বানভাসি মানুষের দুর্দশার কথা

ক্যানটিনে বাক্সে সুসজ্জিত কেক
ক্যানটিনে বাক্সে সুসজ্জিত কেক

চর এলাকা হওয়ায় প্রতিবছরই আমাদের গ্রামের বাড়িতে বন্যা হয়। পার্থক্য হচ্ছে কখনো শুধু নিচু জায়গাগুলো প্লাবিত হয়, আবার কখনো একেবারে সব প্লাবিত হয়ে চৌকির কিনারা পর্যন্ত ডুবে যায়। আমাদের আশপাশের সব কটি গ্রামের মধ্য দিয়েই একসময় প্রমত্তা পদ্মা নদীর প্রবাহ ছিল।

নদী একটা নির্দিষ্ট সময় পরপর গতিপথ পরিবর্তন করে। যার ফলে একপাশে নদীতে ভাঙন দেখা দেয় আর অন্য পাশে চর জেগে ওঠে। আমাদের গ্রামগুলো প্রকৃতির খেয়ালে ঠিক সেভাবেই তৈরি। আর নামকরণগুলো হচ্ছে চরভবানীপুর, চরঘোষপুর, চররঘুনাথপুর। সোজা কথায়, সব কটি গ্রামের নামকরণের শুরুতেই ‘চর’ শব্দটি আছে। ছোটবেলায় আমরা বুঝতাম না কেন আমাদের গ্রামের নাম চরভবানীপুর। বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সত্যটা উপলব্ধি করতে পেরেছি।

১৯৮৮ সালের বন্যা আমাদের রাতারাতি পথে বসিয়েছিল। অবশ্য নদীর পাড়ের মানুষের ভাগ্য সব সময়ই নদীর সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নদীভাঙনের শিকার হয়ে মানুষ রাতারাতি পথের ফকির হয়ে যায়। ঢাকা শহরে যত উদ্বাস্তু মানুষ আছে, তাদের অধিকাংশই নদীভাঙনের শিকার হয়ে সব হারিয়ে ঢাকার রাস্তায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। সেবারের বন্যাও আমাদের সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেল। গবাদিপশুগুলোকে বাড়ির সামনের রাস্তায় নিয়ে রাখা হলো। অবশ্য রাস্তা বলতে সেগুলো ছিল রাস্তার দুপাশের মাটি কেটে একটু উঁচু করে বাঁধ দেওয়া। আর মাটির অধিকাংশই ছিল বালু। তাই সেগুলোকে বালির বাঁধ বলাই উত্তম।

চৌকির তলায় কয়েকটা ইট দিয়ে চৌকিগুলোকে উঁচু করে সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। রান্নাঘরের একটা অংশে উঁচু বাঁশের মাচার ওপর গরুর গোবরের শুকনা ঘুটো রাখা হতো। তাই সেগুলো ভেজার হাত থেকে রক্ষা পেয়ে গিয়েছিল। কিন্তু চাল বা এ রকম নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীগুলো কোনোভাবেই আর ব্যবহার করা যাচ্ছিল না।

তখন গ্রামে ধান সেদ্ধ করে শুকিয়ে সেটা ঢেঁকি দিয়ে চাল বানিয়ে রান্না করা হতো। তাই চালের সংকট দেখা দিল। দোকানে লবণ-তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকল। শিশু বলতে আমাদের পরিবারের তখন আমরা তিন ভাই। আমার বয়স তখন আট বছর। মেজো ভাইটার ছয় আর ছোটটা তখন সবে হাঁটতে শিখেছে। আমাদের দুজনকে কোনো কিছু করতে নিষেধ করলে আমরা সেটা করি না। কিন্তু ছোটজন হামাগুড়ি দিয়ে বা আলতো পায়ে ঠিকই চৌকি থেকে নেমে যায়। আর চৌকির বাইরেই থই থই পানি। তাই মা সারাক্ষণই ওকে কাছে রেখে দেন।

খাবার ও খাবার পানির অভাব প্রকট আকার ধারণ করেছে। চারদিকে কলেরা মহামারির আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। আমাদের বাড়িতে শুরুতে ফিটকিরি দিয়ে খাবার পানি পরিশুদ্ধ করা হলো। পরে সেটা শেষ হয়ে গেলে পানি চুলায় জ্বাল দিয়ে পরিশুদ্ধ করে পান করা হচ্ছে। চালের অভাব দেখা দিয়েছে।

এমন সময় মাঝেমধ্যেই শোনা যেত, কারা যেন রিলিফ নিয়ে এসেছে। তখন অনেকে কলার ভেলা বেয়ে সেখান থেকে রিলিফ নিয়ে আসেন। কখনো দুই-তিন কেজি চাল আবার কখনো এক কেজি ডাল এভাবে পাওয়া যায়। যেগুলো দিয়ে ছোটদের ক্ষুধা নিবারণ হয়। কিন্তু বড়রা কোনো দিন খেতে পান, আবার কোনো দিন পান না। এরই মধ্যে একদিন খবর এল হরিপুরের বোর্ডঘরের সামনে নাকি আর্মি রিলিফ ক্যাম্প খুলেছে। সেখানে বন্যার্তদের রিলিফ দেওয়া হচ্ছে।

আমাদের বাড়িতে সবাই মোটামুটি বিভিন্ন কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তাই দাদি সাব্যস্ত করলেন তিনি আমাকে নিয়ে রিলিফ আনতে যাবেন। সেই প্রথম দাদিকে দেখলাম কারও কাছে হাত পাততে। দাদি আমাদের পাড়ার মাতব্বর আব্বাস আলী মণ্ডলের বড় মেয়ে। আব্বাস আলী মণ্ডল যুবকদের কাছে মোটামুটি ত্রাস। রাস্তার ধারের মুদি দোকানগুলোর পাশে গ্রামের যুবকেরা প্রায়ই তাসের আড্ডায় বসাতেন। হঠাৎ সেখানে আব্বাস আলী মণ্ডল এলে যুবকেরা তাস লুকিয়ে এমন একটা ভাব ধরতেন যেন এইমাত্র তাঁরা সেখানে এসেছেন।

আমরা ছোটরা আব্বাস আলী মণ্ডলের কাছে বড়দের এই অসহায়ত্বটাকে কেন জানি খুবই উপভোগ করতাম। হয়তোবা আমাদের বিনা কারণে শাস্তি দেওয়ার কারণে আমরা তাদের ওপর বিরক্ত ছিলাম। তাই যখন দেখতাম তাদেরও শাসন করার কেউ আছে, তখন স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে আনন্দ খেলা করত।

আমার দাদি সেই আব্বাস আলী মণ্ডলের বড় মেয়ে। তাই স্বাভাবিকভাবেই তাঁর মধ্যে একধরনের অহংকার কাজ করত। বাস্তবে তার প্রতিফলনও দেখেছি অনেকবার। কারও কোনো কথায় শোনার পাত্র তিনি ছিলেন না। ছেলে বা ছেলের বউ, সবারই ওপরেই ছিল তাঁর একক কর্তৃত্ব। অন্যরা শুধু সংসারের উপকরণ ছিল মাত্র। কিন্তু সিদ্ধান্ত তিনি একাই নিতেন। আমাদের সেই দাদি যখন সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি রিলিফ আনতে যাবেন, তখন সবাই খুবই অবাক হলো। তিনি বোধ হয় সবার মনের কথা বুঝতে পেরেছিলেন। তাই একদিন সবাইকে ডেকে নিয়ে বললেন, ‘আমরা বড়রা না খেয়ে থাকতে পারব। কিন্তু আমার নাতি তিনটা খাবারের কষ্ট করবে আমি বেঁচে থাকতে, সেটা হতে দেব না।’ শুনে সবাই ঘাড় নাড়লেন। কারণ সবাই জানেন, আমরা তিন ভাই আমাদের দাদির প্রাণপাখি।

দাদি বললেন, ‘আমি রিলিফ আনতে যাব, কিন্তু কারও কাছ থেকে তো কখনো কোনো কিছু চাওয়ার অভ্যাস নেই। তাই ইয়াকুবকে দিয়ে একটা চিঠি লিখিয়ে নিয়ে যাব। যাঁরা রিলিফ দেবেন, তাঁদের হাতে সেটা দিয়ে দিলে নিশ্চয় তাঁরা বুঝবেন আমরা কষ্টের মধ্যে আছি।’ সেদিন দুপুরের কথা এখনো আমার চোখে ভাসে। আমি জীবনের প্রথম পত্র লিখছি। তখন আমি তৃতীয় শ্রেণিতে পড়ি। দাদি বলে চলেছেন। ঠিক কার বরাবর লেখা হয়েছিল, সেটা আমার মনে নেই। দাদি আমাদের সংসারের সামগ্রিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে গেলেন আর আমি আমার কাঁচা হাতে সেগুলো লিখে গেলাম।

পোস্টার
পোস্টার

একটা লাইন এখনো আমার মনে আছে। সেটা হলো তিনি লিখতে বলছেন, ‘আমাদের একটি ছোট ভাই আছে, তার জন্য যেন এক কৌটা পাউডার দুধ দেওয়া হয়।’ আমার হাতের লেখা বরাবরই অনেক বড় আকৃতির। তাই সামান্য কয়েক লাইন লিখতেই বাংলা খাতার পাতাটা ভরে গেল। দাদি সেটা সযত্নে ভাঁজ করে বালিশের তলায় রেখে দিলেন। হরিপুর যাওয়ার দিন তাঁর আঁচলে বেঁধে নিলেন যাতে কোনোভাবেই হারিয়ে না যায়। একেবারে শেষ মুহূর্তে এসে ছোট ফুফু আমাদের সঙ্গে যেতে চাইলেন। তাঁদের সংসারে সব সময়ই একটু টানাটানি লেগে থাকে। দাদি তাঁদের প্রায়ই সাহায্য করতেন।

চরভবানীপুর একটা অজগ্রাম হলেও আমরা ছিলাম সবদিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আমাদের একটা পাড়ায় বাস করত জেলেরা। গ্রামের এক প্রান্তে বাস করতেন একজন কামার। অন্য প্রান্তে বাস করতেন একজন নরসুন্দর। গ্রামে ছিল আরেকজন। তার কাজ ছিল সারা মৌসুম মানুষের খেত পাহারা দেওয়া। তারপর মৌসুম শেষ হলে তিনি বাড়ি বাড়ি গিয়ে শস্য নিতেন খেতের পরিমাণ হিসাবে। এটাই ছিল তার মজুরি। কারও গরু বা ছাগল যদি অন্য কারও খেতে গিয়ে ঢুকে পড়ত, তাহলে সেগুলো খোঁয়াড়ে দেওয়া হতো। তারপর সেই পশুর মালিককে জরিমানার টাকা দিয়ে সেটাকে ছাড়িয়ে আনতে হতো। গরু ও ছাগলে আলাদা জরিমানা নির্ধারণ করা ছিল। আত্মীয়তা করার সময় কখনো জাতপাতের ভেদাভেদ দেখিনি। আমার ছোট ফুফা ছিলেন জেলে সম্প্রদায়ের মানুষ। আর যিনি নরসুন্দর ছিলেন, তিনি আমাদের দূরসম্পর্কের ফুফা হতেন। এভাবেই একসময় গ্রামবাংলায় মানুষ মিলেমিশে বসবাস করত।

চরভবানীপুর কুষ্টিয়া সদর উপজেলার অন্তর্ভুক্ত হলেও আমাদের প্রাত্যহিক সব কাজকর্ম ছিল পাবনাকেন্দ্রিক। কারণ, কুষ্টিয়া গিয়ে ফিরে আসতে দুদিন লেগে যায়। কুষ্টিয়া সদরে যেতে দুটি নদী পার হতে হয়। প্রথমেই প্রমত্তা পদ্মা নদী। সেটা পার হলে আমাদের হরিপুর। অবশ্য সেটাকে বলা হয় হাটহরিপুর। এমন নামকরণের কারণ এখনো জানি না। হরিপুর হেঁটে পার হওয়ার পর পদ্মার শাখা গড়াই নদী। পদ্মা নদীতে দিনের একটা নির্দিষ্ট সময়ে খেয়া পারাপার করা হতো। একটাই মাত্র নৌকা। সেটা অন্য পাড়ে গেলে অপর পাড়ের লোকেদের ঘাটে বসে অপেক্ষা করা ছাড়া গত্যন্তর থাকত না। বিশেষ করে বর্ষাকালে নদী পানিতে ভরে উঠলে অবস্থা খুবই ভয়াবহ রূপ নেয়। সারা দিনে হয়তো বা একবারই নদী পার করা হয়। আবার সেটাও মাঝেমধ্যে বন্ধ হয়ে যায় নদীর পানির গতি-প্রকৃতি বুঝে।

যা হোক, দাদি আমাকে সঙ্গে নিয়ে হরিপুরে রওনা হলেন। নদীর পাড়ের উঁচু কিছু জায়গা তখনো পানিতে তলিয়ে যায়নি। সেখান থেকে নৌকা ছাড়া হলো। পালের নৌকা। তখনো ইঞ্জিনের নৌকার চল তেমন শুরু হয়নি। বাতাসের গতিবিধি বুঝে নৌকা চালাতে হয়। কারণ, ঢেউয়ের তোড়ে নৌকা কোন দিকে যাবে, তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই। সেবার পরিস্থিতি ছিল আরও ভয়ংকর। একসময় নৌকা অপর পাড়ে পৌঁছাল।

হরিপুর বোর্ডঘরের সামনের মাঠে তিল ধারণের জায়গা নেই। তার মধ্যেই ছোট ছোট বাঁশের খুঁটি পুঁতে তার মাথায় পাটের সুতলি টানিয়ে লোকজনকে সার ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে। দাদি আমাকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে গেলেন। লাইনে দাঁড়ানোর পর সময়ের চাকা থেমে গেল। আমি ছোট মানুষ, বেশিক্ষণ এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকার অভ্যাস নেই। কিন্তু সেখানে করারও তেমন কিছু নেই। একটু পরপর সেনাসদস্যরা সজোরে বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে সতর্ক করে দিচ্ছেন। সেই প্রথম ওই রকম বাঁশির আওয়াজ শুনলাম। আওয়াজটা কেমন যেন হৃদয়ে কাঁপন ধরিয়ে দেওয়া মতো।

প্রায় অর্ধেক দিন অপেক্ষার পর আমরা লাইনের সামনে এসে পৌঁছালাম। দাদি তাঁর আঁচল থেকে আমার লেখা চিঠিটা আমার হাতে দিয়ে সামনে বসা সেনাসদস্যকে দিতে বললেন। আমি চিঠিটা কোনোমতে তাঁর হাতে দেওয়ার পর দাদি বোরকার আড়াল থেকে যত দ্রুত সম্ভব ব্যাপারটা বর্ণনা করলেন। তখন তাঁরা বললেন, ‘সবই ঠিক আছে চাচি, কিন্তু আমরা আসলে উপস্থিতি দেখে সাহায্য দিচ্ছি।’

তখন দাদি আমাদের পেছনেই দাঁড়ানো ছোট ফুফুকে দেখিয়ে তাঁকে একটা শাড়ি দিতে বললেন। সেনারা আমাদের একটা চালের পোঁটলা, একটা ডালের পোঁটলা আর ছোট ফুফুর জন্য একটা শাড়ি দিয়ে বিদায় করলেন। আমার মস্তিষ্ক এখনো অনেক স্মৃতি ধরে রেখেছে। তার মধ্যে এই স্মৃতি জ্বলজ্বলে। আমার মনে হয় এটা যেন গতকালের ঘটনা। ১৯৮৮ সালের বন্যা ও রিলিফের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য এখনো আমি চোখ বন্ধ করলে দেখতে পাই। এরপর থেকে যখনই আমার কাছে কেউ বন্যার্তদের জন্য সাহায্য চেয়েছে, আমি আমার সাধ্যের চেয়েও বেশি এগিয়ে আসার চেষ্টা করি। কারণ, বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ আমার নিজের চোখের দেখা।

২০১৭ সালের বন্যার সময় তাই যখন দেশ থেকে সাহায্য চাওয়া হলো, তখন নিজেদের কমিউনিটিতে প্রথম আমরা চেষ্টা করলাম কিছু তহবিল সংগ্রহের। ফয়সাল খালিদ শুভ ভাইয়ের চেষ্টায় আমরা বেশ বড় অঙ্কের একটা তহবিল সংগ্রহ করে কুড়িগ্রামের উলিপুর সমিতির মাধ্যমে বন্যার্তদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম।

পোস্টার
পোস্টার

এরপর যখন আরও সাহায্যের দরকার হলো, তখন মনে হলো আমি আমার অফিসের সহকর্মীদের কাছ থেকে একটা তহবিল সংগ্রহ করতে পারি। সেটাই আলাপ করলাম সহকর্মী মাইকেল মিকেলপের সঙ্গে। যার ডাকনাম মিক। তিনি বললেন, ‘আমরা তো প্রায়ই এমন সাহায্য–সহযোগিতা করে থাকি। তুমি কোম্পানির পরিচালকদের সঙ্গে আলাপ করো। তাঁরাই ব্যবস্থা করবেন।’ আমি তাঁদের ব্যাপারটা জানাতেই তাঁরা সানন্দে রাজি হলেন। আমাদের অ্যাডমিনের টিনা ফেলপস, যাঁকে আমরা টিনা বলেই ডাকি, তিনি আমার কাছে বাংলাদেশের বন্যার কিছু ছবি চাইলেন। যেগুলো দিয়ে তিনি পোস্টার বানাবেন। এরপর একটা নির্দিষ্ট দিনে একটা কাপকেক ডে পালন করা হলো অত্যন্ত সুন্দর ও সুস্বাদু কেক দিয়ে। প্রতিটা কেকের মূল্য রাখা হয়েছিল পাঁচ ডলার। সংগৃহীত ডলারের সঙ্গে পরিচালক দুজন আরও কিছু অর্থ যোগ করে সেটাকে মোটামুটি একটা বড় পরিমাণে উন্নীত করলেন।

এবারের বন্যার ভয়াবহতা ২০১৭ সালের থেকেও বেশি। কিন্তু দেশে এখন এত ইস্যু যে বন্যার ভয়াবহতা কোনোভাবেই সাধারণ মানুষের দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। এর পাশাপাশি ডেঙ্গু মহামারির আকার নিয়েছে। সেই ডেঙ্গুর মশা তাড়াতে গিয়ে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে চিত্রতারকা সবাই হাসির পাত্রে পরিণত হয়েছেন। এগুলোই এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষয়। এর মধ্যে কে আর ম্যাড়মেড়ে বন্যার কথা বলে নিজেকে খ্যাত প্রমাণ করার ঝুঁকি নেবে। কিন্তু আমি বন্যার যতটুকু আপডেট পাচ্ছিলাম দেশীয় ও বিদেশি সংবাদমাধ্যম থেকে, সেটা দেখে সহজেই যেকেউ অনুমান করতে পারবেন, এবারের ভয়াবহতা অনেক আগেই ২০১৭ সালের বন্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।

যা হোক, এবারও যখন বন্যার্তদের জন্য সাহায্যের আবেদন করা হলো, তখন ভাবলাম আগেরবারের মতো একটা কাপকেক ডে করলে কেমন হয়। সেই মোতাবেক পরিচালক দুজনের সঙ্গে আলাপ করলাম। ইতিমধ্যে টিনার জায়গায় নতুন একজন নারী কাজ করা শুরু করে দিয়েছেন। এক মাস আগে টিনা কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন। আমি মনে করেছিলাম, নতুন নারী অ্যাডমিন হয়তোবা ব্যাপারটা বুঝবেন না। কিন্তু তিনি আমার পাঠানো খবর ও ভিডিও ক্লিপ দেখে খুবই সুন্দর একটা পোস্টার বানিয়ে আমাদের তিনতলা অফিস ভবনের সব তলার ক্যানটিনের ফ্রিজের সঙ্গে টাঙিয়ে দিলেন। লিফটের মধ্যে ও লিফটের বাইরেও দেয়ালের গায়ে টাঙিয়ে দিলেন। এ ছাড়া ই–মেইল দিয়ে সবাইকে কাপকেক ডের স্থান ও সময় জানিয়ে দেওয়া হলো।

এবারেও নির্দিষ্ট দিনে প্রতি তলার ক্যানটিনে একটা করে বাক্সে সুসজ্জিত কেক রেখে দেওয়া হলো। তারপর সবাই অনেক উৎসাহ নিয়ে কেক কিনলেন। প্রতিটা কাপকেকের দাম রাখা হয়েছিল মাত্র পাঁচ ডলার। সবাই তাঁদের সাধ্যমতো অংশগ্রহণ করলেন। তারপর পরিচালক দুজন সংগৃহীত তহবিলের সঙ্গে আরও কিছু অর্থ যোগ করে সেটাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দিলেন। এই অর্থ হয়তো সামগ্রিক বন্যাকবলিত মানুষের ভয়াবহতার তুলনায় কিছুই না; তবুও যদি সামান্য কাজে আসে, সেটাইবা কম কী? আর আমাকে যে বিষয়টা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে, সেটা হলো এই যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবসৃষ্ট জরুরি পরিস্থিতি, এগুলো আমাকে আবারও মানুষের ওপর বিশ্বাস স্থাপন করতে উৎসাহিত করে। বিশ্বের যে প্রান্তেই হোক না কেন, যদি সেই বিপদের কথা অন্য প্রান্তের মানুষ জানতে পারে, তাহলে তারা জাতি–ধর্ম–বর্ণনির্বিশেষে মানুষের বিপদে এগিয়ে আসে। তখন আবারও নতুন করে মানবতাবোধের উপলব্ধিটা জাগরুক হয় মনের মধ্যে। ফকির লালন শাহের ভাষায় তখন বলতে ইচ্ছে করে—

‘মানুষ ভজলে সোনার মানুষ হবি
মানুষ ছাড়া ক্ষ্যাপারে তুই
মূল হারাবি...।’