আকাশের প্রাণ কাঁদে...

ছবি: রয়টার্স। প্রতীকী ছবি
ছবি: রয়টার্স। প্রতীকী ছবি

সন্ধ্যা নামছে নিউইয়র্কের জ্যাকসন হাইটসে। বিচিত্র এই জনপদে শেষ চক্কর দিচ্ছে আকাশ। আজ মাঝরাতে প্লেন ধরবে উরুগুয়ের উদ্দেশে। এই দেশ প্রথম বিশ্বকাপ জিতে নিয়েছিল। চাচাতো বোনের কাছে এক সপ্তাহ কাটাতে ভালোই লাগল।

বিদেশে মানুষ বড় ব্যস্ত। সময় কারও নাই। বোন-দুলাভাইও ব্যস্ত। তবে মনটা তাদের স্নেহসিক্ত। স্পোর্টস রিপোর্টার হিসেবে আকাশ যাচ্ছে ফুটবল খেলার রিপোর্ট করতে। পথে আমেরিকায় আতিথ্যবাস ওর জন্য বিরাট বিলাসিতা। খেলার শখ ছিল তবে মধ্যবিত্তের জন্য শখটা বড় বেমানান। স্কুল, পাড়ার ক্লাব—সবখানে ভালোই খেলেছে।

যখন ফুটবলেই জীবন সমর্পণ করবে ভাবছে তখন বাপ বললেন, খেল, খেলাতে প্রশিক্ষণও নিতে পারিস সাধ্য অনুযায়ী। তবে পেশাদার খেলুড়ে হতে পারবি না। লেখাপড়া করে পেশা একটা বেছে নিতে হবে।

আকাশ নিজের উদ্যোগে ফুটবল খেলার ট্রেনিংই শুধু নেয়নি, এই বিষয়ে এন্তার পড়াশোনা করে তথ্যও সংগ্রহ করছিল।

বাপ বললেন, লেখ, লিখতে শুরু কর। খেলার নিয়ম ও ভালো ট্রেনিং কৌশল কী।

লেখা ও খেলা তার কপাল খুলে দিল। কোচ হিসেবে বিভিন্ন স্কুল ও পাড়ার ক্লাবে কাজের ডাক পেল। থিওরি ও প্র্যাকটিস—দুটোতেই সমান পারঙ্গম। তাই বড়লোকের বাচ্চাদের স্কুলও কোচ হিসেবে ডাকছিল। রোজগারও মন্দ হচ্ছিল না। এর মাঝে জার্নালিজমে ডিগ্রিও করে ফেলল।

এবার বাপের ভাষণ, চাকরি খোঁজ, এই দেশে ফুটবলে লাথি দিয়ে শখ মিটবে, পেট ভরবে না বুঝছিস?

বাপের কথা শুনেছিল বলেই আজ শখ মিটিয়ে ব্রাজিলে বসে ফুটবলে লাথি মারা দেখবে আর লিখবে।

সাবওয়ে ফাস্ট ফুড শপে খাবার কিনতে গিয়ে কিশোর ছেলেটিকে দেখে চেনা লাগল। ওর হাতে খাবারের প্যাকেট দিতে দিতে ছেলেটি বলে উঠল, হাই কোচ হাউ আর ইউ?

: রেহান...!

: ইউ রিমেমবার মি?

: Hi gorgeous তুমি এখানে!

বিস্ময়াভিভূত আকাশের মনে পড়ল, বছর নয় আগে বিত্তবান দাদা তার আদুরে ছোট্ট রেহানকে নিয়ে বিশ্বকাপ দেখতে গেলেন। খেলার সাথি বাচ্চারা মন খারাপ করেছিল খুব। বিত্তশালী পরিবারের রেহান নিউইয়র্কের অতিসাধারণ পাড়ার ফাস্ট ফুড শপ সাবওয়েতে কাজ করছে দেখে আকাশ অবাক।

রেহানের জীবনের গল্প শুনে আকাশের প্রাণ হু হু করে উঠল। ঘর ভাঙা বাবা–মায়ের সন্তান। দাদা-দাদির কাছেই ছিল মূলত। মেধাবী শিক্ষিকা মা আমেরিকাতে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিও পেল এবং একজন সাদা সঙ্গীও জোটাল।

স্কুলে আমোদের ছলে নেশায় জড়িয়ে পড়ে রেহান। দাদা-দাদির কাছে রেহানকে বাঁচানোর চেয়েও মানসম্মান বাঁচানো জরুরি ছিল। তাই রেহানকে তাঁরা মায়ের কাছে আমেরিকা পাঠিয়ে দেন। সেই থেকে নিজেকে বাঁচাতে কাজ করে যাচ্ছে। বাপের অনাদৃত, মায়ের কাছেও অনাহূত রেহান। এখন বিশ্বকাপ ফুটবল তার সাধ্যের মাঝে নেই।

: কোচ, তুমি ওখান থেকে ব্রাজিলের একটা জার্সি নিয়ে এসো; সস্তা হবে।

আকাশ সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের লেখা ‘ব্রাজিলের জার্সি’ গল্পটা প্রথম আলো পত্রিকাতে পড়ে মন খারাপ করেছিল একসময়ে। আজ ওই জার্সিই তার মন খারাপ করাল আবার।

ইন রাশা আ টিচার, ইন আমেরিকা আ ক্লিনার 

প্যাথলজিতে ঢুকে ব্যস্তভাবে স্পেসিমেনটা মহিলার হাতে দিল আমিরা।

ঢোলা অ্যাপ্রোনের ভেতর ঝিরঝিরে শরীরের রোগাটে চেহারার মহিলা কাগজে চোখ বুলিয়েই বলল, হয়নি, এই টেস্টের জন্য দুভাবে স্পেসিমেন দিতে হবে।

: মানে।

: ওয়ান ইন আইস, এখনই কনটেইনার ও আইসপ্যাক দিয়ে দিচ্ছি।

: জিপি তো বলেননি।

: বোধ হয় লিখতে ভুলে গেছে। দাঁড়াও, আমিও নিশ্চিত করছি।

সঙ্গে সঙ্গে কম্পিউটারে বসে কী যেন দেখল। তারপর ক্লান্ত চোখে দৃঢ়প্রত্যয় ফুটিয়ে বলল, হ্যাঁ, ঠিক তাই।

আমিরা হতভম্ব। কোনো প্যাথলজি কর্মী এত দক্ষ হয় কি? হয় ভারত, শ্রীলঙ্কা বা ফিজি থেকে এসেছে।

আমিরার সঙ্গে তার জেনারেল ফিজিশিয়ানের বন্ধুত্ব ভালো। সহানুভূতিশীল, ইতিবাচক জিপি মারিয়া পাইভা খুব জনপ্রিয়। গল্প অনেক হয়েছে। বলেছে তার একুশ বছরের মেয়ে খুবই মেধাবী। তবে দুঃখজনক হলো, চব্বিশ বছরের ছেলের বুদ্ধি আট বছরের বাচ্চার মতো। তারপরও মহিলার হাসি অফুরান, বিরক্তি নাই এতটুকু।

প্যাথলজি কর্মী সম্পর্কে আমিরা জিপি পাইভাকে একদিন জিজ্ঞেস করল। ওই মহিলার দক্ষতা দেখে সে যে বিস্মিত, তা–ও বলতে ভুলল না।

জিপি তখন বলল, বুঝেছি কমল means Lotus–এর কথা বলছ। জানো ওর দেশে সে একজন ভালো ডাক্তার ছিল। এখানে এসে প্রয়োজনীয় পরীক্ষা দেওয়ার মতো ধৈর্য, মানসিক শক্তি—কোনোটাই ছিল না। এখন মেডিকেল টেকনিশিয়ানের কাজ করছে। এই কাজে সে ভীষণ ভালো। আমি ইমিগ্র্যান্ট। আমি জানি ইমিগ্র্যান্টদের অনেক ক্ষতি মেনে নিতে হয়, দুঃখ সহ্য করতে হয়। এখানে ও সুযোগ পেলে ডাক্তার হিসেবে নাম করত। সবই ভাগ্য।

আমিরার তখন একটা সিনেমার কথা মনে পড়ল। বাচ্চাদের সিনেমা ‘পলি’তে পলি নামের টিয়া পাখির সঙ্গে আমেরিকার কোনো এক গবেষণাগারের বিষণ্ন সাফাই কর্মীর গল্প চলে। লোকটি নিজ দেশ রাশিয়াতে শিক্ষক ছিল এখানে ময়লা সাফ করে।

সে বলেছিল, In Russia I was a teacher, in America I am a cleaner.

বাস্তবে তাই দেখে ব্যথিত হলো আমিরা।

আন্টি লিন্ডা

বাচ্চাটিকে চাইল্ড কেয়ারে দিতে গিয়ে মায়ের মনটা বিষণ্ন ছিল। প্রথম দিন যে মেয়েটির কোলে উঠেছিল বাচ্চাটি, সেই হাসিখুশি দীর্ঘাঙ্গী সাদা মেয়েটিকে দেখিয়ে মা বলেছিল, লুক্ ইট্স আন্টি লিন্ডা।

লিন্ডা উচ্ছল হাসি ছড়িয়ে বাচ্চাটিকে নিয়ে এক পাক ঘুরে নিল। লিন্ডার সাদর অভ্যর্থনায় মা ও শিশু দুজনই খুশি। বাচ্চার মা ভেবে রেখেছে, সে তার বাচ্চাকে আদব-কায়দা শেখাবে। বড়দের নাম ধরে ডাকতে দেবে না। সে জন্য লিন্ডাকে আন্টি লিন্ডা বলে পরিচয় করাল।

প্রথম দিকে বাচ্চাটি একটু একটু মন খারাপ করলেও ধীরে ধীরে চাইল্ড কেয়ার সেন্টারের খেলাধুলা ও আনন্দে মেতে থাকা এবং নিয়মশৃঙ্খলায় অভ্যস্ত হচ্ছিল। খেলার ছলে নানা কর্মকাণ্ডে ছোট্ট বাচ্চাদের ব্যস্ত রাখার কত যে কৌশল। অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মিলেমিশে খেলার, খেলনা ভাগাভাগির সুন্দর আচরণগুলোও শিখছিল।

বাচ্চার মুখে কথা ফুটছে। প্রতিদিনই সে নতুন কিছু শব্দ আধো আধো উচ্চারণে বলছে। মা-বাবা আনন্দে হেসে কুটিকুটি।

ওই চাইল্ড কেয়ার সেন্টারে লিন্ডা ও অন্যরা সবাই বাচ্চাদের প্রতি যথেষ্ট যত্নবান। মা ভাবেন, ভারতীয় সারিকা, প্রীতি, মনপ্রীত, মাধুরী, চাইনিজ অ্যানি, নিউজিল্যান্ডের কিরা—এরা সবাই যদি বাচ্চা রাখার মতো কঠিন হিমশিম খাওয়া কাজটি আন্তরিকভাবে না করত, তবে পেশাজীবী মায়েদের কী গতি হতো? অনেক মা পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় বাচ্চা রাখার ভালো বন্দোবস্ত করতে না পেরে।

বেশ কিছুদিন যেতে মা লক্ষ করলেন, বাচ্চার কথাবার্তা ভালোই আগাচ্ছে। ‘থ্যাংক ইউ’, ‘মে আই...’, ‘সরি’ জায়গামতো ঠিকই ব্যবহার করছে। তবে একটা বিষয় মা বারবার বলেও অভ্যাস করাতে পারছেন না। তা হলো শুরু থেকে লিন্ডা ছাড়া অন্য কাউকেই সে আন্টি ডাকে না। যখন সে নিজের মায়ের চেয়েও বয়সে বড়দের প্রীতি, সারিকা, মনপ্রীত বলে ডাকে, মায়ের খারাপ লাগে। লিন্ডা, অ্যানি, কিরাদের নাম ধরে ডাকলেও ওরা কিছুই ভাবত না। আন্টি ডাকলেও ওরা আহ্লাদে আটখানা হয় না। ওদের কাছে আত্মীয়তার চেয়েও সখ্য বেশি কাছের। সারিকাদের আন্টি ডাকলে ওরা বেশি খুশি হতো। বাচ্চার এই আচরণের কোনো কারণ মা ধরতে পারল না। কেন যে বাচ্চাটা এই ভব্যতাটুকু শিখছে না কে জানে?

একদিন সেন্টারে কী এক অনুষ্ঠানে অনেক অভিভাবক জড়ো হয়েছেন।

অন্য এক বাচ্চার মা বলল, তোমার বাচ্চা তো বেশ কথা শিখেছে, কেয়ারারদের নামও জানে ও?

: জিজ্ঞেস করো ওকে।

ওই মা তখন একেকজনকে দেখিয়ে তার নাম কী বাচ্চাটির কাছে জানতে চাইল। চটপট করে সে নাম বলে যাচ্ছিল। লিন্ডাকে দেখিয়ে যখন তিনি প্রশ্ন করলেন, হোয়াট ইজ হার নেম?

বাচ্চাটি সানন্দে বলে উঠল, আন্টি লিন্ডা!

বাচ্চাকে যতই বলা হলো যে ওর নাম লিন্ডা। বাচ্চাটি মাথা দুপাশে দুলিয়ে বারবার বলে গেল, নো ইটস আন্টি লিন্ডা।

ফালতু জ্ঞান 

ছেলেটি ঝরঝর করে একটির পর একটি প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে। দেখতে সে চমকে দেওয়ার মতো বুদ্ধিমান চেহারার অধিকারী নয়। কিছুটা সাদামাটা ধরনেরই বলা যায়। তবে মিলিয়ন ডলার জিততে এসে উত্তর যখন দিচ্ছিল তখন বোঝা যাচ্ছিল ওই ছোকরা জেনেশুনেই উত্তর দিচ্ছে। আন্দাজ করে বাজিমাত করা তার উদ্দেশ্য নয়। উপস্থাপকও অবাক ওর তথ্যভান্ডারের উপচে পড়া বৈভব দেখে। হয় শেষ প্রশ্ন বা তার আগের প্রশ্নটা দেখেই ছেলেটির মুখে বিদ্রূপের হাসি ফুটে উঠল।

সে বলল, এই তথ্য আমি জানি না, আর জানতেও চাই না।

: আরে, আন্দাজ তো কর; এতগুলো প্রশ্নের ঝটপট উত্তর দিলে এখন এটা পারবে না এ কেমন কথা? মিলিয়ন ডলার পেয়ে যেতে পারো!

: এই ফালতু জ্ঞান মাথায় ঠাঁই দিতে চাই না।

প্রশ্ন ছিল বাকিংহাম প্যালেসে মোট কয়টা রুম বা কামরা রয়েছে? আইনের ছাত্র প্রতিযোগী ছেলেটি মিলিয়ন ডলার পুরস্কার ফসকে যাওয়াতেও বেজার হলো না। উপরন্তু এটিকে ফালতু জ্ঞান (যাকে সে useless knowledge) বলে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিল। শেষে উপস্থাপকই জানাল ৭৭৫টি কামরা রয়েছে ওই রাজপ্রাসাদে।

তখন মনে পড়ল আমাদের দেশে, হয়তোবা উপমহাদেশেও স্কুলে ইতিহাস পরীক্ষায় এককথায় উত্তর দিতে বা শূন্যস্থান করার জন্য এমনি এক ফালতু তথ্য বা ওই ছেলের বয়ান অনুযায়ী ‘ইউজলেস নলেজ’ মাথায় রাখতে হতো। তা ছিল ‘বুসিফেলাস’–এর নাম। সে কোন বীর, নৃপতি বা ইতিহাসখ্যাত পণ্ডিত নয়। সে ছিল গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের ঘোড়া!