একজন নেলসার গল্প

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

খুব ধীরে কেউ একজন দরজায় কড়া নাড়ছেন। শব্দের ধরনে মনে হচ্ছে, কড়া নাড়া ব্যক্তি চাচ্ছেন না এই সাত সকালে ঘুম ভাঙাতে। আবার না ভাঙিয়েও পারছেন না। পাশে থাকা মোবাইলে সময় দেখলাম ভোর ৫টা বাজতে তখনো ৮ মিনিট বাকি।

আমি যে বাড়িতে থাকি, সেটা একটি অফিস কাম বাসা। নিচতলায় অফিস আর ওপরে অফিসে কর্মরত কয়েকজনের থাকার ব্যবস্থা। ম্যানিলার এই অফিস বাড়িতে আমি এক সপ্তাহ ধরে অবস্থান করছি। গতকাল সোমবার ছিল সপ্তাহের শুরুর দিন। সপ্তাহের প্রথম দিন অফিস শুরু হয় একটু আগে। কিন্তু এত সকালে কে কড়া নাড়ছেন, বুঝতে পারছি না।

আবারও খুব সাবধানে কড়া নাড়ার শব্দ। এবার উঠে আলো জ্বালালাম। নিজের রুম থেকে বের হয়ে লিভিং রুমের দরজা খুলে দেখি নেলসা, সলজ্জ চোখে দাঁড়িয়ে আছে।

: শুভ সকাল স্যার। ঘুম ভাঙানোর জন্য দুঃখিত। রাস্তায় কোনো জ্যাম না থাকায় আজ আগেই এসেছি।

: শুভ সকাল। একটু হেসে উত্তর দিয়ে আমি রুমে ফিরে গেলাম।

নেলসা আমাদের অফিস সহকারী। নেলসাসহ আরও দুজন নারী কর্মী ও তিনজন পুরুষ কর্মী এই বাসায় বাস করেন। ম্যানিলা থেকে নেলসার বাড়ি প্রায় তিন ঘণ্টার দূরত্বে। বাড়িতে তার স্বামী ও এক সন্তান আছে। স্বামী স্থানীয় পৌরসভায় চাকরি করেন। নেলসা প্রতি শুক্রবার অফিস শেষে বাড়ি যান। আবার সোমবার সকালে ফিরে আসেন।

নেলসার বয়স ৩০-এর কোঠায়। দেখতে মন্দ নয়। নাকটা একটু বোঁচা হলেও নিঃসন্দেহে সুন্দরী বলা যায়।

এমন একজন নারী একা একা এত দূরের রাস্তায় রাতে যাতায়াত করেন। আবার পাশাপাশি ঘরে কিছু পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে বাস করেন শুনলেই আমাদের চোখে-মস্তিষ্কে স্বপ্ন জাগতে পারে। কারণ আমরা এমনটি দেখে অভ্যস্ত নই। অনেকে তো দিনের বেলাতেই একা কোনো নারীকে পেলে মাথা ঠিক রাখতে পারেন না।

আমরা মেয়েদের পোশাকের দোষ দিই। পোশাক তো নিতু-নুসরাতদের রক্ষা করতে পারেনি। আর এদের তো ছোট স্কার্টে কাঁচা হলুদের মতো ধবধবে ফরসা পায়ের দুই-তৃতীয়াংশ অনাবৃত থাকে। টপস বা ব্লাউজে কোনো ওড়নার প্রচলন নেই। চুল আর মুখশ্রীর জন্য মাসে একবার তাদের বিউটি পারলারে যাওয়া চাই-ই।

এমন মেয়েদের দেখেও কেউ হামলে পড়ে না। যাদের অভিজ্ঞতা নেই, তারা অনেকেই মন্তব্য করেন, এরা ভিন্ন ধর্মের ও ওপেন সেক্সের দেশ। ভিন্ন ধর্মের এটা ঠিক, কিন্তু ফিলিপাইন কোনো ওপেন সেক্সের দেশ নয়। প্রাপ্তবয়স্ক নরনারীর সম্পর্ক এখানে বৈধ। ভালোবাসার সম্পর্ক ভেঙে গেলে কোনো পুরুষকে আইনের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয় না। কিন্তু বিবাহিত দম্পতির বিয়ে বিচ্ছেদ বেশ জটিল ও ব্যয়বহুল।

এ দেশে যে নারী নির্যাতন হয় না, তেমন নয়। এখানেও হয়, তবে সেটা হাতেগোনা এবং বিচার সম্পূর্ণ হয় আইনের পথেই। বেশ কয়েক বছর আগে এ দেশের একটি বারে আমেরিকার একজন নৌবাহিনীর অফিসারের সঙ্গে এক মেয়ের পরিচয় হয়। ওই অফিসার তাঁকে তাঁর হোটেল রুমে নিমন্ত্রণ করেন। পরবর্তী সময়ে মেয়েটি তাঁর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আনেন। শক্তিশালী আমেরিকা বা দেশটির সঙ্গে এ দেশের গভীর বন্ধনও সেই ধর্ষককে রক্ষা করতে পারেনি।

এ দেশের কোনো নারী যদি যৌন নির্যাতনের শিকার হয়, তাহলে সে সেটা প্রকাশ করতে কোনো দ্বিধা করে না। আর প্রকাশ করলে বিচার হবে। এখানেই আমাদের ব্যর্থতা। আমরা নির্যাতনের শিকার হলেও লজ্জা ও সামাজিকতার ভয়ে প্রকাশ করি না। আর প্রকাশ করলেও আইনের জটিলতায় অপরাধীরা বের হয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়।

তাই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বন্ধের জন্য দরকার আইনের যথাযথ প্রয়োগ। পারিবারিক সচেতনতা বৃদ্ধি। সামাজিক মেকি লজ্জাবোধের বাইরে এসে অপরাধীকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তার প্রাপ্য সাজা নিশ্চিত করা। আর এ জন্য সরকারের সদিচ্ছা ও জনগণের সহযোগিতাই যথেষ্ট। তাহলে একদিন নেলসার মতো আমাদের মেয়েরাও নির্ভয়ে বিচরণ করবে ঘরে-বাইরে সবখানে।