বঙ্গবন্ধু স্মরণে টরন্টোয় দোয়া ও প্রার্থনা

দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন কবি আসাদ চৌধুরী
দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন কবি আসাদ চৌধুরী

প্রতিটি বাঙালির হৃদয়ে একটি করে হিমালয় আছে। যা ধসে পড়েছিল পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট। অথচ ১৫ আগস্টের আগের দিন পর্যন্ত তা ছিল ‘চির উন্নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির’।

সেদিনের সেই ভয়াল রাতে কৃষ্ণপক্ষের গভীর গহ্বর থেকে উঠে আসা, সেনাবাহিনীর ভেতরের ও বাইরের পাকিস্তানি প্রেতাত্মার দেশীয় দোসরেরা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল সেই মানুষটিকে। যিনি হাজার বছরের বাঙালির অবজ্ঞা, অপমান, জ্বালা, বঞ্চিত ও শোষণের বিরুদ্ধে স্পর্ধিত উচ্চারণ এক তর্জনী উঁচানো হুংকার—‘রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরও দেব, তবু এই দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশা আল্লাহ’। যার ইতিহাস প্রেরণায় বাংলার ফুল, বাংলার ফল, বাংলার বায়ু, বাংলার জলে আগুন জ্বলে উঠেছিল। তিনি সেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

তাঁর ৪৪তম শাহাদতবার্ষিকী ও জাতীয় শোক দিবসে দোয়া মাহফিল ও প্রার্থনা অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছিল কানাডার টরন্টোয় ডেনফোর্থের মিজান অডিটরিয়ামে। আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু পরিষদ কানাডা।

জাতির জনকের শাহাদত দিবস ১৫ আগস্ট। এ বড় দুঃখের দিন। বড় শোকের দিন। এই শোক আমরা যেন বয়ে বেড়াতে পারি দীর্ঘকাল, প্রজন্মকে শোনাতে পারি সেই কৃষ্ণপক্ষ রাতের লম্বা শোকগাথা; স্মৃতির শেষ সীমানা পর্যন্ত। মোনাজাতের ভঙ্গিমায় কথাগুলো বলছিলেন অনুষ্ঠানের সঞ্চালক কবি দেলওয়ার এলাহী।

দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠানে উপস্থিতি
দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠানে উপস্থিতি

সর্বজনীন প্রার্থনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনা হয় পবিত্র কোরআন ও শ্রীমৎ ভাগবত গীতা পাঠের মধ্য দিয়ে। সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন মনির বাবু।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শনের ওপর কথা বলেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য কৃষিবিদ আবদুল আওয়াল, উদীচীর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মুক্তিযোদ্ধা আজিজুল মালিক, সাংস্কৃতিক কর্মী ফারহানা শান্তা, বাকসুর সাবেক ভিপি কৃষিবিদ ফায়জুল করিম, আওয়ামী লীগের কানাডা শাখার নেতা অ্যাডভোকেট আবদুস ছালাম, ওন্টারিও শাখার যুগ্ম সম্পাদক কৃষিবিদ আবুল বাশার, প্রকৌশলী নওশের আলী, তাজুল ইসলাম, দেওয়ান হক, আফিয়া বেগম, বঙ্গবন্ধু পরিষদ কানাডার সভাপতি আমিন মিয়া ও সহসভাপতি কৃষিবিদ সুমন সাঈদ।

আর হিমালয়কে কাছে থেকে প্রত্যক্ষ করেছেন, সান্নিধ্যে এসেছেন, এমন অনেক ভাগ্যবানদের একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় কবি আসাদ চৌধুরী। তাঁর বক্তব্যে অতীত হানা দেয় স্মৃতির দরজায়। ঘুরে আসেন নিজের বাবার কবরে। ১৯৬৫ সালে নিজের বাবার মৃত্যুতে, কবরে মাটি দিয়ে যখন তিনি উঠলেন; তাঁকে তোলা হলো, সারা শরীরে তখনো মাটি। এক ভরসার হাতের অস্তিত্ব টের পেলেন তাঁর কাঁধে; পেছন ফিরে দেখলেন বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে। সেই হাত এখন সতেরো কোটি মানুষের কাঁধে; দাবায়ে রাখতে না পারার সাহস হয়ে পথ দেখায় ইতিহাসের আগে-আগে।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন কী তিনি চান? তিনি চান বাংলার মানুষ ভরা পেট ভাত পাক, তিনি চান, তাঁর বাংলার মানুষ কাজ পাক, বাংলার মানুষ সুখী হোক, হেসেখেলে বেড়াক, তাঁর সোনার বাংলার মানুষের মুখে হাসি ফুটে উঠুক।

এই হাসি ফোটাতে গিয়ে, বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, মানবিক মূল্যবোধ সমন্বিত সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন নিয়ে যখন তৃতীয় বিশ্বের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হতে চলেছিলেন, ঠিক তখনই সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত আর পথভ্রষ্ট কিছু সামরিক বাহিনীর সদস্য, হত্যা করে স্বাধীনতা নামক কাব্যের কবিকে আর তাঁর কবিতার মতো পরিবারকে। তাই কবিহীন এই শোকের সমুদ্রে আজ আমরা হাল ভাঙা মাঝির মতো হারিয়েছি দিশা।

পঁচাত্তর–পরবর্তী প্রতিটি সরকারের প্রত্যক্ষ সহায়তায় বেড়েছে ধর্মান্ধ মৌলবাদের প্রভাব। জাতির জনকের সুযোগ্য কন্যার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অবিশ্বাস্য রকমভাবে উন্নতি করেছে। তবে নৈতিকতার দিক দিয়ে আমরা অনেকটাই নিচে নেমে এসেছি আর চাটার দলের সংখ্যা সূচকের অনেক ঊর্ধ্বে।

দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠানে সমবেতদের একাংশ
দোয়া ও প্রার্থনা অনুষ্ঠানে সমবেতদের একাংশ

তাই সত্যান্বেষী কবি আসাদ চৌধুরী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে এই বিপর্যয় মোকাবিলার কথা বলেছেন। রাজনীতি ব্যর্থ এমন হলে, সাংস্কৃতিক কর্মীদের দায়িত্ব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। যেমন এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলরে’ আর নজরুল বলেছিলেন, ‘লাথি মার ভাঙরে তালা যত সব বন্দিশালা আগুন জ্বালা’। ইতিহাস তাই বলে।

১৯৫৪ সালের নির্বাচনের আগে পদ্মায় বোটে গান থামিয়ে আব্বাসউদ্দীন বলেছিলেন, শেখ মুজিব আমাদের ভাষাটাকে, আমাদের সংস্কৃতিটাকে বাঁচাও। আমাদের সংস্কৃতি না থাকলে আমাদের কিচ্ছু থাকবে না; সাইকেল চালিয়ে রাজনীতি করা সেদিনের শেখ মুজিব তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন (সূত্র: বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী) এবং সেই লক্ষ্যে বাঙালিকে মুক্তির মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছিলেন। এরপর আমরা স্বাধীনতা পেলাম ১৯৭১ সালে।

মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায়, স্বাধীনতাকে বুলেটে রক্তাক্ত করে হায়েনার দল। আমরা হারিয়েছি জাতির পিতাকে। রাজনীতি আবারও ব্যর্থ হলে, বঙ্গবন্ধুর চেতনার রেণু হয়ে সেই যুবসমাজ আর সাংস্কৃতিক কর্মীরা জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিচার ত্বরান্বিত করেছে। বঙ্গবন্ধুর বাঙালি প্রমাণ করেছে, বাঙালি পেরেছে, বাঙালিই পারবে; বাঙালিকে দাবায়ে রাখা যাবে না। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দিতে আমরা বঙ্গবন্ধু পরিষদ কানাডা দায়িত্ব থেকে বিস্তৃত হইনি, হব না। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের কর্মে, আমাদের মর্মে, আমাদের চেতনার হৃদয় আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে থাকা হিমালয় সুবিশাল উচ্চতায়।