্কি মিউজিক শোনা যায়। সুরের সঙ্গে সাথে ‘ইয়ামুর’ শব্দটা হয়তো বারবার ভেসে আসে, যার বাংলা অর্থ বৃষ্টি। একটা অদ্ভুত একাকিত্ব কাজ করে। এসব অনুভূতিকে খুব বিলাসিতা বলে মনে হয় মাঝেমধ্যে।

বাংলাদেশিদের বোধ হয় এসব বিলাসিতার চাদরে ইদানীং আর খুব একটা মানায় না। গেল বছর এই বর্ষাতেই তো নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনে নেমেছিল হাজার হাজার বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। চলতি বছরের বর্ষায় আবার রিকশাচালকদের আন্দোলনে নামতে দেখছি, সড়ক উন্নয়নের স্বার্থে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সড়কে রিকশা বন্ধের প্রতিবাদে। ধর্ষণ, হত্যাকাণ্ডের মতো বর্বরোচিত ঘটনার খবর এখনো বাংলাদেশের জাতীয় পত্রিকায়, অনলাইনে, আমার কম্পিউটারের স্ক্রিনে। খুব উদ্বিগ্নতা তাই সব সময়। দেশের কথা ভাবতেই কেমন যেন অগোছালো মনে হয় সবকিছু। অসংগতি কি আমাদের ছাড়বে না কখনো?

খুব ভাবি, কোনো খারাপ খবর নেই—এমন দৈনিক পত্রিকা আছে কি পৃথিবীতে কোথাও? কী জানি! এই অপেক্ষা আর অনবরত ভাঙা-গড়ার মধ্য দিয়ে একদিন নিশ্চয়ই বাংলাদেশ তার যোগ্য অবস্থানে পৌঁছাবে। যে দেশে বর্ষা এত সুন্দর, সে দেশের মঙ্গল তো হতেই হবে।

বাংলার অপরূপ বর্ষা। ছবি: প্রথম আলো
বাংলার অপরূপ বর্ষা। ছবি: প্রথম আলো

বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে বর্ষার শুরুতেই মুঠোফোনের প্লে লিস্টটা পাল্টে নিই। দিন-রাত গুনগুন করতে থাকি গানগুলো। কিছু কিছু গানের শব্দগুলোর অর্থ নতুন করে আবিষ্কার করি। মানুষের বয়সের সঙ্গে সঙ্গে এই গানগুলোর রং কেমন যেন পাল্টে যায়। আবার বৃষ্টির ঝিরিঝিরি অথবা ঝুমঝুম শব্দটাও আমার কাছে গানের মতো মনে হয়। এই গানের সুর-কথা সবটা খুব অস্পষ্ট আর অদ্ভুত। এই গান কাউকে খুব কাঁদায়, কারওর জন্য আবার এই একই গান সুখস্মৃতির সঞ্চার করে।

এই বৃষ্টির গান মানুষ গুনগুন করে গাইতে পারে না। কারণ স্পষ্ট সুর-কথাকে অস্পষ্ট করার আনন্দ পাওয়া যায় গুনগুন থেকে। আর বৃষ্টির গান তো নিজেই অস্পষ্ট। পৃথিবীর সেরা গায়কের কণ্ঠেও এই গান তাই অসম্ভব। বৃষ্টির মতো আমাদের জীবনেরও অনেক গান থাকে, গানগুলোকে শব্দে-সুরে রূপ দেওয়া খুব কঠিন। তারপরও সেগুলো গান, শিল্প। পিয়ানোর রিডগুলো থেকেই হয়তো জন্ম ওদের, খুব মন দিয়ে খুঁজলে হয়তো পাওয়া যেতেও পারে। এমনই কত সব আপাত অহেতুক সম্ভাবনার সঙ্গে সন্ধি করেই আমাদের বাঁচতে থাকা। জীবনের কোনো একটা অর্থ খুঁজতে থাকাতেই যেন আমাদের নিয়তির সমস্তটা নিবন্ধ।
---

শাকিল রেজা ইফতি: শিক্ষার্থী, ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্তাম্বুল, তুরস্ক। ইমেইল: <[email protected]>