রেলগাড়ি সমাচার

লেখিকা
লেখিকা

ঢাকাগামী মহানগর এক্সপ্রেস চট্টগ্রাম রেলস্টেশন থেকে ছাড়বে সকাল সাড়ে সাতটায়। মাহবুব দুই হাতে দুটো বড় ব্যাগ নিয়ে হাঁটছে আর নির্দিষ্ট বগি খুঁজছে। হাতে সময় আছে বেশ। বাস–ট্রেন ধরার ব্যাপারে মাহবুব খুব সচেতন। কখনো দেরি হয় না তার। ঘড়িতে মাত্র সাড়ে ছয়টা! মাহবুবের পেছন পেছন হাঁটছে তার স্ত্রী সোমা। সোমা দুই হাত দিয়ে একপ্রকার টেনে টেনে হাঁটাচ্ছে দুই বাচ্চাকে। ৯ বছরের মেয়ে অনন্যা আর ৪ বছরের ছেলে অর্ণব। শীতের সকাল। ঘুমে বাচ্চাগুলোর চোখ ঢুলুঢুলু।

ঢাকায় সোমার বাপের বাড়ি। ডিসেম্বরে বাচ্চার ফাইনাল পরীক্ষা শেষ হলে সে ঢাকায় ভাইদের বাসায় কিছুদিনের জন্য ঘুরতে যায়। মাহবুবের চাকরির সুবাদে চট্টগ্রামের এক পাহাড়ি অঞ্চলে থাকে তারা। শীতের ছুটিতে সবাই যখন পাহাড় বা সমুদ্র দেখতে ছোটে, সোমা তখন শহর দেখতে ছোটে। বাচ্চারাও অনেক খুশি থাকে। মামাবাড়ি যাবে বলে কথা।

কিন্তু মাহবুব এত দিনের জন্য ছুটি পায় না। সে সাধারণত বউ বাচ্চাকে আগে আগে পাঠিয়ে দেয়। পরে দুই-তিন দিনের ছুটি ম্যানেজ করে তাদের নিয়ে আসে। অল্পবয়সী সোমা আবার রাস্তাঘাট কিছুই চেনে না। মাহবুব তাকে ট্রেনে বসিয়ে দেয় আর কমলাপুরে সোমার ভাই দাঁড়িয়ে থেকে তাকে রিসিভ করে। সারা দিন ট্রেনে চেপে বাচ্চাদের নিয়ে মায়ের বাড়ির কথা চিন্তা করতে করতেই সোমা ঢাকা পৌঁছে যায়।

এভাবেই প্রতিবছর একই নিয়ম চলমান। আজকেও তার ব্যত্যয় হবে না। মাহবুব বগি খুঁজে পেয়েছে। বগি নম্বর ‘ঠ’। ট্রেন ছাড়তে এখনো প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাকি। রয়েসয়ে মাহবুব ব্যাগগুলো সিটের ওপরে রাখল। ব্যাগ কটা আছে, তা আবার মাহবুবের কয়েকবার গোনা লাগবে। যা হোক, ব্যাগ রেখে বউ বাচ্চাকে বসিয়ে মাহবুবও বসল। ট্রেন ছাড়ার কিছুক্ষণ আগেই নেমে পড়বে সে। পরিবারের সঙ্গে কয়েক সপ্তাহের বিচ্ছেদের আগে একটু সময় কাটানো।

সোমা আবার এক্সপার্ট রাঁধুনি। যত দিন থাকবে না, হিসাব করে রান্না করে বক্সে ভরে ফ্রিজে রেখে দিয়েছে সে। শুধু তাই নয়, ট্রেনে খাবার জন্য আগের রাতেই তৈরি করে রেখেছিল চিকেন ফ্রাই, পরোটা আর বিরিয়ানি। সময় আছে দেখে খাবারের বাটি বের করল সে। সকালের নাশতাটা না হয় একসঙ্গেই হয়ে যাক।

লোকজন আসছে আর সিট খুঁজছে। ব্যাগ রাখা নিয়ে হইচই, হকারদের আনাগোনা। এসবের মধ্যে খাওয়ার একটুও রুচি ছিল না মাহবুবের। কিন্তু সোমার সেসবে বয়েই গেল! সে নাছোড়বান্দা, মাহবুবের খেতেই হবে। অগত্যা সোমা নিজেই পরোটা ছিঁড়ে ছিঁড়ে স্বামী সন্তানদের খাওয়ানো শুরু করল। অর্ণব আবার খুব বাবা ভক্ত। একদম বাবার কোলে চেপে বসেছে। অনন্যা ট্রেনে চেপেই পটেটো ক্রাকার্সের বায়না শুরু করেছে। মাহবুব এরই মধ্যে চিপস আর কোক কিনে বাচ্চাদের হাতে দিল।

ট্রেনের সরু বগিতে কত শত কোলাহল। তাতে এই পরিবারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা নিজেরা ঘরে তৈরি সকালের নাশতা খেতে মশগুল। আনন্দের ভেতরে থাকলে সময় দ্রুত পালায়। হঠাৎ ট্রেনটি নড়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে বাজল ট্রেনের হুইসেল। মাহবুব পরোটা চিবাতে চিবাতেই লাফ দিল। কোনোমতে বাচ্চাদের গালে একটু ছুঁয়ে দিয়ে দৌড়ে নেমে পড়ল ট্রেন থেকে। নেমেই দাঁড়িয়ে রইল। জানালা দিয়ে যত দূর পর্যন্ত দেখা যায় বাচ্চারা হাত নাড়ল। সোমাও শেষ মুহূর্তে ইশারায় যত প্রয়োজনীয় কথা মনে করিয়ে দেওয়া যায়, তা করতে থাকল।

ট্রেনের গতি বাড়ছে, ছোট হয়ে যাচ্ছে জানালা দিয়ে বাড়িয়ে রাখা তিনটি মুখ। হঠাৎ বাঁক নিতে থাকলে মাহবুবকে আর দেখা গেল না। সোমার হাতে তখনো খাবারের বক্স। বাকি খাবারটা বাচ্চাদের খাওয়াতে লাগল। নিজেও একটু একটু খেতে শুরু করল। মায়ের বাড়ি যাচ্ছে, কত খুশি সে। একই সঙ্গে আবার মাহবুবকে নিয়ে রাজ্যের চিন্তা। ঠিকমতো খাবে তো।

এমন ভাবনার মধ্যে হঠাৎ চোখ গেল পায়ের কাছে। দেখতে পেল মাহবুবের ব্যাগ। এই ব্যাগে ওর ক্যামেরা। মাহবুব শখের সাংবাদিকতা করে। ক্যামেরা ছাড়া একমুহূর্ত চলবে না তার। শুধু তাই নয়, সোমা জানে এই ব্যাগেই বাসার চাবি, আলমারির চাবি, বাইকের চাবি। সোমা দুই মিনিট ধরে কাঁপতে লাগল। কী করবে কিছু বুঝতে পারছিল না। ট্রেনের গতি তখন সর্বোচ্চ। জানালা দিয়ে মাথা বের করে দেখল সে। স্টেশনের নামগন্ধও পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক কিলোমিটার এগিয়ে গেছে। একটা উপায় মাথায় এল। চেইন টানা। সোমা পাশের ভদ্রলোককে ঘটনা খুলে বলল। তিনি বুঝিয়ে বললেন, ট্রেন শহর ছেড়ে গ্রামে প্রবেশ করেছে। চেইন টেনে লাভ হবে না। স্টেশন থেকে এত দূরে আসতে পারবে না মাহবুব। আর সোমার পক্ষেও দুই বাচ্চা নিয়ে এই রকম গ্রামে নেমে পড়া বুদ্ধিমানের কাজ হবে না।

এই ঘটনা যে সময়ের, তখন কেবল ল্যান্ডফোনের প্রচলন ছিল। দোকানে গেলে মোবাইল ফোন পাওয়া যেত। কিন্তু মানুষের হাতে হাতে মোবাইল ফোনের ব্যবহার তখনো শুরু হয়নি। ততক্ষণে পুরো বগি সোমার ঘটনা জেনে গেল। একজনের কাছে মোবাইল ছিল। তিনি সোমাকে বললেন, চাইলে সে ফোনটি ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু মাহবুবের তো কোনো মোবাইল ছিল না। কাকে ফোন করবে সে? তাদের বাসা যে শহর থেকে অনেক দূরে। সেই পাহাড়ি এলাকায় একটি মাত্র ফোনের দোকান। সেই দোকানের নম্বর আছে সোমার কাছে। কিন্তু সেখানে ফোন করে কী বলবে সে?

সোমা জানে মাহবুব ব্যাগ ছাড়া একদম দিশেহারা হয়ে যাবে। কী করবে কে জানে? বাসায় ঢুকবে কীভাবে? আশপাশের মানুষ সোমাকে বুদ্ধি দিল ঢাকা গিয়ে ব্যাগটা কুরিয়ার করে দিতে। তার স্বামী নিশ্চয়ই সোমার ভাইদের সঙ্গে যোগাযোগ করবে। সুতরাং ভয় নেই। কিন্তু সোমার মন কী মানে? অর্ণব এত কিছু বোঝে না। সে শুধু বাবার জন্য কেঁদেই চলছে। অনন্যা বাবার ব্যাগটা কোলে করে বসে আছে। সে জানে এই ব্যাগ বাবার কত দরকারি। ছোট মেয়ে এটুকু বুঝতে পারছে যে করেই হোক বাবাকে এই ব্যাগ পৌঁছাতে হবে। সোমা নিজেকে দুষছে। কেন সে মাহবুবকে খেতে বলল? নইলে তো আর এ রকম দেরি হতো না। মাহবুব অত্যন্ত সচেতন। অথচ আজ সোমার বোকামির কারণে কী বিপদটাই হলো!

ঘণ্টাখানেক পর ট্রেন থামল এক স্টেশনে। যাত্রী ওঠানামা করছে। হকাররা ভিড় বাড়াচ্ছে। তাতে সোমা আর তার সন্তানদের কোনো খেয়াল নেই। থমথমে মুখে ছেলেমেয়ে বসে আছে তাদের মায়ের হাত ধরে। যেন পারলে তারা এখনই নেমে বাপের কাছে দৌড় দেয়। এমন সময় কানে বাজল মাহবুবের কণ্ঠ! জানালা দিয়ে চিৎকার করছে সে।

সোমা, সোমা, আমার ব্যাগটা দাও।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না সোমা! মেয়ে অনন্যার কোলে রাখা ব্যাগটা ত্বরিত বেগে স্বামীর দিকে ছুড়ে মারল। মাহবুব চিৎকার করে বলেই যাচ্ছে, ট্রেন বাঁক নেওয়ার সময় আমার খেয়াল হলো ব্যাগের কথা। দৌড়ে শেষ বগিতে উঠলাম। কিন্তু ওই বগি থেকে তোমাদের বগিতে আসার ব্যবস্থা ছিল না। তাই ট্রেন থামার জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আমি এখান থেকে বাস ধরে চলে যাব।

ট্রেন আবার দুলতে লাগল। বাঁশি বাজছে। শোনা যাচ্ছে না মাহবুবের কথা। তবু তাকিয়ে আছে তিন জোড়া চোখ। নাহ, পুরো বগিই তাকিয়ে আছে। সবাই যে জেনে গেছে সোমার কথা। সোমার সঙ্গে যে সবাই চিন্তিত ছিল আজ। সবার মুখেই এখন তৃপ্তিময় হাসি।

ওদিকে মাহবুব চিৎকার করেই যাচ্ছে—একদম টেনশন করো না। পৌঁছে জানাবে আমাকে। খুব ভালোমতো আনন্দ করো। আমি নিতে আসব কিছুদিন পর...।

ট্রেন ছুটছে। মাহবুবের হাত নাড়া থামছে না। তিন জোড়া চোখের ভেতরে আনন্দের ঝিলিক। আর ঠোঁটে–মুখে নিষ্পাপ হাসি।
–––

কাজী সাবরিনা তাবাসসুম: মিলান, ইতালি।