গবেষণা ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

‘গবেষণা হলো এমন কিছু দেখা, যা প্রত্যেকে দেখেছে। কিন্তু এমন কিছু ভাবা, যা কেউ ভাবেনি।’

নোবেল বিজয়ী হাঙ্গেরিয়ান প্রাণরসায়নবিদ আলবার্ট জেন্ট গায়র্গির এ উক্তি প্রত্যেক গবেষককে তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু নিয়ে বারবার ভাবতে শেখায়। একজন সাধারণ মানুষের দেখা আর একজন গবেষকের দেখার পার্থক্য শুধু চিন্তায়। বিশ্ববিখ্যাত পদার্থবিদ আইজ্যাক নিউটন সেই আপেল পড়াটাকে ভিন্নভাবে চিন্তা না করলে ‘মাধ্যাকর্ষণ শক্তি’ ধারণার আবিষ্কার হতো না। সারা বিশ্বের বিখ্যাত উদ্ভাবকেরা তাঁদের কল্পনাশক্তি কাজে লাগিয়েই একের পর এক নতুন প্রযুক্তিপণ্য বা ধারণা উদ্ভাবন করে যাচ্ছেন। বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর দিকে তাকালেও দেখা যায়, তারা গবেষণার মাধ্যমে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে উন্নত।

গবেষণার সুফল পাওয়ার জন্য সমাজ ও রাষ্ট্রের দুটি বিষয়কে সমানভাবে গুরুত্ব দিতে হয়। প্রথমটি গবেষণা করা আর দ্বিতীয়টি সেই গবেষণা থেকে প্রাপ্ত জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগ করা। রাষ্ট্রীয় কাঠামোটা সাধারণত এমন করেই গঠিত হয়। যেখানে যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁরা সেটা প্রয়োগ করার ক্ষমতা থাকার মতো দায়িত্বে থাকেন না। আবার যাঁরা সেটার প্রয়োগ করবেন, তাঁদের হাতে গবেষণা করার মতো এত সময় থাকে না। সে জন্যই প্রয়োজন পক্ষগুলোর সুসমন্বয়।

কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি অ্যাসোসিয়েশন কর্তৃক আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার কারণে ব্রিটিশ সরকারের কিছু সাংসদের সঙ্গে আমার আলাপের সুযোগ হয়েছিল। নীতিনির্ধারণী কাজগুলোর পদ্ধতির কথা আলাপকালে যা জানতে পারলাম, সরকারি নীতি হতে পারে দু রকম—একটি আপত্কালীন দ্রুত নীতি গ্রহণ, অন্যটি প্রমাণ বা গবেষণাভিত্তিক নীতি গ্রহণ।

আকস্মিক প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অপ্রত্যাশিত যুদ্ধ মুহূর্তে দ্রুত সিদ্ধান্ত বা নীতি গ্রহণ করতে হয়। সে সময় গবেষণার জন্য সময়ক্ষেপণ করাটাই একটা ভুল সিদ্ধান্ত। অন্য সব সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে গবেষণা বা তথ্যপ্রমাণের ওপর নির্ভর করাটা নীতি বা সিদ্ধান্তের সফলতার সম্ভাবনাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। আর এটা তো সবাই জানেন, যেকোনো নীতি বা সিদ্ধান্তের সফলতা সরকারের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধিতে যেমন সহযোগিতা করে, তেমন দেশের জনগণও সেটার সুফল ভোগ করে।

নিজেরা সাংসদ হওয়ার পরেও ব্রিটিশ সাংসদের অভিমত, কোনো একক পক্ষের দায়িত্বে সফলভাবে দেশ পরিচালনা সম্ভব নয়। দেশ পরিচালনায় কয়েকটি বিশেষ পক্ষের সুসমন্বয় প্রয়োজন। পক্ষগুলো হলো রাজনীতিবিদ, প্রশাসন, বিচারক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও সাংবাদিক। রাজনীতিবিদেরা সরাসরি নীতি গ্রহণের সঙ্গে জড়িত থাকবেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাঁদের গবেষণার মাধ্যমে সঠিক নীতি নির্ধারণে সহযোগিতা করবেন। গবেষণার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে গ্রহণকৃত নীতি বা সিদ্ধান্তের ফলাফলও বিশ্লেষণ করবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।

প্রশাসন মাঠপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখবেন আর বিচারকেরা সুশাসন ও আইনের সম–অধিকার বাস্তবায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করবেন। আর এসব পক্ষের কাজ ও সমাজের অন্যান্য ঘটনাপ্রবাহের ওপর পর্যবেক্ষকের চোখ রাখবেন সাংবাদিকেরা। সব কটি পক্ষের সমন্বিত কাজের সফলতার জন্য যে বিষয়টি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো পারস্পরিক স্বাধীনতা। অর্থাৎ এক পক্ষ আরেক পক্ষকে রাষ্ট্রীয় কাঠামোর বাইরে গিয়ে ক্ষমতার দাপটে নিয়ন্ত্রণ করবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি অনুষদের অধ্যাপক আ ব ম ফারুক ও তাঁর সহগবেষকেরা সম্প্রতি পরীক্ষা করে দেখেছেন, বাংলাদেশের বাজারের জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের দুধে অ্যান্টিবায়োটিক আছে। তিনি জনস্বার্থে তাঁর গবেষণাপ্রাপ্ত ফল সাংবাদিকদের ডেকে প্রকাশ করে দিয়েছেন। উদ্দেশ্য সাধারণ জনগণকে দুধ নিয়ে সচেতন করা।

কিছুদিন আগে টাইমস হায়ার এডুকেশন র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান না পাওয়া নিয়ে দেশে ঝড় বয়ে গিয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার মান নিয়ে। এ রকম পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো কোনো গবেষণার ফল প্রকাশ প্রশংসনীয়, যা শিক্ষা ও গবেষণা নিয়ে পিছিয়ে থাকার দুর্নাম রোধে সহায়ক।

এমতাবস্থায় নীতিনির্ধারণী পক্ষসমূহের হাতে দুটি বিকল্প ছিল। এক. গবেষকদের ধন্যবাদ জানিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দুই. যদি সংশ্লিষ্ট গবেষণা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকে, তাহলে অধিকতর গবেষণার জন্য বিকল্প গবেষক নিয়োগ ও গবেষণাকালে ওই সব প্রতিষ্ঠানের দুধ খাওয়ার ব্যাপারে জনগণকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া।

নীতিনির্ধারণী পক্ষসমূহকে এটা বুঝতে হবে, দুধে অ্যান্টিবায়োটিক থাকার জন্য কখনোই তারা নিজেরা দায়ী নয়। এমনকি এই গবেষণা এটাও প্রমাণ করে না যে অ্যান্টিবায়োটিক থাকার জন্য দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাতকারী কোম্পানিগুলোই দায়ী। এমনও তো হতে পারে, গোখাদ্যেই অ্যান্টিবায়োটিক ছিল।

অ্যান্টিবায়োটিকের উৎস যা–ই হোক না কেন, গবেষণার এ ফলাফল থেকে অন্তত কোনো পক্ষকেই সরাসরি দায়ী করা যায় না। উৎস বের করার জন্য আরও গবেষণার প্রয়োজন। এ দুটি পদক্ষেপের যেকোনো একটি গ্রহণ করলে সাধারণ জনগণের কাছে একটা ইতিবাচক বার্তা যেত। কিন্তু নীতিনির্ধারণী পক্ষ কোনোটিই না করে সরাসরি আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের হুমকি দিল। পক্ষসমূহ পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবর্তে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ল। নীতিনির্ধারণী পক্ষের গায়েও কাদা মাখল। অথচ দুধে অ্যান্টিবায়োটিক কিন্তু তারা মেশায় না। এই হুমকি দেওয়া ক্ষমতাভিত্তিক সমাজব্যবস্থার ফসল।

বাংলাদেশে গবেষণার ফল অস্বীকার করা নতুন কিছু নয়। গবেষণার ফল স্বীকার করা না–করা নির্ভর করছে প্রাপ্ত ফলাফলের ওপর। বিশ্বব্যাংক তথ্য–উপাত্ত বিশ্লেষণ করে যখন বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ঘোষণা দেয়, তখন আমরা তা সানন্দে গ্রহণ ও প্রচার করি। অন্যদিকে নেতিবাচক কিছু পাওয়া গেলে সেটাকে আমরা গবেষণার ত্রুটি বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। সে জন্য সমস্যাগুলোর সমাধানও হয় না। সমস্যা থাকে যুগের পর যুগ।

সমস্যা সমাধানের প্রথম পদক্ষেপই হচ্ছে গবেষণার মাধ্যমে সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করা। আমাদের নীতিনির্ধারণী মহল সমস্যাকে অস্বীকার করা বা চেপে যাওয়ার চেষ্টা করে জনপ্রিয়তা হারানোর আশঙ্কা থেকে। আর এই আশঙ্কা সৃষ্টির অন্যতম কারণ যেকোনো ঘটনা ঘটার জন্য সরাসরি সরকারকে দায়ী করা। এ ক্ষেত্রে যে চর্চাটা বাংলাদেশে প্রচলিত, ‘যেমন প্রজা তেমন রাজা’। সব ঘটনার জন্য প্রজা যখন রাজাকেই দায়ী করে, রাজা তখন ঘটনা ঘটেছে বলেই স্বীকার করতে চায় না। অথচ সরকার সব ঘটনা ঘটার জন্য দায়ী নয়। সরকারের দায় ঘটনা ঘটার পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

কেবল পদক্ষেপ গ্রহণ না করলেই সরকারকে দায়ী করা যায় বা সমালোচনা করা যায়। কিন্তু যেহেতু ঘটনার পরপরই ঢালাওভাবে সরকারকে দায়ী করা শুরু হয়, সরকারও সেই ঘটনা ঘটেনি বলে বা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে বেশি উদ্যোগী হয়। অথচ দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা ধীরে ধীরে কমে যেত। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায় অপরাধী চক্র। ব্যর্থ হয় জনগণ, ব্যর্থ হয় সমাজ ও রাষ্ট্র। তাই জনগণের বিচক্ষণ আচরণও জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গঠনের অন্যতম ভিত্তি।

পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ওপর যুক্তরাজ্যে অধ্যয়ন ও ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের অনুদানে প্রজেক্টে কাজ করার সুবাদে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়েছিল গবেষণা কীভাবে নীতিনির্ধারণে সহযোগিতা করে। উন্নত বিশ্বে অধিকাংশ নীতিই নির্ধারিত হয় গবেষণায় প্রাপ্ত ফলের ওপর ভিত্তি করে। যেকোনো নীতি গ্রহণ বা উন্নয়ন প্রকল্প শুরুর আগে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে গবেষণার দায়িত্ব দেওয়া হয়। যেমন নতুন কোনো রাস্তা নির্মাণের আগে গবেষণার মাধ্যমে স্থানীয় বাসিন্দাদের পছন্দ-অপছন্দ ও তাদের আর্থসামাজিক অবস্থার ওপর প্রভাব এবং আশপাশের জীববৈচিত্র্যের ওপর প্রভাব বিশ্লেষণ করা হয়।

যুক্তরাজ্যের মেডিকেল সার্ভিসের একটি যুগান্তকারী সামাজিক অর্জন হিসেবে গণ্য করা হয় ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসকে। সম্প্রতি এই ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস নিয়ে এক গবেষণায় দেখা যায়, ৪০ শতাংশ কর্মী কর্মক্ষেত্রের কাজ নিয়ে মানসিক চাপে ভোগেন। এই গবেষণালব্ধ প্রাপ্ত ফলাফলকে ভিত্তি করেই প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারিত হবে।

বাংলাদেশে চিকিৎসকেরা উপজেলা পর্যায়ে বসবাস করতে চান না। প্রভাবশালী ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় হুমকি দিয়েও অবস্থার উন্নতি করতে পারেননি। কিন্তু কেউ খুঁজে দেখার চেষ্টা করেননি, কেন ডাক্তাররা সেখানে না থেকে বসবাসের অযোগ্য ঢাকা শহরেই থাকতে চান। গবেষণা করলে হয়তো বের হয়ে আসবে উপজেলা পর্যায়ে সন্তানের জন্য ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অভাব, প্রাইভেট প্র্যাকটিসের সীমিত সুযোগ বা ভিন্ন কিছু। কিন্তু সেটার জন্য গবেষণা প্রয়োজন।

কিছুদিন আগে রাজউকের চেয়ারম্যান বললেন, ঢাকা শহরের কিছু এলাকা থেকে সব স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় সরিয়ে নেওয়া হবে। এটা কি আদৌ সম্ভব? বলার আগে কি তিনি কোনো গবেষণা করে দেখেছেন এটা সম্ভব কি না? এভাবে গ্রহণকৃত নীতি সাধারণত টেকসই হয় না। এর জন্য দরকার বিস্তারিত গবেষণা। তেমনি গবেষণা প্রয়োজন ঢাকা শহরে রিকশা সম্পূর্ণরূপে বন্ধের আগে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষা বন্ধ বা চালুর আগে, যানজট নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণের আগে এবং শিক্ষার মান যাচাইয়ের জন্য, জঙ্গিবাদে জড়ানো, ধর্ষণ, অসহিষ্ণুতা বৃদ্ধির কারণ জানার জন্য। সর্বোপরি শুধু আপত্কালীন নীতি ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রেই গবেষণার মাধ্যমে গ্রহণকৃত নীতিই অধিক ফলপ্রসূ হতে পারে।

বাংলাদেশে গত নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে আসনগুলোতে প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাই করা হয়েছিল সার্ভে নামক গবেষণা পদ্ধতির মাধ্যমে। সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্যাগুলো চিহ্নিত করার জন্যও শিক্ষা মন্ত্রণালয় গবেষণা পদ্ধতির ‘ফোকাস গ্রুপ ডিসকাশন’ ধারণার প্রয়োগ করেছে। আশা করি, সংশ্লিষ্ট পক্ষসমূহ রাষ্ট্রের উন্নয়নে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের পাণ্ডিত্যকে কাজে লাগিয়ে গবেষণাবিষয়ক সঠিক নীতি গ্রহণে উদ্যোগী হবেন। ক্ষমতাভিত্তিক নীতি ও জনপ্রিয়তাভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ছেড়ে যত দ্রুত গবেষণাভিত্তিক নীতি ও জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থার দিকে যাব, তত দ্রুতই আমাদের উন্নয়নটা টেকসই হবে, দেশটা বিজয়ী হবে।
–––

সবুজ ভৌমিক: কমনওয়েলথ বৃত্তিপ্রাপ্ত হয়ে যুক্তরাজ্যের ক্রেনফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ ব্যবস্থাপনার ওপর মাস্টার্সে অধ্যয়নরত এবং সহকারী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্য পদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।