সম্রাট অশোকের শান্তি স্তূপ

অনুশাসনের সাংরাশ
অনুশাসনের সাংরাশ

সকালের আকাশজুড়ে আলোর উল্লাস ছিল আজ। পুরি শহর ছাড়িয়ে ভুবনেশ্বর অবধি সারা আকাশই যেন সোনালি রোদের স্রোতে ভাসছিল। হঠাৎ ধবলগিরি পৌঁছাতে ঝেপে এল বৃষ্টি। তার এমনই তোড় যে দুই হাত দূরের জিনিসও চোখের ক্যামেরায় স্পষ্ট হয়ে ফোটে না। বৃষ্টির কুয়াশায় চারপাশের দৃশ্য ছবি মুহূর্তেই স্তূপাকার হয়ে গেল। থেকে থেকে চলন্ত গাড়ির চাকায় উঠে আসতে লাগল রাস্তার জল। চারপাশে পিচকারির মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে সেই জলের কুয়াশা চোখের সামনে পর্দা তুলে দিতে লাগল বারবার। সুরেশ সতর্ক দৃষ্টি ছুড়ে পেছনের দিকে তাকিয়ে বলল, সঙ্গে ছাতা এনেছেন তো দাদা? সুচরিত বলল, হ্যাঁ, একটাই আছে। ঠিক আছে, ওতেই হবে। এ বৃষ্টি সহজে থামবে বলে মনে হয় না।

গতিময় শহর দলা পাকিয়ে সরে যাচ্ছে চোখের ওপর দিয়ে। গাড়ির গতি কমিয়ে সংকীর্ণ পাহাড়ি পথে ওপর থেকে আরও ওপরের দিকে ছুটে চলেছে সুরেশ। চারপাশটা দেখার জন্য একসময় ন্যাপকিন দিয়ে কাচের কুয়াশা মুছে দিল বহ্নি। সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ল, অরণ্যের সবুজ ঢেউ বিস্তীর্ণ হতে হতে ছড়িয়ে পড়েছে চারপাশে। নাগরিক সভ্যতার কোলাহল সেখানে নেই। কমে যাচ্ছে গাড়িদের ভিড়ভাট্টা।

আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে গাড়ির ভেতরে বন্দী হয়ে এভাবে অস্পষ্ট চেহারার পৃথিবী দেখতে বড় রোমাঞ্চ লাগছে বহ্নির। আজ সুচরিতরা যাচ্ছে মৌর্য বংশের তৃতীয় সম্রাট অশোকের স্মৃতি রক্ষার্থে অবিস্মরণীয় সৃষ্টি, ধবলগিরির শান্তি স্তূপ দেখতে। জাপান বুদ্ধ সংঘের ভিক্ষুরা ১৯৭০ খ্রিষ্টাব্দে এই শান্তি স্তূপ ধৌলগিরির শিখর চূড়ায় নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়া সেখানে সংগৃহীত রয়েছে অশোকের বিভিন্ন শিলালিপির অনুশাসনের মর্মবাণী, যেগুলো মানবজীবনের কর্তব্য এবং তাঁর রূপান্তরিত জীবন ইতিহাসের কথা ঘোষণা করছে হাজার হাজার বছর পরও।

প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা অনুযায়ী, কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশোক নিজেও বহু স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন, যার ৮৪ হাজারের ধ্বংসাবশেষের নিদর্শন পাওয়া গেছে। সিদ্ধার্থ বুদ্ধের অহিংস বাণী, মানব জীবনের কর্তব্য সম্পর্কে বিভিন্ন অনুশাসন তখনকার বৃহৎ ভারতবর্ষের পাহাড়ের গুহায়, উঁচু স্তম্ভের গায়ে, পাথরের ওপর লিখিতরূপে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন অহিংস ধর্মের অনুসারী মহামতি অশোক। আদর্শ মানুষের জীবনদর্শন ভবিষ্যৎ মানবসমাজের কল্যাণের পথ যাতে সুগম করে, সে জন্য সম্রাটের নিরন্তর চেষ্টার অন্ত ছিল না।

অনুশাসনের সাংরাশ
অনুশাসনের সাংরাশ

খ্রিষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকে বর্তমান শতাব্দীর অনেক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রাচীন ভারতের অংশ ছিল। তিব্বত, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, ইরানের পশ্চিমাংশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মালদ্বীপসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশই অন্তর্ভুক্ত ছিল তার। যে কারণে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ছাড়াও পাকিস্তান, আফগানিস্তান, মালদ্বীপ ও নেপালের অনেক স্থানে অশোকের তৈরি স্তূপ এবং শিলালিপির নিদর্শন মিলেছে। আফগানিস্তানের অফিশিয়াল ভাষা পশতুর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বৈদিক সংস্কৃত শব্দের উপস্থিতি এখনো যে বর্তমান, তারও কারণ আফগানিস্তান ভারতের অঙ্গীভূত হওয়ার কারণে। পূর্ব এশিয়ার সঙ্গেও ভারতের ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগের প্রভাব নিবিড় ছিল। অশোকের নির্মিত বৌদ্ধ স্তূপের স্থাপত্যশৈলীতে পূর্ব এশিয়ার স্থাপত্যশিল্পের প্রভাব তাই পরিলক্ষিত হয়েছে।

যা হোক, বিম্বিসারের দ্বিতীয় পুত্র প্রিয়দর্শী অশোক এমন এক বিশাল রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি হতে চেয়ে কলিঙ্গ রাজ অনন্ত পদ্মনাভকে অসম যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করেছিলেন। ভেবেছিলেন, একচ্ছত্র শক্তির তেজে বলীয়ান হয়ে জীবনের উদ্দেশ্য চরিতার্থ করবেন। কিন্তু সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরিয়েছিল খ্রিষ্টপূর্ব ২৬২ অব্দে সংঘটিত ভয়াবহ কলিঙ্গ যুদ্ধ। পরিণতিতে এক লাখ প্রাণের রক্তস্রোতে শোকবিহ্বল হয়ে উঠেছিল চারপাশের পরিবেশ। আহত হয়েছিল দেড় লাখ মানুষ। তাদের আকুল আর্তনাদের হাহাকারে বিজয় গৌরব উপভোগ করতে পারেননি বিজয়ী সম্রাট। শোকার্ত মানুষের যন্ত্রণায় নিষ্ঠুর অশোক করুণাসিন্ধু হয়ে উঠেছিলেন। বদলে গিয়েছিলেন অন্তর থেকে। বুঝেছিলেন, যুদ্ধ, সংঘর্ষ, হিংসা কিংবা জাগতিক শক্তি লাভের মাধ্যমে জীবনের লক্ষ্য অর্জিত হয় না! মানবজন্মের, মানবধর্মের উদ্দেশ্য সেটা নয়। কারণ পার্থিব মানুষের অনিত্য জীবনে এগুলো মৃত্যু, ধ্বংস আর দুঃখ ছাড়া আর কিছু দিতে পারে না।

শিলালিপি
শিলালিপি

মুষলধারার বৃষ্টি এখনো চারদিকে জলের স্রোত বইয়ে ঝরছে। সিঁড়ির মতো খাঁড়া পথ বেয়ে সুরেশের গাড়ি উঠে এল ধবলগিরির পার্কিং লটে। আরও কিছু এবড়োখেবড়ো পাথরের সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠলে তবে শান্তি স্তূপের প্রাঙ্গণে যাওয়ার সিঁড়ি। সুরেশ বিশাল এক অচেনা গাছের নিচে ম্যানিউভারিং করে ট্যাক্সি দাঁড় করিয়ে বলল, দাদা, ওই অফিস থেকে টিকিট কিনতে হবে। না, না আপনি নামবেন না। আমিই কিনে আনছি। ওদের ভাষা আপনি বুঝবেন না। সুচরিত তার ছাতা এগিয়ে ধরতেই হাসল সে, দরকার নেই। ওটুকু বৃষ্টিতে ভিজলে আমার অসুবিধে হবে না, বলেই উত্তরের জন্য অপেক্ষা না করে সামনের অফিস ঘরের সামনে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়াল।

বহ্নিদের সঙ্গে সুরেশের সম্পর্ক বাঁধা পড়ে যাচ্ছে অন্তরের গভীর টানে। আজ পুরো পথে অনেক সময় ধরে কালকের পিঠে পর্বের অনুষ্ঠানের গল্প শুনিয়েছে সে। কদিন ধরে ওর মুখে পারিবারিক গল্প শুনতে শুনতে সুরেশের পরিবার সুচরিতদের কাছে এখন রীতিমতো সুপরিচিত। বহ্নি গল্প শুনতে বড় ভালোবাসে। আজও তাই আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করেছে, কাল রাতের অনুষ্ঠানে কী কী পিঠা খেল সুরেশ? সে অনেক রকম পিঠা দিদি! দুদুরা, এন্দুরি, আরিসা, বিরি চাউলা, মুদুকা। আচ্ছা! তা এত পিঠা বানাল কে? তোমার মা, নাকি...? মা, বৌদি, আমার বউ, সবাই মিলেই বানিয়েছে। কাল শ্বশুরবাড়ি থেকে আমার দিদিও এসেছিল ছেলেপুলে নিয়ে। বাঃ! তাহলে তো খুব জমজমাট আনন্দ হয়েছে। সুরেশ উত্তরে মুখ উজ্জ্বল করে সুন্দর হেসে বলেছে, হ্যাঁ দিদি।

ওপরে ওঠার সিঁড়ির বাইরে খানিকটা দূরেই একটি বিশাল বোর্ড দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখানে মহামতি অশোকের কর্মধারা এবং তাঁর জনশিক্ষার অনুশাসনগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করে লেখা। হাজার হাজার বছর পেরিয়েও লোকশিক্ষার ধারক হয়ে বর্তমান পৃথিবীর বাস্তবতায় আজও সেগুলো অসাধারণভাবে প্রাসঙ্গিক! কজন পর্যটক সেখানে দাঁড়িয়ে গভীর মনোনিবেশে পড়ছিলেন। সুচরিত কয়েক পা সামনে এগিয়ে শ্রদ্ধাভরে তার কাছে এসে দাঁড়াল। পড়তে পড়তে তার মন বলল, সত্যিকারের জ্ঞান ভালোবাসা থেকেই আসে। তখন মানুষ অনেক দূরের ভবিষ্যৎও স্পষ্ট করে দেখতে পায়। অশোক সেটা পেরেছিলেন বলেই তাঁর শিক্ষার মর্মকথা আজও এত প্রাসঙ্গিক। এতখানি গুরুত্বপূর্ণ।

শিলালিপি
শিলালিপি

তাঁর অনুশাসনের দুই-চারটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরা যেতে পারে। ১) উৎসব পালনে হোক কিংবা রসনাতৃপ্তির উদ্দেশ্যে হোক, সব ধরনের পশু হত্যাই বন্ধ করা হলো। ২) নৈতিক গুণাবলি অর্জন ছাড়া মানুষের জীবনে গৌরব আর খ্যাতি প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ৩) রাজ্যের সব প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা সুষ্ঠুভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবেন এবং নিয়মিত সেসব কাজের রিপোর্ট সম্রাটের কাছে পেশ করবেন। ৪) সাম্য প্রতিষ্ঠায় জগতের কল্যাণ হয়। এই সাম্য বাইরের আইন প্রয়োগ করে নয়, হৃদয় থেকে জাগ্রত করতে হয়। অতএব গৃহের দাসদাসী থেকে কর্মচারী, সমাজের সব বয়ঃজ্যেষ্ঠ থেকে ভদ্র সুধীজন, এমনকি পশুপাখিসহ সব ধরনের প্রাণীর জন্য অন্তরে একইভাবে শ্রদ্ধাপূর্ণ ভালোবাসা লালন করো। ৫) পরিবেশ ও বন্য প্রাণীর জীবন রক্ষার্থে বনায়ন সৃষ্টি করো। ৬) মানুষ ও অন্যান্য প্রাণীর সুস্বাস্থ্য রক্ষায় বনৌষধি লাগাও। ৭) রাজপথের দুই পাশে বৃক্ষ লাগিয়ে, সুপেয় পানীয় জলের ব্যবস্থা করে পথিকের কষ্ট মোচন করতে হবে।

এসব উপদেশ শুধু তাঁর লোকশিক্ষার দৃষ্টান্ত ছিল না। সাম্রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠায়, প্রজাসাধারণের কল্যাণে সম্রাট নিজেও এগুলো প্রতিপালন করেছেন প্রজাবৎসল শাসক হিসেবে। অশোকের রূপান্তরিত চেতনার উপলব্ধি হাজার হাজার বছর পর আজও তাঁকে তাই সভ্যতার ইতিহাসে অনন্যসাধারণ আসন দিয়ে রেখেছে। তাঁর কর্মধারার বিবরণ, লোকশিক্ষার মর্মবাণী, শাক্যসিংহের অমৃত কথা তাই সহানুভূতিশীল পর্যটকের অন্তর ছুঁয়ে যায়।

শান্তি স্তূপ
শান্তি স্তূপ

দুই এশীয় তরুণ ডায়েরির পাতায় কিছু একটা লিখে রাখছিল সুগভীর মনোযোগে। সুচরিতকে দেখেই একজন জিজ্ঞেস করল, এখানে দয়া রিভারের অবস্থান কোন দিকে বলতে পারো মিস্টার? সুচরিত বুঝতে না পেরে সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিয়ে তাকাল, দয়া নদী? হ্যাঁ। কলিঙ্গ যুদ্ধের পরে যে নদীর জল মানুষের রক্তে রক্তাক্ত হয়েছিল। যে নদী আজও কলিঙ্গবাসীর কাছে অপবিত্র। যার জল কৃষিকাজ ছাড়া অন্য কাজে ব্যবহৃত হয় না। আমি সেই নদীর কথা বলছি। সেটা প্যাগোডার আশপাশেই বয়ে গেছে। কিন্তু কেন দেখতে পাচ্ছি না...! বলেই তরুণ তার অর্ধস্ফুট চোখ দুটি আরেকবার চারপাশে ছড়িয়ে দিল। বহ্নি শুনতে পেয়ে আগ্রহভরে এগিয়ে এল এবার, তুমি কি কলিঙ্গ নদীর কথা বলছ?

উত্তর দিতে গিয়ে দ্বিধান্বিত হয়েও ভদ্রতা করল তরুণ, হ্যাঁ, হ্যাঁ। যুদ্ধ যেখানে হয়েছিল তার নাম কলিঙ্গই। আর নদীর নাম দয়া। কে জানে সে নদী এখনো বেঁচে আছে কি না। হয়তো নেই। না, না, বেঁচে আছে। ইয়েস ম্যাম। দয়া এখনো বেঁচে আছে। তার গলার স্বরে বিশেষ রকম চাপ পড়ল। সুচরিত অদূরের টিকিট অফিস দেখিয়ে বলল, ওখানে গিয়ে জিজ্ঞেস করো। ওরা স্থানীয় লোক, নিশ্চয়ই বলতে পারবেন। ফিরে যেতে যেতে স্বামীর মুখে তাকাল বহ্নি, দেখলে তো, এখানে আসার আগেই ছেলেটা সব ইনফরমেশন জেনে এসেছে। আর আমরা? নদীর নামটাও ভুল জানি! ওরা এখানে গবেষণার কাজে এসেছে বহ্নি। ওদের তো এসব জানতেই হবে। তবে আমরা মোটেই ভুল জানি না। একে কলিঙ্গ নদীও বলা হয়।

ধাপে ধাপে ত্রিপল টাঙিয়ে মিষ্টি আর ছোট ছোট ফলের দোকানপাট বসেছে প্রকৃতির তৈরি পাথুরে সিঁড়ির দুই পাশে। ছাতা মাথায় সেই সংকীর্ণ সিঁড়ি পেরিয়ে সন্তর্পণে ওপরের দিকে চলল ওরা। ওপরে উঠতে বৃষ্টি থেমে গেল। আকাশের ফাঁক গলে ম্লান রোদের চাকচিক্য ছড়িয়ে পড়ল চারপাশে। সামনেই নিরাভরণ সাদা শান্তি স্তূপ। ভেতরে শাক্যসিংহ বুদ্ধের ধ্যাননিমগ্ন শুভ্র মূর্তি। প্রশান্তির স্নিগ্ধতায় দ্যুতিময়। প্রজ্ঞাময়তায় অসাধারণ সুন্দর।

শান্তি স্তূপ
শান্তি স্তূপ

ভক্তি বিনত গুটিকয়েক দর্শকের সামনে দাঁড়িয়ে করজোড়ে মাথা নোয়াচ্ছিলেন তখনো। বহ্নিও শান্ত মনে নমস্কার করে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়াল। একটু আগে নিচ থেকে পড়ে আসা বুদ্ধের বাণীগুলো তখনো তার মাথায় ঘুরছিল, ‘Just as a candle can not burn without fire, So men can not live without a spiritual life. None save us but ourselves'. সে অস্ফুটে উচ্চারণ করল-আহা! কী সুন্দর ওই কথাগুলো। কোন কথা? ওই যে নিচে দেখে এলাম, বুদ্ধের বাণী। যেখানে বলেছেন, ‘মোমবাতি যেমন আগুন ছাড়া পুড়তে পারে না, তেমনি অধ্যাত্ম আলোর পরশ ছাড়া মানুষও মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে না।’

পাশেই এক প্রবীণ ভদ্রলোক প্রশান্ত চেহারায় প্রশান্ত বুদ্ধকে প্রশান্ত চোখে দেখছিলেন। হেসে মন্তব্য করলেন, আজকের হিংসাদীর্ণ যুগে কজন আর এসব কথার মর্ম বোঝেন। সুচরিতের মুখে খুশির ঝিলিক জাগল, কলকাতার? না, না। কটকের বাঙালি। বহু পুরুষের বাস। বড় ভালো লাগে এখানে এলে। পান্ডাদের অত্যাচারও নেই। তাই সুযোগ পেলেই চলে আসি। আচ্ছা কলিঙ্গ নদী কি এখনো বেঁচে আছে? ওটা কলিঙ্গ নয়, দয়া নদী। হ্যাঁ বেঁচে আছে। চলুন দেখিয়ে দিচ্ছি।

পাহাড় প্রাঙ্গণের একেবারে বামদিকে চলে এলেন ভদ্রলোক। চোখে পড়ল অনেক দূর অবধি অরণ্যের বিস্তার ছড়িয়ে গেছে হাইয়ের ধার ঘেঁষে। তার এপাশে আরেক প্রস্থ গাছের আড়ালে মোটা জলের ঈষৎ উচ্চকিত ছোট ছোট ঢেউ। দুই পাশের অরণ্য দয়া নদীকে আড়াল করে দিয়েছে সবুজের শামিয়ানা ছড়িয়ে। ভদ্রলোক কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়ে বললেন, ওই দেখুন দয়া নদী! কোনো মতে ধুকপুক করে চলছে! ওডিশার বেশির ভাগ নদীরই অতিদূষণে দীন অবস্থা! জলের চাহিদা যত বাড়ছে, জলের মজুত ততই তলানিতে এসে ঠেকছে। হ্যাঁ সেদিন নিউজ পেপারেও দেখলাম, তামিলনাড়ুতে লেক শুকিয়ে সব মাছ মরে যাচ্ছে। শুধু কি তা-ই? চেন্নাইয়ের সার্জনদের অপারেশনের কাজেও জল কিনতে হয়। তবুও মানুষের হুঁশ নেই। কী দেখেছিলাম, আর এখন কী হাল হয়েছে! সব দেখে শুনে বড় কষ্ট পাই। শান্তির সন্ধানে তাই মাঝেমধ্যে ওই শান্তিময়ের কাছে আসি। বলে ভদ্রলোক হাত তুলে শান্তি স্তূপের শাক্যসিংহকে দেখালেন।

দয়া নদী
দয়া নদী

আকাশে আবারও মেঘের আনাগোনা। পূর্ব এশীয় তরুণেরা এগিয়ে আসছে ওদের দিকে। তাদের মুখের ওপর পাতলা হাসি। বহ্নি আগ বাড়িয়ে চেঁচাল, এদিকটায় চলে এসো। দয়া নদীকে খুঁজে পেয়েছি। ধন্যবাদ ম্যাম। নিচ থেকে কিছু বোঝা যায় না। ওদের চলার ভঙ্গিতে সন্তুষ্টি ফুটল। ঠিক কথা। কারণ প্যাগোডার কাছাকাছি এসে নদীটা জঙ্গলের ভেতর দিয়ে গেছে।

নিচে নামার আগে অনেক উঁচু থেকে আরেকবার চারদিকে চোখ ছড়াল বহ্নি। বুদ্ধের অহিংস ভালোবাসার স্রোত হয়ে ঈশ্বরের পবিত্র প্রেম ঝরে পড়ছে সবখানে। অরণ্যের মাথায় সবুজের লীলায়িত তরঙ্গে সেই প্রেম ধীরে ধীরে নাচছে। কী অসাধারণ সুন্দর তার ভঙ্গিমা। আড়াই হাজার বছর আগে এভাবেই কি প্রেমের পরশ ছিল? এভাবেই কি সৌন্দর্যের বিহার ছিল প্রাচীন কলিঙ্গের আনাচকানাচে? তাহলে কেন রক্তস্নাত নিষ্ঠুর যুদ্ধ হয়েছিল? কেন মানুষ অহিংসার মন্ত্রে দীক্ষিত হতে পারেনি সেদিন? তখনো কী আজকের মতো অধ্যাত্ম আলোর পরশ ছিল না? নাকি জগতের সিংহভাগ মানুষ কোনোকালেই এই আলোর সন্ধান খুঁজে পায় না? (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন : খণ্ডগিরি পর্বত