হেনা খালার হজ

.
.

ঘুমের চুমু সবে আলতো করে চোখের পাতা ছুঁয়েছে। রাত কত হবে? সাড়ে বারোটা কী বড় জোর একটা। টেলিফোনের ক্রিং ক্রিং। হুড়মুড় করে উঠে রাফা রিসিভার তুলল। ওপারে আমেরিকা থেকে বোন। ওখানে এখন দিনের শুরু মাত্র।

: হ্যালো রাফায়েল, শোন ঘটনা একটা ঘটেছে।

গুরুত্বপূর্ণ খবর দিতে হলে বোন তার পুরো নাম ধরে কথা শুরু করে। শঙ্কিত গলায় সে জানতে চাইল, কী হয়েছে আপু খুলে বল?

: এইমাত্র হেনা খালা ফোন করে জানালেন উনি হজে যাচ্ছেন না।

: বলো কী! ওনার তো হজ ফ্লাইট ধরার জন্য এখন এয়ারপোর্টে থাকার কথা।

: কথা তো সেটাই।

: এত টাকাপয়সা খরচ করে...।

ডাক্তার বোনের ও তার এমবিএ ডিগ্রিধারী স্বামীর ম্যাকডোনাল্ড, কেএফসি ব্যবসায় বিস্তর বিত্ত। পয়সা ওদের কাছে কোনো ব্যাপারই না।

: পয়সার কথা বাদ দে। তুই যে বন্ধুবান্ধবকে কত ফোন করে ব্যতিব্যস্ত করলি, হেনা খালার দশ বছরের পুরোনো ছবি ই–মেইল করলি, যাতে দরকার হলে তারা খালার দেখভাল করতে পারে। এখন তাদের কী বলবি?

রাফায়েল সঙ্গে সঙ্গে মনে মনে ঠিক করে নিল তার কর্তব্য। সে বলল, আমার বন্ধুরা কী বলেছে জানিস, ‘তোরা তোদের খালার হজের জন্য রাজকীয় এনতেজাম করেছিস আর কারও কিছু করা লাগবে না। আমরা দূর থেকেই তাকে দেখব।’ এখন বল কেন উনি হজে যাবেন না?

: এই মুহূর্তে ওনার মনে হচ্ছে ধর্মকর্মের চেয়ে মানুষের প্রতি কর্তব্য বড়।

: কিন্তু হজের নিয়ত করে না গেলে অমঙ্গল...।

: নিয়ত করার কথা আমিও নরম গলায় বলেছিলাম। উনি তেজি ভাষণ দিলেন।

: কী রকম? কী রকম?

: শোন বললেন, যে নিয়ত করেও হজ পালন করিনি এই বোঝাপড়া হবে আমার আল্লাহর সঙ্গে। তোদের জবাবদিহি করব না।

রাফায়েলের বোন ফারিয়েল হেনা খালার হজের ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব একরকম জোর করেই নিজ কাঁধে নিয়েছিল। কম বয়সে বিধবা নিঃসন্তান হেনা খালা ঐশ্বর্যশালী নারী। কিছুদিন হলো শিক্ষাবিদের সম্মানজনক পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। রাজধানীর নামীদামি আবাসিক এলাকায় ছয়তলা বাড়ির বিরাট বিরাট বারোটি অ্যাপার্টমেন্টের মালিক। আপনজন বলতে রাফায়েল আর ফারিয়েল। হজে যাবেন ঠিক করার প্রথম আয়োজন ছিল ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ ছাড়া বাকি সব সম্পদ ওদের দুই ভাইবোনের নামে দানপত্র করা। করেছেনও তা।

হজ করার মতো অর্থবিত্ত তাঁর আছে। তবে বাবা-মা নাই, তাই খালার হজের খরচ বহন করতে পেরে কৃতার্থ হয়েছিল ফারিয়েল।

রাফায়েলকে তেমন কিছু করতে হয়নি। সে তার সৌদি আরবে কর্মরত রইসকুতুব বন্ধুদের হেনা খালার হজের খবর খুব গৌরবের সঙ্গে দিয়েছিল। বলেছিল, আমার হেনা খালা লম্বা নন তেমন, গায়ের রং ফরসা, মুখের গড়ন লম্বাটে, নাক থেবড়া নয় তবে ভারী কিছুটা আর চুল কাঁধ পর্যন্ত সমান করে ছাটা।

এক বন্ধু বলল, চুল জানার দরকার নেই।

: কেন দূর থেকেই ওই চুল দেখলে বুঝবি হেনা খালা আসছেন বা যাচ্ছেন।

: আরে উনি তো তখন থাকবেন জুলবাব আর হিজাবে ঢাকা।

রাফায়েল দেখল সৌদি আরবের পেট্রো ডলারের মালিক হোমরাচোমরা বন্ধুরা শব্দও ব্যবহার করে অদ্ভুত আলিশান। যার কিছু সে বোঝে, কিছু বোঝার ভান করে।

: ওহো তাই তো; তবে চশমার ফ্রেম কালো ও চার কোনা।

: অতশত বর্ণনা বাদ দিয়ে একটা ছবি ই–মেইল করে দিস।

: কথাটা ঠিক বলেছিস, তাই করব। আচ্ছা সাফামারওয়া পাহাড়ে দৌড়াদৌড়ি, কাবা শরিফ সাত চক্কর দেওয়া যদি খালার জন্য খুব কষ্টকর হয় কী হবে তখন?

: শোন ওই রকম অপারগ কেউ হলে তাকে আগের কালে কুর্সিতে বসিয়ে কাফ্রি চারজন লোক কুর্সি কাঁধে নিয়ে ওই চক্করগুলো করাত।

: কাফ্রি কী?

: আফ্রিকান তারা, শক্তিশালী জবরদস্ত হয় এরা। এদের পারিশ্রমিক দিতে হতো, এখন হুইলচেয়ারেই করা যায়।

: আমি খালার জন্য ওই ব্যবস্থাটাও করে রাখি কি বলিস তোরা?

: তুই ভাবিস না এ নিয়ে, প্রয়োজনে ব্যবস্থা করা যাবে; তা ছাড়া হজের মৌসুমে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে আমাদের আত্মীয়স্বজনেরাও আসেন তো। আমরা তো ওই কদিন এখানেই সময় কাটাই।

আন্তরিকভাবে আগ্রহী তিন বন্ধুকে খালার ছবিও ই–মেইল করে পাঠিয়েছিল। যদিও ছবিটা সাত কী আট বছর আগে তোলা। রাফায়েল কখনোই বন্ধুবান্ধবের কাছে অনুরোধ–উপরোধ করেনি। এবার এই সামান্য অনুরোধে বন্ধুরা সাড়া দিয়েছে দারুণভাবে। রাফায়েল সগৌরবে জানিয়েছে তার একমাত্র খালা যার নাম হেনা, উনি এবার হজে যাচ্ছেন। এক ডাক্তার বন্ধু ওই সময়ে খোদ মক্কা মনোয়ারায় হাজিদের প্রয়োজনে খেদমত করায় নিয়োজিত কোনো এক মেডিকেল টিমের নেতৃত্ব থাকবে। সে ফোন করে রাফায়েলকে জানিয়েছে হেনা খালার কোনো সমস্যা হবে না, হওয়ার কথা নয়। এখন দেখা গেল হেনা খালা নিজেই সমস্যা সৃষ্টি করেছেন।

আমেরিকায় যখন রাত নামছে অস্ট্রেলিয়ায় দিন। তখন রাফায়েল ধীরেসুস্থে বোনকে ফোন করল হেনা খালার শেষ মুহূর্তে হজ বাতিলের বৃত্তান্ত জানতে। যা জানল তা নিয়ে বেশ কিছুটা সময় ভাবল। ভাবনার শেষে এই সিদ্ধান্ত পৌঁছাল যে, খালার বিচারের মালিক সে নয়। আল্লাহ একমাত্র জানেন কী ঠিক আর ঠিক নয়। তবে হেনা খালার হজযাত্রার খবর যত সাড়ম্বরে সৌদি বন্ধুদের জানিয়েছিল, এবার বিপরীত সিদ্ধান্ত নিল। হজ বাতিলের খবর কাউকেই জানাবে না বলে ঠিক করল।

ওদিকে এয়ারপোর্টে হজ ফ্লাইট ধরতে যাওয়ার কিছু সময় আগে হঠাৎ একটা ফোন। ফোন করেছেন হেনা খালার দীর্ঘদিনের এক কলিগ বা সহকর্মী বাসবী ধর। কান্নাভেজা গলা। অল্পক্ষণ আগে ডাক্তার তাঁকে জানিয়েছেন যে, তাঁর অসুখ ভয়ংকর। অপারেশন করানো জরুরি। যদি অপারেশন সফল হয় তাতেই বাঁচার সম্ভাবনা আছে। এটাই এখন একমাত্র উপায়। ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর যাওয়া তাঁর পক্ষে হয়তো অসম্ভব ব্যাপার নয়। কথা হলো আপনজন তাঁর কেউ নাই যে, কাছে থেকে ব্যবস্থা করবে। বিদেশি হসপিটালের সঙ্গে যোগাযোগ করা, অপারেশনের জন্য নিয়ে যাওয়া চাট্টিখানি ব্যাপার নয়। হেনা খালা জানতেন, তার ওই কলিগের একমাত্র মেয়ে অধরা বিদেশে থাকে। তবে এই প্রথম জেনে আশ্চর্য হলেন যে, সে বড় দুঃখিনী। অধরার একমাত্র সন্তানকে যখন অটিস্টিক বলে ডাক্তাররা চিহ্নিত করল তখন তার স্বামী স্ত্রী-সন্তানকে ফেলে রেখে একদিন নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। ওই মেয়েটির নিজের প্রায় অসুস্থ সন্তান নিয়ে একা একা প্রতিদিন বেঁচে থাকার সে এক নিদারুণ যুদ্ধ।

সমস্ত ঘটনা শুনে হেনা খালা হজে যাওয়া বাদ দিয়ে অসহায় অসুস্থ মানুষটির সেবা করা, চিকিৎসার বন্দোবস্ত করার জন্য থেকে গেলেন। রাফায়েল পর্দা সরিয়ে রাতের আকাশ দেখল। হজ বাতিলের খবর বন্ধুদের জানানো জরুরি নয় বলেই আবারও ভাবল। তা ছাড়া তার খালা আত্মনির্ভরশীল মানুষ। কোনোভাবেই তার বন্ধুদের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন খালার পড়ত না। কাফ্রি, কুর্সি, হুইলচেয়ার কোনো কিছুই লাগবে না তার হেনা খালার।

রাফায়েল স্বস্তি নিয়ে ঘুমাতে গেল। ভোর রাতে টেলিফোনের শব্দে ঘুম ভাঙল। ভয়ে ভয়ে ফোন ধরল। সৌদি আরব থেকে বন্ধুদের কেউ ফোন করলে এবার হেনা খালার হজ বাতিলের পাঁচালি গাইতে হবে। ভাবতেই মনটা বিরক্তিতে ভরে উঠল। না ফোনটা করেছেন হেনা খালা স্বয়ং। গলার স্বর তেমনি তেজি তবে একটু যেন ক্লান্ত।

: রাফা শোন আগামীকাল আমার ওই কলিগ বান্ধবীকে নিয়ে ব্যাংককে রওনা হচ্ছি। ওকে তোরা দেখেছিস।

: নামটা কী

: বাসবী।

: ওহো বাসবী মাসিমার কথা খুব মনে আছে। পুজোর সময় আমাদের নিজ হাতে বানানো তিলের নাড়ু, নারকেলের তক্তি খাওয়াতেন।

: হ্যাঁ রে সেই বাসবী; আচ্ছা শোন ফারিয়েলকে ফোনে পাচ্ছি না। তোকে বলছি তুই ওকে জানাবি।

: কী জানাব?

: তোদের দুজনের নামে দুটো অ্যাকাউন্ট খুলে ভাড়ার টাকা মানে তোদের অ্যাপার্টমেন্টসের ভাড়ার টাকা অ্যাকাউন্টে জমা দেওয়ার ব্যবস্থা করেছি।

: এখনই কেন খালা।

: ভাবছিস আমি মরলে করতে হবে? নারে দানপত্রের নিয়ম হলো সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করতে হয়। আর এটা আমার হজের নিয়তের অংশ। আমার ল ইয়ার তোদের জানাত। আজ আমি আছি বলে জানালাম। ফারিয়েলকে তুই জানিয়ে দিস তাহলে।

: হজে যাবে বলে এত ঝামেলা করলে?

: থাম তো। আরও শোন তোরা দুই ভাইবোন ছাড়া আমার তো কোনো ওয়ারিশান নাই। তাই তোদের জানা দরকার আরেকটা বিষয়।

: আর কী বিষয়?

: আমার ব্যাংক অ্যাকাউন্টের নমিনি করেছি একটা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী শিশু কল্যাণ সংঘকে। আশা করি আমি মারা গেলে এসব নিয়ে কোনো ঝামেলা করতে হবে না তোদের।

: শোনো খালা তোমার সঙ্গে যোগাযোগ কোথায় করব, মানে ব্যাংককে?

: জানাব আমি।

বলেই লাইন কেটে দিলেন খালা। রাফা আবার ঘুমিয়ে পড়ল। পরদিন বোন ফারিয়েল ফোন করল। তখন রাফায়েল জানাল খালার সম্পত্তি বিলিবণ্টনের খবর, সেই সূত্রে তাদের প্রাপ্তির বিষয়। সেসব তথ্য বোন শুনল কিনা বোঝা গেল না। সে রাফাকে খালার ব্যাংককের যাবতীয় খবর ও সেই সঙ্গে খালার হোটেলের ঠিকানা ও ফোন নম্বর সব জানাল। রাফায়েল কেন আঁতিপাঁতি খুঁজে খালার ব্যাংককের সব খবরাখবর জোগাড় করল না নিজেও জানে না। তবে ফারিয়েল নিজের নামের মান রেখেছে। যখনই কোনো কাজ সে করে শতভাগ মনপ্রাণ ঢেলে দেয় তাতে। খালার দেখভালের জন্যও তাই–ই করছে।

শেষে ফারিয়েল বলল, রাফা শোন তোর মনে আছে খালা আমাদের ছোটবেলা কবিতা পড়ে শোনাত?

: হু আছে তো, একটা লাইন এখনই মনে পড়ল।

: কোনটা? কোনটা বলত?

‘মানুষ বড় কাঁদছে, তুমি মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়াও’

: শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাই না?

: হ্যাঁ, তাই।

দুই ভাইবোন ফোনের দুই প্রান্ত পরস্পরের শ্বাসপ্রশ্বাস শুনল শুধু আর কোনো কথা হলো না।

হজ শেষ হলো। ঈদও শেষ হলো। তার পরপরই রাফায়েল সৌদি আরব থেকে এক বন্ধুর ফোন পেল।

: ঈদ মোবারক রাফায়েল!

: ঈদ মোবারক।

তারপর বন্ধু তরতরিয়ে একনাগাড়ে বলে গেল, সরি বন্ধু তোর হেনা খালাকে ধরতে পারলাম না। কী ভিড়! এই ভিড়ের মাঝে আমি তাঁকে একবার দেখেছি আরাফাতের ময়দানে দূর থেকে। ডাক্তার তানভীর দেখেছে ভোর রাতে সুবহে সাদেকের সময়। বোতলে আবে জমজমের পানি নিয়েছেন। নিরিবিলি ছিল। হিজাব খুলে জমজমের পানি হাতে নিয়ে মুখে ও তাঁর কাঁধ পর্যন্ত লম্বা চুলে মাখছেন। তানভীর কাছে যেতে না যেতেই পরির মতো মুহূর্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেলেন!

ফোন রেখে রাফায়েল বিস্ময়ে নীরব নিথর হয়ে বসে রইল।

বি. দ্রষ্টব্য: গল্পটি বিশ্বখ্যাত লেখক টলস্টয়ের একটি ছোটগল্পের পুনর্নির্মাণের বিনম্র প্রয়াস।