আউট বইয়ের গল্প

অলংকরণ: তুলি
অলংকরণ: তুলি

একটা সময় পাঠ্যবইয়ের বাইরের যেকোনো বইকেই আউট বই আখ্যা দিয়ে সেগুলো পড়া থেকে ছাত্রছাত্রীদের নিরুৎসাহিত করতেন অভিভাবক থেকে শুরু করে শিক্ষক, সবাই। এতে করে আউট বই পড়ার প্রতি তাদের আগ্রহ বহুগুণে বেড়ে যেত। আউট বই পড়লে সময়টা যেমন ভালো কাটত, তেমনি কী পড়েছে সেটা নিয়ে আর পরবর্তীতে মাথা ঘামাতে হতো না। কারণ পরীক্ষায় আউট বই থেকে কোনো প্রশ্ন করা হবে না।

আউট বই বলতে সাধারণত পাঠ্যবইয়ের বাইরে গল্পের বইগুলোকেই বোঝানো হতো। একেবারে ছোটবেলা থেকে শুরু করলে কমিকস বই ছিল আউট বই। অবশ্য কমিকস বইগুলো সমবয়সী পাঠককেই মন্ত্রমুগ্ধের মতো আটকে রাখে। কমিকসের রঙিন চিত্র ও কথোপকথনগুলো এতটাই সহজ সরল ছিল যে, সেগুলো বুঝতে খুব বেশি মাথা খাটাতে হতো না। বিভিন্ন উৎস থেকে চুপি চুপি আউট বইয়ের জোগান আসত।

বাংলাদেশের পড়াশোনায় একসময় ক্লাসের ক্রমগুলো ছিল এমন—পাঁচ বছর বয়স হলে ছোট ওয়ান, এর পরের ক্লাস বড় ওয়ান। তার পরের ক্লাস হচ্ছে ক্লাস টু। আমাদের সময় যত দূর মনে পড়ে ছোট ওয়ান ও বড় ওয়ানে একটা মাত্র বই ছিল, যার মধ্যে বাংলা ভাষা শিক্ষাটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হতো। আর বইগুলোর মধ্যে বিভিন্ন রং ও চিত্রের মাধ্যমে বর্ণমালাটাকে তুলে ধরা হতো। তাই আমরা সহজেই বইগুলোর প্রতি আকর্ষণ বোধ করতাম।

আমার এখনো মনে আছে, ছোট ওয়ানের বইয়ে শেষ শব্দগুলো ছিল যেমন একদিকে সহজ, অন্যদিকে শ্রুতিমধুর। বড় ওয়ানের বইয়ের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য ছিল। তবে শব্দে বর্ণের সংখ্যা বেড়ে যেত। ছোট ওয়ানের বইয়ের শব্দগুলো ছিল কোনো প্রকার মাত্রা ছাড়া। আর বড় ওয়ানে এসে শুরু হতো মাত্রার প্রয়োগ।

আর রিডিং পড়াটা শুরু হতো ক্লাস টু থেকে। ক্লাস টুয়ের বইয়ে অত্যন্ত সহজ ভাষায় কিছু গল্প বলা হতো। গল্পের বিষয়বস্তুগুলো ছিল একদিকে যেমন উপভোগ্য, অন্যদিকে অনেক শিক্ষণীয়। একটা গল্পের কথা এখনো মনে আছে। একটা সিংহ প্রতিদিন একটা করে প্রাণী খায়। তাই প্রাণীরা নিজেদের মধ্যে সভা করে ঠিক করে, কে কোন দিন সিংহের কাছে যাবে। একবার একটা খরগোশের পালা এল। খরগোশ যেতে দেরি করল। সিংহ দেরির কারণ জানতে চাইলে সে বলল, রাস্তায় ঠিক তারই মতো অন্য একটা সিংহ তার পথ আটকে ছিল।

এরপর বাচ্চারা ক্লাস টু থেকে যখন ক্লাস থ্রিতে ওঠে, তখন বইয়ের সংখ্যা দুই থেকে বেড়ে ছয়ে উন্নীত হতো। বাংলা, ইংরেজি, গণিতের বাইরে তখন যোগ হলো পরিবেশ পরিচিতি সমাজ, পরিবেশ পরিচিতি বিজ্ঞান আর ধর্ম। নতুন বছরে স্কুল শুরুর দিনেই সবার হাতে নতুন বই দিয়ে দেওয়া হতো। আমরা বইগুলোকে বুকের মধ্যে আগলে ধরে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নিতে নিতে বাড়ি ফিরতাম। ক্লাসে পড়ানোর আগেই বাংলা বইয়ের সব গল্প একাধিকবার পড়ে শেষ করে ফেলতাম। কিন্তু অন্য বইগুলোর পড়া আর এগোতেই চাইত না।

এরপর যখন প্রাথমিক শেষ করে মাধ্যমিকের পাঠ শুরু হলো, তখন বইয়ের সংখ্যা ছয় থেকে বেড়ে দশে উন্নীত হলো। সেখানেও বাংলা বইয়ের গল্পগুলো ক্লাসে পড়ানোর আগেই বেশ কয়বার শেষ করা হতো। মাধ্যমিকের অন্যতম আকর্ষণ ছিল বাংলা ও ইংরেজি বইয়ের সঙ্গে বাড়তি দুটো বই। বাংলার বাড়তি বইটাকে বলা হতো দ্রুত পঠন আর ইংরেজির বাড়তি বইটাকে বলা হতো র‍্যাপিড রিডার।

এমন অদ্ভুত নামকরণের হেতু আমরা কোনোভাবেই বুঝতাম না। নতুন ক্লাসের বই হাতে পেয়েই বাংলা বইয়ের গল্পগুলো পড়া শুরু করতাম। একটু পড়ার পরই বুঝতে পারতাম এটা আর চালিয়ে যাওয়া সম্ভব কিনা। আর যেগুলো ভালো লেগে যেত, সেগুলো পড়া হতো একাধিকবার। এর বাইরে দ্রুত পঠনের গল্পগুলোকে বছরব্যাপী বেশ কবার পড়া হয়ে যেত। দ্রুত পঠনের গল্পগুলো পড়তে গিয়েই বুঝতে পারলাম পাঠ্যবইয়ের চেয়ে কেন আমার গল্পের বই ভালো লাগে। কারণ গল্পের বইয়ের বিষয়বস্তু থেকে শুরু করে বর্ণনা আর সঙ্গে থাকত কিছু অলংকরণ। সব মিলিয়ে পাঠের সময়টা হতো দারুণ উপভোগ্য। কিছু সময়ের জন্য হলেও পাঠক হারিয়ে যেত গল্পের কল্পনার রাজ্যে।

অবশ্য সব সময় যে কল্পনার গল্পই বলা হতো, তা কিন্তু নয়। অনেক সময় রূঢ় বাস্তবতার গল্পও বলা হতো। শরৎচন্দ্রের ‘মহেশ’ এখন পর্যন্ত আমার মনে দাগ কেটে যাওয়া গল্পগুলোর অন্যতম। আমাদের নিজেদের পোষা গরু-ছাগল ছিল। মা এগুলো দেখতেন। আমাদের পরিবারের সদস্যদের মতোই তাই খুব সহজেই গফুরের মনের ভাবটা বুঝতে পেরেছিলাম। আর ভালোবাসা যে জীবজন্তুকেও পোষ মানাতে পারে, সেটাও জানতাম। কারণ যখনই আমাদের পোষা গরু-ছাগলগুলোকে আব্বা বিক্রির জন্য হাটে নিয়ে যেতেন, মা আঁচলে মুখ লুকিয়ে বাড়ি ছেড়ে কোথায় যেন চলে যেতেন। আর গরুগুলোর চোখের নিচটা ভেজা থাকত ওদের চোখের জলে।

আমার প্রথম আউট বই হাতে পাওয়ার গল্পটা অনেকটা কাকতালীয় বলা যায়। বাবার ছোট ব্যবসার আয় দিয়ে সংসার চালিয়ে আমাদের পড়াশোনার জন্য বাড়তি টাকা খরচ করা সম্ভব হয়ে উঠছিল না। তাই মা ঠিক করলেন ঠাকুর বাড়ি থেকে কাগজ এনে ঠোঙা বানানো শুরু করবেন। সেই অনুযায়ী ঠাকুর বাড়ি থেকে কেজি হিসাবে কাগজ, সঙ্গে আটা আর তুঁতে নিয়ে আসা হতো। আটার মধ্যে তুঁতে মিশিয়ে সেটা চুলায় নিয়ে জ্বাল দিলে খুব ভালো আঠা হয়। সেই আঠা দিয়ে ঠোঙা বানিয়ে শুকিয়ে ফেরত দিলে প্রতি কেজিতে ১ টাকা ৫০ পয়সা মজুরি পাওয়া যায়।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

এই সময় আমরা আউট বইয়ের এক বিশাল ভান্ডারের সন্ধান পেলাম। ঠোঙার কাগজ হিসেবে ব্যবহার করা হতো পুরোনো বই, ম্যাগাজিন আর খাতা। সেগুলোর মধ্যে ছিল পুরোনো পাঠ্যবই থেকে শুরু করে কিশোর ম্যাগাজিন, কমিকসের বই, বড়দের দেশ-বিদেশের ম্যাগাজিন, বিজ্ঞানের বই, সাহিত্যের বই, গবেষণার বই। কী ছিল না তার মধ্যে। একটাই সমস্যা ছিল, সেটা হলো সেগুলোর সবই এক-দুই বছরের পুরোনো। তাতে আমাদের কোনো সমস্যা হতো না। কারণ আমরা তখনকার সময়ের তুলনায় অনেক পিছিয়ে ছিলাম। এই বইগুলো হাতে পেয়ে বরং পিছিয়ে থাকার ব্যবধানটা কমে এক-দুই বছরে নেমে এল।

আমাদের সবচেয়ে ভালো লাগত কমিকসের বইগুলো। কারণ এর মধ্যে ছবি দিয়ে গল্প বলা হতো। রং-বেরঙের ছবির সঙ্গে গল্প পড়তে পড়তে আমরা নিজেদের একেকজন ‘চাচা চৌধুরী’ আর ‘টিনটিন’ ভাবা শুরু করতাম। তবে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ অনুভব করতাম ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত মাসিক আনন্দমেলার পূজা বার্ষিকী সংখ্যাটার প্রতি।

সেই প্রথম কাকা বাবুর সঙ্গে পরিচয় হলো। তার সঙ্গে আমরা সারা বিশ্বময় ঘুরতে শুরু করলাম। পরিচয় হলো ফেলুদা আর তার জনক সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে। ফেলুদার গল্প পড়তাম আর আশপাশে ঘটে যাওয়া অস্বাভাবিক ঘটনাগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করা শুরু করলাম। এমনকি আমরা ছোটরা নিজেরা একত্রে বসে সেগুলোর চুলচেরা বিশ্লেষণ করতাম। পরিচয় হলো অরণ্যদেব নামে নতুন এক কমিকস চরিত্রের সঙ্গে, যে গভীর বনের মধ্যে একটা গুহায় লুকিয়ে থাকে। গুহার মুখটা মানুষের মাথার খুলির আকৃতির। মনে পড়ে তার পরনের পোশাক বেগুনি রঙের।

বড় হয়ে অনেক দেশি বিদেশি ম্যাগাজিন পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে। কিন্তু আনন্দমেলার মতো শুধু শিশু-কিশোরদের জন্য এতটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ম্যাগাজিন আর দ্বিতীয়টি পড়িনি এখন পর্যন্ত। ভবিষ্যতেও পড়তে পারব, এমন আশা ক্ষীণ। আমরা দুই ভাই ভাগাভাগি করে এই আউট বইগুলো পড়তাম, সেটাকে ঠোঙার তলায় পট্টি হিসেবে ব্যবহার করার আগেই। আমাদের পড়তে হতো অনেক দ্রুত। কারণ দ্রুত সময়ের মধ্যে ঠোঙা বানিয়ে ফেরত দেওয়ার তাগাদা থাকত।

একাদশ শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন বন্ধু আমিনুর খবর দিল কুষ্টিয়া পুলিশ লাইন স্কুলের মাঠে বইমেলা হচ্ছে। তারপর দুজন মিলে বুদ্ধি করে একদিন মেলায় চলে গেলাম। মেলায় বইয়ের অনেক দোকান থাকলেও সেখানে কোনো ভিড় নেই। সব মানুষ ভিড় করে আছে খাবারের দোকানের সামনে। দেখে একটু খারাপই লাগল। সেখানে খাবার বিক্রির নামে মানুষের গলা কাটা হচ্ছে।

আমাদের কলেজের কিছু বন্ধু যারা পুলিশ লাইন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র, তারাও একটা খাবারের দোকান দিয়েছে। আমাকে আর আমিনুরকে তারা জোর করে ধরে তাদের দোকানে খেতে বাধ্য করল। বিল দিতে গিয়ে আমাদের বমি হওয়ার জোগাড়। একেকটা খাবারের দাম রাখা হয়েছে স্বাভাবিক দামের তুলনায় পাঁচ-দশ গুণ।

যা হোক, খাবারের বিল দিতে গিয়েই আমাদের সব টাকা প্রায় শেষ হয়ে গেল। এরপর আরাফাত লাইব্রেরির স্টলে গিয়ে ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ চাইলাম। দোকানি আমাদের নিউজপ্রিন্টের পাতার আর হার্ড কভারে মোড়ানো একটা বই বের করে দিলেন। নিউজপ্রিন্টের বলেই অনেক সস্তায় বইটা কিনে আমরা ফিরে এলাম। এরপর সেই বইটা এতবার পড়া হয়েছিল যে, এর প্রতিটা পাতা আমাদের মুখস্থ হয়ে গেল।

কুষ্টিয়া থেকে একসময় ঢাকায় আসতে হতো দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া ফেরি হয়ে। কারণ তখনো বঙ্গবন্ধু সেতু চালু হয়নি। কুষ্টিয়ার বাসগুলো একটু উল্টোদিকে গিয়ে ঝিনাইদহ, মাগুরা ও ফরিদপুর হয়ে রাজবাড়ী আসত। তারপর গোয়ালন্দের দৌলতদিয়া ঘাটে ফেরির জন্য লাইন দিত। ফেরির সিরিয়াল পেতে অনেক সময় লাগত। অনেক সময় ১৫-২০ ঘণ্টা বা তারও বেশি সময় লেগে যেত ফেরিতে বাস উঠতে। এ সময় বিভিন্ন রকমের ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা বাসে উঠত একে একে।

আমরা অবশ্য বাস থামার সঙ্গে সঙ্গেই বাস থেকে নেমে ঘাটলাগোয়া রেস্টুরেন্টগুলো থেকে গরম-গরম রুটি আর আলুভাজি দিয়ে নাশতা সেরে নিতাম। মাঝেমধ্যে সঙ্গে ডিমও নিতাম। এখানকার খাবারের একটা বিশেষত্ব ছিল, সেটা হলো যতই ঢেকে রাখা হোক না কেন, খাবারে অবধারিতভাবে বালি পড়ত। আর সেগুলো খেতে গেলে দাঁতের মধ্যে কিচকিচ শব্দ হতো। অনেকের শুনে অবাক লাগতে পারে, কিন্তু আমরা সেই খাবারই পরম তৃপ্তি নিয়ে খেতাম।

ফেরিতে গাড়ি ওঠার আগে বা পরে যে সব ভ্রাম্যমাণ ফেরিওয়ালা আসত, তাদের মধ্যে আমাদের পছন্দের ছিল বইয়ের ফেরিওয়ালা। তাদের কাছে বিভিন্ন সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকা ছাড়াও বিভিন্ন রকমের বিষয়বস্তুর বই পাওয়া যেত। যেমন ১০০ দিনে জিন হাজির করার মন্ত্র, বিভিন্ন প্রকারের ভেষজ চিকিৎসার বই, বিভিন্ন রকমের কৌতুকের বই, বিভিন্ন রকমের মন্ত্রের বই। তবে আমাদের পছন্দ ছিল মাসিক ‘উন্মাদ’ পত্রিকা।

শুরুর দিকে আমরা বাজারের দামের তুলনায় একটু সস্তায় কিনতাম। কারণ এগুলো সাধারণত কেউ কিনত না। তাই আমাদের সস্তায় দিয়ে দিত। পরবর্তী সময়ে যখন নিয়মিত আসা-যাওয়া শুরু হলো, তখন আর তারা সস্তায় দিত না। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়ে গেল আমাদের দেখলেই তারা এগিয়ে এসে বলত, ‘উন্মাদ’ লাগবে কি না? এখন পর্যন্ত যত মজার পত্রিকা পড়েছি ‘উন্মাদ’ তাদের মধ্যে সবার সেরা।

বুয়েটের টিভি রুমে বাজারের সব দৈনিক ও সাপ্তাহিক বা পাক্ষিক পত্রিকা রাখা হতো। সেখানেই পরিচয় হলো ‘রহস্য পত্রিকা’ নামের একটা পত্রিকার সঙ্গে। ছোটখাটো নোট বইয়ের আকারের একটা পত্রিকা। যেখানে দৈনন্দিন সব বিষয়ের অবতারণা করা হয়ে থাকে। একেবারে গৃহস্থালি থেকে শুরু করে বিজ্ঞান কল্পকাহিনী পর্যন্ত থাকত সেখানে। অপরদিকে রাশিফল বা স্বাস্থ্যসেবা-বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা ছড়াও একটা অংশ থাকত এই বিষয়ক প্রশ্নোত্তরে।

আমরা দুই-তিন বন্ধু মিলে একসঙ্গে বসে সেই অংশটা রসিয়ে রসিয়ে পড়তাম। রহস্য পত্রিকা পড়তে গিয়েই পরিচয় হলো জুলভার্ন, আইজ্যাক আসিমভ, স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের সঙ্গে। এরপর আলাদাভাবে তাঁদের বই কিনে নিয়ে এসে পড়া শুরু করলাম। বইমেলা শুরু হলে অন্য বইয়ের পাশাপাশি সেবা প্রকাশনীর এই অনুবাদ বইগুলো আমাদের খুবই টানত। আমার মতে বাংলাদেশে একমাত্র সেবা প্রকাশনীই বিদেশি ভাষার বইগুলোর ভাবানুবাদ করে থাকে। বাকিদের অনুবাদ পড়তে গেলে দাঁত ভেঙে যাওয়ার উপক্রম হয়। বিশেষ করে কিশোর সাহিত্য অনুবাদে সেবার অবস্থান সবার ওপরে।

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

সময় ও নদীর স্রোত নাকি কারও জন্য থেমে থাকে না। আমরাও একসময় সময়ের ভেলায় চড়ে অস্ট্রেলিয়ার সিডনি এসে বসবাস শুরু করলাম। ইতিমধ্যেই জীবনে বহু পরিবর্তন হয়েছে। একা আমি থেকে এখন আমরা সর্বসাকল্যে চারজন। সবচেয়ে ছোটজন রায়ান, যার বয়স মাত্র সাড়ে তিন, তারও রংচঙে বইয়ের প্রতি বিশাল আকর্ষণ। আর সুযোগ পেলেই বসে যায় রঙিন কলম নিয়ে। তার ক্যানভাস হচ্ছে বাসার দেয়াল, টিভির পর্দা, দরজার কপাট।

আর আমার মেয়ে তাহিয়ার বয়স ৯ বছর। এখন সে এখানকার একটা পাবলিক স্কুলে চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ে। আমার শৈশবের কথা মাথায় রেখেই ওর শৈশবটাও যাতে আনন্দময় হয়, সেই জন্য ওকে কিনে দিয়েছি বেশ কিছু গল্পের বই। তবে সংগত কারণেই সেগুলোর ভাষা ইংরেজি। তার মধ্যে কিছু ওর বয়সের উপযোগী আবার কিছু ওর জন্য ভারিক্কি হয়ে গেছে। তাই সেগুলো সে এখনো ধরেও দেখেনি। সে ইতিমধ্যেই টিনটিনের সব কমিকস পড়ে শেষ করে ফেলেছে। এখন চলছে ‘হ্যারি পটার’ সিরিজ। একটা করে ‘হ্যারি পটার’-এর ছবি দেখে আর সঙ্গে সঙ্গে বই পড়ে সেটা আবার মেলায়।

এ ছাড়া আলমারিতে তোলা রয়েছে ‘জুলভার্ন সমগ্র’, ‘শার্লক হোমস’ আর ‘আইজ্যাক আসিমভ’ সমগ্র। আরও রয়েছে আনা ফ্রাংকের দিনপঞ্জি, গ্যালিভারের ভ্রমণকাহিনি এবং আমার জীবনে পড়া অন্যতম সেরা বই ‘আংকেল টমস কেবিনের’ ইংরেজি ভার্সন। বইগুলো কিনে রাখার কারণ হচ্ছে যদি কখনো ওরা ইদানীংকার বইয়ের বাইরে অন্য রকম বই পড়তে চায় তখন এগুলো ধরিয়ে দেব।

এত গেল ছেলেমেয়েদের কথা। আমি মনে মনে খুঁজছিলাম শৈশবের ফেলে আসা কমিকস বা কৈশোরের ‘উন্মাদ’, ‘রহস্য পত্রিকা’। এগুলোর সবই অবশ্য এখন অনলাইনে পাওয়া যায়। কিন্তু বইয়ের গন্ধ নিতে নিতে বই পড়ার মজা সেখানে নেই। বেশ কিছু বই বাধ্য হয়ে পড়েছি। কিন্তু বই পড়ার মজাটা পাইনি মোটেও। হঠাৎ একদিন শ্যালিকা ও সুলেখিকা সামার তিন্নি বাংলাদেশে বেড়াতে গিয়ে আমাদের শৈশবে পড়া ‘চাচা চৌধুরী’, ‘পিংকি’ আর ‘বিল্লু’র কিছু কমিকস বইয়ের ছবি দিল। ছবিগুলো দেখে আর আবেগ সংবরণ করতে না পেরে তাঁকে বললাম, আমার জন্য কমিকসের কিছু বই আনতে। তিন্নি জানাল, তার হাতে আর সময় নেই। একদিন পরেই অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে রওনা দেবে।

মনটা একটু দমে গেল। একদিন হঠাৎ দেখি তার খুদে বার্তা। ভাইয়া হঠাৎ একটু কাজে বাইরে গিয়েছিলাম, তাই আপনার জন্য কিছু কমিকসের বই এনেছি। মনে মনে ভীষণ খুশি হলাম আর তাকে ধন্যবাদ দিলাম। আসলে যাদের শৈশব ও কৈশোর এই বইগুলো পড়ে পার হয়েছে, শুধু তারাই এই আবেগের বিষয়টা বুঝতে পারবেন। বাকিদের কাছে হয়তোবা ব্যাপারটা নিছক পাগলামি বা শো অব মনে হবে।

দূরের কাছের পরিচিত কেউ দেশে গেলেই আমি বইয়ের একটা তালিকা ধরিয়ে দিই। মুনা ভাবি, ফেরদৌস ভাই এখন পর্যন্ত সিডনিতে আমার আউট বইয়ের সবচেয়ে বড় জোগানদাতা। এ ছাড়া আশফাক ভাই, অগ্নি আপু, তুলি আপু, নদী আপু, সত্যজিৎ দাদা সবাই আমাকে বই এনে দিয়েছেন।

মজার ব্যাপার হচ্ছে, তাঁরা সবাই কিন্তু সিডনিতে থাকেন না। তাঁরা যার যার মতো করে বই আনেন। তারপর আবার নিজের পকেটের টাকা খরচ করে কুরিয়ার করেন। একজনের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়, তিনি হলেন একই সঙ্গে লেখক, কবি ও গবেষক নাজমিন মর্তুজা। আমার স্বভাবের জন্য আমাকে তিনি ভীষণ পছন্দ করেন। তার স্বামী মর্তুজা ভাই এবং দুই মেয়ে রায়া ও রুহার সঙ্গে আমার এখন পর্যন্ত সামনাসামনি আলাপ না হলেও তাঁরা সবাই আমাদের পরিবারের সদস্য হয়ে গেছেন। নাজমিন মর্তুজা আমাকে অনেক বই এনে দিয়েছেন সঙ্গে কিছু খুবই অমূল্য উপহার, যার আর্থিক মূল্য হয়তোবা খুবই সামান্য কিন্তু শৈল্পিক মূল্য অপরিসীম। আর তিনি যে পরিমাণ দরদ দিয়ে সেগুলো বয়ে এনেছেন সেটার উল্লেখ আর না-ই বা করলাম। তাঁদের কল্যাণে আমার আউট বই পড়ার নেশাটা পুনর্জীবন পেয়েছে। তফাৎ শুধু একটাই, আগে পাঠ্যবই না পড়ে আউট বই পড়তাম আর এখন সংসারের কাজ ফাঁকি দিয়ে আউট বই পড়ি।

আউট বইগুলো আসলে এমন বই যেগুলোর সিলেবাসিক মূল্য শূন্য বললেও কম বলা হবে। কারণ এগুলো পড়তে গিয়ে যে পরিমাণ সময়ের অপচয় হয়, তার চার ভাগের এক ভাগও সিলেবাসের বইয়ের পেছনে দিলে আমাদের আধুনিক অভিভাবকদের ভাষায় তাদের একেকটা বাচ্চা একেকজন আইনস্টাইন বা নিউটন হয়ে যেত। কিন্তু আউট বই শিশু, কিশোর এমনকি সব বয়সের পাঠককেই এমন একটা জগতের সন্ধান দেয় যেখানে রয়েছে একই সঙ্গে আনন্দ, দুঃখ এবং আরও বহু বিষয়। সোজা কথায়, আউট বই একটা বাচ্চার সৃজনশীলতা বিকাশের পথে প্রথম ধাপ। আর অন্য বয়সের পাঠকের জন্য একটি নির্মল বিনোদনের সবচেয়ে সহজলভ্য উপকরণ। তাই পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি আউট বই পড়ার ব্যাপারে প্রত্যেক শিশু-কিশোরকে উৎসাহিত করা অভিভাবক হিসেবে আমাদের অন্যতম দায়িত্ব।