আদিবাসী অধ্যুষিত শিল্পসমৃদ্ধ গ্রাম রঘুরাজপুর

রঘুরাজপুর গ্রামের একটি শিল্পকর্ম
রঘুরাজপুর গ্রামের একটি শিল্পকর্ম

রঘুরাজপুর আদিবাসী অধ্যুষিত এক শিল্পসমৃদ্ধ গ্রাম। মহানন্দার কন্যা ভার্গবী নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত। দূর থেকেই আম, জাম, তাল, কাঁঠাল, নারকেলগাছের সবুজ সৌন্দর্য চোখে পড়ে।

এখানে সর্বমোট ১২০টি পরিবারের বাস। প্রতি বাড়িতেই দু-একজন করে চিত্রকর রয়েছেন। বাঁশ, বেত, ঘাস, তালপাতা, সামুদ্রিক শেল, শুকনো গোবর, কাপড়, কাঠ, পাথরসহ নানান প্রাকৃতিক জিনিস ব্যবহার করে, যাঁরা অসাধারণ সব শিল্পসামগ্রী প্রস্তুত করতে সক্ষম।

ভুবনেশ্বর থেকে মাত্র ৫৫ কিলোমিটার দূরে থাকা সত্ত্বেও এখানকার শিল্প ঐতিহ্যে আধুনিক যুগ সভ্যতার কোনো প্রভাব পড়েনি। কারণ রঘুরাজপুরের শিল্পীরা শিল্প-সংস্কৃতিতে ধারণ করে রয়েছেন প্রাচীন ওডিশার আদি অকৃত্রিম ঐতিহ্যকে।

২০০০ সালে ‘Indian National Trust For Art and Cultural Heritage’ প্রথমবার এই শিল্প এবং তার ঐতিহ্যকে বাইরের জগতে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। একই সঙ্গে নজর দেয় গাঁয়ের সার্বিক উন্নয়ন প্রকল্পের দিকে।

বিশ্বখ্যাত নৃত্যশিল্পী কেলুচরণ মহাপাত্রের জন্মভূমি রঘুরাজপুর শিল্পগৌরবের খ্যাতিতে আন্তর্জাতিক দুনিয়ার নজর কেড়েছে আজ। ইদানীং তাই শিক্ষালাভের জন্য দুই-চারজন বিদেশি শিক্ষার্থীর আগমন চোখে পড়ে। এ সম্বন্ধে একদিন ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিনে একটি ছোট্ট লেখা পড়ে বিস্তারিত জানতে আগ্রহী হয়েছিল বহ্নি। সুচরিতরা হোটেল সি প্যালেস থেকে তাই সাতসকালে সেই গাঁয়ের দিকেই যাচ্ছে।

রঘুরাজপুর গ্রামের একটি শিল্পকর্ম
রঘুরাজপুর গ্রামের একটি শিল্পকর্ম

কাল গভীর রাতে সম্ভবত একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল। ভোরের নরম আলোয় চারপাশ ভিজে ভিজে। বহ্নির হঠাৎ চোখে পড়ল, বহু দূরে পাহাড় উপত্যকার মাথা ছুঁয়ে স্ফটিক স্বচ্ছ চেহারা নিয়ে দিগন্তজোড়া রংধনু তার অস্তিত্ব ঘোষণা করছে। সুচরিতের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেই সুরেশ বলল, ‘ওহো, ওটা তো ইন্দ্রধনু দিদি! আকাশের দেবতা ইন্দ্রের অস্ত্র। আপনারা বুঝি একে রংধনু বলেন?’

বহ্নি বুঝল, ড্রাইভিং সিটে বসে থাকলেও সুরেশের কান জোড়া পেছনের দিকেই ফোকাস করা রয়েছে। কদিন ধরে সুযোগ পেলেই দ্বিধাহীন হয়ে সে নিজের উপস্থিতি বেশ সাহসী আন্তরিকতায় জানান দেয়। বহ্নি হেসে বলল, হ্যাঁ ভাই। তবে আজ তোমার কাছ থেকে নতুন নামও জানা গেল, ইন্দ্রধনু। আমিও জানলাম দিদি।

আচ্ছা দাদা, আপনি কি আজ দাদা-বৌদির হোটেলে খেতে চান? ওখানে সব রকম বাঙালি খাবার পাওয়া যায়। সেটা কোথায়? সুচরিত আগ্রহ নিয়ে নড়েচড়ে বসল। আপনাদের হোটেলের কাছেই। ওখান থেকে বড়জোর তিন মাইলের মতো হবে। আচ্ছা ঠিক আছে। আজ তাহলে রঘুরাজপুর থেকে ফিরে ওখানেই খাওয়া যাবে।

হাইওয়ে ধরে অনেক সময় ছুটতে ছুটতে পিপলি ছাড়িয়ে গাড়ি বাঁক নিল ডানদিকে। এদিকটায় যানবাহনের ভিড় নেই। বাইসাইকেল চালিয়ে কেউ কেউ দূরের যাত্রায় বেরিয়েছে। দূরে একটি সরু নদী বয়ে চলেছে কোনোমতে। ওটাই সম্ভবত ভার্গবী নদী। তার ঢালু পাড় থেকে ডালপালাসুদ্ধ একটি মস্ত গাছের ডাল কাঁধে নিয়ে ওপরে উঠে আসছে কয়েকজন সুঠামদেহী আদিবাসী তরুণী। অচেনা ভাষায় গান গাইছে তারা। শুনেই বোঁদা নারীদের কথা মনে পড়ে গেল বহ্নির।

সুরেশ তার কৌতূহল লক্ষ করে বলল, ওরা সবাই ভূমিজ সম্প্রদায়ের মানুষ। করম উৎসব শুরু হয়েছে কিনা, তাই পুজোর আয়োজন করছে। এই পুজোয় করম দেবতা আর করমসানি দেবীর স্তুতিগান গাইতে হয়। ও আচ্ছা! এই উৎসব বুঝি ভাদ্র মাসে হয়? না দিদি। কোথাও ভাদ্রের গোড়ায় শুরু হয়, কেউ কেউ আবার আশ্বিন মাসেও করে। কেন করা হয় এই উৎসব? করম দেবতা পুজো পেয়ে খুশি হলে ফসল ভালো হয়। মানুষের সুখশান্তি বাড়ে। কিন্তু গাছের ডাল দিয়ে কী হয়? ওটাই তো করম দেবতার গাছ। ওই গাছ গাঁয়ের একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ওরা পুঁতবে। গোবরের প্লাস্টার দিয়ে শুকিয়ে ফুল আর মালা দিয়ে খুব করে সাজাবে। তারপর পুজো করবে। মেয়েরা নাচবে। ছেলেরা নাকাড়া বাজাবে। মহাধুমধামে অনুষ্ঠান হবে।

রঘুরাজপুর গ্রামের একটি শিল্পকর্ম
রঘুরাজপুর গ্রামের একটি শিল্পকর্ম

বহ্নি বলল, সে অনুষ্ঠান দেখা যাবে? আপনাদের তো সময় হবে না দিদি। কালই তো ফিরে যাচ্ছেন। তা ঠিক। জানো তো সুরেশ, খ্রিষ্টানরাও ওদের ক্রিসমাস ট্রিকে এভাবে সাজিয়েই বড়দিনের উৎসব পালন করে। ওই ক্রিসমাস ট্রি হলো ওদের পবিত্র দেবতা। কিন্তু গোবরের প্লাস্টার তাতে দেয় না। সুচরিত এতক্ষণে মন্তব্য করল। না তা দেয় না। কারণ গোবরের উপকারী দিকগুলো ভারতবর্ষের মানুষই কেবল জানে।

রঘুরাজপুরে প্রবেশের মুখেই একটি হলুদ রঙের সাইনবোর্ড চোখে পড়ল, Craftsman Village, Raghurajpur. সুরেশ কয়েকজনকে সামনে উপস্থিত হতে দেখে মন্তব্য করল, এরা সবাই চাইছে, ওদের কাছ থেকে কিছু কেনা হোক। অনেক ভিজিটর এখানে কেবল দেখতেই আসেন, কিছু কেনেন না! সে জন্যই...। কিছু সময় থেমে থেকে ফের বলল, ওদের পেট তো এই কাজেই চলে। বিক্রিবাট্টা না হলে খাবে কী? তুমি কি এর আগে এখানে এসেছ? হ্যাঁ, দিদি। গেল বছর একবার এসেছিলাম, তখনই ওদের মুখে শুনেছি সব। সরকারও উন্নয়নের কথা কেবল মুখেই বলে। জানেন তো, এখনো গাঁয়ে স্যানিটারির সুবিধে নেই। বাইরের ভিজিটরদের থাকা-খাওয়ার জন্য কোনো হোটেল, রেস্টুরেন্টের ব্যবস্থা নেই। এমন অবস্থায় কিছু হয় বলুন?

ট্যাক্সি থেকে নেমে কয়েক হাত যেতে ডানদিকে চোখে পড়ল মাটির দেয়াল দেওয়া চায়ের দোকান। কাছেই খোলা আকাশের নিচে ক্যারাম বোর্ড খেলায় ব্যস্ত কয়েকটি কিশোর। তার পাশে রাস্তার দুটি কুকুর বসে বসে ঝিঁমুচ্ছে। ওপরে এক ঝাড় হেলে পড়া বাঁশ। তাদের মাথায় গুটিকয়েক শালিক ঝগড়া বাধিয়েছে তুমুল চিৎকারে। পাশের কুয়ো থেকে জল তুলছে দুই কিশোরী। গ্রাম সীমানার মাঝখানে ছোট ছোট কয়েকটি মন্দির চোখে পড়ল। একটির সামনে এসে প্রণাম শেষ করে ভক্তিভরে সুরেশ বলল, এটি রঘুনাথজির মন্দির দাদা। আর ওটা? অদূরের মন্দিরটি হাত দিয়ে দেখাল সুচরিত। ওটা গাঁয়ের দেবী, বাসুনীর। বাসুনী স্থানীয় মানুষদের নিজস্ব দেবী। আর একটু সামনে এগোলেই স্টুডিও দেখতে পাবেন। কিসের স্টুডিও? ওই তো, যেখানে ভিজিটরদের দেখার জন্য, বেচাকেনার জন্য জিনিসপত্র সাজিয়ে রাখা হয়। আগে এতসব কিছু ছিল না। এখন এখানে সরকারের ট্যুরিজম সংস্থাগুলোর জমজমাট অবস্থান বেড়ে যাচ্ছে।

কিন্তু তুমি যে তখন বললে, বেচাকেনা তেমন একটা হয় না? যেটুকু হয় দাদা, তার সবটা এখানকার শিল্পীদের হাতে যায় না। ওই মিডলম্যানদের পকেটেই অনেকটা চলে যায়।

মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য দরিদ্র দেশগুলোয় সাধারণ জনজীবনে কত বড় মাপের বিশৃঙ্খলা ঘটাতে সক্ষম, সে সম্পর্কে ভাবতে ভাবতেই গ্রামের ভেতরে প্রবেশ করল সুচরিতরা। প্রতিটি বাড়ির দেয়ালে চমৎকার সব ম্যুরাল পেইন্টিং। প্রাচীন ভারতের বিখ্যাত দুই মহাকাব্য—রামায়ণ-মহাভারতের টুকরো টুকরো গল্প-ছবিতে সেগুলো কাহিনির মতো সাজানো। চারদিক দেখতে দেখতে মনে হলো, বিরাট ভারতের বিচিত্র সাংস্কৃতিক মানচিত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান যেন রঘুরাজপুর গ্রাম। পুরো গ্রামই ডুবে রয়েছে শিল্পের স্বপ্ন সরোবরে। পটচিত্র, তশোর পেইন্টিং, ভাস্কর্য, ছোটদের খেলনা, তালপাতার চিত্র ছবি, কাঠ কিংবা পাথরের কাজ যাই-ই হোক না কেন, সবটাতেই রয়েছে শিল্পরসের সুগভীর স্পর্শ। এই অত্যাধুনিক যুগেও বড় বড় যেকোনো আর্টের চাইতে নান্দনিকতায় এসব সৃষ্টি মোটেই পিছিয়ে নেই। যুগে যুগে, দেশে দেশে বিখ্যাত শিল্পসৃষ্টির মধ্যে যোগাযোগ স্থাপনের যে সক্ষমতা রয়েছে, সে সক্ষমতা এতেও সুচারুভাবে বর্তমান। অথচ এগুলোর কোনোটাই পরিবর্তিত সমাজচিত্রের সময়কালের চলন্তিকা নয়। ব্যাপক পৌরাণিক কাহিনির এক একটি মিনিয়েচার।

রঘুরাজপুর গ্রামের একটি শিল্পকর্ম
রঘুরাজপুর গ্রামের একটি শিল্পকর্ম

সুরেশের সঙ্গে একটি বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল বহ্নিরা। ঘরের বারান্দায় বসে এক গৃহবধূ রং তৈরির কাজ করছিলেন। জিজ্ঞেস করতেই বললেন, বিভিন্ন রঙের পাথর আর শঙ্খ গুঁড়ো করেই আমরা রং তৈরি করি। সঙ্গে গাছের পাতার রস, চুনাপাথর আর তেঁতুলের বিচির গুঁড়ো মিশিয়ে দিই। পাশেই এক বয়োবৃদ্ধ শিল্পী কতগুলো মুখোশ বানাচ্ছিলেন নিখুঁত কৌশলে। প্রশ্নের উত্তরে জানালেন, সব কাঁচামাল আমরা প্রকৃতি থেকেই নিই। কৌতূহল বাড়ছিল বহ্নির। তাই জানতে চাইল, কাদের মুখোশ বানাচ্ছেন? রাজা আর রানিদের। আর পাশেরগুলো কাদের? ওগুলো অসুর আর সাধারণ মানুষের। সুচরিতের দিকে এবার বিশেষ দৃষ্টিতে তাকাল বহ্নি, দেখছ তো, কী নিখুঁতভাবে এদের মুখের পার্থক্য, চুলের স্টাইল, পোশাকের ভিন্নতা, রঙের ব্যবহারে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে? অথচ একটু আগেই একজন বলছিলেন, কোনো আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে এঁরা শিক্ষালাভ করেননি।

রাশি রাশি শিল্পসম্ভার থেকে একটি নৃসিংহ মূর্তির সঙ্গে টুকিটাকি জিনিস কিনে নিল সুচরিত। হিসাব করে না কিনলে ভারী হয়ে যাবে লাগেজ। এয়ারপোর্ট অবধি বয়ে নিলেও সিকিউরিটিতে আটকে দেবে সব। মনে হলো এই বিকিকিনি দেখে মনে মনে খুশি হয়েছে সুরেশ। তাই থেকে থেকেই সে মুখ খুলছে, এসব শিল্পের নকলও আজকাল কাঁড়ি কাঁড়ি বেরোচ্ছে দাদা। কী রকম? ওই যখন থেকে সরকার রঘুরাজপুরকে রুরাল ট্যুরিজমের মডেল হিসেব গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে, তখন থেকেই শুরু হয়েছে। এসব জিনিস আপনি পাশের গাঁয়েও দেখতে পাবেন। কিন্তু সেগুলো সব মেশিনে তৈরি, হস্তশিল্প নয়।

এতক্ষণে হাসল সুচরিত, বাহ, তোমার নলেজ তো দেখছি অনেক সুরেশ। অনেক খোঁজখবর রাখো! না, তেমন কিছু নয় দাদা। ওই টুরিস্ট নিয়ে নানা জায়গায় ঘোরাঘুরি করি তো, তাদের কাছেই কিছু কিছু শুনতে পাই।

ফেরার পথে পুরো পথটাই রঘুরাজপুর গ্রামের স্মৃতি পরশপাথর হয়ে ওদের মন ছুঁয়ে যেতে লাগল বারবার। মনে হতে লাগল, রঘুরাজপুরের এই শিল্পসৃষ্টি কোন আধুনিক অভিজ্ঞতার প্রতিনিধিত্ব করছে? এঁদের অনেকেই অক্ষরজ্ঞানহীন। আধুনিক সমাজ সংস্কৃতির যে প্রবণতা, এঁরা তার সংস্পর্শের বাইরে। তাহলে কোন মানসিক সংস্কৃতিতে এঁদের সৃষ্টি এভাবে আধুনিক মানুষের অন্তর ছুঁয়ে যায়? সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকার ব্লুমবস গুহায় যখন ৭৩ হাজার বছর আগেকার ড্রয়িং পিকচার বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছিলেন, তখন তারাও সেই আর্টের কলাকৌশল দেখে চমকে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, হাজার হাজার বছর ধরে অনেক নাটকীয় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে পৃথিবীর চেহারা বর্তমান অবস্থায় পৌঁছেছে ঠিক কোথায়। কিন্তু মানবসভ্যতার শুরু কখন হয়েছিল কে জানে। সে জন্যই হঠাৎ হঠাৎ টুকরো আবিষ্কারের নিদর্শন এভাবে তাঁদের চমকে দেয়। আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে তাদের অবিচ্ছিন্ন সংযোগ তাই এই অত্যাধুনিক যুগেও অস্বীকার করা যায় না। (চলবে)

ধারাবাহিক এ ভ্রমণকাহিনির আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন : শ্রীক্ষেত্রের জগন্নাথ