বঙ্গবন্ধু আর কবিতা এক হয়ে যায়

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে বঙ্গবন্ধু পরিষদের শ্রদ্ধাঞ্জলি
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে বঙ্গবন্ধু পরিষদের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে জাতি হারিয়েছে নির্ভরতার প্রিয় মানুষটিকে। বাঙালি তাঁকে স্মরণ করে দারুণ মনোবেদনায়। আবার জ্বলেও ওঠে অদম্য সাহসে।

এ যে কবিতার লাইন। তাই তো ‘খই ফোটায়’ যত্রতত্র।

সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবিতে বাংলাদেশ দূতাবাস ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন করল যথাযোগ্য মর্যাদায়। শুরুর পর্বে আমার সোনার বাংলা বাজছে। রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ ইমরান জাতীয় পতাকার রশি ছাড়ছেন। আস্তে আস্তে সে পতাকা উঠল খুঁটির অর্ধেক দৈর্ঘ্য পর্যন্ত। সবাই তাকিয়ে রইলেন। শ্রদ্ধায় অবনত হলো জাতির জনকের স্মৃতিতে।

এরপর শ্রদ্ধাঞ্জলি ঢেলে দিল বঙ্গবন্ধুর উদ্দেশে। বাংলাদেশ দূতাবাস, জনতা ব্যাংক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, প্রজন্ম বঙ্গবন্ধু নিজেকে সঁপে দিল ফুলের বেদিতে। কবিতাগুলো ফুল হয়ে যায় কিংবা ফুলগুলো কবিতা।

নওশাদ নুরী ১৯৭৫ সালের ১৭ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর লাশ দাফনের পর লেখেন ‘জন্ম টুঙ্গিপাড়া’।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে আওয়ামী লীগের শ্রদ্ধাঞ্জলি
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে আওয়ামী লীগের শ্রদ্ধাঞ্জলি

তোমরা কি জানো? তোমারা কি জানো?
পথের শুরুটা হয়েছিল এই খানে,
পথ খোয়া গেল, হায়, সেও এই খানে।

নুরী বাংলাদেশের প্রধানতম উর্দু কবির একজন। ব্রিটিশ-ভারতের বিহারে জন্ম। তবে একপর্যায়ে বাংলাদেশে থিথু হন।

কিছু তরুণ লাশটা নিয়ে বিপদেই পড়েছিল। তারা সন্তর্পণে এদিক-ওদিকে তাকায়। খোঁজে একটি অভয় অরণ্য।

‘এ লাশ আমরা রাখব কোথায়?’ তাই তো! সমস্যাই বটে।

কিন্তু ওদের বেলায় কোনো ঝামেলা হয়নি। ওই যে অল্প কিছু বিপথগামী সেনাসদস্য! ১৫ আগস্টের রাতে ঠিক ঠিকই পৌঁছে গিয়েছিল ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে। ঘটিয়েছিল বাঙালির ইতিহাসে সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হত্যাকাণ্ড।

আসলে কি বঙ্গবন্ধুকে মারা সম্ভব হয়েছিল?’ পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টেই নুরী লেখেন প্রাণের কথা। কবিতার নাম ‘উত্থান-উৎস’।

তিনি বলেছেন, …সে আছে, সে আছে— / সর্বদা হাজির সে যে, অফুরান শক্তি হয়ে/ সে আছে, সে আছে/ সে অমর, মৃত্যুঞ্জয়ী, মৃত্যু নেই তার।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে কবির লেখা এ দ্বিতীয় কবিতা।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে জনতা ব্যাংকের শ্রদ্ধাঞ্জলি
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে জনতা ব্যাংকের শ্রদ্ধাঞ্জলি

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের প্রথম কবিতাটি রচিত হয় আরবিতে। দ্বিতীয় ও তৃতীয়টি উর্দুতে। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ কাফনের কাপড়ে মুড়িয়ে সমাধিস্থ করার পর মৌলভি শেখ আবদুল হালিম লেখেন তাঁর মনোবেদনা। আরবি এই শিক্ষক বঙ্গবন্ধুর বাল্যবন্ধু।

হে মহান, যাঁর অস্থি-মজ্জা, চর্বি ও মাংস এই কবরে গ্রোথিত।/ যাঁর আলোতে সারা হিন্দুস্তান, বিশেষ করে বাংলাদেশ
আলোকিত হয়েছিল। /… … নিশ্চয়ই তুমি বিশ্বের উৎপীড়িত এবং নিপীড়িতদের পৃষ্ঠপোষক হিসেবে জন্মগ্রহণ করেছিলে।…
চতুর্থ কবিতাটি লেখেন দেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক সন্তোষ গুপ্ত। কবিতার নাম ‘রক্তাক্ত প্রচ্ছদের কাহিনি’। বাংলায় এরপর লেখেন নির্মলেন্দু গুণ। আমি আজ কারও রক্ত চাইতে আসিনি। বাংলা একাডেমিতে এই কবিতা পড়ার কারণে কবিকে সাত দিন রমনা থানা হাজতে থাকতে হয়েছিল।

কবিতার গণ্ডি অনেক বড়। ১৫ আগস্ট দূতাবাসে বাংলাদেশ থেকে পাঠানো লেখা পড়লেন কর্মকর্তারা। রাষ্ট্রপতির বাণী উচ্চারিত হলো শ্রমবিষয়ক কাউন্সেলর মোহাম্মদ আবদুল আলীম মিয়ার কণ্ঠে। প্রধানমন্ত্রীর লাইনগুলো পাঠ করলেন প্রথম সচিব রেয়াজুল হক। প্রথম সচিব মোহাম্মদ জোবায়েদ হোসেন পড়লেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর লেখা। কবিতার সুরে ভরা এ বাণী।

ফাঁকে বলে নিই, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তাঁকে নিয়ে প্রথম গল্পটি লেখেন আবুল ফজল। ‘মৃতের আত্মহত্যা’। ১৫ আগস্ট গল্পটি লেখা হয়। প্রথম গান লেখেন কবি কামাল চৌধুরী ও নাট্যব্যক্তিত্ব লিয়াকত আলী লাকী। কবিতার প্রসঙ্গ নিয়ে শুরু। মূলত বঙ্গবন্ধু নিজেই একজন কবি, তিনি যা বলেন তা–ও কবিতা। কেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তার এ কথাগুলো কি কবিতা নয়? নির্মলেন্দু গুণ সে সত্যটি জীবন্ত করে তুলেছেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে যা লেখা হয়, তা–ও হয়ে ওঠে কবিতা। কবিতার বরপুত্র তিনি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও এমনটিই বলেছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে বাংলাদেশ সমিতির শ্রদ্ধাঞ্জলি
বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে বাংলাদেশ সমিতির শ্রদ্ধাঞ্জলি

শেখ যায়েদ ইউনিভার্সিটির সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. হাবিব উল হক খন্দকার বললেন, সংক্ষিপ্ত এক কবিতা। বঙ্গবন্ধুর শোক আয়োজনের আছে এক ঐতিহাসিক তাৎপর্য। কোথায় দাঁড়িয়ে আমরা সেটিও বের করার চেতনায় প্রদীপ্ত হই এই অনুষ্ঠানে। সমাজতত্ত্বের বিশ্লেষণ বুঝি এমনই!

বাংলাদেশ সমিতির সভাপতি প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর শাহাদতবার্ষিকীতে এক জায়গায় আসি আমরা। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর বাণীতে পুনরুজ্জীবিত হই। সুনির্দিষ্ট আকাঙ্ক্ষা নিয়ে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বাংলাদেশ হয়ে উঠবে শান্তির নীড়। এ–ও কি কম কবিতা! দূতাবাস থেকে রাষ্ট্রদূতের পক্ষে শহীদুল ইসলাম আমন্ত্রণ জানান, তাতেও কবিতার ছন্দ।

১৫ আগস্টকে সাজানো হয় হৃদয়ের মাধুরী দিয়ে। প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব, তাঁর ব্যক্তিত্বমানস ফুটে ওঠে। ভাষ্যকারের বর্ণনা এ ক্ষেত্রে হয়ে ওঠে দুধে চিনি সংমিশ্রণ।

কবিতার পাতা খুলতে থাকে। জনতা ব্যাংকের নির্বাহী কর্মকর্তা আমিরুল হাসান বলেন, সময়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু অধিকতর প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন। দুঃখে দৈন্যে তাঁর আত্মজীবনী ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রীয় জীবনে পথ দেখায়। একই ব্যাংকের ব্যবস্থাপক আবদুল হাই তুলে আনেন জননন্দিত মুজিবকে। বলেন, মানুষের প্রতি ভালোবাসার জন্য বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন অনুপ্রেরণার উৎস।

বঙ্গবন্ধু পরিষদ আবুধাবির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ইমরাদ হোসেন ইমু। অনুপ্রবেশকারী মতলববাজেরা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করবে, ভয় তাঁর। আবার তৎক্ষণাৎ বলে ওঠেন, সতর্ক থাকলে সবই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।

জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ
জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতকরণ

এসেছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ আল আইনের উত্তম কুমার হাওলাদার। ষোলো আনা আশা তাঁর। বলেন, শোক দিবসে শ্রদ্ধা জানাই, অঙ্গীকারের নবায়ন হয়, প্রস্তুত হয়ে উঠি বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে।

আওয়ামী লীগ আবুধাবির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি এস কে আলাউদ্দিন দলীয় কার্যক্রম অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেন। ভিসা সমস্যা শেষ হবে, সে প্রত্যাশা তাঁর মনে।

সবই কবিতা, কবিতার ডানারা ওড়ে ব্যক্তি থেকে সমাজে, সমাজ থেকে রাষ্ট্রে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই তরুণদের কাঁধে তখনো বঙ্গবন্ধুর লাশ। ওরা বলে—মৃত্তিকা বলো, পর্বত বলো/ অথবা সুনীল-সাগর-জল—সবকিছুই ছেঁদো, তুচ্ছ শুধুই!/ তাই তো রাখি না এ লাশ/ আজ মাটিতে পাহাড়ে কিংবা সাগরে।

ওরা নির্ভার হয়। মনের কথাগুলো বেরিয়ে যায়।

হৃদয়ে হৃদয়ে দিয়েছি ঠাঁই।

বঙ্গবন্ধু আর কবিতা এক হয়ে যায়। তরুণেরা স্বস্তি পায়। তারা ছোটে সামনের দিকে।