ছুটির নিমন্ত্রণে

হ্রদে শাপলা
হ্রদে শাপলা

শীতপ্রধান দেশ কানাডার গ্রীষ্মকালটা অতি সুন্দর। উষ্ণ হাওয়ার আন্দোলনে আর রঙে-রসে-গন্ধে প্রকৃতি নিজেকে সাজিয়ে তোলে এক অপরূপ সাজে। হৃদয়ের ছন্দের সঙ্গে গড়ে ওঠে প্রকৃতির ছন্দের এক নিবিড় সম্পর্ক। তাই সেই ছন্দে ছন্দ মেলাতে আর অন্তহীন আনন্দের এক অসীমতাকে কাছে পেতে যান্ত্রিক জীবনের যান্ত্রিকতাকে পেছনে ফেলে চলে যাই দূরে। কোলাহল ও ব্যস্ততাবিহীন মাটির কোলে ক্যাম্পিং করতে।

সালটা ছিল ২০১০। যখন কানাডার জর্জিয়ান বের কূলঘেঁষা এওয়ান্ডা পার্কে প্রথম ক্যাম্পিং করতে গেলাম। সেই ছিল প্রথম ভালো লাগা। প্রথম ভালোবাসা। তারপর থেকে সেই ভালোবাসার আবেশ ধরে প্রতি গ্রীষ্মে চলে যাই প্রকৃতির অক্ষয় কমন্ডলু থেকে আনন্দের যে অমিয়ধারা অবিরাম প্রবাহিত হচ্ছে, তার কিছুটা স্বাদ আস্বাদন করতে।

হ্রদে শাপলা
হ্রদে শাপলা

প্রকৃতির মাঝে অনন্তের ছোঁয়া পেতে গত বছর ক্যাম্পিং করতে গিয়েছিলাম শারবট লেক প্রভিন্সিয়াল পার্কে। ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ৮০ হেক্টর জায়গাজুড়ে থাকা শারবট লেক কানাডিয়ান শিল্ডের দক্ষিণ তীরে অটোয়া ও কিংস্টন শহরের কাছাকাছি অবস্থিত। হাইওয়ে সেভেনের পাশঘেঁষা পার্কটির নাম শারবট লেক রাখা হলেও আসলে এখানে ব্ল্যাক লেক ও শারবট লেক নামের দুটি লেক আছে। নামকরণ শারবট লেকের অনুকরণে করা। তবে ব্ল্যাক লেকের দুটো সৈকত পর্যটকদের কাছে বেশি জনপ্রিয়।

অন্য প্রাদেশিক পার্কগুলোর তুলনায় বেশ ছোট এই পার্কের ১৯৪টি ক্যাম্প সাইটের ৪২ নম্বর সাইটটি ছিল আমাদের তিন দিনের অস্থায়ী ঠিকানা। এওয়ান্ডা বা এলগনকুইন পার্কের মতো নানাবিধ গাছের ঘনবসতিপূর্ণ না হলেও ম্যাপল, ওক, বার্চ ও হিকোরিগাছে আবৃত ছায়াময় জায়গাটি। অত্যন্ত সুন্দর লেকের কোলঘেঁষা সাইটটি দুটি তাঁবু ও দুটি গাড়ি রাখার জন্য যথেষ্ট প্রশস্ত। আর বনভোজনের টেবিল ও আগুন কুণ্ড ইতিমধ্যে সেখানে ছিল।

আঁকাবাঁকা পথ ঘুরে ঘুরে অনেক প্রত্যাশার নির্ধারিত সাইটে এসে আমরা একেবারে আনন্দে আত্মহারা। আমার সন্তানেরা ইলেকট্রনিকসের পর্দা ভুলে নিমগ্ন থাকে প্রকৃতির দেয়ালে আঁকা বৈচিত্র্যময় নিপুণ কারুকার্যে। ছোট ছেলে প্রিন্স বেশ বড় বড় কিছু পাথর এনে আগুন কুণ্ডের চারপাশে সাজিয়ে রাখে। ওইটুকু শরীর নিয়ে তার এই কাজ দেখে উদ্বিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ‘বাবা, তুমি এই ভারী ভারী পাথরগুলো দিয়ে কী করছ?’

ঝোপ জাতীয় একটি গাছে থোকায় থোকায় ফুটে আছে কিছু ফুল। দেখতে একদম কদমফুলের মতো
ঝোপ জাতীয় একটি গাছে থোকায় থোকায় ফুটে আছে কিছু ফুল। দেখতে একদম কদমফুলের মতো

‘পাথর দিয়ে চেয়ার বানাই মা।’ ব্যস্ততার সঙ্গে উত্তর দেয় প্রিন্স। ‘রাতে আমরা সবাই ফায়ার পিটের পাশে বসে স্মোরস খাব।’

‘তাই বলে পাথর দিয়ে?’ আবার আমার জিজ্ঞাসা।

‘মা, আই অ্যাম অ্যাট স্টোন এজ নাও দ্যাটস হোয়াই।’ দ্বিধাহীনভাবে উত্তর দিয়ে আবারও সে কাজে ব্যস্ত হয়ে যায়।

‘ওকে, মাই বয় ফ্রম স্টোন এজ, লেট মি নো ইফ উই নিড এনি হেল্প’ বলে আমিও ব্যস্ত হয়ে পড়ি আমাদের অস্থায়ী ঠিকানা সাজাতে। আর মনে মনে ভাবতে থাকি, সত্যিই তা-ই, যখন যেমন, তখন তেমন, স্টোন এজে থাকলে তো স্টোন দিয়েই সব গড়া উচিত। যখন মাটির কোলে, প্রকৃতির কাছে আসি, তখন যেন মাটির সঙ্গেই মিশে থাকি। তাঁবু টানিয়ে, সব গুছিয়ে বিছানা পেতে যখন ক্লান্ত শরীরটি এলিয়ে দিই, মনে হয় আহা কী শান্তি, কী শীতল ধরণি মায়ের মাটির কোল!

আকাশের আঁচলে আঁকা মেঘেদের জলছবি সরিয়ে মধ্যদিনের দিনমণি যখন তার উষ্ণ আলো দিয়ে হ্রদের বদ্ধ জলকে স্পর্শ করছে, তখনই সেখানে গেলাম অবগাহন করতে। কী যে সুন্দর হ্রদ সৈকতের সেই শান্ত রূপ! সবুজ গাছের বেষ্টনীতে ঘেরা তার জল আর একদিকে শুধু ভেজা বালুকার তট। সেখানে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তৈরি করছে বালুর প্রাসাদ। তরুণ-তরুণীরা উপুড় হয়ে শুয়ে সূর্যস্নান করছে নিঃশব্দে। কয়েকটি পরিবার জলে সাঁতার কাটছে আনন্দে।

হ্রদে ডিঙি নৌকায়
হ্রদে ডিঙি নৌকায়

হ্রদের ঠিক মাঝখান দিয়ে দেখি একটি কেনিউ বা ডিঙি বেয়ে যাচ্ছেন দুজন মাঝি। খালি পায়ে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে দেখি এক বিস্ময়—শান্ত জলের একধারে সবুজ ভাসমান লিলি প্যাডের আবরণ ভেদ করে ফুটে আছে শুভ্র শাপলা। আমার বাংলার শাপলা। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই আনন্দের চিৎকার বেরিয়ে এল অজান্তে, শাপলা ফুল! বেশ কয়েক বছর আগে এলগনকুইন পার্কে ক্যাম্পিং করতে গিয়ে হৃদয়গ্রাহী এই ফুলের দেখা একবার পেয়েছিলাম। তবে এবারের মতো এত সহজলভ্য ছিল না। চির চেনা শাপলাকে চোখে দেখে হাতে স্পর্শ করার ইচ্ছেটা সামলাতে না পেরে আমার বরকে বললাম, আমি চাই একটা শাপলা! সে কিছু বলল না। শুধু চাইল আমার চোখে আর আমি পড়ি তার চোখের ভাষা—শাপলা? এ আর এমন কী কঠিন কাজ। শাপলা ফুলকে হাতে পেয়ে মনে হলো ভালোবাসার বাংলাদেশকে যেন হাতের মুঠোয় পেলাম। বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে উঠল। শাপলার বাইরের রূপ দেখতে দেখতে মন ডুবে রইল অন্তরের চিন্তনে।

সারা দিনের শেষে যখন রৌদ্রের প্রখরতা কমে এসেছে, তখন সবাই মিলে বের হলাম পুরো পার্ক ঘুরে দেখতে। উঁচু-নিচু পাহাড়ের বৈচিত্র্যপূর্ণ বনভূমি আর তার দুই কূল ছুঁয়ে থাকা দুটো হ্রদের জল। শারবট লেকে নৌকা নামানোর যে কয়েকটি ঘাট আছে, তার একটিকে খুব কাছ থেকে দেখতে গেলাম। জলের কাছে পৌঁছানোর আগেই খেয়াল করলাম একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। ভাবলাম যে দেশের বেশির ভাগ ফুলই গন্ধহীন সেখানে এত সুবাসিত ফুল কী হতে পারে? হেঁটে একটু সামনে এগিয়েই দেখি মাঝারি ধরনের ঝোপ জাতীয় একটি গাছে থোকায় থোকায় ফুটে আছে কিছু ফুল, যা কিনা দেখতে একদম কদম ফুলের মতো।

প্রথমে আমি তো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারিনি। তারপর সত্যতা যাচাই করতে আরও কাছে গিয়ে একটি ফুল তুলে নিয়ে ঘ্রাণ নিলাম। এই সেই চির চেনা কদম ফুল, যাকে দেখলেই মন গেয়ে ওঠে, ‘বাদল-দিনের প্রথম কদম ফুল করেছ দান,/ আমি দিতে এসেছি শ্রাবণের গান!’ ভাবলাম তাই তো এখন তো শ্রাবণ মাস। মনে পড়ে গেল ইডেন কলেজের পুকুর পাড়ের সেই বিশাল আকৃতির কদমগাছটার কথা, যার গন্ধ কলেজের গেট থেকে হোস্টেলের গেট পর্যন্ত পুরোটা পথ মাতিয়ে রাখত। শারবট লেকে এসে সেই বৃষ্টিভেজা কদম ফুলের মাতোয়ারা গন্ধে ভিড় করল কত স্মৃতি মনের ক্যানভাসে!

দিনের শেষে সন্ধ্যা নেমে এলে ফিরে আসি ক্যাম্প সাইটে। রান্না করে সান্ধ্যভোজ সেরে জ্বালি আগুনের প্রজ্বলিকা। তার পাশে বসে স্মোরস (মার্সমেলো রোস্ট) খেতে খেতে শুরু হয় পালা করে আমাদের গল্প বলা। ছোটবেলার গল্প, বড়বেলার গল্প, ভয়ের গল্প, হাসির গল্প। গভীর হয় রাত, আর গভীর হয় রাতের নীরবতা। মায়াবী চাঁদ তার শুভ্র জোছনায় আলোকিত করে বাইরের ঘন অরণ্যকে আর ভেতরের অন্তরাত্মাকে। জীবনের অসমাপ্ত গল্পের রেশ নিয়েই আমার ক্লান্ত ছেলে দুটো তাঁবুর শক্ত মাটিতে ঘুমাতে যায়। আর আমরা দুজনে নিঝুম রাতের নিস্তব্ধতা গায়ে মেখে কাটিয়ে দিই আরও অনেকটা সময়। কখনো গল্পে, কখনো নিঃশব্দে।

স্মোরস (মার্সমেলো রোস্ট)
স্মোরস (মার্সমেলো রোস্ট)

ঘুম ভাঙে পাখির গানে। শান্ত ভোরের হাওয়ায় যেন ভেসে আসে ভৈরবের সুর। কান পেতে শুনি কোমল ঋষভ আর ধৈবতের গম্ভীর আন্দোলন। প্রকৃতির ছন্দে আর সুরে পূর্ণ হয় প্রাণ। পরের দিনটি কাটে লেকে ডিঙি দিয়ে ঘুরে ঘুরে শাপলা তুলে। আমার শাপলা প্রীতি দেখে আমার ছেলেরা আমাকে যে কত শাপলা তুলে দিল! ‘মা, এটা দেখো কত সুন্দর; এই যে একটা কলি তুললাম তোমার জন্য, আমরা কেনিউটা ওই দিকে নেই মা, ওখানে অনেক বেশি শাপলা আছে; শাপলাতে পা দিয়ো না কিন্তু।’

নৌকার মাঝখানে রাখা শাপলাগুলোতে পা না দেওয়ার জন্য তাদের বাবাকে সাবধান করে দেয়। কত ছোট ছোট বিষয়ে যে এত আনন্দ লুকিয়ে থাকতে পারে! বিকেলবেলা গেলাম ব্ল্যাক লেকের শান্ত জলে মাছ ধরার জন্য। তবে সেখানে তেমন সুবিধা হলো না। তাই কয়েকটা সানফিস নিয়ে গোধূলির রং গায়ে মাখতে মাখতে ফিরে এলাম ক্যাম্প সাইটে। ভিক্টর কয়েক দিন ধরে তার গিটারে লালন ফকিরের সুর তুলছিল আর ক্যাম্পে এসে বারবার সেটাই গুনগুন করে গাইছিল, ‘মিলন হবে কত দিনে, আমার মনের মানুষের সনে।’ প্রকৃতির সান্নিধ্যে এসে ১৩ বছর বয়সী কিশোরের ভাঙা গলায় মনের মানুষের এই গান শুনে আমার ভেতর থেকে কে যেন গেয়ে উঠল, ‘আমি কোথায় পাব তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।’ মানুষের মন সত্যিই এক আজব কারখানা, প্রকৃতির মাঝে পেতে চায় অনন্তের ছোঁয়া!

শারবট লেক মাছ ধরার জন্য উত্তম জায়গা। এই তথ্য পেয়ে পরদিন নির্মল আকাশ উত্তপ্ত হওয়ার আগেই আমরা মাছ ধরার টানে চলে গেলাম সেখানে। আর নিরাশ হলাম না। বেশ কিছু সানফিস ধরলাম। দুটো হ্রদের মাঝখানের যে ভূখণ্ডটি আছে তাকে বলে পরজ। সেখানে ১ দশমিক ৭ কিলোমিটারের একটি ‘ডিসকভারি ট্রেইল’ আছে, যা কিনা দুটো হ্রদের কূলঘেঁষে চলে যাওয়া একটি লুপ। সরু ট্রেইলটির একপাশে বনভূমি আর অন্য পাশে হ্রদের টলমল করা জলরাশি। ট্রেইলের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখলাম একপাশের গুল্ম-বৃক্ষ-তরুলতার বৈচিত্র্য আর অন্যপাশের হ্রদের শীতল জলে মাঝে মাঝে ভিজিয়ে নিলাম ক্লান্তি ভরা পা। শান্ত স্নিগ্ধ প্রকৃতির সঙ্গে অনাবিল সুখের সময়টা খুব দ্রুত কেটে যায় আর সময় ঘণ্টা বাজায় ঘরে ফেরার। প্রকৃতির স্বর্গীয় রূপকে এত কাছে থেকে উপভোগ করার, নিবিড় করে পাওয়ার এই কয়েকটা দিন আমার কাছে এক পরম পাওয়া।

পড়ন্ত বিকেলে একপশলা বৃষ্টির পর ঝলমলিয়ে ওঠা রক্তিম সূর্য যেমন বদলে দেয় আকাশের রং। তেমনি সাদা-কালোয় মাখা ব্যস্ততাময় গতানুগতিক জীবনকে রংধনুর রঙে রাঙিয়ে দেয় প্রকৃতির অচৈতন্যতলে ডুবে থাকা এই দিনগুলো। নিজের অস্তিত্বের সঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় প্রকৃতির অস্তিত্ব-অনাবিল আনন্দে তুলে আনি জীবনের নির্যাস।