যন্ত্রণাহরণ

ছবি: প্রথম আলো
ছবি: প্রথম আলো

প্রিয় পাঠক, এমন একজন মানুষের নাম বলুন তো, যিনি জীবনে একবারও কোনো ধরনের শারীরিক যন্ত্রণায় ভোগেননি? এমন কেউই নেই, তাই না? কখনো ভেবেছেন কী, ডাক্তার, পরীক্ষা–নিরীক্ষা আর যত রাজ্যের আলগা খরচ না করেও কী করে শরীরের বেদনাকে দূরে ঠেলা যায়? আমি নিজে বেশ ভয়াবহ শারীরিক কষ্টে ভুগি। অনেক বছর ধরে। কিন্তু আমার মতো যাঁদের বেদনানাশকে বিপদ (Allergic to painkillers) অথবা যাঁরা প্যারাসিটামল, ডাইক্লফেনাক সোডিয়াম বা আইবুপ্রফেনের দাসত্ব করতে নারাজ, তাঁরা বেদনা নাশ করবেন কী করে? চলুন জেনে আসি।

প্রচুর পানি পান

আমি সব সময় খেয়াল করি, দিনে কবার আমার ৫০০ মিলি পানির কাপটি ভরলাম। দিনে চারবার ভরলে বেশ হয়। দিনে ২ লিটারের কম পানি পান করা উচিত নয়। পানিশূন্যতা আপনার মাথা আর কোমরের বেদনা বাড়াবে।

খাওয়া আর ঘুমের খেয়াল রাখুন

নিয়মিত এক গাদা মিষ্টি জাতীয় খাবার না খেয়ে অনেক রকম সবুজ শাকপাতা আর ডাল/সয়াবিন জাতীয় খাবার যোগ করুন খাদ্যতালিকায়। সপ্তাহের সব দিনে একই সময় ঘুমানো আর ঘুম থেকে ওঠার অভ্যাস করুন। ছুটির দিনে একটু বেশি ঘুমালেও তা যেন অন্য দিনের চেয়ে দুই ঘণ্টার বেশি না হয়। শোবার ঘরে পর্যাপ্ত বাতাসের চলাচল রাখুন। আর ঘুমানোর আগে আলো যতটা সম্ভব কমিয়ে ফেলুন।

ভাইরে, একটু নড়েন না!

আমার শারীরিক কষ্টগুলো তখনই বেশি হয়, আমি যখন নড়াচড়া কম করি। সপ্তাহে চার থেকে পাঁচ দিন কলেজ থেকে বাস স্টপ অবধি (১৫ মিনিট) হাঁটলে যন্ত্রণা অনেক কমে যায়। ছুটির সময়ে নিয়মিত বাড়ির সবার কাপড় শুকানোর কাজটি আমি নিজের উৎসাহেই করি। তাতে কাজও হয়, বেশ একটু নড়াচড়াও হয়। আপনাকে যদি আমার মতো বহু পুরোনো একটানা যন্ত্রণার সঙ্গে যুঝতে হয় সব সময়, তবে একটু হাঁটাচলা কষ্ট হলেও করতেই হবে।

মালিশ

আমি সব সময় লোশন আর যন্ত্রণানাশক মলম (হতে পারে মুভ বা বেন গে) হাতের কাছে এদিক-ওদিক রেখে দিই। চিকিৎসকের দেখানো পদ্ধতি ছাড়াও আমি ইউটিউবে বিভিন্ন ধরনের মালিশের ভিডিও দেখে, শিখে, নিজের ওপর প্রয়োগ করি তা। ব্যথানামক দৈত্যের আচমকা আক্রমণকে প্রতিহত করতে স্পর্শ আমার জন্য জাদুর মতো কাজ করে।

গরম পানি

জল চিকিৎসার সুফল হয়তো অনেকের জানা। শুধু গরম পানি খেয়ে কিছু যন্ত্রণার উপশম হতে পারে। কিছু ব্যথায় গরম পানির সেঁক বা গোসলও কার্যকর।

ভালোবাসুন

পাঠক এ অংশটি পড়লে হয়তো হাসবেন, তবু বলছি। আমার শারীরিক যন্ত্রণাগুলোর অতিরিক্ততা কখনো কখনো অবশ করে দেয় শরীরের নির্দিষ্ট একটি অংশকে। (এ জিনিসে এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তবু ভোগান্তি তো আছেই)। ভাইপো–ভাইঝিরা যখন ছোট ছিল, ওদের কোলে নিয়েই ভুলতাম অসহ্য যন্ত্রণা। এখনো খারাপ লাগলে ছোট্ট ভাইপোকে কাছে টানি। সে দুই মিনিট আদর নিয়ে দৌড়ে পালায় (এখন বড় হয়ে গেছে যে!)। ওর ওই দুই মিনিটের ছোঁয়াকে পুঁজি করে নিজেকে সামলে নিই।

শিশুদের মধ্যে একধরনের অদ্ভুত সুন্দর ইতিবাচক শক্তি থাকে। হয়তো সবাই মানবেন। এমনকি কাছের কোনো বন্ধু বা বড় বোনের সঙ্গে কথা বলাও ওই অসহনীয় মুহূর্তে আমার জন্য সঞ্জীবনী। যদি আপনার সামনে বা আশপাশে ওই সময় স্নেহের বাঁধনে বাঁধার কোনো মানুষ না পান, পোষা প্রাণীকে কোলে তুলে নিন। তবে জীবকে ভালোবাসুন, ওই যন্ত্রণার মুহূর্তে তুলোর পুতুল জড়িয়ে ধরলে লাভ হবে না।

দুধ

দুধ জিনিসটায় অনেকেরই অনীহা, এমনকি আমার নিজেরও। তবু যদি গরম দুধে সামান্য একটু হলুদ গুঁড়ো মিশিয়ে খেতে পারেন। তা যেকোনো ধরনের ফোলা ভাব বা ব্যথাকে কমাতে সক্ষম। দুধ শুধু বেদনানাশক নয়, ঘুমের বড়ির চমৎকার বিকল্পও বটে।

ফল

পেয়ারা, কমলা, আপেল, আমলকী, আঙুর ইত্যাদিতে হরেক রকম বেদনানাশক গুণ থাকে। আর অবশ ভাব কমাতে ডালিম ভীষণভাবে কার্যকর। অতএব, ফল খান, ভালো থাকুন।

আপুরে, শখ ভুলে যাবেন না যেন

কর্মক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরেছেন? যত কাজ থাক, দিনে ১৫ মিনিট সুইয়ে রেশমি সুতো ভরে নিন। বাগান করুন, ছবি আঁকুন। যত সৃজনশীলতা পছন্দ, সব করুন। শখ শারীরিক বেদনা থেকে আপনার মনকে সরিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।

আর কিছু চাই না আমি গান ছাড়া

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বেশ কয়েক বছর আগে, চিকিৎসার অংশ হিসেবে খুবই দীর্ঘ আর অতি যন্ত্রণাদায়ক কিছু ফিজিওথেরাপি করিয়েছিলাম। চিকিৎসক আমার পা ধরে এমনভাবে মোচড় দিতেন, মনে হতো হাড়গোড় সব খুলে পড়ে যাবে। তার ওপর বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাঁধা থাকার জ্বালা। যে জানে না তাকে বোঝানো মুশকিল। চিকিৎসক কিছুটা আদেশই করতেন, গান ধরো! তিনি মাঝেমধ্যে নিজেই গুনগুন করতেন আমার সঙ্গে। অন্য রোগীরাও যোগ দিতেন। আমার মাথায় ওই মুহূর্তে বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি উর্দু যা আসত গাইতাম। আমি গান শিখেইছি নিজের মনের খোরাক হিসেবে। তবে গান অথবা বাজনার ক্ষেত্রে মাথায় রাখবেন, গানটি যেন অতিরিক্ত ধুমধাড়াক্কা গোছের না হয়। আবার অতি দুঃখেরও না হয়। অতি দুঃখের গান যন্ত্রণার মুহূর্তে আপনার মনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। আর গানে অতিমাত্রায় যন্ত্রানুষঙ্গের ব্যবহার ব্যথা বাড়ানোর কারণ হতে পারে।

ক্যাফেইন

এ জিনিসটিকে যন্ত্রণানাশক হিসেবে ব্যবহার করতে হলে একটু সাবধান থাকতে হবে। আপনি যদি এমনিতে চা–কফি পান না করেন, তবে চা–কফিকে কেবল যন্ত্রণানাশক হিসেবেই পান করুন। যদি নিয়মিত পান করেন, তবে ব্যথা কমাতে এক–দুই কাপ বাড়তি যোগ করুন। তবে স্বাভাবিকভাবে যা পান করেন, সেটা কম করবেন না। ক্যাফেইনে যাঁদের ঘুমের সমস্যা, তাঁরা দূরে থাকুন।

প্রার্থনাতেই মুক্তি

কোনো কোনো পাঠক হয়তো বলবেন, গান আর প্রার্থনা একসঙ্গে যায় না। তবে আমার কাছে এ ব্যাপারটি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। অসুস্থ হলে আব্বু–আম্মু দুজনকেই দেখেছি সুরা ইয়াসিন পড়তে বসেছেন। আমি নিজে সুরা আর রহমান (অবশ্যই অর্থসহ) শুনতে ভালোবাসি খারাপ লাগলে। সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক আর সুরা নাস (অর্থসহ) ক্রমান্বয়ে তসবির মতো করে পড়াও আমার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। আয়াত উল কুরসি বা আস্তাগফার পড়লেও ফল পাই। নামাজ ছাড়তে ভালো লাগে না। সেজদাতে অন্য রকম শান্তি আসে মনে। অন্য ধর্মাবলম্বী বন্ধুদেরও দেখেছি, তারা প্রার্থনার শক্তিকে বিশ্বাস করে।

সব শেষে বলব, যন্ত্রণাকে নিজের ওপর রাজত্ব করতে দেবেন না। জীবন আপনার দিকে এক ডজন লেবু ছুড়ে দিয়েছে? সবগুলোকে লুফে নিয়ে শরবত বানিয়ে খেয়ে ফেলুন। (When life gives you lemons, make Lemonade out of it)। ভালো থাকুন।