বন্ধুত্বের রকমফের

ছবি: প্রথম আলো ছবি
ছবি: প্রথম আলো ছবি

আমাদের পরিবারে আমরা তিন ভাই। আমাদের কোনো বোন নেই, সেটা নিয়ে একসময় খুশি হতাম। কারণ, বোন বিয়ে দিতে গেলে একগাদা টাকা যৌতুক দিতে হবে। আমার গাত্রবর্ণ ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ হওয়াতে মাও মাঝেমধ্যে বলে ফেলতেন, তুমি যদি ছেলে না হয়ে মেয়ে হতে তাহলে দুর্দশার অন্ত ছিল না।

বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ধারণা ভুল প্রমাণিত হতে থাকল। আমরা হয়তোবা হাতেপায়ে বেড়ে উঠছিলাম। কিন্তু আমাদের মানসিক বৃদ্ধি সেই একেবারে শিশু বয়সেই আটকে ছিল। অনেক বড় হয়ে যাওয়ার পরও আমি মেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে কথা জড়িয়ে ফেলতাম। গলা শুকিয়ে যেত। শরীরে ঘাম শুরু হতো।

আর আমাদের সিদ্ধান্তগুলো হতো সব সময়ই অপরিপক্ব ও একপেশে। কোনো মেয়েকে ভালো লেগে গেলে তাকে কীভাবে ভালো লাগার কথাটা বলা যায়, সেই বুদ্ধি দেওয়ার জন্য আমাদের কোনো বোন ছিল না। তাই আমাদের কারওই আর বিয়ের আগে প্রেম করা হয়ে ওঠেনি। কখনো বা যদি প্রেম গায়ে এসে পড়ত, আমরা পালিয়ে বাঁচতাম। তবে আমাদের তিন ভাইয়ের মধ্যে বন্ধুত্বটা ছিল দারুণ উপভোগ্য। সে গল্পই আজ বলব।

আমি আর মেজ ভাই ইউনুস পিঠাপিঠি। আমাদের মধ্যে বয়সের ব্যবধান মাত্র দুই বছর। আর সবার ছোট ইসমাইল আমার চেয়ে প্রায় আট বছরের ছোট। আমাদের তিন ভাইয়ের নামই দাদি রেখেছিলেন নবীদের নামে। কারণ, দাদির মনে ক্ষীণ আশা ছিল অন্ততপক্ষে একজন নাতি তার মাদ্রাসায় পড়ে কোরআনে হাফেজ হবে। তাহলে তাঁরা পরকালে তার সওয়াব পাবেন। কিন্তু তাঁদের দুর্ভাগ্য আমরা তিন ভাই কেউ মাদ্রাসায় পড়িনি।

আমি তৃতীয় শ্রেণিতে ওঠার পর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তাম। তৃতীয় শ্রেণি থেকে পাঠ্যবইয়ের সংখ্যা বেড়ে গিয়ে ছয়টা হয়েছিল। বাংলা বইয়ের নাম ছিল আমার বই। ইংরেজি বইয়ের নাম ছিল ইংলিশ ফর টুডে। অঙ্ক বইয়ের নাম ছিল গণিত। এ ছাড়া ছিল পরিবেশ পরিচিতি সমাজ এবং পরিবেশ পরিচিতি বিজ্ঞান। আর ছিল ইসলাম ধর্ম শিক্ষা।

ইসলাম শিক্ষা বই পড়ে নামাজের নিয়মকানুন থেকে শুরু করে দোয়া দরুদগুলো জেনে গেলাম। তারপর থেকে নামাজ পড়া শুরু করেছিলাম। কিন্তু কেন জানি ধর্মের প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ কখনোই বোধ করিনি। আমার পিঠাপিঠি ইউনুসও বড় হয়ে গেল। তখনো দাদির আশা ছিল অন্ততপক্ষে ইসমাইল মাদ্রাসায় পড়বে। কিন্তু আমি তত দিনে বড় হয়ে গেছি ও সংসারের বিভিন্ন সিদ্ধান্তে হস্তক্ষেপ করতে শুরু করেছি। আমি আমার সাইকেলে চড়িয়ে ইসমাইলকে নিয়ে গিয়ে কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলাম।

আমার আর ইউনুসের বয়সের ব্যবধান কম বলেই হয়তোবা আমাদের মধ্যে বোঝাপড়াটা ছিল দারুণ। দাদির কাছ থেকে আমার শোনা, যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাড়িতে কেউ এসে ইউনুসকে নিয়ে যেতে চাইলে আমি নাকি কান্নাকাটি শুরু করে দিতাম। একটু বড় হয়ে যাওয়ার পর আমাদের চর ভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠানো হলো প্রাথমিকের পাঠ নেওয়ার জন্য। বিদ্যালয়ে দুটি ভবনটি ছিল। একটায় ছিল টিনের বেড়া আর ওপরে টিনের চৌচালা। সেখানে ছিল দুটো কক্ষ। একটাতে ক্লাস নেওয়া হতো ছোট ওয়ান ও বড় ওয়ানের। আর অন্যটাতে নেওয়া হতো দ্বিতীয় শ্রেণির ক্লাস।

স্কুলঘরের টিনের বেড়ার মাঝে কিছু আয়তাকার ফাঁক ছিল জানালা বসানোর জন্য। কিন্তু কোনো জানালা ছিল না। এমনকি দরজার জন্য নির্ধারিত ফাঁকা জায়গাতে ছিল না কোনো দরজা। বর্ষা–বাদলায় মানুষ সেটার মধ্যে গরু–ছাগল বেঁধে রাখত। তাই বালুর মেঝে আর টিনের বেড়ার মধ্যে ফাঁক তৈরি হয়ে গিয়েছিল।

ওখানে আমরা ক্লাস করাকালে কোনো কোনো দিন পড়া পারতাম না। স্যার মার দেওয়ার জন্য কাছে আসতেই আমরা দুই ভাই একে অন্যের দিকে আড়চোখে তাকাতাম আর বুঝে ফেলতাম আমাদের করণীয় কী? আমরা দ্রুতই বইগুলো হাতের মধ্যে নিয়ে হলিউডের সিনেমার নায়কদের মতো করে টিনের বেড়া আর মেঝের ফাঁকা জায়গা দিয়ে পালিয়ে যেতাম। তারপর মাঠের মধ্যে গিয়ে সারা দিন রাখালদের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম।

তখন আমাদের দুজনেরই রাখালদের জন্য মনের মধ্যে এক ধরনের ঈর্ষা কাজ করত। স্বাধীন তাদের জীবন। কোনো স্কুলে যেতে হয় না। ওদের সঙ্গে খেলাধুলা করলেও আমাদের সতর্ক দৃষ্টি থাকত রাস্তার দিকে, কারণ যখন স্কুল ছুটি দিয়ে দেবে। তখন আমরাও তাদের সঙ্গে বাড়ি ফিরব। ভাবটা এমন যে আমরা আসলে সারা দিন স্কুলেই ছিলাম।

পরে নদীভাঙন আমাদের নিয়ে এসে ফেলল কুষ্টিয়ার শহরতলি বাড়াদীতে। ওখানে আসার পর আমরা দুই ভাই যেখানেই যাই সমবয়সী বাচ্চারা সবাই আমাদের দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত শুরুতে। অথবা কোনো খেলায় নিলেও কাইন্টামি করত। আর সেটার প্রতিবাদ করলে আমাদের মার দিত। মার খেয়ে আমরা দুই ভাই কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি চলে আসতাম।

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

একদিন আমরা কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি ফিরে দেখি আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে দাদি আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন। দাদি আমাদের কাঁদতে দেখে বললেন, তোরা আমার নাতি, তোরা পরিজান বিবির নাতি। কার এত বড় সাহস তোদের গায়ে হাত তোলে। আর হাত তুললেই বা তোরা মার খেয়ে কেন কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি আসবি। উল্টো তাকে দুটো মার দিয়ে আসবি।

এরপর থেকে আমাদের সঙ্গে কেউ কাইন্টামি করলে বা লাগতে এলে তাকে আমরা দুই ভাই মিলে এমন মার দিতাম যে সে জীবনে আর আমাদের সঙ্গে লাগতে আসত না। এমনকি আমাদের চেয়ে বয়সে অনেক বড় কেউও যদি আমাদের সঙ্গে কাইন্টামি করত, আমরা তাকে পর্যন্ত মার দিতাম।

একবার এক বড় ভাই ডাংগুলি খেলায় আমাদের সঙ্গে কাইন্টামি করছে দেখে আমরা দুই ভাই একে অপরের দিকে তাকালাম। তারপর আমরা বুঝে গেলাম আমাদের কী করতে হবে। আমি গিয়ে গায়ের জোরে তাকে জাপটে ধরে রাখলাম আর ইউনুস ডাংগুলির ডাং দিয়ে সপাটে তাকে মার দিয়ে চলল। আমাদের কাজকর্ম দেখে তো তিনি রীতিমতো হতভম্ব। পাল্টা মারের আগেই আমরা দুমদাম মার দিয়ে সটকে পড়লাম সেখান থেকে।

পরে এমনও হয়েছে আমাদের সঙ্গে কোনো প্রকার ঝামেলা করেনি, কিন্তু অন্য কারও সঙ্গে কাউকে অন্যায় করতে দেখলেও আমরা দুই ভাই গিয়ে তাকে মেরে আসতাম। এরপর থেকে প্রায় প্রতিদিনই আমাদের বাড়িতে মায়ের কাছে বিচার আসতে শুরু করল। মা আমাদের কোনো ব্যাখ্যা না শুনে উত্তম মধ্যম দিতেন।

আমরা পরদিন আবার অভিযোগকারীকে হাতের নাগালে পেলেই শোধ নিয়ে নিতাম। ফলে অভিযোগ আসা কমে গেল। কিন্তু পাড়ার সব মায়েরা আমাদের নিয়মিত নিজেদের মধ্যে সভা করতে শুরু করলেন। আমরা তখন বেশ কিছু উপাধিও অর্জন করে ফেলেছিলাম। কেউ বলত ডাকাত, কেউ বলত গোঁয়ার, কেউ বলত পারু মানে আমরা চর ভবানীপুর থেকে নদী পার হয়ে শহরে এসেছি ইত্যাদি।

আমাদের ঘরে দুটো কক্ষ ছিল। একটাতে মা–বাবা থাকতেন। তাদের সঙ্গে ইসমাইল ঘুমাত। আর অন্যটাতে আমি আর ইউনুস ঘুমাতাম। আম–তালের মৌসুমে রাতে ঝড় হলেই আমরা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতাম। বাড়িতে কোনো ঘড়ি না থাকায় আমাদের তেমন একটা সময়জ্ঞান ছিল না। সন্তর্পণে ঘরের দরজার খিল খুলে বাইরে এসে শিকল লাগিয়ে দিয়ে আমরা চলে যেতাম আশপাশের বাড়ির আম বা তালগাছের তলায়। তারপর সেই অন্ধকারের মধ্যেই আমরা আম বা তাল কুড়িয়ে আবার বাড়ি ফিরে আসতাম।

একরাতে আমরা মনে করেছি হয়তোবা কিছুক্ষণ পরেই ভোর হবে। তাই ঘর থেকে বের হয়েছি। কারণ সেই রাতে ঝড় হয়েছে। সবার আগে গিয়ে গাছ থেকে পড়া জিনিস কুড়িয়ে আনতে হবে। বাইরে বের হয়ে এপাড়া ওপাড়া ঘুরে গাছের তলা খুঁজে আমরা অপেক্ষায় আছি কখন ফজরের আজান দেবে। কিন্তু আজান আর হয় না। তখন আমাদের উপলব্ধি হলো এখন আসলে অনেক রাত। আমরা অনেক ভয় পেয়ে গেলাম ও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।

রাত জেগে আমরা আরও একটা কাজ খুবই নিয়মিত করতাম। সেটা হলো ভিসিআরে সিনেমা দেখা। আমাদের বাড়িতে কোনো টিভি ছিল না। কিন্তু আশপাশের পাড়ায় কারও বাড়িতে ভিসিআর ভাড়া নিয়ে এলেই আমরা দুই ভাই অবধারিতভাবে সেখানে হাজির হয়ে যেতাম। আগে থেকেই আমরা সবাই জেনে যেতাম কবে কার বাড়িতে ভিসিআর ভাড়া নিয়ে আসবে। সেদিন দিনের বেলাতেই আমরা দুই ভাই মায়ের জমানো টাকা থেকে টাকা চুরি করে রাখতাম। কারণ, আমরা জানতাম মা কোথায় টাকা লুকিয়ে রাখে। সারা রাত নির্ঘুম কাটিয়ে আমরা একটার পর একটা সিনেমা দেখতাম। মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তখনকার সমসাময়িক প্রায় সব বাংলাদেশি ও কলকাতার বাংলা এবং ভারতের সব হিন্দি সিনেমা দেখা হয়ে গিয়েছিল।

এ ছাড়া পাড়ার সব খেলাধুলায় ছিল আমাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। পাড়ায় গাদনের কোর্ট কাটা হবে সেখানে আমরা। ক্রিকেট খেলা হবে, নারকেলগাছের শাখা দিয়ে ব্যাট বানানো থেকে শুরু করে কারও গাছের তলা থেকে জাম্বুরা কুড়িয়ে আনা সবকিছুই আমরা নিজ দায়িত্বে করতাম। আর আমাদের খেলাধুলা করার কোনো নির্দিষ্ট সময় ছিল না। ইচ্ছে করলেই দলবল নিয়ে মাঠে নেমে পড়তাম। আমাদের খেলাধুলার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে পাড়ার মা–বাবারা আমাদের সঙ্গে তাঁদের ছেলেমেয়েদের মেশার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা পর্যন্ত আরোপ করেছিলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমরা এত খেলাধুলা করার পরও স্কুলে সব সময় আমাদের রোল নম্বর প্রথম দিকে থাকত। আসলে আমরা যেসব স্কুলে পড়েছি সেখানে প্রথম বা দ্বিতীয় হওয়ার জন্য তেমন কোনোই পড়াশোনা করা লাগত না। তাই ছিল খেলাধুলা করার অবারিত সুযোগ।

আমি কলেজে ভর্তি হওয়ার আগে পর্যন্ত আমাদের জীবনযাপন প্রণালি মোটামুটি এমনই ছিল। এরপর আমি কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। তারপর থেকে ইউনুসের সঙ্গে সেভাবে সময় কাটানো হয়নি। তত দিনে ইসমাইলও বড় হয়ে গেছে। আমি পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছিলাম চর ভবানীপুর প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। সেখানে পড়া অবস্থায় বোর্ড নির্ধারিত ছয়টা বইয়ের বাইরের অন্য কোনো বই যেমন বাংলা ব্যাকরণ বা ইংরেজি গ্রামার সম্বন্ধে বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। জানতাম না বৃত্তি পরীক্ষা কাকে বলে। তাই যখন ইসমাইলের বেলা এল তখন আমি ওকে নিজ দায়িত্বে পড়ানো শুরু করলাম। ইসমাইল বাড়াদী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অধিকার করলেও পড়াশোনা তেমন একটা হতো না সেখানে। তাই আমি বাড়িতে পড়িয়ে বোর্ড নির্ধারিত বইয়ের বাইরের বিষয়গুলো ঝালাই করে নেওয়ার চেষ্টা করতাম। এতে ওর উপকার হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে সে যখন কুষ্টিয়া জিলা স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেল তখন অনেক ভালো ফল করেছিল। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে যখন মাধ্যমিক দেবে তত দিনে সে জিলা স্কুলে প্রথম স্থান অধিকার করে নিয়েছিল। এরপর কুষ্টিয়া সরকারি কলেজ এবং পরবর্তী সময়ে সেখান থেকে বুয়েটে ভর্তি হয়েছিল।

আমার আর ইউনুসের মধ্যে সেই অর্থে মারামারি হয়েছে মাত্র একবার। এ ছাড়া আমাদের মধ্যে কখনো ঝগড়াও হতো না। বড় হয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সবারই নিজ নিজ সার্কেল তৈরি হয়ে গেল। ইউনুস ও ইসমাইলের বন্ধুদের কাছে আমি হয়ে গেলাম মিয়া ভাই। এখনো ওরা আমাকে সেই নামেই ডাকে। ইউনুসের বন্ধু উপল, তামিম, রকি, মওদুদ, বিজল, তানভীর সবাই আমার ছোট ভাইয়ের জায়গা নিয়ে নিল। একইভাবে ইসমাইলের বন্ধু পাভেল, পুনম, সওগাত, সজীব, নয়ন, আশিক ওরাও আমার ছোট ভাই হয়ে গেল।

বিভিন্ন ছুটিতে যখন আমরা তিন ভাই বাড়ি ফিরতাম, তখন তারা সবাই আমাদের বাড়িতে আসত। এলেই আমরা দলে দলে ভাগ হয়ে কার্ড নিয়ে বসে যেতাম। উপল বলত, মিয়া ভাই তাওয়ায় বসবেন না। আর পাভেল বলত, মিয়া ভাই চলেন মোনাজাত ধরি। আমি ইউনুস ও ইসমাইলকে যতখানি স্নেহ করি ওদের প্রত্যেককে ঠিক ততখানিই করি। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে তার চেয়ে বেশি স্নেহ করি। ওরা আমাদের পরিবারেরই অংশ ছিল ও আছে। আমাদের বিয়ের সময় ওরা সবাই দল বেঁধে এসে হাত লাগিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়া আসার পরও ফেসবুকের কল্যাণে ওদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ হয়। যতবারই কথা হয় ততবারই ওরা আক্ষেপ করে, কত দিন মোনাজাতে বসি না মিয়া ভাই।

ভাইদের মধ্যে ভালোবাসা বা অনুভূতিটা হয় একটু অন্য রকম। এটা ঠিকভাবে প্রকাশ পায় না। কিন্তু এর গভীরতা অনেক। বোনদের মধ্যে বা ভাইবোনের মধ্যে অনুভূতিটা প্রকাশ যতটা সহজ ভাইদের মধ্যে কেন জানি সেটা প্রকাশ করা সম্ভব হয় না। আমি নিজে টিউশনি করে নিজের লেখাপড়ার পাশাপাশি ভাইদের পড়াশোনার খরচ চালাতাম। কিন্তু যখন কেউ বলত, তোমার ছোট ভাইটাকে বা মেজ ভাইটাকে বলো আমার ছেলে বা মেয়েটাকে পড়াতে, আমি পারতপক্ষে রাজি হতাম না। কারণ, আমি মনে করতাম ওদের হয়ে আমিই তো কষ্ট করছি। তাদের এই কষ্টটা করার দরকার নেই।

আমি আমার এই ছোট্ট জীবনে কেঁদেছি মাত্র দুবার। প্রথমবার ইসমাইল যখন অভিমান করে এক সপ্তাহের জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল তখন। তার আগ পর্যন্ত আমার ধারণাও ছিল আমি ওকেই বেশি স্নেহ করি। ওর লেখা ডায়েরি বুকে চেপে ধরে সারা রাত চিৎকার করে কাঁদলাম। আমার কান্না কেউ কখনো শোনেনি। তাই সারা পাড়ার লোক জুটে গেল বাড়িতে। পাড়ার সবাই আমাকে কমবেশি স্নেহ করেন। তাই বিভিন্নজন আমাকে বিভিন্নভাবে প্রবোধ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কিন্তু আমার কান্না আর থামে না। ইসমাইলের বন্ধুরাও অবাক হয়ে আমাকে দেখছিল। ওরাও ওদের মিয়া ভাইয়ের এই আচরণে অভ্যস্ত ছিল না।

দ্বিতীয়বার কান্নার ঘটনাটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত। কাকতালীয়ভাবে ইউনুসের বিয়ের দিন ঠিক করা হলো আমার বিয়ের পরদিন। আসলে ইউনুসের হবু শ্বশুর চাইছিলেন যেহেতু মা–বাবা আমার বিয়ে উপলক্ষে ঢাকা এসেছেন তাই একসঙ্গে দুটো বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে। গত্যন্তর না দেখে আমাদের বিয়ের পরদিন ইউনুসের বিয়ের দিন ধার্য করা হলো। বিয়ের সব রকম আনুষ্ঠানিকতা শেষে ইউনুস থেকে গেল ওর শ্বশুরবাড়িতে। আমি বাসায় ফিরে এলাম। সেই রাতে কেন জানি চোখের পানি আর বাধা মানতে চাইছিল না।

ছবি : সংগৃহীত
ছবি : সংগৃহীত

ইসমাইল বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর যেভাবে কেঁদেছিলাম ঠিক সেভাবে আবারও কাঁদলাম। আমার রুমমেট সাজিদ, সনি, মঈনুল, পার্থ খুবই অবাক হয়েছিল আমার এমন আচরণে। ওদের সঙ্গে বুয়েটে পড়া অবস্থায় পরিচয় ছিল না। কারণ, আমরা ওরা ছিল আমার চেয়ে এক ব্যাচ জুনিয়র আর থাকতও বিভিন্ন হলে। পরবর্তী সময়ে পাস করে থাকার জায়গা খুঁজতে গিয়ে বন্ধু মাহমুদের মাধ্যমে ওদের সঙ্গে পরিচয় হলো। আমরা প্রায় চার বছর একসঙ্গে ছিলাম। আমাদের বাসার পরিবেশ দেখে মনে হতো আমরা যেন বুয়েটের হলেই আছি। তফাত শুধু একটাই আমাদের কোনো পড়াশোনার চাপ নেই। সবাই বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিতে তখন আমরা কাজ করি। বিভিন্নজন বিভিন্ন এলাকায় কাজের অছিলায় গিয়ে বিভিন্ন জিনিস নিয়ে আসি আর মজা করে খাই।

সপ্তাহান্তে ম্যারাথন আড্ডা বসে। সেখানে আবার তাদের বন্ধুরাও এসে যোগ দেয়। তখন পুরো বাসাটা গমগম করতে থাকে। তারাও ছিল আমার ছোট ভাইদের মতোই এবং ইউনুস আর ইসমাইলের বন্ধুদের দেখাদেখি তারাও আমাকে মিয়া ভাই বলেই ডাকত। এমনকি এখনো তাই ডাকে। আমাদের বিবাহ–পরবর্তী অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে তারা বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছিল। ফেসবুকের কল্যাণে এখনো আমাদের মধ্যে যোগাযোগটা আছে। তাদেরও একই প্রশ্ন দেশে কবে আসবেন?

আমার কাছে জীবনের সফলতার মাপকাঠি হচ্ছে মানুষের ভালোবাসা অর্জন। সেদিক দিয়ে আমি আসলেই অনেক ভাগ্যবান। বহু মানুষের ভালোবাসা পেয়েছি ও পেয়ে যাচ্ছি। এখন পেছন দিকে ফিরে তাকালে জীবনটাকে সার্থক মনে হয় যদিও বস্তুগতভাবে আমি তেমন একটা উন্নতি করতে পারিনি। তবে রুমমেট সাজিদ, সনি, মঈনুল, পার্থ এবং ইউনুসের বন্ধু উপল, তামিম, রকি, মওদুদ, বিজল, তানভীর আর ইসমাইলের বন্ধু পাভেল, পুনম, সওগাত, সজীব, নয়ন, আশিক এদের ভালোবাসাটা আমার কাছে বিশেষ কিছু। কারণ, এদের কারও সঙ্গেই আমার রক্তের কোনো সম্পর্ক নেই। এমনকি আগে থেকে তাদের কাউকেই চিনতাম না। তারা আমার কাছে আরও একটা কারণে বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে সেটা হলো ওরা একইসঙ্গে আমার ছোট ভাই আবার আমার বন্ধুও বটে।

এবারের বন্ধু দিবস কবে এসে কবে চলে গেছে বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে খেয়ালই করা হয়ে ওঠেনি। পরবর্তী সময়ে যখন মনে হলো তখন শুধু বারবারই এই ছেলেগুলোর কথা মনে হয়েছে যারা আমাদের পরিবারের কেউ না হয়েও এখন আমাদের পরিবারের অংশ। যদিও সব সময়ই ওদের কথা আমার মনে পড়ে, কারণ ওরা ছিল আমার অবসর মুহূর্তগুলো সুন্দর করে পার করার একনিষ্ঠ সঙ্গী। দোয়া করি ওরা পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক না কেন সারা জীবন যেন এমন বন্ধুবৎসল থাকে আর অকুণ্ঠভাবে পরিচিত–অপরিচিত সবাইকে ভালোবেসে যায় নিঃস্বার্থভাবে। শুভেচ্ছা সবার জন্য।