রূপকথার দিনরাত্রি-এক

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আজকে রূপকথার সাপ্তাহিক ছুটি। রূপকথা ডাক্তার হিসেবে কাজ করে আমেরিকার একটা হাসপাতালে। অনেক কষ্টে পাওয়া তাঁর এ অর্জন। সুখ কিন্তু সোনার হরিণ হয়ে রয়ে গেল ওর কাছে।

শৈশব-কৈশোরে বহুমুখী প্রতিভার কারণে দারুণ একটা জীবন ছিল ওর। আজকে খেলা তো কালকে গল্প বলা বা লেখা পরশু গান। কিন্তু ডাক্তারির প্রতি ভালোবাসা সবকিছুর ওপরে চলে এল। রূপকথা চলে গেল ভিন্ন শহরে আত্মীয়পরিজন ছেড়ে। খুব সহজ হলো না ট্রানজিশনটা। কিছু আজেবাজে ছেলে পিছে পড়ে গেল।

রূপকথার বাবা-মা পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝলেন না। ক্যাম্পাসে থাকার আকুলতায় রবিনকে বিয়ে করল সে। ২০ বছর বয়সের ক্যালকুলেশনে ছয়-সাত বছরের বড় রবিনকে সৎ ও ভদ্র ডাক্তার হিসেবে মন্দ লাগেনি তাঁর। রবিন বলল, চল বিয়ে নিজেরা করে ফেলি। বাবা-মার ওপর চাপ দেওয়া চলবে না। রূপকথা তখন ডেসপারেট। যেকোনো দিন কোনো ক্যাডার তাকে তুলে নিয়ে যেতে পারে। দেশে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন শেষ হয়ে যায় বুঝি।

কোর্টে বিয়ের পর কিছু হুমকি ছাড়া পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হলো। রূপকথা বুঝে গেল ডাক্তার সে হতে পারবে। এর মাঝে রবিন ওর বাবার বাসাতে নিয়ে যাবে বলল। রূপকথা গেল। যেতে যেতে শুনে নিল, টিনশেডেও থাকতে হতে পারে তাকে। চিরকাল শহরবাসী রূপকথার মনটা খারাপ হলেও মেনে নিল। মনে মনে বলল, ভালোবাসার জন্য সবকিছু করতে পারে সে।

রবিনদের বাসায় ঢুকে দেখল বিশাল বাড়ি। চার-পাঁচজন কাজের লোক। হিসাব মিলাতে খুব কষ্ট হলো। রবিনের বড় ভাই তার কয়েক দিন আগেই গ্রাম থেকে স্বল্পশিক্ষিত বউ ঘরে তুলেছেন। প্রথম তিন দিনেই রূপকথা জেনে গেল শ্বশুর-শাশুড়ি আর রবিনের বড় বোনের (ননাস) কথা। বড় বোন বহু বছর ধরে আমেরিকায় আছেন। তেমন পড়াশোনা করেননি। শুধু স্বামীর টাকায় চলেন। তাঁদের অবস্থা ভালো না। রবিনকে তাঁদের দায়িত্ব নিতে হবে আর রূপকথার পড়াশোনার দায়িত্ব অবশ্যই তাঁর বাবা-মার।

একটা সুতাও রূপকথাকে দেওয়া হলো না। এর মাঝে সকাল সাতটায় উঠে শ্বশুরকে চা দিতে হবে। গ্যাস থাকা সত্ত্বেও মাটির চুলায় বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াতে হবে। কাপড়ে সাবান দিয়ে বা নিজের কাপড় নিজেকে ধুয়ে নিতে হবে। এসব চলতেই থাকল। রবিনের বড় ভাই তাঁদের ব্যবসা দেখে। বড় ভাইয়ের সবকিছুই বাবা দেন। এমনকি শ্বশুরবাড়িতে বড় ছেলে যাবে, তার জন্য টাকা নিয়ে তাঁকে দৌড় দিতে দেখেছে রূপকথা।

রবিনদের বাসা শহর থেকে দূরে। রবিন শহরে গেলে বাসার একগাদা কাজ নিয়ে যেত। রূপকথা শুধু ওর সঙ্গে বসে থাকতে চাইলেও শাশুড়ির আপত্তি। রূপকথার যাবতীয় খরচ যা পারত রবিন নিজের জমানো টাকা থেকে করত। রূপকথা একটু বাইরে খেতে চাইলেও রবিন বাইরে নিত না। বাসার জন্য গাদাগাদা ফল–মিষ্টি নিয়ে আসতে হতো রবিনকে। কারণ, তাদের বাসায় নিজেদের লোকের চেয়ে কাজের লোকের সংখ্যা বেশি। রূপকথা নিজের পাওয়া স্কলারশিপের টাকা দিয়ে রবিনদের বাসার সবাইকে অনেক গিফট কিনে দিল।

এর মাঝে রবিনের বড় বোন তাঁদের রুমে ঢুকে ক্যাসেট প্লেয়ারের ওপর ধুলা কেন এবং রূপকথা কেন তা পরিষ্কার করছে না বলে বিকট চিৎকার করে গেলেন। রূপকথা ওর জীবনে এ রকম ঘটনা দেখেনি। রবিন ওর বোনকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করল এ রকম আর হবে না। চার-পাঁচ দিন বোন কথা বন্ধ করে দিলেন জিদ করে। তা ছাড়া প্রথম থেকেই পিঠ ব্যথার নাম করে রূপকথাদের ঘরের ম্যাট্রেস নিয়ে যেতেন।

রূপকথা জীবনে প্রথম মাটিতে শুয়ে কাটাল দেড় মাস। মেডিকেল কলেজে মেয়েদের হোস্টেলে ওর বিছানা আর ম্যাট্রেস আছে। রবিনের বড় বোনকে আমেরিকা থেকে নিয়ে আসা হয়েছে। যেহেতু তিনি তাঁর স্বামীর সঙ্গে ঝগড়া করে চলে আসতে চেয়েছেন।

একদিন রবিন ঠিক করল, ওরা কক্সবাজার যাবে। রবিনের বোন বলল, তাঁর জন্য অবশ্যই যেন মুক্তার মালা আনা হয়। চিরদিন চট্টগ্রামে বড় হওয়া এবং বহুবার কক্সবাজার যাওয়া বোনের এখন কেন মালা লাগবে বুঝল না রূপকথা। রবিন নেমেই বোনের জন্য তিনটা মালা কিনল। আর রূপকথাকে সাধল একটা মালা। ওরা থাকল একটা হোটেলে আর খেল সস্তা রেস্টুরেন্টে। কারণ পয়সা বাঁচাতে হবে। হোস্টেল খরচ হাতে থাকাতে বেঁচে গেল রূপকথা।

কয়েক দিন পর রবিনের বড় বোনকে আবার আমেরিকা পাঠানো হলো তাঁর ইচ্ছায়।

রূপকথার জমানো যত টাকা ছিল সব সে রবিনের কাছেই তুলে দিয়েছিল। এর মাঝে রবিনের স্কলারশিপ হয়ে গেল ইউরোপে। দেড় মাসের একসঙ্গে জীবনের ইতি ঘটবে সহসাই। যাওয়ার আগে রবিন তাঁর বাবা-মাকে জানাল। তাঁর বাবার তখন সদ্য ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে। রিটায়ারমেন্টের আগে পাওনা ছুটি নিয়ে বিশ্রামে আছেন। মা চাকরি করে সংসারটা চালিয়ে নিচ্ছেন। তাঁরা খুব রাগ করলেন। কিন্তু মেনে নিলেন। রবিন চলে গেল।

রবিন চলে যাওয়ার পর রূপকথা হোস্টেল থেকে একদিন বাবাকে ফোন করে বলল, বাবা আমাকে টাকা পাঠিও কিন্তু। পরে রূপকথা শুনেছে, বাবা চোখে পানি নিয়ে মাকে বলেছেন, আমার এই মেয়েকে আমি কোথায় না বিয়ে দিতে পারতাম।

তিন মাস পরে রবিন জানাল ওর ফুলটাইম স্কলারশিপ হয়ে গেছে। এর মাঝে রবিনদের বাড়ি থেকে প্রতি সপ্তাহে কয়েকজন করে রোগী আসত। রূপকথাকে সব সময় তাদের নিয়ে যেতে হকো। কোনো দিন একটা গাছের ফল ওর কাছে কেউ নিয়ে আসেননি। লোক মুখে শুনেছে রবিনদের পেয়ারাবাগান আছে। মাঝে মাঝে রূপকথা ঢাকায় বাবা–মার কাছে যেত আগের মতো কাপড়চোপড় আনতে বা রান্না খাবার আনতে। রবিনের প্রতিটা চিঠিতে অনুযোগ থাকত, কেন ছুটিতে তাদের বাড়িতে গিয়ে তাঁর বাবা-মাকে দেখে আসেনি। স্কলারশিপের টাকা থেকে বাঁচিয়ে ওর বাবা-মাকে পাঠানো শুরু করল রবিন। জানতে পেরে রূপকথা রবিনের কাছে ওর হোস্টেল খরচ চেয়েছিল। রবিন জানিয়ে দিল, এত লোভী মানুষ সে দেখেনি।

সাত-আট মাস পর রবিন এল দেশে। রূপকথার বাবা-মা একটা অনুষ্ঠান করতে চান। রবিনের বাবা-মা সাফ জানিয়ে দিলেন, তাঁরা কিছু দেবেন না বা করতে পারবেন না। রবিন অবশ্যই যেন কিছু না করে এ জন্য।

ঢাকায় রূপকথার বাবা–মার অনুষ্ঠানে রবিন ওর মা-বাবা ও বোনকে নিজে নিয়ে এল। প্রতিটা মুহূর্ত তাঁরা কাটালেন খাবার আর থাকার জায়গার কঠিন সমালোচনা করে। এই প্রথম রূপকথার মনে হলো, এ সংসার তাঁর আর হবে না। কিন্তু ক্যাম্পাসের কুৎসিত রূপ সে দেখেছে। একটা সাইনবোর্ড ছাড়া নিজের পায়ে দাঁড়ানো হবে না। ওর খুব বেঁচে থাকার শখ। ২১ বছর বয়সে কাঁদতে কাঁদতে রূপকথা সিদ্ধান্ত নিল চেষ্টা করে যাবে বেঁচে থাকতে।

এর মধ্যে রবিন তাঁর বড় বোনকে আমেরিকায় দেখে এসেছে। তাঁকে টাকা দিয়ে এসেছে। সিঙ্গাপুর থেকে শপিং করেছে বাবা–মার জন্য। এ ছাড়া জার্মানির শপিং তো আছেই। রূপকথা একটা ঘড়ি পেয়েছে।

এসব দেখে রূপকথার বাবা-মার কাছ থেকে পড়ার খরচ নিতে কষ্ট হয়।

রবিন দেশে থাকাকালে ওর বড় ভাইয়ের বউকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে ঘোরা শুরু করল ইনফার্টিলির চিকিৎসা করতে।

রূপকথা বলল, কেন তোমার ভাই সঙ্গে থাকছে না? কেন তোমার তাকে শাড়ি কিনে দিতে হবে? কুৎসিত মন এই প্রথম সব জেনে গেল। ক্লাসের জন্য খুব কম সময়ের জন্য রবিনের সঙ্গে থাকা হলো রূপকথার। রবিনদের বাসায় গেলেই শুনতে হতো কেন রবিন এল দেশে। এই টাকাটা পাঠিয়ে দিলে বরং ওদের সংসারের কাজে লাগত। পাঁচ-ছয়জন কাজের লোকের কিন্তু কোনো হেরফের নেই। কিন্তু ওই বাসায় থাকতে গেলে রূপকথাকে দুই বেলা সবজি খেতে হতো। কারণ, তাঁদের রবিন আরও বেশি টাকা দিচ্ছে না।

এর মধ্যেও রূপকথার পড়াশোনা চলল নিজের গতিতে। ফোর্থ ইয়ারে ওঠার পর একটা উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটল। পুরো খরচ দিয়ে রবিন ওর ছোট বোনের বিয়ে দিল আর দেশ থেকে পার্লের মালা নিয়ে বিক্রি করে রূপকথাকে জার্মানি নিয়ে গেল তার মাস কয়েক পর। দেড় মাসের জন্য বেড়াতে। বন্ধু পরিবারের সঙ্গে শেয়ার করে থাকাতে এক্সট্রা কোনো খরচ হলো না। রূপকথার বোনের দেওয়া ৫০০ ডলার রেখে দিল রবিন।

রূপকথা চলে আসার পরপর রবিন ওর বাবাকে নিয়ে গেল জার্মানিতে। তার আগে রবিনের কাছে কিছু ফ্যাক্স এসেছে টাকা চেয়ে আর বাবা-মার আগে জার্মানিতে বউ কীভাবে যায় সে ব্যাপারেও অনেক বাজে কথা দিয়ে। জার্মানি থাকাকালে রবিন ওই ফ্যাক্স দেখিয়ে রূপকথাকে জানাল, দেখেছ কতটা ত্যাগ করে সংসার করতে হয় আমাকে তোমার জন্য।

দেশে আসার পর পর শুরু হয়ে গেল রবিনের বাবাকে নিয়ে রূপকথার ডাক্তারের কাছে দৌড়াদৌড়ি। আজকে ওর দুলাভাইয়ের বন্ধু বিখ্যাত মেডিসিনের ডাক্তার দেখায় তো কালকে ওর মেডিকেলের সার্জারির ডাক্তার দেখায়। রবিন টাকা পাঠাল প্রাইভেট হাসপাতালে প্রোস্টেট সার্জারির জন্য। রবিনের পাঠানো টাকা তাঁরা অন্য কাজে খরচ করে ফেলায় মেডিকেল কলেজে ফ্রি চিকিৎসা করাতে গিয়ে বাজে গালি শুনল রূপকথা। কারণ, তাঁর প্রাইভেট হাসপাতালে সার্জারির কথা ছিল।

একদিন রূপকথা রবিনকে বলল, ওর খুব খারাপ লাগে বাবার টাকায় চলতে। রবিনকে অনুরোধ করল, হোস্টেল খরচ ২০০০ টাকা দিতে। রবিন ফিফথ ইয়ারে এসে রাজি হলো। রবিন টাকাটা তাঁর বাবার কাছে পাঠাবে। আর তাঁরা শহরে এলে রূপকথাকে দিয়ে যাবেন। রবিনকে ফোন করতেই সেই টাকার অর্ধেক খরচ যেত। এদিকে বড় ভাইয়ের বাচ্চা হওয়ার সময় মেডিকেলে কেন কেবিন পাওয়া যায়নি বলে রবিনের বাবা চিৎকার করলেন। ভাইয়ের বাচ্চা নিয়ে বাসায় পৌঁছে দিলও রবিন।

এর মাঝে ঢাকা গিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা করিয়ে টাকা বাকি রেখে (রূপকথার দুলাভাই ওই হাসপাতালের কনসালট্যান্ট) চলে এলেন রবিনের বাবা। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে কুৎসিত কথা শুনল সে। রবিন দেশে এসে তাঁর বাড়ি থেকে বের করে দিল রূপকথাকে। অনেক দিন হোস্টেলে থাকল। এর মাঝে ডাক্তার হয়ে গেল সে।

ঘটনা সবই জানল আশপাশের সবাই। অনেকেই রবিনকে ডিভোর্স দিয়ে দিতে বলল। অনেকেই ভালোবাসার হাত বাড়াল। মেডিকেলের অন্যতম সেরা সুন্দরীর এত কষ্ট কেউ মেনে নিতে চাইল না। কিন্তু এত বছরের মায়ার বাঁধন ছিঁড়তে পারল না রূপকথা। দেখল রবিনদের বিশাল বাগানের অর্ধেক পাকা করা হয়েছে। শুনতে হলো রবিনের দানবীর বাবা স্কুল করেছেন। যে স্কুলে রবিনের বড় ভাইয়ের বউ চাকরি করেন। একদিন সরকারি হয়ে গেল সেটা। তাদের বাজারে বেশ কয়েকটা দোকান আছে। যেগুলোর আয় রবিনের বাবার করা মসজিদে ব্যয় হয়। রূপকথাকে মসজিদ উন্নয়নে ফান্ড রাইজিং করতে বলা হলো। (চলবে)