অরোরার ঈদ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ফটো সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করবে কী করবে না, করলে কী হতে পারে, ভাবতে ভাবতে একটা ছবি পাঠিয়েই দিল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া অরোরা। রুপালি জগৎ তাকে খুব টানে। নাটক, সিনেমা, মডেলিং আর মানুষের সঙ্গে কাজ। সে আসলে পিপলস পারসন। ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনশিপ নিয়ে তাই ওর পড়াশোনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের বাড়াবাড়ি রকম আগ্রহ দেখে মনে হয়, এ জগৎটা ওরই হয়তো।

মাস কয়েক চলে গেল পড়াশোনা, গল্প, আড্ডা আর গান দিয়ে। তারপর একদিন ফোন এল। প্রাথমিক বাছাইয়ের পর তারা এসে ফটো তুলে যাবে ওই দিনই। বহু কষ্টে মাকে বলে রাজি করাল অরোরা। মানে প্রচণ্ড বকা খেয়েও কাঁদল না। যদি চেহারা খারাপ আসে। ফটো তোলার সময় অরোরার মনে হলো মেঘের ওপর ভাসছে। তারপর কয়েক পর্বে ছবি তোলা শেষ। কয়েক মাস পর হঠাৎ একদিন জানল সে ফার্স্ট হয়েছে।

আলোকিত জীবনের শুরু সেই থেকে। প্রথম বিজ্ঞাপনে নাচল ‘মহুয়া বনে দেখেছি তারে, এলো চুল ঘুঙুর বাঁধা পায়’ গানের সঙ্গে। দারুণ জনপ্রিয় হয়ে গেল একটা বিজ্ঞাপনেই। অরোরার নাম হয়ে গেল স্বপ্ন কন্যা। প্রথম নাটকে সাইন করল তখনকার জনপ্রিয় নায়ক পিয়াস ভাইয়ের সঙ্গে।

জীবনে প্রথম অভিনয় করবে। সংলাপগুলো পুরো মুখস্থ করে আয়নার সামনে হাজারবার প্র্যাকটিস করল। প্রথম শুটিং স্পট রাঙামাটিতে। মা সঙ্গে গেলেন। শুটিংয়ের আগে পিয়াস বাংলোতে এসে পরিচিত হলো তাদের সঙ্গে। এত সাধারণভাবে কথা বলল, মনে হলো তার ভার্সিটির বন্ধু।

পিয়াস তার দারুণ স্মার্ট কিন্তু মায়াভরা চোখে বলল, অরোরা, রূপকথার রাজকন্যা, দুনিয়ার সব রূপ তুমি চুরি করে বসে আছ। শুধু মনে রেখ যখন যে চরিত্র করবে, সে চরিত্র তখন জীবনকাহিনি হয় যেন তোমার। অভিনয় না, চরিত্রের সঙ্গে মিশে যাবে।

অরোরা অভিনয় করল। নৌকায় লেকে, পাহাড়ের চূড়ায় আর সমুদ্রের পাশে। অনেকগুলো দিন স্বপ্নের মতো চলে গেল। নাটক শেষ করে চলে যাওয়ার আগের দিন সারা রাত কাঁদল অরোরা। অনেকবার মনে হলো পিয়াসকে বলে, ‘আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচব না।’ কিন্তু বলা হলো না। তার সঙ্গী হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।

এরপর আরও কয়েকটা টেলিফিল্ম, সিনেমা আর নাটক করল অরোরা। একবার পুরস্কার নিতে গিয়ে দূর থেকে দেখা হলো পিয়াসের সঙ্গে। সব সময় সে সুন্দরী মেয়ে পরিবেষ্টিত। তাকে বলা হলো না তার কথামতো সব বিখ্যাত সিনেমা দেখার চেষ্টা করছে সে। সঙ্গে সময় পেলে অনলাইনে অভিনয় শিখছে, নাচ আর ফাইটিংয়ের ক্লাসও করছে। অরোরা পত্রিকা খুললেই দেখে মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর পিয়াসের সঙ্গে অনেকেই নিজেকে জড়িয়ে কথা বলছে। শুধু তার কাছাকাছি হলে ভালোবাসার ঝিকিমিকি রং দেখে অরোরা পিয়াসের চোখে। বোঝে এটা ওর বোঝার ভুল।

বহু ঝামেলা করে মাস্টার্স শেষ করল অরোরা। মা–বাবা বিয়ের জন্য অনেক চাপ দিলেন। কারণ তাদের বাসায় অনেক ঝামেলা হচ্ছে। তার ওপর বিভিন্ন জায়গায় শুটিংয়ে ওর মা বা বাবা থাকছেন। ছোট ভাইবোনের দেখাশোনার সমস্যা হচ্ছে। ইদানীং লোকাল শুটিংয়ে শুধু তার ম্যানেজার যায়। বহু মাস পিয়াসের সঙ্গে কোনো কাজ করেনি অরোরা। হঠাৎ কোরবানি ঈদের কিছুদিন আগে নাটকের শুটিংয়ের জন্য সুইডেন যেতে হবে জানল। কাজটা পিয়াসের সঙ্গে। বাসায় সবাই বেঁকে বসল। এর আগে কোনো ঈদেই কাজ করেনি অরোরা।

লেখিকা
লেখিকা



কিন্তু এ কাজটা অরোরা করবে। সবার অমতে। প্লেনে পিয়াসের পাশে বসে অরোরা স্ক্রিপ্ট দেখল। কাজটা নিয়ে আলাপ করল পুরোটা পথ। স্টকহোম পৌঁছে হোটেলে উঠল তারা। সেদিন রাত থেকেই কাজ শুরু হলো। একটু ভিন্নধর্মী ডিটেকটিভ ধাঁচের কাজ। পিয়াসের কাজ দেখে মুগ্ধতা আরও বাড়ল অরোরার। কোরবানি ঈদের চার দিন আগে একটা রাজবাড়ির মতো বাড়ির সামনে অরোরা হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার সময় কোত্থেকে মাঝপথে ধরে ফেলল ওকে পিয়াস। ব্যথায় চোখে পানি এসেছিল অরোরার। যত্ন করে মুছিয়ে দিল পিয়াস।

অনেক পর্বের কাজ শেষের পথে। হোটেলে ফিরে ফ্রেশ হয়ে পার্কে হাঁটতে গেল অরোরা একা। এই প্রথম কোনো ঈদে আগে মেহেদি, নাচ, গান আর বাবা-মা আর ভাইবোনের কথা মনে করে পার্কে খুব কাঁদল অরোরা। দুই দিন পরই কোরবানির ঈদ। এবারের ঈদ একদম একা করবে সে।

অরোরা পার্ক থেকে হোটেলে ফিরে দেখল তার রুমের সামনে পিয়াস। অরোরাকে দেখেই বকা দিল, কই হাওয়া হয়ে যাও অরোরা? দেশে যাওয়ার টিকিট করেছি, এক্ষুনি রওনা হতে হবে। অরোরা নিজেকে গোপনে চিমটি দিয়ে দেখল ও স্বপ্ন দেখছে না। কিন্তু শুটিং? প্রযোজক প্রচণ্ড বিরক্ত মুখে বললেন, পিয়াস সাহেব নিয়ে আসবেন আপনাকে ঈদের পরে। দুঃখ নিয়ে অভিনয় করলে নাকি হিট হবে না এ সিরিজ।

সবার টুকটাক শপিংগুলো গুছিয়ে আর নিজের জিনিস নিয়ে এত তাড়াতাড়ি অরোরা এর আগে কখনো রেডি হয়নি।

দ্রুতই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল ওরা। প্লেনে বসল পাশাপাশি। মাঝ আকাশে পিয়াস বলে বসল, ‘অরোরা, তুমি তো অনেক নামকরা অভিনেত্রী। তবু তোমার চোখে আমি ভালোবাসার সাত রং দেখি কেন?’ অরোরা চমকে পিয়াসের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘মানে?’ ‘মানে তোমার চোখে তাকিয়ে আমি আমার বউকে দেখি, বাচ্চার মাকে দেখি, আমি কেন একজন অভিনেত্রীকে দেখি না? অরোরা আমি তোমাকে ভালোবাসি। যদি ভুল হয়ে থাকে আমার অবজারভেশন তবে কলিগ হয়েই...। অরোরা তাকাল ভিভিড লিকুইড চোখে, বলল, ‘ভালোবাসি পিয়াস। পুরোটা পথ হাত ধরে থাকল ওরা।’

কোরবানি ঈদের আগের দিন আকদ হয়ে গেল বাংলাদেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় জুটির। ঈদের দিন দুটি চ্যানেলের লাইভ ইন্টারভিউতে ওরা এল। স্বামী-স্ত্রী হিসেবে। বহু ভক্তকে কাঁদিয়ে বা হাসিয়ে ঘোষণা দিল নতুন জীবনের। ওদের দুই বাসাতেই ঈদের দিন তুমুল ব্যস্ততা। কোরবানির পরপর লোক শুধু আসছেই শুভেচ্ছা জানাতে।

সবার জীবনে ঈদ বয়ে আনুক অফুরন্ত সুখ, আনন্দ আর সফলতা।