শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ

শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ
শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ

গণেশ পান্ডার পরিবার চার পুরুষ ধরে জগন্নাথধামের সেবায়েত। আচার–আচরণ, কথাবার্তায় সহজাতভাবে তাই অহংকার প্রকাশ পায়। সুচরিত ফোন করতেই বললেন, না, না, কোনো অসুবিধে হবে না স্যার! গেটে পৌঁছে একবার কেবল গণেশ পান্ডার নাম বলবেন, তাহলেই হবে। চার পুরুষ ধরে এই মন্দিরে আমাদের পরিচিতি। কেবল বিদেশিরা নয়, এখানকার মন্ত্রী–মিনিস্টাররা এলেও এই গণেশ পান্ডার ডাক পড়ে।

ওখানে গেট পর্যন্ত ট্যাক্সি যাবে তো? না, ট্যাক্সি আপনাকে আগেই ছেড়ে দিয়ে হেঁটে আসতে হবে। গেটের বাইরে জুতা-স্যান্ডেল রাখার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে রেখে হাত-পা ধুয়ে শুদ্ধ হয়ে অন্দরে আসবেন। আপনার দেখা তাহলে পাব কোথায়? ওই যে বললাম, নাম বললেই সিকিউরিটি পুলিশ আমায় ডেকে দেবে। সুচরিত কথা না বাড়িয়ে চুপ করে রইল। বুঝল, গণেশ পান্ডার স্ট্যাটাস যথেষ্ট উঁচুতে। চাইলেই গেটের বাইরে তার সাক্ষাৎ মিলবে না।

চারদিকে বেলে বেলে রোদ ছড়ালেও সকাল দশটায় রোদের তাত কম নয়। সুরেশ অনেকখানি দূরে ট্যাক্সি থামিয়ে বলল, এখান থেকেই হেঁটে যেতে হবে দাদা। দূরে জগন্নাথ মন্দিরের সুউচ্চ চূড়া দেখা যাচ্ছে। বাম পাশে গেটের বাইরে আকাশছোঁয়া রথ। তার জাঁকজমক আর আকারই জানিয়ে দিচ্ছে বিশাল গৌরব আর খ্যাতির মহিমা। রথযাত্রা উৎসবে জগন্নাথ, বলরাম, সুভদ্রা এই রথে চড়েই নগর পরিক্রমা করেন।

ট্যাক্সি থেকে নামতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল বহ্নি, কী সর্বনাশ! চারদিকে যত রাজ্যের বড় বড় গরু চরে বেড়াচ্ছে। এই রাস্তায় হাঁটব কী করে? সুরেশের মুখে কোমল হাসি ফুটল, ওরা কিছু বলবে না দিদি। এগিয়ে যান। তাই বললে হয়! কী ভারী ভারী গরু। কত বড় বড় খাড়া শিং। একবার তেড়ে এলে...। সুরেশ তার গলার স্বরে জোর দিল, প্রভুজির নাম করে চলে যান, কিচ্ছু হবে না। ওই তো মানুষজন যাচ্ছে দেখুন।

বহ্নির বুকে ভক্তের বিশ্বাস নেই। সে কাঠ হয়ে দাঁড়াল। রাস্তার দুই পাশে স্থায়ী–অস্থায়ী দোকানপাট। সেসব জায়গা ছেড়ে গরুগুলো রাস্তাজুড়ে এমনভাবে হেঁটে বেড়াচ্ছে যেন সেটাই তাদের চারণভূমি। হেঁটে হেঁটে চারদিকে ছড়িয়ে রাখা ডাবের খোসা, ভাঙা তরমুজের টুকরা, আরও এটা-সেটা কুড়িয়ে কুড়িয়ে খাচ্ছে। এর আগে রাজপথে এতটা বিশৃঙ্খলা অন্য কোথাও দেখেনি বহ্নি। সুচরিতও ভয় পেয়েছে। তারপরও সতর্ক চোখ ছড়িয়ে চলতে আরম্ভ করে অভয় বাণী শোনাল, ভয় নেই! আমাকে ফলো করে পেছন পেছন চলে এসো।

জুতা রাখার দোকানে টাকা দিয়ে জুতা রেখে টোকেন নিয়ে এবার খালি পায়ে হাঁটার পালা। এদিকটায় অবশ্য গরুদের দলে দলে চরে বেড়ানোর দৃশ্যপট নেই। কেবল দু–চারটি ইতস্তত হেঁটে বেড়াচ্ছে খাদ্যের সন্ধানে। চারপাশে তেলেভাজা, জিলাপি, জিবেগজা, আরও সব নাম না জানা খাবারের গন্ধে বাতাস ব্যাকুল হচ্ছে।

গেটে পৌঁছে বহ্নিরা হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। যেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সমুদ্র পেরিয়ে সদ্য তারা তীরে পৌঁছেছে। এরই মধ্যে ভেতরে দৃষ্টি ছুড়তে চোখে পড়ল, ডজনখানেক নারী আর পুরুষ পুলিশ দাঁড়িয়ে থেকে প্রহরীর দৃষ্টি ছড়াচ্ছেন চারপাশে। সামনেই জলের কল। সেখানে হাত-পা ধুয়ে পবিত্র হওয়ার ব্যবস্থা।

বহ্নিরা পবিত্র হতে না–হতেই গণেশ পান্ডার দর্শন মিলল। খুব ফরসা, ভারী আর বেঁটে চেহারার মানুষ। পানের রসে ঠোঁট লাল। কপালে লাল চন্দনের তিলক। এসেই খুব ভারিক্কি চালে বললেন, চলুন, গর্ভগৃহে প্রণাম সেরে পরিক্রমা শুরু করি। অনেক সিঁড়ি পেরিয়ে কয়েক পা ওপরে উঠতে হঠাৎ বহ্নির চোখ আটকে গেল কোণের দিকে। সেখানে এক বর্ষীয়ান নারী যতই ভেতরে যাওয়ার জন্য জোর করছেন, প্রবীণ পান্ডা ততই চোখ পাকিয়ে বলছেন, আপ বহাঁ কভি নহিঁ যা সকতে। পহলে পয়সা দেঁ ফির অন্দর যায়েঁ।

কিসের জন্য? প্রাণের ঠাকুর দেখতে পয়সা লাগে? জন্মে শুনিনি। এখানে কোনো এন্ট্রি ফি নেই, সে কি আর আমি জানিনে নাকি? পুজো দিতে হবে। নইলে ভেতরে যাওয়া চলবে না। সে সময়মতো দেবোখন। এবার পথ ছাড়ো বাপু। নইলে সোজা ম্যানেজিং কমিটিকে জানিয়ে নালিশ করব। আমাকে অত হেঁজিপেঁজি ভেবো না, যে যা খুশি তাই করতে পারবে। শেষটুকু আর দেখা হলো না। পাশ থেকে গণেশ পান্ডার তাড়া এল, মা জননী, সামনে এগোও। দাঁড়িয়ে থাকলে যে পেছন থেকে চাপ বাড়বে।

পুরির জগন্নাথ মন্দিরে পান্ডাদের দৌরাত্ম্যের ইতিহাস ভুবনবিখ্যাত। অর্থ রোজগারের ধান্দায় যতভাবে সম্ভব দর্শনার্থীদের দুর্ভোগ বাড়িয়ে তোলায় এদের জুড়ি নেই। গণেশ পান্ডা যে সুচরিতদের এত যত্নআত্তি করছেন, সেটাও সম্ভব হচ্ছে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে। হাড়ে হাড়ে বুঝেছে বহ্নি। সে অবশ্য ভদ্রতা করে সঙ্গে সঙ্গে পা বাড়াল ওপরের দিকে। দরজায় দাঁড়াতে চোখে পড়ল, বাম পাশের বিশাল বেদিতে বলভদ্র, সুভদ্রার সঙ্গে জগদীশ্বরের মোহন মূর্তি।

নিচে নামার আগে গণেশ পান্ডা সাবধান বাণী শোনালেন, সাবধানে পা ফেলবেন। এখানটায় খুব পিচ্ছিল কিন্তু। বহ্নির চোখ আটকে গেল নিচে। মেঝেজুড়ে এত দই, ঘি, মধু ছড়ানো কেন গণেশজি? প্রশ্ন শুনে বিরক্ত হয়েও জবাব দিলেন গণেশ পান্ডা, এগুলোর সবই সাত্ত্বিক জিনিস মা জননী। হিন্দুধর্মে সাত্ত্বিক জিনিস সদাই পবিত্র বলে গণ্য। পবিত্র জিনিস পবিত্র স্থানে থাকবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু বুড়ো মানুষদের তো এখানে আসতে খুব অসুবিধে হবে। এবার বিরক্ত হলো সুচরিত, কেন কথা বাড়াচ্ছ বহ্নি? সামনে এগোও না। গণেশজি নিচু গলায় বললেন, জগতের নাথকে তাঁর চরণ ছুঁয়ে দর্শন করবে, পুণ্য কুড়োবে, আর এই সামান্য কষ্ট স্বীকার করবে না, তাই কখনো হয়? ভবনদী পার হওয়ার ক্ষেত্রে এত যৎকিঞ্চিৎ দৃষ্টান্তমাত্র।

মন্দিরের অভ্যন্তর বৈদ্যুতিক আলোয় আলোকময়। বাইরে থেকে একে যত বড় আর ভারী দেখায়, ভেতরটা তার চেয়েও বেশি ম্যাসিভ। অসম্ভব ভারী ভারী পিলার। দেয়ালগুলো যেন পাথরের পাহাড়। এর স্থাপত্যশিল্পে দ্রাবিড়িয়ান শৈলীর ছাপ। সবটা ঘুরে দেখতে দেখতে হাজার বছরের পুরোনো মুহূর্ত ভেসে এল বহ্নির কল্পনার স্রোতে। শ্রীক্ষেত্রের এই স্থান তখনো বালুর সমুদ্রে আবৃত। রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন আর বিষ্ণুর অবতার শ্রীনীলমাধবের গল্পকাহিনিতে স্কন্দ, ব্রহ্ম, সংহিতা, পদ্ম, নীলাদ্রি, প্রভৃতি পুরান শাস্ত্র সুদীর্ঘকাল মুখর।

তারপর আরও অনেক শতাব্দী অতিক্রান্ত হয়েছে। মধ্যযুগে এখানে আধ্যাত্মিক জগতের মধ্যমণি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু তাঁর স্বর্গীয় লীলার ইতিহাস গড়েছেন। সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক, এখানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছেন যুদ্ধ জয়ের প্রত্যাশায়। তার বিশ্বাস ছিল, জুনাগড় যুদ্ধাভিযানে যাওয়ার আগে মন্দির ভাঙলে পুণ্য সঞ্চয় হবে। আর সেই পুণ্যের জোরেই তিনি বিজয় লাভ করবেন।

সেই সময়ও পেরিয়েছে সাত শ বছর আগে। আরও পরে মন্দির ঘিরে আবর্তিত হয়েছে আরও অনেক ঘটনা। ইতিহাস ছড়িয়েছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। ভবিষ্যতে সেসব অবলম্বন করেই সৃষ্টি হয়েছে লোকজ কাহিনির সম্ভার। ভক্ত চিত্তের বিশ্বাসে, রহস্যের আবরণে এখন পান্ডাদের মুখে মুখে দর্শনার্থীরা সেগুলো শুনতে পান।

জগন্নাথধামের চারদিকে সীমানার মধ্যে ছোট ছোট ত্রিশটি মন্দির। বিপুল উৎসাহে গণেশ পান্ডা তাদের নাড়িনক্ষত্রের আদ্যন্ত ইতিহাস শোনাতে শোনাতে চলেছেন। সহসা দুই মন্দিরের বাঁকে এসে পুরুষ কণ্ঠের উঁচু আওয়াজ শুনে কৌতূহল নিয়ে থেমে পড়ল বহ্নি। দেখল, ডান পাশের প্রশস্ত জায়গায় শতরঞ্জি বিছিয়ে নানা বয়সের অনেকগুলো বিধবা বসে রয়েছেন। একজন প্রবীণ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পবিত্র শাস্ত্র পড়ে শোনাচ্ছেন তাঁদের।

গণেশজির মনোযোগ আকর্ষণ করতেই বললেন, এখানে শাস্ত্র শুনিয়ে বিধবা মা জননীদের পাপক্ষয় করা হচ্ছে। বৈধব্যের যন্ত্রণা তো আর কম নয়। একজন অমনোযোগী অল্প বয়সী বিধবা শাস্ত্র ছেড়ে সুচরিতদের সুগভীর আগ্রহে দেখছিল। পান্ডাজি দেখেই সতর্ক হলেন, চলুন, চলুন। ওদিকটায় চলুন। এসব জায়গায় দাঁড়াতে নেই। কেন গণেশজি? দাঁড়ানোর নিয়ম নেই মা। এ রকম শাস্ত্র পাঠ কি রোজই হয়? হ্যাঁ। এটাই পণ্ডিতজির চাকরি কিনা। রোজ পুজো আর ভোগ ছাড়া আর কী কী অনুষ্ঠান হয় এখানে? সন্ধেবেলা ফ্লাগ চেঞ্জিং অনুষ্ঠান হয়। পুরুত মশাই নিজেই সেটা করেন। আচ্ছা, ওদিকটায় চলুন, সব দেখলেই বুঝতে পারবেন।

মন্দিরের অনবদ্য স্থাপত্যশিল্প আর উচ্চতা যেন প্রথম চোখে পড়ল, এমনিভাবে ওরা ছাদের দিকে তাকাল। গণেশ পান্ডাও তাকালেন সুচরিতের মুখে। ওপরের গম্বুজ মিলিয়ে মন্দিরের উচ্চতা পঁয়তাল্লিশ তলা বিল্ডিংয়ের মতো। অথচ কোনো ইলেকট্রিক ল্যাডারের সাহায্য না নিয়ে পুরুত ঠাকুর ম্যানুয়ালি রোজ সন্ধেবেলা ওই ফ্লাগ বদলে দেন। বাপ রে! সে তো সাংঘাতিক রিস্কি ব্যাপার। কিন্তু এটাই ট্র্যাডিশন। শত শত বছর ধরে চলে আসছে। যদি একদিন এর ব্যতিক্রম হয়, তাহলে আঠারো বছরের জন্য মন্দিরের দরজা আপনাআপনি ভেতর থেকে বন্ধ হয়ে যাবে।

আশ্চর্য। হ্যাঁ, স্যার। তবে আশ্চর্য ব্যাপার আরও অনেক আছে। যেমন ধরুন, জিওগ্রাফিক্যাল নিয়ম অনুযায়ী পৃথিবীর সবখানে দিনের বেলা সাগর থেকে ভূমির দিকে বাতাস বয়ে যায়, আর সন্ধেবেলা ভূমি থেকে সাগরে। কিন্তু এখানে এর উল্টো। আবার অ্যানটেনার ওপরকার ওই চক্রটা, যার ওজন এক টন। পুরি শহরের যেকোনো কর্নার থেকেই চোখে পড়ে। কিন্তু অবাক ব্যাপার হলো যেখান থেকেই দেখুন, চক্রের সামনেটাই দেখতে পাবেন।

মন্দিরের স্ট্রাকচারে কোনো ইঞ্জিনিয়ারিং রহস্য রয়েছে নাকি? সুচরিতের মুখের ওপর জিজ্ঞাসার আকুতি ফুটল। জানি না। আরও একটা জিনিস, আজ অবধি ওখানে কোনো পাখি বসেনি। ওখানকার আকাশপথ দিয়েও কোনো বিমান উড়ে যেতে পারে না। আর আরও আশ্চর্য হলো, শ্রীক্ষেত্রের এই মন্দিরের কখনো ছায়া পড়ে না। বিজ্ঞান এর কোনো সায়েন্টিফিক ব্যাখ্যা এখন পর্যন্ত দিতে পারেনি। গণেশ পান্ডার কথাগুলো কেবল বিশ্বাস করা নয়, নিঃশব্দে মনে মনে গেঁথে নিচ্ছে বহ্নি। শুনতে শুনতে তার নিবেদিত অন্তর পুরোনো কথার উপসংহারে ঘুরেফিরে যাচ্ছিল বারবার। অস্ফুটে সে তাই বলেছে, বিজ্ঞান নিজেও জানে, জগৎ সম্পর্কে বিজ্ঞান এখনো অতি অল্পই জানে।

দর্শকের ভিড় উপচে পড়ছে চারদিকে। ছেলে–বুড়োর কলকাকলিতে চারপাশ মুখর। গড়ে রোজ এখানে কয়েক হাজার দর্শকের সমাগম হয়। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণির পূজারির সংখ্যা ছয় হাজারের মতো। রাঁধুনির সংখ্যা সাত শ। প্রতিদিন ছয়বার নির্দিষ্ট সময়ে ভোগ নিবেদনের প্রথা আজও এখানে শ্রদ্ধাভরে প্রতিপালিত। এখানে মধ্যাহ্ন ধূপের (মধ্যাহ্নভোজনের) রান্নার পদ্ধতি খুব ইউনিক। কাঠের উনুনে পরপর সাতটি মাটির হাঁড়ি একটার পর আরেকটা চাপিয়ে ডাল, ভাত ও বিভিন্ন ধরনের সবজির আইটেম একসঙ্গে বসিয়ে দেওয়া হয়। এই পদ্ধতিতে প্রতিবারই ব্যবহৃত হয় নতুন হাঁড়ি। প্রথমটা ছাড়া বাকিগুলো সরাসরি আগুনের স্পর্শ পায় না। ছয়টির রান্না হয় বাষ্পে। কিন্তু এই রান্না পদ্ধতির অব্যাখ্যাত রহস্য হলো, সবচেয়ে ওপরের পাত্রের রান্নাই সবার আগে শেষ হয় এবং সবশেষে হয় নিচেরটা।

দুপুরের রোদ তীব্র হচ্ছে। যদিও বাইরের মতো উষ্ণতা এখানে নেই। হালকা হাওয়ার পরশ সবখানে। মন্দির চত্বরে আরও অনেক দর্শনীয় স্থান দেখার পরে গণেশজি সুচরিতদের কিচেন এরিয়ায় নিয়ে এলেন। জমজমাট এলাহি কাণ্ড মুহূর্তেই চোখে পড়ল। গণেশজি খুব ভক্তিভরে বললেন, এই এরিয়ায় বাইরের কারোর আসার নিয়ম নেই। মহাপ্রসাদ রান্না হয় কিনা, তাই পবিত্র ধামের রাঁধুনিরাই কেবল প্রবেশ করতে পারেন। চলুন, এখানে বেশি সময় থাকা চলবে না।

বহ্নি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, আচ্ছা গণেশজি, এখানে রোজ একই সংখ্যায় দর্শনার্থীরা তো না–ও আসতে পারেন। তাহলে কী করে আপনারা রান্নার পরিমাপ বুঝতে পারেন? উত্তর দিতে গিয়ে মন্দিরের বিখ্যাত পান্ডা প্রথমেই হাত দুটি জড়ো করে কপালে ঠেকালেন। মুহূর্তেই বদলে গেল মুখের চেহারা। নিমগ্ন হয়ে বললেন, সেটাও আমাদের সবার কাছে এক বিরাট রহস্য মা। প্রসাদ একই নিয়মে, একই পরিমাণে রোজ রান্না হয়। অথচ মানুষের সংখ্যা যেমনই হোক, পঞ্চাশ হাজার হোক, কিংবা দুই লাখ, প্রসাদ কিন্তু কখনোই কম কিংবা বেশি হয় না।

কিছুক্ষণ হলো দুপুরের ভোগারতি শেষ হয়েছে। গণেশ পান্ডা মাঝারি আকারের একটি ঘরের মেঝেতে বসিয়ে ওদের প্রসাদ খেতে দিলেন। দুপুর সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে ঠাকুরকে ভোগ নিবেদনের পর সবাইকে প্রসাদ দেওয়ার নিয়ম। খেতে খেতে বহ্নি দেখতে পেল, বড় তৃপ্তিতে খাচ্ছে সুচরিত। সেটা ভক্তচিত্তের পরিতৃপ্তি নাকি আর কিছু, জানে না সে। খেতে খেতে একসময় মন্তব্য করল সুচরিত, বড় ভালো লাগল গণেশজি। মনে হচ্ছে, এই প্রসাদের স্বাদ বড় চেনা আমার। আর এই মন্দিরের সবকিছুই খুব পরিচিত। অথচ এবারই এখানে প্রথম আসা। প্রথম দেখা সবকিছু। জবাবে গণেশজি নরম মুখে নিঃশব্দে হাসলেন। যেন এটাই বলতে চাইলেন, এই অনন্ত বিশ্বে অনন্ত জীবনের কথা কেই–বা জানে, আর কেই বা কতটুকু বলতে পারে? (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: