বিষাদবলয়

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

হিয়ার খুব ইচ্ছে করল হাতটা রাখে ঘুমন্ত মানুষটার শরীরে। বাইরেটা দুধে ধোয়া জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে। উপচে পড়া সেই আলো হিয়ার বিছানা, ঘরদোর, ভাসিয়ে নিতে থাকে।

হিয়ার মনটা কেমন যেন কাঙালপনায় মেতে উঠতে চায়। ওর মন ও শরীর চিরন্তন এক আকাঙ্ক্ষায় জেগে উঠতে চায়। ভীষণভাবে চায়, স্বামী নামের মানুষটা, এ মুহূর্তে তার হাতে হাত রাখুক। চোখ, ঠোঁট, সারা শরীরে মাখিয়ে দিক সোহাগী জোনাক পোকার আগুন।

কিন্তু আগাগোড়া নিস্পৃহতায় মোড়া, কাটা গাছের মতো পড়ে থাকা শরীরে সে জোয়ার ওঠা সম্ভব নয়। কঠিন তপস্যায় মগ্ন ধ্যানীর ধ্যান হয়তো ভেঙে দেওয়া সম্ভব। কিন্তু যে বোধহীন নির্লিপ্ততায় নিজেকে সব অনুভূতির উৎসমুখ থেকে সরিয়ে রাখে, তাকে কীভাবে নিজের দিকে আকর্ষিত করা সম্ভব!

হিয়া জানে না। উৎসুক হয়ে তাই ঢুকে পড়তে চায় পাশে ঘুমন্ত মানুষটার ভেতর বাড়িতে। তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখতে ইচ্ছে করে, আপাত নিরাসক্ত এই লোকটার মনের কোনো একটা কোনা ঘুপচির, কোথাও কী আছে হিয়ার জন্য একটু আশ্রয়।

হিয়া নিজেই চমকে যায় নিজের দীর্ঘশ্বাসের শব্দে। ফোনেও আজকাল এটা সে গোপন করতে পারে না। মা প্রায় জানতে চান, তুই সত্যি ভালো আছিস তো হিয়া? সাতসমুদ্র তেরো নদীর দীর্ঘ দূরত্ব ভুলিয়ে দিতে, হিয়া হেসে গড়িয়ে পড়তে চায়। ভাবখানা, দেখ, আমি কেমন হাসছি। কষ্টে থাকলে কেউ এমন হাসতে পারে?

ভাগ্যিস, অবুঝ মা দেখতে পান না, মেয়ের দুই চোখ উপচানো ধারা। যোজন দূরত্বে থাকা মা, হাসি শুনে ছোট্ট শিশুর মতো খুশি হয়ে ওঠেন। কিছুক্ষণ আগেই মেয়ের দীর্ঘশ্বাস শুনে শঙ্কিত হয়েছিলেন, বেমালুম ভুলে যান সে কথা। হিয়ার সংসারের নানান গল্প শুনতে শুনতে মায়ের মনটা ভরে ওঠে।

এটাই তো চায় হিয়া। ওর প্রিয় মানুষগুলো জানুক, হিয়া সুখে আছে। ভালো আছে। তবুও কেন ওর বুকের ভেতর উদাসী ঘুঘুটা ডেকে ওঠে সময়ক্ষণ ভুলে। সযত্ন অভিনয়ে অন্যের চোখে নিজের বিষাদরেখা লুকিয়ে রাখে হিয়া। তার বিষাদবলয়ে কারও প্রবেশাধিকার নেই। কেবল যখন সে একা থাকে, সযত্নে মুখোশ খুলে নিজেকে দেখে।

সেই প্রথম দিকে, স্বামীর সংসারে এসে, রাগ-ঘৃণা সরিয়ে, একবার ফোন করেছিল ভাইয়াকে। খুব স্পষ্ট করে না হলেও বোঝানোর চেষ্টা ছিল, এমন নির্বাসিতের জীবন সে চায়নি। হয়তো ভেবেছিল আশ্রয় না পাওয়া হোক, খানিক সান্ত্বনা তো পাওয়া যেতেই পারে। কিন্তু হিয়াকে অবাক করে দিয়ে কঠিন গলায় ভাইয়া জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘এসব অভিযোগ ভুলেও যেন সে আর মুখে না আনে। বরং সব মানিয়ে নেবার চেষ্টায় ওর মন দেওয়া উচিত। মা-বাবা দুজন প্রায়ই অসুস্থ থাকেন। তা ছাড়া, সমাজে তাদের একটা অবস্থান আছে। বিয়ে হওয়া মেয়ে ফিরে এলে, তাতে মান খুব বাড়ে না। কাজেই এসব নিয়ে জটিলতার কোনো মানে হয় না। মন দিয়ে সংসার করে যাও।’

হিয়ার যা বোঝার বুঝে গিয়েছিল। ভুলেও সে আর পরিবারের কারও কাছে উচ্চারণ করেনি নিজের দুঃখ কথা। মন দিয়ে সংসার করার অভিনয়টা নিপুণভাবে করে যাওয়ায় মন দিয়েছে। মা–বাবার সঙ্গে যোগাযোগ না রাখলেই নয়, সে কারণে মাসে বার দু-একবার ফোন করে। ভুলেও তাদের স্কাইপ বা ভিডিও চ্যাটের আগ্রহকে আশকারা দেয় না। বন্ধুবান্ধবদেরও সযত্নে এড়িয়ে চলে।

এমনিতে হিয়া খুব শান্ত ধরনের মেয়ে। অভাব-অভিযোগ নিয়ে সরব হওয়াটা খুব একটা ধাতে নেই। দুই ভাইবোনের মধ্যে হিয়া ছোট। ভাইয়াটা চিরকালই ক্যারিয়ার সচেতন আর স্বার্থপর ধরনের। মায়ের পেটের বোনের সঙ্গে ভাইয়া যা করেছে, সেটা ঠিক কোন স্বার্থ হাসিলের জন্য করা? নিজে খুবই ভালো চাকরি করে। বাড়ি–গাড়ি কিছুরই তো অভাব নেই। বোনের জন্য মানবিকতা বোধে, এতটা দেউলিয়াত্ব দেখানো কীভাবে সম্ভব হলো ভাইয়ার পক্ষে? এই প্রশ্নগুলো মাঝেমধ্যেই ওকে ভোগায়।

নাহ্ ইমতিয়ারের সংসারে ওর কোনো কিছুর অভাব নেই। প্রাচুর্যে মোড়া ওর চারপাশ। সংসারের সবই তার ইচ্ছেতেই হয়ে থাকে। ইমতিয়ার তার হাসপাতাল, কনফারেন্স, চ্যারিটি ইত্যাদি নিয়েই ব্যস্ত। এত সব থেকেও হিয়ার ভেতরটা বড় খাঁ খাঁ করে। সব থেকেও রিক্ত ভিখারিনীর মতো মনে হয় নিজেকে। খুব সাধারণের মতো ছোট্ট সুখের সংসারই হিয়ার চাওয়া ছিল। এমন যক্ষপুরীর পাহারায় থেকে, শূন্য হবে ‘জীবনের প্রচুর ভাড়ার’ কে ভেবেছিল।

রূপবতী হিয়া কোনো পুরুষ হৃদয়ের কাঙ্ক্ষিতজন হওয়ার ক্ষেত্রে ব্যর্থ, এমনটা বলা যাবে না। সে রকম হওয়ার সব যোগ্যতাই ওর ছিল। সে সম্ভাবনাকে প্রাপ্তির দিকে টেনে নেবার ছুতোয় কম চিরকুট ছুটে আসেনি ওকে লক্ষ্য করে। কিন্তু সেগুলোকে নিতান্তই ছেলেমানুষি ভেবে পাশ কাটিয়েছে। যাদের অনুভূতি গুরুত্ব পেতে পারত, তাদের কেমন একটা ধারণা ছিল, ওর নিশ্চয়ই কারও সঙ্গে সম্পর্ক আছে।

এমন নিশ্চিত, অথচ মস্ত ভুল ধারণা, হিয়ার প্রতি আগ্রহীদের এগোনোর সাহস জোগায়নি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদেরও কেউ সে ভুল ভাঙানোর সদিচ্ছা দেখায়নি, কোনো এক অজানা কারণে। অবশ্য হিয়াও হৃদয়ঘটিত বিষয়ে কারও প্রতি খুব একটা টান বোধ করেনি। যার প্রতি ক্ষীণ একটা টান, না, টান না বলে মোহ বলাই ভালো। হ্যাঁ, সে রকম একটা ব্যাপার যার ক্ষেত্রে ঘটেছিল, তিনি হিয়াদের ইউনিভার্সিটির শিক্ষক। বলাই বাহুল্য, শিক্ষকটি বিবাহিত। এসব ক্ষেত্রে প্রায়শ যা হয়, মুগ্ধতা সীমানা পেরোনোর উৎসাহ হারিয়েছিল।

কারও সঙ্গেই হিয়ার প্রেম-ভালোবাসা সম্পর্কিত কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। মাঝেমধ্যেই হিয়া ভাবে, আহা তার যদি সে রকম একজন থাকত! যার সঙ্গে সে জীবনের জোড় বেঁধে, চাওয়া-পাওয়ার চৌহদ্দিতে পা রাখত। তারও হতে পারত ছোট্ট সুখের একটা সংসার।

হিয়া আর নিজের আবেগকে ধরে রাখতে পারল না। একছুটে লাগোয়া ওয়াশ রুমে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয় ওকে। এই ওয়াশ রুমই তার একান্ত আশ্রয়। তার অনেক কান্না আর দীর্ঘশ্বাস জমা রেখেছে ইট-কাঠের এই ঘর। দেয়ালজোড়া আয়নায় যে মেয়েটা এখন জলভরা চোখে তাকিয়ে আছে, তার দিকে চোখ রেখে হিয়া ফিক করে হেসে ফেলল। আশ্চর্য হলো, কান্না ভুলে হাসি আসায়। প্রশ্নবোধক চোখে নিজের দিকে তাকাল ‘হাসছ কেন, বলো হাসছ কেন!’ হাসিই পেল আয়নার বুকে ফুটে থাকা রূপে ফেটে পড়া প্রতিফলনটা দেখে।

ইউনিভার্সিটির বন্ধুগুলো প্রায় বলত, যার সঙ্গে ওর বিয়ে হবে সে হিয়াকে খুব ভালোবাসবে। এমন রূপবতী মেয়েকে ভালো না বেসে পারে কেউ? রূপে মানুষ ভোলে, কিন্তু ভালোবাসা নামের অনুভূতির বৃত্তে পা রাখার জন্য রূপই শেষ কথা না। তারও অধিক কিছু লাগে। সেটা কী, হিয়ার জানা নেই। হিয়া শুধু জানে, রূপই সব না। হলে ওর স্বামী ইমতিয়ার, সে রূপের ঘোরে আটকে গেল না কেন। হিয়ার রূপ কিংবা শরীরের প্রতি ইমতিয়ারের কোনো আকর্ষণ নেই। বিয়ের প্রথম দিকে, স্বামী তাকে একবার মাত্র স্পর্শ করেছিল, ব্যস। তারপর থেকে আর স্বামীর অধিকার ফলাতে হিয়ার ওপর চড়াও হয়নি। তাই বলে মানুষ হিসেবে ইমতিয়ারকে খারাপও বলতে পারবে না হিয়া। একজন কর্মনিষ্ঠ মানুষের সব গুণ ইমতিয়ারের মধ্যে আছে। ভান–ভণিতা নেই মানুষটার মধ্যে।

দুই.

প্রথম চমকটা ইমতিয়ার বিয়ের রাতেই দিয়েছিল।

বিয়ের আনুষ্ঠানিকতার হাঁপ ধরানো ঝুটঝামেলা শেষ করার পর যখন বাসরঘরের দরজা বন্ধ করে দুজনে মুখোমুখি হলো, তখন ক্লান্ত শরীরেও হিয়ার রোমান্টিক কৌতূহলটা বারবার ইতিউতি করছিল, অচেনা এক পুরুষকে জীবনের সবচেয়ে গোপনতম অধ্যায়ের সঙ্গী করার বাসনায়। কী বলতে হয় এমন সময়ে? নাকি চুপটি করে লক্ষ্মী মেয়ের মতো বসে থাকতে হয় স্বামীপ্রবরের মিষ্টি রোমান্টিকতায় ভর দিয়ে। কেউ কিছু বলে দেয়নি তাকে। আজকাল সবাই সবকিছু জানে। কিন্তু সে কিছুই জানে না এসবের। কোনো বিবাহিত আত্মীয় বন্ধু তার সঙ্গে এসব আলাপ করেনি কখনো। সিনেমার রোমান্টিক চিত্রগুলো চোখে ভাসে। কিছুটা আশায় কিছুটা আশঙ্কায়। স্বামী যদি শরীরলোভী হয়, তাহলে বিশ্রী ব্যাপার হবে। সে চায় রোমান্টিক সম্পর্কটা শব্দে শব্দে এগিয়ে তারপর শরীর আসবে।

বসে বসে হিয়া যখন এসব ভাবছিল তখন ইমতিয়ার লাগোয়া বাথরুমে গেছে ফ্রেশ হওয়ার জন্য। শাওয়ারের শব্দ শোনা যাচ্ছে। সারা দিনের যা ধকল গেছে শাওয়ার নিয়ে ফ্রেশ হওয়াই ভালো। হিয়া নিজেও শাওয়ার নেবে। যদি তিনি রাজি থাকেন। ভেবে অদ্ভুত লাগল। এত দিন সে নিজের ইচ্ছায় সব করেছে। কয়েক ঘণ্টা আগের বিয়েটা তার সারা জীবনের স্বাধীনতা হরণ করে নিয়েছে? এখন শাওয়ার নেবার সময়ও স্বামী কী ভাববে, এটা ভাবতে হচ্ছে। না, সে এমন পরাধীন হবে না। এসব ব্যাপারে স্বামীর মতামত নেবার কোনো মানে নেই। হাস্যকর। বিয়ে হয়েছে বলে সে কেনা গোলাম হয়ে যায়নি। সে নিজের স্বতন্ত্র ইচ্ছে বজায় রাখবে। ইমতিয়ারকে সেটা আজ রাতেই পরিষ্কার করে বলবে। সব কথা আগেভাগে বলে নেওয়া ভালো। তাতে ভুল–বোঝাবুঝি হবে না পরে।

তাই ইমতিয়ার যখন শাওয়ার থেকে বেরিয়ে জানাল, তুমিও শাওয়ার নিয়ে ফেলো হিয়া। এই গরমে ঘেমে পুরো শরীর চ্যাটচ্যাটে হয়ে আছে। তারপর দুজনে গল্প করব। বাহ্‌, এই তো চেয়েছিল হিয়া। এভাবে শুরুতেই দুজনের মনের মিল দেখতে পেয়ে হিয়ার মনটা আপ্লুত হয়ে উঠল। সে ইমতিয়ারের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে বলল, ঠিক আছে, আমিও শাওয়ার নিয়ে আসছি। ততক্ষণ আপনি গানটান কিছু শুনতে থাকুন।

ইমতিয়ার মাথা নেড়ে সায় দিল।

শাওয়ার নিয়ে, পোশাক পাল্টে, হিয়া বিছানায় উঠে বসল। এবার গল্প করা যাক। ইমতিয়ার যখন আলতো করে ওর হাত দুটো ধরল, তখন হিয়ার সমস্ত অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। কিছুটা সুখ, কিছুটা ভয়। পুরুষটি কী করবে এরপর। ঝাঁপিয়ে পড়বে ভদ্রতার মুখোশ খুলে? নাহ ইমতিয়ারকে দেখে তেমন মনে হয় না। কথা ইমতিয়ারই শুরু করল।

: তোমাকে অনেক ধন্যবাদ হিয়া।

এ কেমনতরো কথার ছিরি। হিয়া ভেবে পেল না কিসের ধন্যবাদ।

হিয়া বলল, কেন কিসের ধন্যবাদ?

: আমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিতে পারার জন্য।

: তাহলে তোমাকেও ধন্যবাদ দিতে হয়। তুমিও তো আমাকে বিয়ে করেছ।

কথাটা হাসির হয়ে গেল কিনা, ভেবে ফিক করে একটু হেসেও নিল হিয়া। কিন্তু ইমতিয়ার হাসল না। মুহূর্তে ইমতিয়ারের মুখে অন্য একটা ছায়া ভেসে উঠল। সে ছায়ায় অন্য রকম এক দুর্বোধ্যতা।

: আমি তোমাকে বিয়ে করেছি একটা স্বার্থ নিয়ে। যে স্বার্থের অনুকূলে কোনো মেয়ে সহজে রায় দেয় না। আমাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ কাজ নয়। একজন বয়স্ক, বিপত্নীক, দুই সন্তানের বাবাকে, কোনো তরুণী স্বামী হিসেবে মেনে নেয় না সহজে। যেখানে রোমান্টিকতার চেয়ে দায়িত্ববোধের পরিমাণ অনেক গুণ বেশি। কিন্তু নিজের সবটাই বিয়ের আগে জানিয়েছি তোমার ভাই–ভাবিকে, তাদের মাধ্যমে তুমি সবই জেনেছ। সবটা জেনেশুনে, বিয়েতে রাজি হয়ে তুমি আমার কতটা উপকার করলে, ঠিক বোঝাতে পারব না। আমার সংসারে তোমার সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যের এক তিলও কমতি হবে না, এটা জেনে রাখো।

এটুকু শুনে থমকে গেল হিয়ার হাসি। এসব কী বলছে ইমতিয়ার! বিয়ের আগে এসব কথা তাকে কেউ বলেনি। ভাইয়া-ভাবি, শুধু বলেছেন, পাত্রের বয়সটা একটু বেশি। হিয়া তাতে আপত্তি করেনি। কেননা, চল্লিশোর্ধ্ব পাত্র আজকাল এমন কোনো বিরল প্রাণী নয়। কিন্তু বিবাহিত, বিপত্নীক, সন্তানের বাবা, এসব কী শুনছে হিয়া! বিয়ের রাতেই যেন তার মাথায় স্বপ্নবাড়িটা ভেঙে পড়েছিল। বাসরঘরের এমন মহার্ঘ মুহূর্তে এমন কথা কেউ কখনো শুনেছে? কেমন আশ্চর্য, মুহূর্তকাল আগে তার ভবিষ্যৎ জীবনের যে ছকটা, এই সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক, যিনি আইন আর ধর্মীয় বিধানমতে ওর স্বামী, তিনি শোনালেন; ভাইয়া–ভাবির বক্তব্যমতো তো সে রকমটা হওয়ার কথা না! হিয়া আর মা–বাবাকে, ভাইয়া-ভাবি সম্পূর্ণ ভিন্ন গল্প শুনিয়েছেন। হিয়া জেনেছিল, আমেরিকাপ্রবাসী কাজপাগল মানুষ ইমতিয়ার, কাজে ডুবে থাকায় সময়মতো বিয়ে করা হয়নি। এত দিনে বিয়ের ফুরসত পাওয়ায় বিয়ের জন্য দেশে এসেছে। ভাবির মায়ের বান্ধবী মারফত প্রস্তাবটা আসামাত্রই তারা হিয়ার কথা ভেবেছেন। এমন পাত্র হাতছাড়া করা বোকামিই হবে।

হিয়ার ভেতরটা পাথর হয়ে গিয়েছিল সেই মুহূর্তেই। সেরাত নির্ঘুম কেটেছিল ওর। আরও অনেকগুলো রাত। রাতের পর রাত। ইমতিয়ার অবশ্য ঘুমিয়ে পড়েছিল কথাগুলো শেষ করেই। বাসররাতে বিয়ে করা নতুন বউ হিয়া, রোমান্টিক স্বপ্নের ডানা ভাঙা বেদনা নিয়ে চুপচাপ পাশে পড়েছিল।

দেশে থাকতে এই মারাত্মক তথ্যটি হিয়া কারও সঙ্গে শেয়ার করেনি। কী এক অভিমানে গুটিয়ে গিয়েছিল সে। মা–বাবা কিংবা ভাইয়া–ভাবি কাউকে বুঝতে দেয়নি তার ভেতরের ঝড়। এমনকি ইমতিয়ারকেও খুলে বলতে ইচ্ছে করেনি, তার সঙ্গে ভাইয়া-ভাবির অমানবিক নিষ্ঠুর ব্যবহারের কথা।

ইমতিয়ার লইয়ার ধরে হিয়ার আমেরিকা যাওয়ার কাগজপত্রের সবকিছু খুব দ্রুতই করে ফেলে। কয়েক সপ্তাহ পরেই হিয়া আমেরিকায় স্বামীর সংসারে চলে আসে। পেছনে চিরদিনের জন্য ফেলে আসে মা-বাবা, তার জন্মশহর আর সুখস্মৃতির সবটা। মা–বাবা প্রায় বলেন, একবার যেন দেশে ঘুরে যায় হিয়া। কিন্তু হিয়া নানান অজুহাতে পাশ কাটায়। নাহ্, সে আর ফিরে যাবে না। তাকে বিদায় করে সুখে থাকা ভাইয়া–ভাবির সংসারে, সে কোনো দিন আর পা রাখবে না। ইমতিয়ারও বলেছে বার দু-এক। ছেলে–মেয়ের সামারের ছুটিতে গিয়ে বেড়িয়ে এসো। মা–বাবাকে দেখে এসো। হিয়া ম্লান হেসে কথা ঘুরিয়েছে। সবদিক বজায় রাখতে গিয়ে নিজের ভেতরটা ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাচ্ছে, টের পায়। কত দিন এভাবে চালাতে পারবে, সেসব ভাবতেও ভয় করে ওর।

তিন.

ইমতিয়ার বিয়ের সম্বন্ধ হওয়ার সময়ই হিয়ার সঙ্গে সরাসরি সব কথা বলে নেবার পক্ষপাতী ছিল। সে বিবাহিত, স্ত্রী বছর দেড়েক আগে রোড অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেছে। দুটো ছেলে-মেয়ে আছে। আটচল্লিশে এসে নতুন করে আর বাবা হওয়ার কোনো রকমের ইচ্ছাই তার নেই। বিয়েটা সে করছে ছেলেমেয়ের কথা ভেবে। তাকে পেশাগত কারণে, প্রায় নানা জায়গায় যেতে হয়। বাচ্চাগুলোকে তখন হয় ফুফুর কাছে ক্যালিফোর্নিয়াতে চলে যেতে হয় অথবা ফুফুর পক্ষে সম্ভব হলে তিনি এসে থাকেন। এমন টানাহেঁচড়ায় বাচ্চাদের লেখাপড়ার ভীষণ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। তাই একটা স্থায়ী মীমাংসার জন্য বিয়ে করার সিদ্ধান্ত। এমন শর্তে কেউ রাজি হবেন কিনা জানা নেই। তবু বিষয়টা নিয়ে হিয়ার সঙ্গে কথা বলে ইমতিয়ার এগোনোর পক্ষপাতী ছিল। ভাইয়া-ভাবি সে সময় জানিয়েছিল হিয়া ও মা–বাবাকে তারাই বিষয়টা বিস্তারিত জানাবে।

আমেরিকায় নামকরা হাসপাতালের হার্ট সার্জন, এমন পাত্র কিছুতেই হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না হিয়ার ভাবি। ছেলেপুলের বাবা তো কী হয়েছে। সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যের অভাবে পড়তে হবে না হিয়াকে। আর দু-দুটো ছেলেমেয়ে যখন আছেই, তখন আর ছেলেপুলের দরকারই বা কী! মায়ের স্নেহে মানুষ করতে পারলে একসময় ওদেরই মা হয়ে উঠবে। হয়তো এমনটাই ছিল ভাবির মনোভাব। ভাইয়া হয়তো সামান্য গাঁইগুঁই করেছেন প্রথম দিকে, পরে সংসারের শান্তির কথা বিবেচনা করে বউয়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গেছেন। সে রকম আড়ম্বরে না গিয়ে, খুব কাছের কিছু আত্মীয়স্বজনের উপস্থিতিতে হিয়ার বিয়ে দিয়ে বিড়াল পার করার দায়িত্ব সেরেছেন ভাইয়া। একমাত্র মেয়ের বিয়ে এভাবে দেওয়ার বিপক্ষে ছিলেন মা-বাবা। কিন্তু তাদের আপত্তি ধোপে টেকেনি। ছেলে আড়ম্বরহীন বিয়েতে আগ্রহী, এই এককথায় সব আপত্তির নেতিয়ে গেছে।

স্বামীর সংসারে এসে, নিজেকে মানিয়ে নেবার সময়টাতে, অখণ্ড অবসরে হিয়া নানা ভাবনায় ডুবে যেত। সে সময়গুলোতে সবার ওপর এমনকি নিজের ওপরও হিয়ার দারুণ রাগ হতো। তার বাবা একজন অবসরপ্রাপ্ত আইনজ্ঞ। তার রেকর্ডে নাকি একটাও ভুল বিচারের নজির নেই। কেস ঘেঁটে সঠিক সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে তিনি দৃষ্টান্ত অনেকের। সেই বাবাও ভাইয়া-ভাবির আচার–আচরণে কোথাও সন্দেহ করার মতো কিছুই দেখতে পেলেন না! একবারও মনে হলো না, পাত্রের সঙ্গে সরাসরি কথা বলা প্রয়োজন? নাকি অবসর নিয়ে ছেলের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার অসহায়ত্বের কাছে বিষয়টাকে অতটা গুরুতর মনে হয়নি। মা বা বাবার ওপর রাগ করেই বা কী হবে। সে নিজে একটা ভার্সিটি–পড়ুয়া মেয়ে, তার নিজেরও কী উচিত ছিল না, কার সঙ্গে তার বিয়ে হচ্ছে, জীবনসঙ্গী হিসেবে কার সঙ্গে সে বাকি জীবনটা কাটাতে চলেছে, একবার তার সবটা না হলেও কিছুটা যাচাই করে নেওয়া? ভাইয়া–ভাবি যা বললেন, সে তাতেই পুতুলের মতো সায় দিয়ে গেল কোন যুক্তিতে? প্রশ্নগুলো প্রথম প্রথম হিয়াকে ভীষণ জ্বালাতন করত। এখন সব সয়ে গেছে। এই বিশাল বাড়ির কেয়ারটেকার কাম বেবিসিটার হিসেবে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে হিয়া।

বিয়ের পরপরই ইমতিয়ার এটাও স্পষ্ট করে দিয়েছে, হিয়ার কাছে তার তেমন কোনো চাহিদা নেই। শুধু সন্তান দুটোকে মায়ের ভালোবাসা দিলেই চলবে। কাজটা হিয়ার জন্য মোটেও সহজ ছিল না। প্রথম দিকে হিয়াকে সহ্যই করতে পারত না ইশতি আর ইরা। ইশতি বয়সে বড় হওয়ায় মুখে সে রকম কিছু না বললেও আচার–আচরণে বুঝিয়ে দিত, হিয়াকে মা হিসেবে তার পছন্দ নয়। ইরা দুমদাম নানা বিব্রতকর প্রশ্ন করে বসত।

হাউ লং উইল ইউ স্টে হিয়ার? কিংবা হোয়াই ইউ এন্টার্ড মাই ড্যাডস রুম, উইদাউট হিজ পারমিশন?

এমন সব প্রশ্নের কী উত্তর দেওয়া যায়! হিয়া নিজের বোকাটে ভাব লুকিয়ে হাসবার চেষ্টা করত। এক ছুটির দিনে খাওয়ার টেবিলে দুম করে ইরা জানান দিল, আই নো, হু ইউ রিয়েলি আর। ইউ আর মাই ড্যাডস নিউ ওয়াইফ, বাট নট মাই মম।

: ইরাআ...।

ইমতিয়ারকে সেই প্রথম আর শেষবার গলা তুলতে শুনেছিল হিয়া। ছেলে আর মেয়েকে নিয়ে টেবিল ছেড়ে ঘণ্টাখানেকের জন্য নিজের স্টাডি রুমে চলে গিয়েছিল।

ঘণ্টাখানেক পর ফিরে এসে, ইরা হিয়ার গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, সরি আন্টি, আই ওন্ট সে দিজ ওয়ার্ডস টু ইউ এগেইন।

ইমতিয়ার ছেলে-মেয়েকে কী বুঝিয়েছিল হিয়া জানে না। তবে সেদিনের পর ওদের সম্পর্ক কেমন ভোজবাজির মতো বদলে গিয়েছে। যদিও ছেলে-মেয়ের কাছে হিয়া আন্টি হয়েই আছে, মা হতে পারেনি। সে চেষ্টাও হিয়া করে না। তবে মাঝেমধ্যে ভীষণ ইচ্ছে করে কেউ তাকে মা বলে ডাকুক। সন্তানের নরম শরীরের উষ্ণতায় নাক ডুবিয়ে নিজের ভেতর জমে থাকা বিষাদের বুদ্‌বুদগুলো উড়িয়ে দেওয়ার জন্য মাঝেমধ্যে হিয়ার বুকটা কেমন একটা করে।

চোখেমুখে পানি দিয়ে ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে আসে হিয়া। নাহ্। আর ঘুম আসবে না। পাশ থেকে হিয়ার উঠে যাওয়াতে ইমতিয়ারের কোনো হেলদোল হয়নি। সে ঘুমের আবেশেই ডুবে আছে। একপলক সে দিকে তাকিয়ে সন্তর্পণে দরজা ভেজিয়ে প্যাসেজটায় এসে দাঁড়ায়। ইশতির ঘরে আলো জ্বলছে। ছেলেটা মাঝেমধ্যে পড়তে পড়তে, আলো না নিভিয়েই ঘুমিয়ে পড়ে। নিঃশব্দে দরজা খুলে আলোটা নিভিয়ে দেয় হিয়া। ইশতি হাইস্কুলে যাচ্ছে গত মাস থেকে। ইরা ফিফথ গ্রেডে। হিয়ার সঙ্গে এখন ওদের বেশ ভাব। প্রথম প্রথম কেমন অস্বস্তি লাগত, নিজেকে এত বড় বড় ছেলে-মেয়ে দুটোর মা ভাবতে। এখন আর তেমনটা হয় না।

প্যাসেজ পেরিয়ে কাচঘেরা নিচের লিভিং রুমে এসে দাঁড়ায়। কাচের বাইরে জ্যোৎস্নার বন্যায় পুরো বাগানটা দেখতে কেমন অপার্থিব লাগছে। এই রুমটা হিয়ার খুব প্রিয়। কাজের অবসরের বেশির ভাগ সময় সে এই রুমে কাটায়। পেছনের বাগানের প্রায় সবটাই দেখা যায় ভেতরে বসেই। প্রায় হিয়া অলস চোখে তাকিয়ে দেখে, দুজন লোকের বাগান পরিচর্যার নৈমিত্তিক কর্মতৎপরতা। তারা হিয়াকে দেখতে পায় না। কাচটার কায়দাই এমন, বাইরে থেকে ভেতরের কিছু দেখার উপায় নেই। কখনো বা পুলের নীল টলটলে পানিতে রোদের চিকমিক দেখে বসে বসে। বিশাল বিত্তবানের সঙ্গেই হিয়ার বিয়ে হয়েছে। কারও কারও কাছে হয়তো বিত্তবৈভবই সব। হিয়ার জানা হয়ে গেছে, বিত্তবৈভবই সব না।

একটা জীবনের অনেক রকম চাওয়া–পাওয়ার হিসাব–নিকাশ থাকে। একজন নারী বা পুরুষ যখন যৌথভাবে সংসার পাতে সেটা শুধু সন্তান জন্ম এবং লালনপালনের প্রজেক্ট নয়। সেখানে অনেক আবেগ–অনুভূতির খেলা আছে। আছে পারস্পরিক সহমর্মিতা, বোঝাপড়া। স্বামী–স্ত্রী পরিচয়ের দুজন মানুষ, একই ঘরে পাশাপাশি বাস করে পরস্পর থেকে যোজন যোজন দূরত্বে থাকে, এটা একদম বিরল নয়। কিন্তু বিবাহিত জীবনে থেকেও স্বামী–স্ত্রী তেমন শারীরিক-মানসিক, বিশেষ করে শারীরিক অন্তরঙ্গতায় তেমন জড়ায়নি, এমন ব্যাপার বেশ অস্বাভাবিক। অথচ সেই অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্য দিয়ে কাটছে হিয়ার জীবন, যা তার ঘনিষ্ঠ স্বজনেরাও জানে না।

এমন অস্বাভাবিক জীবনের বাঁধন কেটে, নিজের মতো করে বাঁচবার সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও, কী এক যুক্তিহীন ক্ষোভ কিংবা জেদের বশবর্তী হয়ে হিয়া এই জীবনের খোপে নিজেকে নিজেই আটকে রেখেছে। এমন জীবন কী শুধু হিয়া যাপন করছে, নাকি আরও অনেকে আছে তার মতো। কে জানে প্রতিদিন কত কত নিরীহ মেয়ে, পরিবারের ঠুনকো সম্মান রাখতে গিয়ে এমন পরিস্থিতির বলি হচ্ছে। কেউ হয়তো বেরিয়ে আসতে পারছে। কেউ সম্মান হারাবে, পরিবারের লোকগুলো দুঃখ পাবে, অযৌক্তিক নানান ছুতোয় একটা জীবন পার করে দিচ্ছে, জীবন ঘষে অন্যের জীবনে আলো জ্বালবার চেষ্টায়। কিন্তু যে আলোতে নিজস্ব আঁধার কাটে না সে আলোর মূল্যটাই বা কী?

বাঙালি কমিউনিটির বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে, বয়স-চেহারায় আকাশ-পাতাল পার্থক্য থাকা দম্পতি তো কম দেখে না হিয়া। তাদের কারও চেহারা দেখে তো বোঝার উপায় নেই, কেউ অসুখী। তবে কী তারাও হিয়ারই মতো, কে কত সুখী এমনটা বোঝাতে অভিনয় করে? হয়তো করে, হয়তো না। করলেও দুজন মিলেই করে, হিয়ার মতো একলা একা নয়। কত দিন এ অভিনয়টা হিয়া চালিয়ে যেতে পারবে, জানে না। যত দিন পারছে, তত দিন পৃথিবী জানুক হিয়া ভালো আছে। সুখেই আছে। ওর ওয়াশ রুমের বলয়ে জমা থাকুক নিজস্ব বিষাদকথন। হিয়ার দীর্ঘশ্বাসের দীর্ঘ পদাবলি।

নাহার তৃণা: ইলিনয়, যুক্তরাষ্ট্র।