সৌন্দর্য আর শুভ্রতার অন্বেষণে ল্যাভেন্ডার বাগানে

ল্যাভেন্ডার ফুল
ল্যাভেন্ডার ফুল

ল্যাভেন্ডার নামটা শুনলেই একটা শুভ্রময়, শান্তিময় ও সুগন্ধময় অনুভূতি চলে আসে। বেগুনি রঙের এই ফুলের মাঝে যেন অদ্ভুত এক শুভ্রতা আছে, যা মানুষকে কাছে টেনে নেয়। হালকা বেগুনি এই ফুলের রংটাকে বলা হয় রাজকীয় বর্ণ। বাস্তবে ল্যাভেন্ডার হচ্ছে পরিশুদ্ধতা, বিশ্বস্ততা ও স্বকীয়তার প্রতীক। এ তো গেল রঙের বিশ্লেষণ। আর ল্যাভেন্ডার ফুল হলো কেন্দ্রীভূত শক্তির প্রতীক।

ল্যাভেন্ডার বাগানে দোকান
ল্যাভেন্ডার বাগানে দোকান

এই গ্রীষ্মের ছুটিতে ঠিক করলাম ল্যাভেন্ডার বাগানে যাব আর সুন্দর সুন্দর ছবি তুলব। ফুলটা থাকে জুলাই থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত। পুরো ইংল্যান্ডে অনেক ল্যাভেন্ডার বাগান আছে, যা দর্শনার্থীর জন্য দিনের বেলা খোলা থাকে।

আমরা ঠিক করলাম দক্ষিণ ইংল্যান্ডের ক্রয়ডন শহরের কাছে মে ফিল্ড ল্যাভেন্ডার বাগানে যাব। এটা আমাদের বাসা থেকে খুব একটা দূরেও না। মোটরওয়ে থেকে নেমে শেষের সাত-আট মাইল কান্ট্রি রোড। কোনোমতে দুটি গাড়ির জায়গা হয়। আর ফার্মে ঢোকার আগেই গাড়ির বিশাল লাইন। ভিড় দেখেই অনুমান করা যায় ল্যাভেন্ডারের জনপ্রিয়তা।

ট্রাক্টরে লেখিকার দুই মেয়ে
ট্রাক্টরে লেখিকার দুই মেয়ে

বেগুনি আমার বড় মেয়ে ইসরার পছন্দের রং। তাই সে অনেক বেশি উৎসাহী ছিল। বাগানে যাওয়ার জন্য গেটের ভেতরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে অদ্ভুত একটা জিনিস চোখে পড়ল। সেটা হলো এখানে ফুলের সঙ্গে মিতালি করার জন্য অন্য সব জিনিসও বেগুনি। যেমন ছোট ছোট ঝুলন্ত ফুলের ঝুড়িগুলো বেগুনি। ঝুড়ির ভেতরের ফুলগুলোও বেগুনি আর সাদার মিশ্রণ।

এ ছাড়া এখানকার সব রেস্টুরেন্ট, আইসক্রিমের দোকান, কফি শপ, স্যুভেনির শপের সব সাজসজ্জা, বিস্কুটের প্যাকেটের রং, কেকের মোড়কের রং, কফির কাপের রং এবং ছাদের রংও বেগুনি। শুধু তা-ই নয়, চেয়ার-টেবিল, বাথরুমের দরজা, এমনকি বিনগুলোও বেগুনি।

ল্যাভেন্ডার বাগান
ল্যাভেন্ডার বাগান

যেহেতু ফুলটা থাকে মাত্র কয়েক মাস, তাই মাঠজুড়ে ছিল অসংখ্য মানুষ। সবাই বিভিন্ন স্টাইলে ছবি তুলছে। মাঠের মাঝখানে একটা ট্রাক্টর আর লাল টেলিফোন বুথ রাখা। লাইন ধরে সবাই ছবি তুলছে। আমরাও বাদ গেলাম না তা থেকে।

আমাদের মেয়েরা মাঠে নেমেই ঘোষণা দিল, গাছের সারিগুলোতে ঢুকবে না (ছোটজন বড়জনের উপযুক্ত সাগরেদ, বড়জন যেটাই বলবে বা করবে, তারও ঠিক তা-ই করতে হবে)। কারণ, এই ফুলে নাকি অনেক মৌমাছি থাকে। আমরা বোঝালাম, চল ঢুকি, মৌমাছি থাকলে বের হয়ে আসব। তারপর যখন সারি সারি বেগুনি ল্যাভেন্ডারের মাঝে ঢুকলাম তখন আর কে পায় ওদের। দুজনে এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে পুরো মাতিয়ে ফেলল।

সপরিবার লেখিকা
সপরিবার লেখিকা

বিশাল মাঠের মাঝে এত এত সারি সারি বেগুনি ল্যাভেন্ডারের মাঝ দিয়ে হাঁটার সময় মনের ভেতর এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছিল। সঙ্গে সঙ্গে সেদিনের আকাশটাও এত দারুণ সুন্দর নীল ছিল। আকাশের নীলের সঙ্গে বেগুনি ফুলের শুভ্রতা যেন এক অপার্থিব সুন্দর পরিবেশ তৈরি করেছে।

বেগুনি ফুলের সঙ্গে ছবি তোলার জন্য অধিকাংশ মানুষই বিভিন্ন ডিজাইনের সাদা কাপড় পরেছে। সাদা ও বেগুনি মিলে একটা অন্য রকমের উজ্জ্বলতার আবহ তৈরি করেছে। একটা মাঠে ঘোরাঘুরি শেষ করে পরেরটাতে যাওয়ার পর অনুভূতিটা ছিল এমন যে এই বেগুনি রংটা তো আগেরটার চেয়ে আরও বেশি সুন্দর। আসলে ফুলটা এতই স্নিগ্ধ যে কোনটা বেশি আর কোনটা কম সুন্দর বলার উপায় নেই।

এই ফুল যে শুধু সৌন্দর্যই বিলিয়ে দিচ্ছে, তা কিন্তু নয়। এর আরও বহুবিধ গুণও রয়েছে। এর নির্যাস থেকে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের সুগন্ধি দ্রব্য। যেমন সাবান, পারফিউম, তেলসহ অনেক কিছু। এই ফুলের প্রদাহ নিরোধক গুণ থাকায় বিভিন্ন ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়। ল্যাভেন্ডার নামটা মূলত ল্যাটিন লাইবেরিয়া থেকে এসেছে, যার বাংলা নীলাঞ্জনা। কথিত আছে, ল্যাভেন্ডারের লুক্কায়িত শক্তি আছে, যা কিনা মানুষের আশা ও ভালোবাসাকে আরও দৃঢ় করে।

কীভাবে যে কয়েক ঘণ্টা কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না। বাগানের একজন স্টাফ এসে বলে গেলেন, আর পাঁচ মিনিট পরে বাগানের গেট বন্ধ করে দেবেন। তাই সবাই সবকিছু গুছিয়ে গাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম।

ল্যাভেন্ডারের মতো আমাদের সবার মন ও জীবন সুন্দর আর শুদ্ধ হোক, সেই সঙ্গে ছড়িয়ে পড়ুক ভালোবাসার আলোকচ্ছটা। বিদায় বেগুনি রানি, আবার হয়তো হবে দেখা।