প্রবাসে ছাপার অক্ষরে বাংলা

আগমনী অস্ট্রেলিয়ার স্মরণিকার প্রচ্ছদ
আগমনী অস্ট্রেলিয়ার স্মরণিকার প্রচ্ছদ

দেশে থাকতে একটি মাত্র স্মরণিকার কাজের সঙ্গে একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্ত ছিলাম। সেটা ছিল আমাদের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের অংশ। ৩০তম বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে নন-ক্যাডার হিসেবে আমরা সাতজন স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরে যোগদান করেছিলাম সহকারী প্রকৌশলী হিসেবে।

প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তাদের চাকরিতে যোগদানের কিছুদিনের মাথায় বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ নিতে হয়। এই প্রশিক্ষণে সরকারি নিয়মকানুন থেকে শুরু করে আচরণবিধিগুলো হাতেকলমে শেখানো হয়। আবার সরকারি চাকরি স্থায়ীকরণের তিনটি শর্তের একটি হলো বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ শেষ করতে হবে। আমি, রকিব, মামুন, আমিনুল, কবির, দেবাশীষ আর জুনায়েদ—এই সাতজনই প্রথম, যারা বিসিএসের মাধ্যমে এলজিইডিতে যোগদান করেছিলাম। তাই আমাদের মনের মধ্যে একধরনের অহংবোধও কাজ করত কিছুটা।

চাকরিতে যোগদানের পর আমাদের বিভিন্নজনকে বিভিন্ন জেলায় পেস্টিং দেওয়া হয়। তাই আমাদের নিজেদের মধ্যে সেভাবে সখ্য আর গড়ে ওঠেনি। বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের সময় একসঙ্গে দুই মাস কাটানোর ফলে আমাদের মধ্যে এমন একটা সম্পর্ক তৈরি হলো, যেটা বন্ধুত্বের চেয়েও বেশি কিছু ছিল। বয়সে আমি সবার বড়, তাই অবধারিতভাবেই তাদের পরিচালনা করার ভার পড়ল আমাদের ওপর।

বুনিয়াদি প্রশিক্ষণে আমাদের সাতজনকে ডাকা হতো সপ্তপাণ্ডব হিসেবে। আমাদের প্রশিক্ষণের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়েছিল কুমিল্লার বার্ড। আমরা সেখানে রীতিমতো নিজেদের রাজত্ব কায়েম করে বসলাম। রাতবিরাতে আনারস আর কাঁঠাল চুরি, কারও জন্মদিন পালন থেকে শুরু করে মাঝরাতে ক্ষুধা পেলে অন্যদের কক্ষে হামলা করা—সবই করেছিলাম আমরা।

পাশাপাশি আমরা সাতজন সব ধরনের কমিটিতে ঢুকে পড়লাম। কারণ, অন্য কেউই এগিয়ে আসছিল না। স্মরণিকা কমিটি, সাংস্কৃতিক কমিটি, দেয়ালপত্রিকা কমিটি—সব কটিতেই আমরা কাজ শুরু করে দিলাম। অবশ্য যেখানে টাকাপয়সার ব্যাপার আছে, সেগুলো আমরা সাবধানে এড়িয়ে গেলাম। আর এই কমিটিগুলোরও আমরা শুধু সদস্য হিসেবেই থাকলাম। অন্য কেউ একজন সভাপতি ছিলেন। কিন্তু পুরো কাজটা করতাম আমরাই।

ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের স্মরণিকার প্রচ্ছদ
ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুলের স্মরণিকার প্রচ্ছদ

আমাদের নীতি ছিল, কাজ করার দরকার, আমরা করব। আমাদের নাম লোকে জানুক বা না জানুক। রকিব আর আমার দুজনেরই আদর্শের ব্যক্তিত্ব ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। তাঁর একটা কথা আমাদের মগজে ঢুকে গিয়েছিল। তাজউদ্দীন আহমদ বলেছিলেন, ‘আমি দেশের জন্য এমনভাবে কাজ করব, যেন দেশের ইতিহাস লেখার সময় সবাই এ দেশটাকেই খুঁজে পায়; কিন্তু আমাকে হারিয়ে ফেলে।’

স্মরণিকার কাজগুলো আমরা কয়েকটা ধাপে ভাগ করে দায়িত্ব নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নিয়েছিলাম। আর প্রতি সপ্তাহান্তে আমরা একবার করে বসে নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে নিতাম। মোট ৪০ জন ছিলেন আমাদের ব্যাচে। পুরোনো স্মরণিকাগুলো ঘেঁটে আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম, প্রত্যেকের আত্মজীবনী লেখা হবে গল্পের আদলে, যাতে যদি কেউ পড়তে বসেন, তাহলে যেন বিরক্তবোধ না করেন। কয়েকজনেরটা নির্দিষ্ট সময়ে হাতে পেলেও অনেকেই সেটা দিতে পারলেন না নিজেদের লেখালেখির অভিজ্ঞতা না থাকার কারণে। তখন আমরা তাঁদের কক্ষে গিয়ে তাঁর কাছ থেকে শুনে নিয়ে নিজেরা লিখে দাঁড় করিয়ে ফেললাম। কয়েকজন বলেছিলেন নিজেরা লিখেই জমা দেবেন। তাঁদের কাছে ধরনা দিয়েও আর লেখা আদায় করা সম্ভব হয়নি।

পরে সংগৃহীত লেখাগুলো আমরা প্রেসে দিলাম কম্পোজ করার জন্য। সব লেখা টাইপ করা হয়ে গেলে আমরা প্রেসের লোককে বার্ডে ডেকে এনে সাতজন মিলে বসে যেতাম বানান ও ব্যাকরণ শুদ্ধীকরণে। আমাদের এই সব কাজের তদারকি করতেন বার্ডের স্মরণিকা কমিটির উপদেষ্টা শেখ মাসুদুর রহমান স্যার। প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে ছবি সিলেকশন এবং ছবির ক্যাপশন লেখার ব্যাপারে তাঁর ছিল সামগ্রিক তদারকি। তাঁর কারণেই আমরা একটা স্ট্যান্ডার্ড স্মরণিকা প্রকাশ করতে পেরেছিলাম।

এত সময় নিয়ে সংশোধন করার পরেও যখন স্মরণিকাটা ছাপা আকারে প্রকাশ পেল, তখন কিছু ভুল আমাদের চোখে পড়ল। তখনই প্রথম উপলব্ধি করলাম, আসলে ভুল সংশোধনের কোনো সীমা নেই এবং কখনোই শতভাগ নির্ভুল বই প্রকাশ করা সম্ভব নয়। যেমন একটা ভুলের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। এক বড় ভাই ১৯৯৭ সালে অনার্সে ভর্তি হয়েছিলেন। স্মরণিকা প্রকাশের পর দেখা গেল ১৯৯৭ সালের জায়গায় ছাপা হয়েছে ২০৯৭ সাল। ভুলটা দেখে তিনি মজা করে বললেন, ‘আচ্ছা আমার তো এখনো জন্মই হয়নি।’

প্রবাসে এসে প্রথম আলোর কল্যাণে লেখালেখিটা এখন মোটামুটি নেশায় পরিণত হয়েছে। একটা লেখা প্রথম আলোতে পাঠানোর পর সেটা প্রকাশ না হওয়া পর্যন্ত নিজের মধ্যে একধরনের ছেলেমানুষি অস্থিরতা কাজ করতে শুরু করে। এমনকি মাঝেমধ্যে প্রকাশ পেতে বেশি দেরি হয়ে গেলে মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়। অকারণে পরিবারের লোকদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি। আর যেদিন লেখাটা প্রকাশ পায়, সেদিন আমি পুরোপুরি হাওয়ায় ভাসতে থাকি। এই লেখালেখি দেখে বুয়েটের এক সিনিয়র রুনু আপু আমাকে বুয়েট অ্যালামনাই অস্ট্রেলিয়ার প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদকের দায়িত্বে চাপিয়ে দিলেন। একে নতুন এসেছি, তার ওপর আমরা শহরতলিতে থাকি, তাই প্রথম দিকে বুয়েট অ্যালামনাইয়ের অনুষ্ঠানে আমার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হয়নি। অনুষ্ঠান হয়ে গেলে বান্ধবী রিফাতের কাছ থেকে ফোনে বর্ণনা শুনে আমি রিপোর্ট লিখে দিই। এরপর গণমাধ্যমে পাঠানো হতো।

এভাবে জোড়াতালি দিয়ে দুই বছর পার করে দিলাম। দুই বছরের মাথায় কমিটি সিদ্ধান্ত নিল, একটি স্মরণিকা প্রকাশ করবে। আর নিয়মমাফিক তার দায়িত্ব আমার ঘাড়েই বর্তায়। আমিও মোটামুটি রাজি হয়ে গেলাম। অনলাইনে বুয়েটের বিভিন্ন ফোরাম ঘুরে প্রচ্ছদের জন্য একটা প্রচ্ছদ সিলেক্ট করে দিলাম। এর ঠিক পরেই আমার গিন্নির চাকরি হলো। আমাদের বাসা থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার ড্রাইভ দূরে। আমার গিন্নি তখনো গাড়ি চালানো শুরু করেনি। আবার আমাদের আলাদা গাড়িও নেই যে সে চালিয়ে যাবে।

বুয়েট অ্যালামনাই অস্ট্রেলিয়ার স্মরণিকার প্রচ্ছদ
বুয়েট অ্যালামনাই অস্ট্রেলিয়ার স্মরণিকার প্রচ্ছদ

গিন্নি প্রতি সপ্তাহের রোববার রাতে কাজের জায়গায় যায় আর ফিরে আসে শুক্রবার গভীর রাতে। এই সময় চাকরির পাশাপাশি আমাকে বাচ্চাদের সামলাতে হয়। তাই ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি স্মরণিকা প্রকাশের দায়িত্ব থেকে সরে এলাম। এরপর রিপা আপু একাই সব দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অনেক সুন্দর একটি স্মরণিকা তাঁরা প্রকাশ করছিলেন। সেখানে বুয়েট অ্যালামনাই অস্ট্রেলিয়া নিয়ে আমার একটি লেখাও ছাপা হয়েছিল। কিন্তু আমার লেখায় যে বানানগুলো ভুল ছিল, স্মরণিকাতেও সেই ভুলগুলো ছিল। তখনো বুঝিনি কেন ভুলগুলো সংশোধন করা সম্ভব হয়নি।

এ ছাড়া লেখালেখির সুবাদে এখানে বেশ কিছু সংগঠনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। এর মধ্যে আগমনী অস্ট্রেলিয়া, চট্টগ্রাম ক্লাব অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। তাদেরও স্মরণিকায় আমার লেখা ছাপা হয়েছিল। কিন্তু সেখানেও দেখি আমার লেখার বানান ভুলগুলো রয়ে গেছে। আমার যেহেতু কোনো লেখায় রিভিশন দেওয়ার অভ্যাস নেই, তাই ভুলগুলো আমার চোখে পড়ে না। কিন্তু ছাপা আকারে প্রকাশ করার পর যখন পড়তে যাই, তখন দেখি অনেক ভুল বের হচ্ছে। কিন্তু তখনো আমার মাথাতেই আসেনি কেন সম্পাদক বানানগুলো ঠিক করে দেননি। পরবর্তী সময়ে ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল তাদের স্মরণিকা প্রকাশ করার দায়িত্ব দিলে বুঝতে পারলাম, কেন ছাপার অক্ষরের বাংলা ভাষাতে ভুলগুলো সংশোধন করা সম্ভব হয় না।

শুরুতেই সবার কাছ থেকে লেখা সংগ্রহ করে নিলাম। অনেকেই বাংলা টাইপ করা লেখা দিলেন। আবার অনেকেই হাতে লিখে স্ক্যান করে মেইল করে দিলেন। যেগুলো হাতে লেখা সেগুলো আমি অফিসের কাজের ফাঁকে গুগল ইনপুট টুলস দিয়ে টাইপ করে নিলাম। কারণ, আমি ধারণা পেতে চাইছিলাম স্মরণিকার কলেবর কেমন হতে পারে। অবশেষে সব লেখা টাইপ করা হয়ে গেলে মোট ২৪ পৃষ্ঠার একটা স্মরণিকার লে-আউট দাঁড় করিয়ে ফেললাম। এরপর বাচ্চাদের আরও কিছু কর্মকাণ্ডের ছবি দিতে গিয়ে মোট ২৮ পৃষ্ঠার একটা লে-আউট দাঁড় করিয়ে প্রেসে পাঠিয়ে দিলাম। আমার ধারণা ছিল, প্রেসের লোকজন বাকি কাজটা নিজেরাই করে নেবেন। অর্থাৎ, যেভাবে বাংলাদেশের স্মরণিকার সময় করেছিলাম। আমি যে কতটা অজ্ঞ ছিলাম, সেটা টের পেলাম দুই সপ্তাহের মাথায়।

সব লেখা ও ছবি দিয়ে যেহেতু লে-আউট দাঁড় করানো হয়ে গেছে, তাই সবাই জিজ্ঞেস করছিল স্মরণিকা প্রকাশের কত দূর। আমি তাদের আশ্বস্ত করছিলাম, আমাদের শতকরা নব্বই ভাগ কাজ শেষ করে প্রেসে দিয়েছি। তাঁরা বাকিটা করে নেবেন। আমরা শুধু সময়ে সময়ে বানানগুলো শুধরে দেব। কিন্তু এক সপ্তাহের মাথায়ও প্রেস থেকে কোনো ই–মেইল না পেয়ে সরাসরি ফোন দিলাম। আমার ফোন পেয়ে তারা আমাকে একটা পিডিএফ ফাইল পাঠিয়ে দিল। দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ। এটা তো আমার লে–আউটেরই শুধু পিডিএফ ফরম্যাট। আমি আবার প্রেসে ফোন দিলে মালিক বললেন, ভাইয়া আমার এখানে বাঙালি যে ছেলেটা কাজ করত, সে ছুটিতে যাচ্ছে। তাই কোনো সংশোধন সম্ভব হয়নি। আমি বললাম, তাহলে উপায়? তিনি বললেন, তাহলে আমি অন্য একটা প্রেসের নম্বর দিচ্ছি, আপনি সেখানে কথা বলে দেখতে পারেন। এরপর তিনিও ভুলে গেলেন আর আমিও আমার অফিসের কাজের চাপ থাকায় আর ফলোআপ করতে পারিনি। আমি মোটামুটি হাল ছেড়ে দিলাম। সবাইকে বললাম, প্রেস খোঁজাখুঁজি করতে। কিন্তু তেমন কোনো প্রেসের খোঁজ পাওয়া গেল না।

পরের সপ্তাহে প্রেসের মালিক ফোন দিয়ে বললেন, ইয়াকুব ভাই একভাবে কাজটা করা যায়। সেটা হচ্ছে আপনি যদি সব বানান সংশোধন করে আমাকে পিডিএফ ফাইল পাঠান, তাহলে আমি প্রিন্ট করতে পারব। তার কথায় হালে কিছুটা পানি পেলাম। তখন আশফাক ভাই আর মিথুন ভাই মিলে পরিকল্পনা করলাম আমরা এক রাতে বসে সব বানান সংশোধন করে ফেলব। কিন্তু তিনজনের সময় আর মিলছিল না। কারণ, ইদানীং আমার গিন্নির প্রায়ই নাইট ডিউটি থাকে হাসপাতালে। তবু এক শনিবার রাতে আমরা ঠিক করলাম বসব।

মিথুন ভাই চাচ্ছিলেন একেবারে সন্ধ্যা থেকে বসতে। কারণ, তিনি জানতেন অনেক বেশি সংশোধনী আছে। আমি ভাবলাম, কী আর এমন সংশোধনী। রাত ১০টার পরে বসলেই হবে। ততক্ষণে বাচ্চাদের খাওয়াদাওয়াও শেষ হয়ে যাবে। তাহলে টানা কাজ করা যাবে। অবশেষে আমরা রাত ১০টার পর আমাদের বাসায় বসলাম বানান সংশোধন করতে। বানান সংশোধন করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, কেন মিথুন ভাই সন্ধ্যা থেকে বসার জন্য পীড়াপীড়ি করছিলেন। একটানা কাজ করে আমাদের কাজ শেষ হলো রাত সাড়ে তিনটায়। মাঝখানে আমি শুধু একবার উঠে গিয়ে চায়ের পানি বসিয়ে এসেছিলাম।

এরপর শুরু হলো প্রেসের সঙ্গে আমার টেবিল টেনিস খেলা। আমি সংশোধন করে পাঠাই আর তারা সেটা প্রিন্ট করার নির্দিষ্ট ফর্মে ফেলে আমাকে পিডিএফ করে ফেরত দেয়। আমি সেটা আবার আশফাক ভাই আর মিথুন ভাইকে পাঠাই। তাঁরা কোনো সংশোধনী দিলে আমি আবার সেটা আমার ওয়ার্ড ফাইলে হালনাগাদ করে সেটাকে পিডিএফ করে প্রেসে পাঠাই। আর ভুল সংশোধনের যেহেতু কোনো সীমা নেই, তাই একটার পর একটা পরিবর্ধন পরিমার্জন চলতেই থাকল। আমি যেহেতু একটু লাজুক প্রকৃতির, তাই প্রেসের লোকজনকেও বেশি চাপ দিতে পারি না। আবার মিথুন ভাইয়ের সংশোধনীগুলো হালনাগাদ করার দরকার, সেটাও ভাবি।

যাহোক, মোটামুটি ২০ বারের বেশি সময় টেবিল টেনিসের বলের মতো স্মরণিকা আমাদের মধ্যে আদান–প্রদান হলো। এরপর মোটামুটি একটা মানসম্পন্ন স্মরণিকা প্রেস থেকে আমাকে পাঠানো হলো। তখন শুরু হলো আমার নিজের চোখে ধরা পড়া ভুলগুলোর সংশোধন। যেমন কোথাও শিরোনামের ফন্ট ছোট আবার কোথাও বড়। কোথাও ফন্ট বোল্ড আবার কোথাও সাধারণ। এভাবে আরও প্রায় পাঁচবার শুধু প্রেসের সঙ্গে আমার স্মরণিকাটা আদান–প্রদান হলো। সবকিছু যখন গুছিয়ে এনেছি। পরদিন প্রিন্ট নেব, তার আগের দিন প্রেসে গিয়ে দুই কপি রাফ প্রিন্ট নিয়ে এলাম কেমন হয়েছে সেটা দেখার জন্য।

তখনই নতুন একটা ভুল চোখে পড়ল। এত দিন প্রেসে একটা শ্রীলঙ্কান ছেলে ফাইলটা নিয়ে কাজ করেছিল। কিন্তু সেদিন এক বাংলাদেশি ভদ্রলোক কাজ করতে গিয়ে একটা পাতায় ছবি ওলটপালট করে ফেললেন। পরদিন আবার সেটার সংশোধন নিয়ে ভাইয়াদের পাঠানো হলে তাঁরা বললেন, সবই ঠিক আছে শুধু একটা শব্দের বানানে একটা অক্ষর বেশি আছে। আমি আবারও আমার ওয়ার্ড ফাইলে সেটা সংশোধন করে প্রেসে পাঠিয়ে তাঁদের ফোন দিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে সেটাকে হালনাগাদ করতে বললাম। তারপর ছাপার কথা বললাম। এই পুরো কাজটা আমাদের করতে হয়েছে আমাদের অফিসের কাজ, বাসার কাজ সামলে সময় বের করে। কেউ যখন আমাদের এই গল্প শুনবেন, তখন হয়তোবা মনে মনে হাসবেন। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য ছিল, আমাদের যেহেতু এটা বাংলা স্কুল, তাই যত দূর সম্ভব আমরা বাংলাটাকে বানানগত ও ব্যাকরণগত দিক থেকে নির্ভুল করার চেষ্টা করব।

প্রবাসে সেই দেশের ভাষা শিখেই আমাদের প্রজন্ম বেড়ে উঠবে। কারণ, তারা রাস্তাঘাট, দোকানপাট, স্কুল–কলেজে সেই ভাষাতেই ভাব বিনিময় করবে। এর বাইরে গিয়ে বাংলা ভাষার শিক্ষা দেওয়াটাকে অনেকেই বিলাসিতা হিসেবে দেখেন। কিন্তু আমরা মনে করি, মাতৃভাষার শিক্ষা দেওয়াও জরুরি। কারণ, তা না হলে তারা একটা সময় গিয়ে শিকড়ের পরিচয়টা হারিয়ে ফেলবে। ইংরেজিভাষীর দেশ অস্ট্রেলিয়াতেও আমাদের বাচ্চারা যারা ছোট বয়সে এই দেশে এসেছে বা এখানে জন্ম নিয়েছে, তারা ইংরেজিতেই কথা বলে। এমনকি অনেক মা–বাবা গর্ব করে বলেন, তাঁদের বাচ্চারা কত দ্রুত অস্ট্রেলিয়ান উচ্চারণে ইংরেজি বলা শিখে গেছে। এটা নিয়ে আমাদের অভিযোগ নেই। কারণ, এখন বাংলাদেশেই অনেক পরিবারে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

বহু ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির দেশ অস্ট্রেলিয়া সব সময়ই তাদের ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত বৈচিত্র্য সংরক্ষণের ব্যাপারে সচেষ্ট। সেই চেষ্টারই অংশ হিসেবে বিভিন্ন ভাষাভাষীর কমিউনিটি স্কুলগুলোর কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বোর্ড অব এডুকেশনের অধীনে। ঠিক তেমনই একটা স্কুল ক্যাম্বেলটাউন বাংলা স্কুল। যেটা প্রায় ১৮ বছর ধরে তার কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। এখানে বাচ্চারা বাংলা ভাষা পড়তে ও পাঠ নিচ্ছে প্রতি রোববার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। আর দুপুর ১২টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত চলে বাঙালি সংস্কৃতি শিক্ষা কার্যক্রম। আশা করি আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এখান থেকে শেখা বাংলা ভাষাটাকে তাদের ব্যবহারিক জীবনেও কাজে লাগাবে। তখন আর এই প্রবাসেও ছাপার অক্ষরে শুদ্ধ বাংলা ভাষাটাকে দেখতে আমাদের বেগ পোহাতে হবে না।