ডায়েরিতে নানি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সাবিনা? কে, সাবিনা? সাবিনা এসেছে?

একবার না, দুবার না, তিন-তিনবার আমার নাম উচ্চারণ করলেন। আমার দিকে তাকালেন সমস্ত মনোযোগ মেলে। তাকিয়েই থাকলেন অনেকক্ষণ। তাঁর ঠোঁট দুটো, দাঁতের পাটি ও চোয়ালও নড়ছে। সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে কিছু যেন বলতে চাচ্ছেন। কিন্তু আর কোনো শব্দই বেরোল না।

বালিশে এলানো আপনার হাতখানেক বেণিটা নিয়ে গেল দুই যুগ আগে। এই বেণি কয় হাত লম্বা ছিল, মনে আছে? সেই সুঠাম, দীঘল বেণি বোনার বান্দা হেয়ার ড্রেসার ছিলাম আমি। আপনার হাঁটু ছাড়ানো ওই সুন্দর বনে মাঝে মাঝে উকুনের উপদ্রব হতো। আমাকে সেনাপতি নিযুক্ত করেছিলেন উকুনযুদ্ধের। বলতেন, তুই মাঠে না নামলে ওরা সমূলে উৎপাটিত হবে না। তাই, বারবার, দূত পাঠিয়ে আমাকে ডেকে নিতেন যুদ্ধক্ষেত্রে।

উষ্ণ বা শীতল, শিমুল বা সাগরি যেই রং আপনার কোলে উঠত, সেই রংই প্রিয় মনে হতো; সেই শাড়িগুলোর প্রেমে পড়তাম বারবার। মুছে গেছে সেই বর্ণাঢ্য অনুচ্ছেদ। মেঘলা হয়ে গেছে আপনার সেই অরুণ বরণ, যা দেখে ‘মেম এসেছে’ রব উঠত গ্রামে বেড়াতে গেলে। সতত আসরের মধ্যমণি আপনি, এখন নিলয়ের বিয়ের কোনো কোণেও নেই। একই বাড়িতে কত আয়োজন, গুঞ্জন, কত সাজ সাজ রব। আর আপনি নীরব।

ঘুমের মাঝে প্রায়ই টুং টাং শুনলে বুঝতাম আপনি সাহরি করছেন। নানি, এত রোজা রাখেন কেন? জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘তোর অমুক মামা/খালা পেটে থাকতে বা দুধ খাওয়ার সময়ের কাজা রোজা এসব।’ আপনার সেই সংগ্রাম না দেখলে হয়তো আমার কাজা রোজাগুলো এখনো গলায় ঝুলত। ঘুম ভেঙে দেখতাম আমার জন্য খাবার সাজিয়ে রেখেছেন। ছিমছাম টেবিলে ঢাকা প্লেট ও বাটির পাশে ঢাকা ভরা গ্লাস। লবণের খুরিটি পর্যন্ত অনতি দূরে রাখা। ভালো কিছু রান্না করলে খবর পাঠাতেন। খেতে বসে দেখতাম মগজ, কলিজা ভুনা, কাবাব আরও কত পদ! সেই পদাবলির শানে নুজুল জানতে চাইলে বলতেন, ‘তোর পছন্দের খাবারগুলো একটু একটু করে ফ্রিজ করে রাখি। তোকে তো আর সহজে পাই না।’

আমার পছন্দের কথা কেমনে জানে নানি?

মনে মনে ভাবতাম, আর স্কুবা ডাইভে ডুবে যেতাম আপনার প্রীতি সাগরে।

আপনার ফরমাশে ঈদের শুভেচ্ছাবাণী লিখে দিতাম আর আপনি সেসব ঈদ কার্ড কপি করে বিদেশে মামাদের কাছে পাঠাতেন। যথারীতি, আপনার প্রথম পুতির জন্য প্রথম ঈদের শুভেচ্ছা বাণী লেখার গুরুভার আমার কাঁধে দিলেন। আমি খেয়ে না খেয়ে, দাঁড়িয়ে, বসে, শুয়ে মোমিনের জন্য বেস্ট ছড়া এভার ইন দ্য হোল ওয়াইড ওয়ার্ল্ড খুঁজতাম। তারপর, আমার সেই কাব্য কণাটি মনে আছে?

সোনামণি চাঁদ তুমি জ্যোৎস্নায় গলে,
এসো এসো চুপি চুপি দাদিমার কোলে।

কত সহজেই না আপনাকে খুশি করা যেত। সেই অমূল্য সুখের নাওয়ে ভাসা যেত দুজনে।

যেমন, আপনি বিছানা ঝাড়ছেন।

: দেন নানি আমি ঝাড়ি।

: ঝাড়বি? আচ্ছা নে।

হাসতে হাসতে ঝাড়ুটা হস্তগত করতেন, যেন আপনাকে ১৬ কোটি টাকা অফার করেছি।

অথচ, আপনি বিছানা ঝাড়ার ভর ও গতি ঝড়ের বেগে বাড়িয়ে বলতে পারতেন, সর! সকাল থেকে বিছানা উলটে ছিল, তখন কোনো খবর ছিল না, আর এখন এসেছে ঢং করতে!

অন্য কেউ হলে তার মদনা ঝাড়ি কিংবা ঝাড়ুর বাড়ির ভয়ে টুঁ শব্দটা করতে পারতাম না। সকাল থেকে বিছানা না গোছানোর অপরাধ নিয়ে জীবন পার করতে হতো। আর আপনি প্রায়শ্চিত্ত করতে দেন। এক কুটি ভালোবাসাও সহাস্যে হাত বাড়িয়ে নেন। সহজে ভালোবাসা গ্রহণের সহজাত পারদর্শিতা ছিল আপনার।

লস অ্যাঞ্জেলেস থেকে আমার বান্ধবী সিমি আপনাকে দেখতে গিয়েছিল।

ও চলে গেলে অশ্রু নেয়ে বলেছিলেন, ‘সবাই আসে, শুধু আমার ছাওয়ালটা আসে না।’

নাহার বলে, আমি আসার আগে ফুফুমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। ফুফু জিজ্ঞেস করেছিল, ‘তুইও কি সাবিনার মতো একবারেই চলে যাবি? আর আসবি না কোনো দিন?’

আপনার মতো শান্তিপ্রিয় মানুষ একদিন ফোনে আমার শাশুড়িকে আক্রমণ করলেন, কেমন ছেলে পালছেন...? আমার সাবিনাকে নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে!

মামারা বিদেশ থেকে এলে, ছোট খালা, বড় খালারাসহ আমরা তৎকালীন ১০ জন কাজিন আপনার বাসায় মিলিত হতাম। রাতে গানের আসর বসত। ছোট মামা তবলায়, আর আমরা বোনরা গানে। ‘আজও মধুর বাঁশরী বাজে’, ‘যাক না নিশি গানে গানে জাগরণে’, ‘আহা আজি এ বসন্তে’ এসব গানের বানে সত্যিই মধ্যরাত হয়ে যেত। আমরা বাসায় চলে আসতে চাইলে বাদ সাধতেন। স্থান সংকুলানজনিত উদ্বেগেরও অবসান করতেন এক বিশেষ বাক্যে।

‘মনে জায়গা হলেই ঘরে জায়গা হয়।’

জানেন নানি, সেদিন বাফেলো থেকে রেণু ভাবিরা বেড়াতে এলেন। রেণু ভাবির পরিবার, বাংলাদেশ থেকে আগত তার মা-বাবা ও আমরা মিলে অনেক মানুষ। রাতে তাঁরা হোটেলে উঠতে চাচ্ছিলেন জায়গা হবে না ভেবে।

তখন আমি বললাম, মনে জায়গা হলেই ঘরে জায়গা হয়।

রেণু ভাবি ভাপা পিঠার উষ্ণতা ছড়িয়ে বললেন, ‘সুন্দর কথা বলেছেন তো! এমন কথা শুনিনি কখনো।’

ভাবিকে জানালাম, এটা, আমার কথা না, আমার নানির কথা।

আমেরিকা আসার আগের দিন, রাত ১২টার পর বাসায় ফিরে দেখি হাস্যোজ্জ্বল আপনি দরজা মেলে দাঁড়িয়ে।

: কখন এলেন নানি?

: এই তো সন্ধ্যায়।

: এতক্ষণ ঘুমাননি?

: তোর জন্যই তো অপেক্ষা করছি। আগামীকাল ভিড়ের মধ্যে তোকে কী আর এভাবে পাব?

যখন রুপা খচিত, মেন্দি রং, জর্জেট থ্রি পিসটা সুটকেসে ভরছিলাম, আপনি বিটলামি করে বললেন, ‘এটা পরলে নাতজামাই জ্ঞান হারায় কিনা…!

তখন পাশ থেকে কে যেন গেয়ে উঠল, ‘আমি জ্ঞান হারাব, মরেই যাব…।’ আর আমরা সে কী হাসি। আমরা একসঙ্গে আর কোনো দিন হাসব না, গল্প করব না, আপনি কি তা বুঝেছিলেন? তাই কি এক রতি স্মৃতির গয়না গড়তে অত রাত অবধি বসেছিলেন? এই ১৯ বছর ধরে যখনই আপনার কথা ভেবেছি, মনে ভেসেছে মধ্য রাতের সেই মধ্যবয়সী চাঁদমুখ, যা একটু বেশিই জোস্নীল লাগছিল।

৯ মার্চ ২০১৮

নানি মানে সুন্দর শাড়ি, গয়না, পরিপাটি বাড়ি। নানি মানে সুস্বাদু তরকারি, উচ্ছ্বসিত হাসি, উপচানো গল্প। নানি মানে শেষ রাতের নামাজ। নানি মানে প্রিয় ফুফু, প্রিয় খালা, প্রিয় চাচি, প্রিয় বুবু। নানি মানে প্রিয় কন্যা, জায়া, জননী। নানি মানে প্রিয় নানি। নানি মানে জাহানআরা।

আজ যেমন নানির ইহজীবনে দাঁড়ি, তেমনি তাঁর তাবৎ কষ্টেও দাঁড়ি দিয়ে দাও। এই শেষ বিকেলের রোদ যেমন নরম, এর চেয়েও নরম থেকো তুমি তাঁর প্রতি পরকালে। নানি যেমন রাজকীয় মনের মানুষ, তেমনি রাজকীয় সংবর্ধনা তাকে দিয়ো তোমার চিরকালীন রাজস্থানে।
___

নুসরাত সাবিনা: শিক্ষিকা, মন্টেসরি স্কুল, মেরিল্যান্ড, যুক্তরাষ্ট্র।