তেতো এপ্রিকটের বাদাম ও ক্যানসার

এপ্রিকটের বাদাম
এপ্রিকটের বাদাম

ডিসেম্বরের এক পড়ন্ত বিকেল। আমি বিষণ্ন হৃদয়ে অস্থির মস্তিষ্কে রাস্তার দুই পাশে দোকানগুলোতে অনেক আশা নিয়ে তেতো এপ্রিকট কেরনেল (Kernel) খুঁজে মরছি। এপ্রিকট কেরনেল হচ্ছে এপ্রিকটের বিচির ভেতরের বাদাম, দেখতে আ্যামন্ডের (Almond) মতো। তবে গড়নটা আরও ছোট। বেশির ভাগ দোকানিই বিস্মিত হলেন শুনে। তেতো এপ্রিকট কেরনেল আছে নাকি? আর থাকলে তা কী দরকারে লাগে ভাবছেন তারা।

এক অহংকারী আফগানি দোকানি কিছুটা অবজ্ঞা নিয়ে বললেন, আজ সকালে এক সাদা অস্ট্রেলিয়ানও এসে ওই তেতো এপ্রিকট কেরনেল খুঁজছিল, কী কাজে এটা লাগে?

তার কথার উত্তর দিতে ইচ্ছা করল না। সে ভাগ্যবান মানুষ। তার আপনজনদের কেউ অসুস্থ নয়। তাকে হন্যে হয়ে এপ্রিকট কেরনেল খুঁজতে হচ্ছে না।

আমার বিপন্ন ব্যাকুলতা দেখে দোকানি নিজে থেকে বলল, আমার কাছে অন্যটা আছে। তবে রাস্তার উল্টোদিকে এক দোকানে দেখেছিলাম তেতোটাও আছে। জানো তো এটা সহজে পাওয়া যায় না।

আমিও একদিন আগে মাত্র এই বস্তুর অস্তিত্বের কথা জেনেছি। এটি নাকি ক্যানসার প্রতিরোধে ও ক্যানসার নামে মরণব্যাধির আগ্রাসন থামাতে সাহায্য করে।

ক্যানসার এমন এক রোগ ক্ষেত্রবিশেষে বা রোগের ধরন অনুযায়ী কোনো চিকিৎসাতেই এর নিরাময় সম্ভব হয় না। তাও মানুষ আমারই মতো হাল ছাড়তে চায় না। ধানদূর্বা বা খড়কুটাকেও গভীর আশা নিয়ে আঁকড়ে ধরে। ওই মুহূর্তে এপ্রিকট কেরনেল তেমনি এক আশ্বাস। হয়তো এটা পাওয়া গেলে উপকার হবে। মনে হচ্ছে উপকার হবেই। জিনিসটা পেতে হবে আগে। পেলেই হবে না, ঢাকায় পাঠানোরও ব্যবস্থাও করতে হবে।

একজন সজ্জন মানুষ কথা দিয়েছেন নিয়ে যাবেন। আজই আমাকে এটা জোগাড় করতে হবে। ভোররাতে খালাতো ভাই লন্ডন থেকে ফোনে বললেন, হেলথ শপে হয়তো পাওয়া যেতে পারে। তিনি হেলথশপে দেখবেন পাওয়া গেলে পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন। তাই সকালে খুঁজেছি সুপার মার্কেটের হেলথ শপগুলোতে। পাইনি। মিডল ইস্টার্ন দোকানে দেখেছি নানা ধরনের শুকনো ফল আর বাদাম পাওয়া যায়। তাই এখানে এসেছি। পেস্তাবাদাম, আখরোট, আনজির, কিশমিশ, আলুবোখারা, জাফরান সবই আছে। শুধু নেই তেতো এপ্রিকট কেরনেল।

আফগান দোকানির পরামর্শমতো রাস্তার অন্য পাশের দোকানে পৌঁছালাম। গিয়ে দেখি সত্যি ওখানে দুটো কন্টেইনারে এপ্রিকট কেরনেল রাখা আছে। দোকানিকে কোনোমতে বোঝালাম, বিটার এপ্রিকট কেরনেল চাই। তিনি নিস্পৃহভাবে বললেন, কোন কনটেইনারে তেতোটা আছে জানেন না। আমিই যেন এক-একটা মুখে দিয়ে দেখি কোনটি কী।

ওভাবে চিবিয়ে তেতোটা শেষ পর্যন্ত শনাক্ত করা গেল। এক কেজি তেতো এপ্রিকট কেরনেল কিনে সন্ধ্যা নাগাদ ঘরে ফিরলাম। সে রাতেই ভালো মানুষ মুশফিক ভাইয়ের হাতে অর্ধেক তেতো সেই বাদাম দিয়ে এলাম। তিনি কিছুটা অবাক হলেন অসুস্থ ভাইয়ের জন্য এত কম বাদাম দিচ্ছি দেখে। আমি তাকে জানালাম, এটা ওষুধের মতো খেতে হবে। দৈনিক পাঁচ থেকে সাতটার বেশি খাওয়া যাবে না। আমি নিজে তখনো এ বিষয়ে কোনো তথ্য তালাশ করিনি। তবুও স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা, এতে যেন উপকার হয়।

সেই রাতে দেশে ফোন করে এপ্রিকট কেরনেল পাঠানোর খবর দিতে গিয়ে জানলাম, ভাইকে আবার ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। গত কয়েক মাস তাকে ঢাকা-সিঙ্গাপুর, বাসা-ক্লিনিক করতে হয়েছে অনেকবার। ভালো হয়ে অফিসও শুরু করেছিল। আবারও ক্লিনিকে নিতে হয়েছে শুনে বুক কেঁপে উঠল। এমনিতেই কী এক ঘোরের মাঝে সময় কাটছিল, এবারের অনুভূতি প্রকাশের মতো নয়। শুধু মনে হলো, তেতো এপ্রিকট কেরনেল তো আগামীকালই পৌঁছাবে। আমার গভীর আশা...।

এপ্রিকট কেরনেল ঠিকই পৌঁছাল, কিন্তু ভাই আর তা চেখে দেখার অপেক্ষায় রইল না। তারপর আমার মনে হয়েছে ওই তেতো কেরনেল যদি অন্য কারওরও প্রয়োজনে লাগে তাকেই দিতে হবে।

যা হোক কেউ একজন আমারই মতো আশা নিয়ে এই তেতো বাদাম গভীর আশায় দেশে নিয়ে গেল। আবার কেউ কেউ আস্থাহীনতায় ভুগল। তাদের মনোভাব এমন যে, এত এত দামি ওষুধে যখন কাজ হচ্ছে না আর ওই তেতো বাদাম কীই-বা করতে পারে।

হঠাৎ মনে পড়ল, একদিন এক গ্রিক বা সাইপ্রিয়ট (সাইপ্রাসের মানুষ) নারী আমার পাড়ার এফির সঙ্গে এসে আমার ব্যাকইয়ার্ডের এপ্রিকট গাছের নিচ থেকে এপ্রিকটের শুকানো বিচি সব কুড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিল। তখন গাছে এপ্রিকট ছিল না মোটেও। ঝরে পড়েছিল সব। জানতাম না কী দরকারে এগুলো নিচ্ছেন। এর ভেতরে বাদাম রয়েছে তাও জানতাম না। এখন মনে হচ্ছে ওই নারী জানতেন এপ্রিকট কেরনেলের গুণের কথা।

আজকাল কিছু জানতে চাইলে সহজেই ইন্টারনেট ঘাঁটলে তথ্য মিলবে। তেমনি এপ্রিকট কেরনেল বিষয়েও নানান তথ্য রয়েছে। তেতো এপ্রিকট কেরনেলে সায়োনাইড আছে। বলা হয়েছে এমিগডেলিন (যা ভিটামিন বি ১৭) আছে এতে। তাই এটি মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ করে। অনেকেই ক্যানসার রোগের ঔষধি বা ভেষজ ওষুধ হিসেবে এটি বেছে নেন। ক্যানসার ছাড়াও এই তেতো বাদাম মানুষের শরীরের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে বলা আছে।

তবে ব্যবহার করতে হবে সাবধানে। একসঙ্গে বেশি পরিমাণে তেতো এই বাদাম খাওয়া ক্ষতিকর। রাশিয়াতে ১৮৪৫ সাল থেকে ক্যানসার চিকিৎসায় এপ্রিকট কেরনেল ব্যবহৃত হচ্ছে। আমেরিকাতে একই চিকিৎসাতে এই বাদাম ব্যবহার শুরু হয়েছে ১৯২০ সাল থেকে। যদিও এর ব্যবহার নিয়ে বিতর্ক চলছেই। আজ অবধি কোনো মীমাংসায় পৌঁছানো যায়নি।

কেউ কেউ উপকৃত হয়েছেন এমন ঘটনা যেমন আছে, তেমনি খাওয়ার পরপরই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যেতে হয়েছে কয়েকজনকে। তেতো এপ্রিকট কেরনেল খেয়ে কারও মৃত্যু ঘটেছে, এমন খবর পাওয়া যায়নি। তবে দায়িত্বশীলভাবে সাবধানে খেতে হবে। আস্ত বা গোটা বাদাম গিলে খাওয়া নিষেধ। খেতে হবে চিবিয়ে অথবা গুঁড়ো করে জুস বা অন্য খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে। জরুরি যে বিষয়টি মনে রাখা অত্যাবশ্যকীয় তা হলো, পাঁচ-সাতটির বেশি তেতো বাদাম একসঙ্গে খাওয়া যাবে না। প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ডায়েটিশিয়ানের সঙ্গে পরামর্শ করে মাত্রা বা পরিমাণ ঠিক করতে হবে। এমন উদাহরণও আছে, কোনো কোনো ক্যানসার আক্রান্ত মানুষ দৈনিক ৩৫টা করে এই তেতো বাদাম বছরের পর বছর খেয়ে যাচ্ছেন এবং ক্যানসারমুক্ত রয়েছেন। তবে অনেকের কাছে শোনা গেছে ক্যানসারের ব্যথা-যন্ত্রণা উপশমে এপ্রিকটের বাদাম অনেক সহায়ক।

ক্যানসারের রোগী পল রেইডকে অংকোলজিস্টরা জানালেন, তার আয়ু পাঁচ কী সাত বছর। তখন সেই পল রেইড কেমোথেরাপিকে বিদায় জানিয়ে দৈনিক ৩০টি করে এপ্রিকটের তেতো বাদাম খেয়ে ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন করে ১৪ বছর ধরে ক্যানসারমুক্ত জীবন যাপন করছেন। (সানডে মর্নিং হেরাল্ড ৭ মার্চ ২০১০ ও দ্য এইজ ২০ নভেম্বর ২০১১)।

সূত্র: ইন্টারনেট ও বাস্তব প্রেক্ষিত।