মশার নিয়ন্ত্রণ হতে হবে গবেষণানির্ভর

মশা দমন নিয়ে সিটি করপোরেশনের ভাবনাটা এখনো বিচ্ছিন্ন বলা যায়। মশার উৎপাত বাড়লে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নামমাত্র এক্সপার্ট এনে সভা করে করণীয় ঠিক করা হয়। কিন্তু কার্যকর দমন আর হয়ে ওঠে না। যদিও সম্মিলিতভাবেও কাজ করতে দেখা যায়। যেমন ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়ার প্রাদুর্ভাব বাড়লে বিভিন্ন চিকিৎসা বা গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর, আইসিডিডিআরবি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ইত্যাদি) সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক ও গবেষকেরা সম্মিলিতভাবে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসেন।

যাহোক, দেশে ডেঙ্গুর চিকিৎসা (কিউর) মোটামুটি ভালো চললেও এর প্রিভেনশনটা কিন্তু ঠিকমতো করা যাচ্ছে না। বর্তমানে সিটি করপোরেশন মশা দমনের পুরো বিষয়টা যেভাবে দেখছে বা সার্বিকভাবে যেভাবে দেখা হচ্ছে, তাতে সফলভাবে মশা নিধন আদৌ সম্ভব নয়।

সুতরাং মশা নিধনে (প্রিভেনটিভ মেজার) সিটি করপোরেশনকে নতুন করে ভাবতেই হবে। যেহেতু মশা নিধন ছাড়াও সিটি করপোরেশনের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, তাই এই সেক্টরটাকে আলাদা করে দক্ষ লোকবলের সমন্বয়ে যুগোপযোগী ও গবেষণাভিত্তিক ইউনিট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে।

মশা নিধনে সিটি করপোরেশন শুরু থেকেই নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও যেমন রুটিন করে সকাল-বিকেল বিভিন্ন ওয়ার্ডে কীটনাশক স্প্রেইং ও ফগিং কার্যক্রম অব্যাহত রাখা। প্রশ্ন হচ্ছে, এই অপারেশন টিম বা যাঁরা স্প্রে করছেন, তাঁরা কি জানেন কোন প্রজাতির মশা কোথায় কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে? তাঁদের কাছে কি কোনো কীটনাশক প্রতিরোধী পরীক্ষিত ডেটা রয়েছে। যা দেখে তারা রিকমেন্ডেড ডোজ প্রয়োগ করতে পারে? নাকি তারা মশা মারার জন্য কীটনাশকের ডোজ নিজেরাই ঠিক করছেন বা প্রয়োজনে বাড়িয়ে দিচ্ছেন? কিংবা যাঁরা কীটনাশক প্রয়োগ করছেন, তাঁরা কি অ্যাপ্রোপ্রিয়েটলি ট্রেইনড?

শোনা যাচ্ছে, ঢাকার মশা নাকি এখন কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠেছে। ফলে কীটনাশকে আর মশা মরছে না। যদি কীটনাশকে ভেজাল না হয় তবে অল্প ডোজে কাজ হওয়ার কথা। তবে সাধারণত কীটনাশকের ভুল প্রয়োগেই (অতিরিক্ত ডোজ ও অদক্ষ স্প্রেয়ারম্যান) মশারা প্রতিরোধী হয় বেশি। কারণ মাত্রাতিরিক্ত ডোজে মশারা কীটনাশক প্রতিরোধী হয়ে উঠবে এটাই স্বাভাবিক।

মশার নিজস্ব একটা ক্ষমতা আছে কীটনাশক প্রতিরোধী হওয়ার। অতিরিক্ত প্রতিকূল পরিবেশে মশারা বাঁচার জন্য দেহের ফিজিওলজিক্যাল সিস্টেমের পরিবর্তন করতে পি-৪৫০ জিনকে (কীটনাশক প্রতিরোধী জিন) কাজে লাগায় এবং ধীরে ধীরে চরম প্রতিরোধী হয়ে ওঠে। কীটনাশক দিয়ে এদের আর ধ্বংস করা যায় না। সুতরাং মাত্রাতিরিক্ত বা ভুল ডোজ যে কত ভয়ানক হতে পারে তা এখান থেকে অনুমেয়।

তাই বিভিন্ন টার্গেট এরিয়ায় মশা কী পরিমাণ কীটনাশক প্রতিরোধী হয়েছে এবং এই প্রতিরোধের মাত্রা (রেজিসট্যান্স রেশিও) কেমন তা গবেষণার মাধ্যমে জানতে হবে। কোন কীটনাশক (এডাল্টিসাইড/লার্ভিসাইড) কোন মশা/লার্ভাকে সফলভাবে দমন করতে পারে তা প্রথমে ল্যাব টেস্ট করে (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) পরে প্রয়োগ করতে হবে। নিয়মিত ও রুটিনমাফিক গবেষণা ছাড়া মশা নিয়ন্ত্রণ কোনো দিনই টেকসই হবে না।

সফলভাবে মশা ও মশাবাহিত রোগ দমন করতে আলাদা করে মশা নিয়ন্ত্রণ সেল (মসকিউটো কন্ট্রোল ইউনিট) গঠন করা যেতে পারে। তবে এটা হতে হবে গবেষণানির্ভর। এর মূল কাজ হবে—ক. মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম (অপারেশন)। খ. সফল নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা করা এবং গ. জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা।

এই তিন ধরনের কাজের জন্য আলাদা সাবসেল থাকবে। এই সাবসেলগুলো দু-একজন সায়েন্টিস্টের তত্ত্বাবধান ও কিছু দক্ষ টেকনিশিয়ান কর্তৃক পরিচালিত হবে।

মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের (অপারেশন) জন্য একদল দক্ষ টেকনিশিয়ান (যাঁদের মশার বায়োলজি সম্পর্কে মিনিমাম জ্ঞান থাকবে) লাগবে। যাঁরা নিয়মিত কীটনাশক (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) স্প্রে করবেন। যাঁরা বুঝবেন এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড কোথায় কোন মাত্রায় ব্যবহার হচ্ছে। যাঁরা থারমাল ফগার, ইউএলভি স্প্রেয়ার ইত্যাদিসহ নতুন নতুন ইকুইপমেন্ট ঠিকঠাকমতো ব্যবহার করতে পারবেন। যাঁরা এডিস মশাসহ (ডেঙ্গু/চিকুনগুনিয়া রোগবাহী) অন্যান্য মশা (কিউলেক্স, অ্যানোফিলিস ইত্যাদি) শনাক্ত করতে পারবেন। টার্গেট ও নন-টার্গেটস প্রজাতি চিনতে পারবেন।

মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের (অপারেশন) পাশাপাশি মশা নিয়ে গবেষণা একটা অতীব জরুরি বিষয়। যার ওপর ভিত্তি করে সাধারণত মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়ে থাকে। মশা দমনে গুরুত্বপূর্ণ একটা গবেষণার বিষয় হচ্ছে, মশার সার্ভিল্যান্স (সায়েন্টিস্ট ও দক্ষ টেকনিশিয়ান কর্তৃক পরিচালিত হবে)। এডিসসহ অন্য মশার (এডাল্ট ও লার্ভা) সার্ভিল্যান্স কার্যক্রম নিয়মিত (সারা বছর) পরিচালনা এবং তা মনিটরিং করতে হবে। হোস্ট-সিকিং মশা (মানুষ বা প্রাণীদের কামড়ায়) ও এগ-লেইং মশা (ডিম পাড়া মশা) ধরার জন্য বিভিন্ন ট্র্যাপ (মশা ধরার ফাঁদ) যেমন লাইট ট্র্যাপ, বিজি ট্র্যাপ, গ্রাভিড ট্র্যাপ, অভি ট্র্যাপ (ডিম সংগ্রহের জন্য) ইত্যাদি ব্যবহার করা যেতে পারে।

তা ছাড়া বিভিন্ন এলাকায় জমানো পানিতে লার্ভার উপস্থিতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতে হবে। এতে করে কোন এলাকায় কী কী প্রজাতির মশা রয়েছে, এদের আধিক্য কেমন, এমনকি কোথাও জীবাণুবাহী মশা আছে কি না, তা–ও জানা যাবে। জিবাণুবাহী মশা শনাক্তে আরবোভাইরাল টেস্ট করতে হবে। নিয়মিত সার্ভিল্যান্স করে কোথায় কোন প্রজাতির মশা আছে তা জেনে নির্দিষ্ট কীটনাশক (ডোজসহ) প্রয়োগে সুপারিশ করতে হবে। কীটনাশক (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) নির্বাচন করার আগে তা প্রথমে ল্যাব টেস্ট (টক্সিসিটি বায়োঅ্যাসে) করতে হবে। এসব গবেষণা কাজের জন্য লাগবে ইনসেকটারি (মশা পালন), ল্যাবরেটরি ইত্যাদি। দু-একজন দক্ষ বায়োলজিস্ট/এন্টমোলজিস্ট/মলিকুলার বায়োলজিস্টরা যেটা তত্ত্বাবধান করবেন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর মশা দমনে কার্যকরী পদক্ষেপ নেবেন।

জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য সারা দেশে এয়ারনেস উইক, ওপেন ডে পালন করা যেতে পারে। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (মসজিদসহ) পরিদর্শন করে মশার প্রজাতি, মশার আক্রমণ, জীবনচক্র, মশাবাহিত রোগজীবাণু, রোগের ভয়াবহতা সম্পর্কে আগাম অবহিত করা যেতে পারে। মশার বংশবিস্তার রোধ করতে সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।

মশা নিয়ন্ত্রণে বর্তমানে কীটনাশকের (এডাল্টিসাইড ও লার্ভিসাইড) পাশাপশি বায়োলজিকাল কন্ট্রোলও কার্যকরী হয়ে উঠেছে। বায়োলজিক্যালি কন্ট্রোল করতে বর্তমানে ওলবাকিয়া ব্যাকটেরিয়া (স্ত্রী মশার উর্বর ডিম উৎপাদন ব্যাহত করে), মেল স্টেরাইল টেকনিক (মশাদের মেটিং হবে কিন্তু ডিম উৎপাদন হবে না), বিভিন্ন মশক প্রিডেটরস যেমন মশক মাছ (গ্যামবুসিয়াসহ অন্যান্য), ওয়াটার বাগ, বিটল ইত্যাদি ব্যবহার অনেক দেশে প্রচলিত আছে। আমাদের দেশেও এসবের ব্যবহার পরীক্ষামূলকভাবে (ল্যাব রিসার্চ করে) চালু করা যেতে পারে।

মশা এখন শুধু বিরক্তিকর নয়, আতঙ্কেরও বিষয়। ইমার্জিং পাবলিক হেলথ ইস্যু। তাই ইন্টিগ্রেটেড মসকিউটো ম্যানেজমেন্ট (আইএমএম) অনুসরণ করে আমাদের দেশে আলাদা করে মশা নিয়ন্ত্রণ সেল (মসকিউটো কন্ট্রোল ইউনিট) প্রতিষ্ঠার নতুন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। যেখানে অপারেশন ও গবেষণা দুটোই চলবে এবং প্রয়োজনে অন্য আরবো-ভাইরাল ডিজেজ ভেক্টর নিয়েও কাজ করা যাবে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যেমন ডব্লিউএইচও, সিডিসি, ইউএসডিএ ইত্যাদি মশার সফল নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন দেশকে সহযোগিতা (টেকনিক্যাল, আর্থিক) করে আসছে। মশা নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা করে একটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে (ধাপে ধাপে) প্রথমে কিছুটা সময় লাগলেও পরে খুব সফলভাবে মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। সফলভাবে মশা ও মশাবাহিত রোগ দমন করতে আধুনিক ভাবনা এখন সময়ের দাবি। কারণ দেশ এগিয়ে যাচ্ছে, নাগরিক সুবিধা কেন পিছিয়ে থাকবে?

ড. মো. আসাদুজ্জামান মিয়া: সায়েন্টিস্ট, এনাসটাসিয়া মসকিউটো কন্ট্রোল, সেন্ট অগাস্টিন, ফ্লোরিডা, আমেরিকা। টিচিং ফেলো, মসকিউটো কন্ট্রোল রিসার্চ গ্রুপ, ইউনিভার্সটি সায়েন্স মালয়েশিয়া, পেনাং, মালয়েশিয়া।  ই–মেইল <[email protected]>