ঘুরে এলাম ক্যামেরন হাইল্যান্ডস

ক্যামেরন হাইল্যান্ডস
ক্যামেরন হাইল্যান্ডস

ঘুরে এলাম মালয়েশিয়ার পাহাড়ি পর্যটন এলাকা ক্যামেরন হাইল্যান্ডস। যেখানে অনেক উঁচু উঁচু পাহাড়ের সমারোহ। পাহাড়ের গায়ে গুহা আর গুহা। পাহাড়ের চূড়ায় মেঘেরা খেলে। ক্যামেরনের পাহাড়গুলো যেন মেঘেদের বাড়ি। মেঘেরা সেখানে ঘর-সংসার পেতেছে। এ জন্য সেখানে সব সময় মেঘ থাকেই। মেঘকন্যারা নিজেদের ঘরসংসার ফেলে যাবেই–বা কোথায়। ওরা (মেঘ) সেখানেই উড়ে বেড়ায়। কখনো বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ে। যতই বৃষ্টি হয়ে ঝরে পড়ুক, সেখানে মেঘবালিকাদের পুনর্জন্ম হয়ে যায়। সব সময়ই মেঘবালিকারা ঘুরে বেড়াবেই।

গুহার ওপরের দিকে শাকসবজির বাগান আর আঁকাবাঁকা সড়কের পাশ ঘেঁষে স্ট্রবেরি বাগান। স্ট্রবেরি বাগানগুলো সবার জন্য উন্মুক্ত। যেকোনো বাগান পরিদর্শন করা যায়। সব বাগানই অত্যন্ত চমৎকারভাবে সাজানো-গোছানো। দেখে মন জুড়িয়ে যায়। সব বাগানের সামনেই বিক্রয় প্রদর্শনী আছে। সেখানে তাজা স্ট্রবেরি, স্ট্রবেরি দিয়ে তৈরি চকলেটসহ নানা ধরনের খাবার বিক্রি হয়।

স্ট্রবেরি ফলটা আসলেই দেখতে খুব সুন্দর। মায়াবী রং ফলটির। হয়তো মেঘের ছায়ায়, মেঘের মায়ায়, মেঘে ঘেরা পাহাড়ে হয় বলে তার চেহারা এত সুন্দর!

ক্যামেরন হাইল্যান্ডস
ক্যামেরন হাইল্যান্ডস

ক্যামেরনে আছে মৌমাছি মিউজিয়াম। মৌমাছি মিউজিয়ামে পাওয়া যায় খাঁটি মধু। মৌমাছি মিউজিয়াম থেকে সামনে আরেকটু গাড়ি চালালেই দেখা যায় প্রজাপতির ফার্ম। এর আগে আছে গোলাপ বাগান—রোজভেলি। পাঁচ রিঙ্গিত প্রবেশ ফি দিয়ে বাগানে ঢুকলেই গোলাপ দেখে ফুলপ্রিয় যেকোনো মানুষের মন ভরে যাবে ফুলের সৌরভে। সেখানে আছে নানান রঙের নয়নাভিরাম গোলাপ ফুল।

কুয়ালালামপুরের চায়নাটাউনে কাঁচা ফুলের দোকানগুলোতে বহু বছর ধরে দেখে আসছি নানা রঙের গোলাপ ফুল। কেউ কেউ বলেন, এগুলো আসলে রং করা; গোলাপ এত রঙের হয় না। রোজভেলিতে ঢুকেই বুঝলাম চায়নাটাউনের সেই গোলাপগুলোর রং নকল নয়। আসলেই গোলাপ ফুল বহু রঙের হয়। রোজভেলিতে গোলাপ ছাড়াও আছে বিভিন্ন ফুল, ঝরনা, ময়ূরসহ নানান পাখি ও ছবি তোলার মতো ভিউ নিয়ে বৈঠকখানা।

প্রজাপতির ফার্ম ফেলে গেলেই মিলবে পাচার মালাম (রাতের বাজার, যেটা বিকেল থেকেই বসে)। পাচার মালামে স্ট্রবেরিসহ তাজা শাকসবজি ও স্থানীয় বিভিন্ন ফল বিক্রি হয়। সেখান থেকে উঁচু–নিচু পথ চলতে চলতে গাড়ি পৌঁছে গেল চা–বাগান ক্যামেরন টি ভেলিতে। অসাধারণ সুন্দর ক্যামেরন টি ভেলি। দুপাশে উঁচু পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় সাদা-কালো মেঘ ওড়ে। পাহাড়ের ঢালুতে ও গুহায় বিশাল চা–বাগান। বাগানের এক পাশে ওপরে আছে একটি রেস্টুরেন্ট, আরেক পাশে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে সড়ক। চা–বাগান ভিউ রেস্টুরেন্টটিতে বসে চা–বাগান, উঁচু পাহাড় ও মেঘ দেখে দেখে চা খেতে সত্যিই দারুণ উপভোগ্য। রেস্টুরেন্ট লাগোয়া আছে চা বিক্রয় কেন্দ্র। সেখান থেকে নানা প্রকার চা-পাতা, স্যুভেনির ও ক্যামেরন হাইল্যান্ডস লেখা টি-শার্ট কেনা যায়। এসব অবশ্যই সব স্পটেই পাওয়া যায়।

ক্যামেরন হাইল্যান্ডসে ঝরনা
ক্যামেরন হাইল্যান্ডসে ঝরনা

নিচে নামার পথে দেখা মেলে স্থানীয় আদিবাসীদের (ওরাং আসলি)। অর্ধেক নামার পর লাতান ইস্কান্দারে রয়েছে নয়নাভিরাম পাহাড়ি ঝরনা। ঝরনা এলাকায় রয়েছে আদিবাসীদের হাতে তৈরি জিনিসের কয়েকটি দোকান। পাশাপাশি খাবারের দোকানও রয়েছে।

পুরো ক্যামেরন হাইল্যান্ডসে বিভিন্ন জায়গায় সড়কের পাশে মার্কেট ও হোটেল। রয়েছে কুয়ালালামপুরের মতোই ১৫-২০ তলা অ্যাপার্টমেন্ট।

ক্যামেরন হাইল্যান্ডস পাহাং প্রদেশের একটি জেলা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২ হাজার ৬০০ থেকে ৫ হাজার ২৫৯ ফুট উঁচু ক্যামেরন হাইল্যান্ডস। এটি মালয়েশিয়ার প্রাচীনতম পর্যটন এলাকাগুলোর একটি। আমাদের পিকনিক বাস কুয়ালালামপুর থেকে সমতলে দুই ঘণ্টা পথচলার পর পৌঁছে যায় পাহাড়ি পথে; সম্পূর্ণ পাহাড়ি পথ। মাত্র দুই লেনের পাহাড়ি সড়ক। এক লাইন দিয়ে ওপরে ওঠা, আরেক লাইন দিয়ে নিচে নামার। আমরা অবশ্য যে পথ দিয়ে ক্যামেরন হাইল্যান্ডসের ওপরে উঠেছি, সে পথ দিয়ে নিচে আসিনি। আমাদের বাস পর্যটন স্পটগুলোয় থামতে থামতে অন্য পথ দিয়েই নিচে নেমেছে। সর্বশেষ আমরা দেখেছি লাতান ইস্কান্দারে পাহাড়ি ঝরনা।

পাহাড়ি পথ বেয়ে বাস যখন ওপরে উঠছিল, তখন মনে হচ্ছিল রাঙামাটি যাচ্ছি। রাঙামাটির মতো আঁকাবাঁকা পথ। তবে ক্যামেরনের সড়ক রাঙামাটির চেয়ে অনেক বেশি আঁকাবাঁকা। গাড়ি প্রতি মিনিটেই মোড় নেয়। এমনকি কোথাও কোথাও মিনিটে দুবারও মোড় নিতে হয়। রাঙামাটিতে ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক হলেও গাড়ি যে গতিতে চলে, ক্যামেরন হাইল্যান্ডসে গাড়ি চলে তার চেয়ে অনেক কম গতিতে। সড়কে সব জায়গায় লেখা আছে কত গতিসীমায় গাড়ি চালাতে হবে। বাসচালক সড়কে লেখা নির্দেশনার বাইরে গাড়ি চালায়নি কোথাও। তাই ক্যামেরন হাইল্যান্ডসে ওপরে উঠতে মোটামুটি সময় লাগে অনেক।

ভ্রমণসঙ্গীদের লেখক
ভ্রমণসঙ্গীদের লেখক

ওপরে উঠে প্রথমেই দেখা যাবে স্ট্রবেরি বাগান। ক্যামেরনে আছে অসংখ্য পর্যটন স্পট। গাড়িতে পথ চলতে চলতে বিভিন্ন স্পটে থেমে থেমে পরিদর্শন করেছি স্পটগুলো। যাওয়া, আসা ও ঘোরাঘুরি—সব মিলিয়ে আমাদের বরাদ্দ ছিল এক দিন। প্রবাসী তরুণ উদ্যোক্তা শাহাবুদ্দিন আহমেদের ট্রাভেল স্টোরিজের আয়োজনে সকাল আটটায় পিকনিকের বাস ছেড়েছিল কুয়ালালামপুরের মসজিদ জামেক ডব্লিউ হোটেলের সামনে থেকে। ক্যামেরন ঘুরে রাত পৌনে ১২টায় বাস ফিরে এসে মসজিদ জামেক এলআরটি স্টেশনের সামনে থামার মধ্য দিয়ে ১৬ ঘণ্টার আনন্দভ্রমণের পরিসমাপ্তি হয়।

ট্রাভেল স্টোরিজের কথা একটু বলতেই হয়। শাহাবুদ্দিন নামে বাংলাদেশি এক তরুণ আটটা-পাঁচটা কাজ করেন একটি ফার্নিচার কোম্পানিতে। ছুটির দিনে প্রবাসীদের আনন্দ ভ্রমণ ও পিকনিকে নিয়ে যাবেন বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে। মালয়েশিয়ার দর্শনীয় স্থানগুলোতে ঘোরাবেন, দেখাবেন, আনন্দ দেবেন স্বদেশ ও স্বজন ছেড়ে দূরে থাকা প্রবাসীদের। সেই জন্য গড়ে তুলেছেন ট্রাভেল স্টোরিজ। ক্যামেরন হাইল্যান্ডস ভ্রমণ তাঁর প্রথম উদ্যোগ। তাঁর পরবর্তী ভ্রমণস্থান মালাক্কা প্রদেশ। আগামী কোরবানি ঈদের পরের দিন প্রবাসী ভ্রমণপিপাসুদের নিয়ে যাবেন মালাক্কা প্রদেশের দর্শনীয় স্থানগুলোতে।