টুম জীবন: কফিময় সকাল ও দেশি ফ্রাউ

ক্লিনিকুম রেখট ডের ইজার। ছবি: সংগৃহীত
ক্লিনিকুম রেখট ডের ইজার। ছবি: সংগৃহীত

‘ন‍তুন আসা ফ্রাউ ডক্টর তো তিন কাপ কফি গিলে টেবিলে মাথা ঠুকে পড়ে আছে।’

ঝটকা মেরে সোজা হয়ে বসলাম। কে মাথা ঠুকে পড়ে আছে? ১০ মিনিটের একটা পাওয়ার ন্যাপ নিচ্ছিলাম, সেটাও কারও সইল না।

ছোট্ট করে বলে রাখি, ফ্রাউ মানে ভদ্রমহিলা, মহাশয়া, মেয়ে ইত্যাদি।

যা হোক, তুর্কি ক্লিনিং লেডির অভিযোগ ভেসে আসছে, ‘সকালটাও পার হতে পারল না, এদিকে কাগজের কাপে ময়লার বিন উপচে পড়ছে। আর পারি না বাপ...’ গজগজ গজগজ। তারপর অফিসের খোলা দরজার সামনে যার কাছে মনের ঝাল ঝাড়ছিল, তাকে বিদায় দিয়ে খালি বিন জায়গামতো রেখে আমাকে পুরোপুরি উপেক্ষা করে সে পা চালিয়ে দিল।

বেগতিক দেখে তার পথ আগলে মৃদু গলাখাঁকারি দিলাম, ‘সালাম। মাফ চাইছি, কফিটা বেশি খাওয়া হয়ে যাচ্ছে বুঝি? কাপগুলো না হয়ে একসঙ্গে জড়ো করে নিজেই ফেলে দিয়ে আসব?’

কথাগুলো বলে বানোয়াট একটা অপরাধী হাসি দিয়ে নিপাট ভদ্রলোক সেজে দাঁড়ালাম চিড়া ভেজার অপেক্ষায়। মাঝে মাঝে বুলন্দ বংশীয় ব্যবহার কাজে দেয়।

ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি। ছবি: সংগৃহীত
ইনস্টিটিউট অব প্যাথলজি। ছবি: সংগৃহীত

সালামের বদৌলতে নাকি আমার বুলন্দ আদবের গুণেই ঠিক বলতে পারি না, তবে চিড়া ভিজল খানিকটা।

‘তুমি ফেলবে কেন, এটা তো আমার কাজই, তাই না?’ সঙ্গে এক গাল হাসি যোগ হলো, ‘এই তোমার বাড়ি কই, বলো তো? স্কার্ফ দেখেই বুঝেছি তুমি মুসলিম।’

কথাটা উড়িয়ে দিয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বলি, ‘ধুর, ওটা তো ভেক মাত্র। আসলে যে কী মানের মুসলমান, সেটা তো দুই কাঁধের কিরামান-কাতেবিন ভালো জানেন। লাল কালিতে আমলনামা ভেসে যাচ্ছে বোধ হয়।’

হো হো করে হেসে উঠলেন তুর্কি মহিলা। পরের মিনিট পাঁচেক দেয়ালে হেলান দিয়ে ঢাকা টু মিউনিখ ভায়া ইস্তাম্বুল এক ঝটিকা আড্ডা চলল। টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ ওরফে টুমের (TUM) দিনগুলো ভালোই যাবে মনে হয়। যদিও ক্লিনিং লেডির সঙ্গে খাজুরে আলাপ চাকরি কেমন যাবে, তার মাপকাঠি না। তবুও কোথায় যেন একটা উষ্ণতা টের পাওয়া যায়।

এর আগে চাকরি বদলের মাঝের মাস তিনেক সকাল ১০টা পর্যন্ত ঘুমিয়েছি। সেই আরাম এখন হারাম হয়ে গেছে। ১০টা অবধি ঘুমের বারোটা বাজিয়ে নতুন চাকরিতে ঢুকেছি। টুমের প্যাথলজি ইনস্টিটিউটের কোর রিসার্চ ফ্যাসিলিটে কাজ। পোস্টডক হিসেবে কাজটা আসলে ক্যানসার রোগীদের টিস্যুর ডিজিটাল ইমেজ অ্যানালাইসিস করা। শুধুই গবেষণা, রুটিন ডায়াগনোসিসের সঙ্গে যোগ নেই। তাই মানসিক চাপটা সহনীয়। সকাল সাড়ে সাতটায় দিন শুরু করি। কাকভোর মনে হয় সময়টাকে। তাই গলায় দেদার কফি না ঢাললে চোখ মেলে রাখা দায়।

ঘণ্টাখানেক কাজ করে আবার কফি আনতে ক্যাফেটেরিয়ার দিকে রওনা হলাম। ম্যাক্স ওয়েবার প্লাৎজ ক্যাম্পাসের প্যাথলজি ভবন থেকে দুই কদম হাঁটলেই ক্লিনিকুম রেখট ডের ইজার। ইউনিভার্সিটির হাসপাতাল। রোজ দুপুরে সেখানের ক্যাফেটেরিয়ার চর্ব্য-চোষ্য খেতে হানা দেওয়া হয় কলিগদের সঙ্গে। হাসপাতালের হেঁশেলের অবস্থা আর কত ভালো হবে। সব পদেই রোগীর পথ্যের স্বাদ। হররোজ সেদ্ধ আলু, নয় ঢ্যালঢ্যালে পাঁচ মিশালি নিরামিষ। বাবুর্চিদের নিকুচি করতে করতে তা-ই পেটে চালান দিয়ে দিই আমরা।

আজকে শুক্রবার। মাছ আছে। জার্মানিতে, বিশেষ করে ঘোর ক্যাথলিক বাভারিয়া রাজ্যে শুক্রবার মাছ খাওয়া সুন্নত। ধর্মীয় আর সব ব্যাপার ফিঁকে হয়ে এলেও মাছকেন্দ্রিক ঐতিহ্য তেমনই রয়ে গেছে। তাই বেশ যত্ন নিয়ে রাঁধে। স্বাদ একেবারে খারাপ হয় না। ফাঁকতলে আমিও ফাউ সুন্নত কামিয়ে নেই। আজকে আছে আলাস্কা লাকস, মানে স্যামন মাছ। বিস্কুটের গুঁড়ায় মুড়িয়ে মচমচে করে ভাজা। সঙ্গে আলুর সালাদ। উফ্, তোফা!

ঝোলানো মেন্যুটা দেখে সন্তুষ্ট ভঙ্গিতে কফি নিয়ে বেরিয়ে আসছি। পাশ থেকে কে বলে উঠল, ‘এইইক, সরে দাঁড়াও।’

প্যাথলজি ভবন
প্যাথলজি ভবন

ঘাবড়ে গিয়ে কফি ছলকিয়ে এক ব্যাঙ লাফ দিলাম। দেখি, গলফ কার্টের মতো গাড়িটায় গোটা চারেক খাবারের অ্যালুমিনিয়াম কনটেইনার জুড়ে দিয়ে রেলগাড়ি হাঁকিয়ে যাচ্ছে লোকটা। মাছের ধ্যানে বিভোর আমি বেখেয়ালে তারই গাড়ির সামনে পড়ে গিয়েছি। আড়ষ্ট হয়ে একটা দুঃখিত ফুখিত বলতে যাব ভাবছি। তার আগেই দাদু দাদু চেহারার বুড়োটা বলে বসল, ‘তোমাকে নতুন দেখছি মনে হয়। দেশ কি ইতালির ওদিকে নাকি?’

বিভ্রান্ত বোধ করলাম। এক নম্বর শরিফ ছাতার মতো গায়ের রং দেখে এর আগে এক-আধজন ইথিওপিয়ার কী সোমালিয়া, এমনকি ঘানার লোক বলেও সন্দেহ করেছে। কিন্তু ইতালিয়ান বলাটা একটু বাড়াবাড়ি হয়ে গেল না?

বুড়োটার ভুল ভেঙে বাংলাদেশের নাম বলতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কথায় কথায় জানলাম তিনি জাতে উইঘুর। তুরস্ক থেকে চীনে গিয়ে আবাস গাড়া এক গোষ্ঠী এই উইঘুর। জীবনের তাগিদে আর চীন সরকারের পেষুনিতে পড়ে আবার এরা সারা দুনিয়ায় ছড়িয়ে পড়ছে। রান্নায় এদের হাতের জুড়ি মেলা ভার। তাই কাজের অভাব হয় না। বুড়োটার ট্যাঁকে গল্প আছে প্রচুর। গল্প শোনানোর আগ্রহটাও বেশ কড়া। কিন্তু হাতঘড়িটা টিকটিকিয়ে জানিয়ে দিল, সময় নেই, কফি গেলো, কাজে ফেরো।

বিদায় নিয়ে চলেই যাচ্ছি। বুড়োটা পিছু ডেকে বসল, ‘তোমার দেশ থেকে কি একটা ফ্রাউ জোগাড় করে দিতে পারো?’

কৌতূহলী হয়ে তিন পা পেছোলাম, ‘ফ্রাউ দিয়ে কী করবে?’

ইউনিভার্সিটির ভেতর সবাই সবাইকে তুমি বলে ডাকি। জার্মান ভাষায় বাংলার মতো আপনি, তুমি ইত্যাদি আছে। উইঘুর বুড়ো হাত উল্টে কৈফিয়ত দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘ফ্রাউ তো একটা লাগেই। ঘর-সংসার করতে হবে না? বয়স তো কম হলো না।’

দুষ্ট হাসি হেসে বলি, ‘বয়স তো কম না, বরং মেঘে মেঘে বেলা তোমার একটু বেশিই পড়ে গেছে। আচ্ছা দেখব নে। আসি এখন।’

রসিক বুড়োটাও ঝনঝনিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে।

দেশি ফ্রাউয়ের খোঁজ চেয়ে এর আগেও একজন খুব ধরেছিল। আগে যে রিসার্চ সেন্টারে কাজ করতাম, সেখানের বাসের রুটে এক ভীমরতি ধরা বুড়ো ড্রাইভার ছিল। তার বাসে উঠলেই সে বিপজ্জনকভাবে এক হাতে স্টিয়ারিং ধরে আরেক হাত নাচিয়ে আলাপ জুড়ে দিত। পকেট উল্টিয়ে দুটি আধুলি দেখিয়ে বলত, ‘এই দেখো, আমার পয়সা আছে।’ আর চলতে থাকা সরকারি বাসটার গায়ে চাপড় মেরে বলত, ‘গাড়িও আছে। খালি আফসোস, একটা ফ্রাউ নেই। তোমার খোঁজে কি কোনো বাংলাদেশি ফ্রাউ আছে?’

কী মুশকিল! কেন যে ভিনদেশি পাগলাটে বুড়োগুলো ভাবে, তাদের কাছে বিয়ে দেওয়ার জন্য আইবুড়ো মেয়েদের লম্বা লিস্টি সঙ্গে নিয়ে ঘুরছি। এখানে আস্তে করে বলেই ফেলি, দেশি ফ্রাউদের একটা লিস্ট কিন্তু হাতে আসলেই আছে। শখের ঘটকালি আর কী। তবে এই ফ্রাউদের জন্য কোনো দেশি মান (ফ্রাউয়ের পুংলিঙ্গ) পাওয়া যাচ্ছে না। দেশি পাত্রের কিনারা আবার অনেক উঁচু আর পুরোটাই চাওয়া-পাওয়া, দাবি-দাওয়ায় থই থই। উর্বশী, রম্ভা কী চাকভুম বলিউড ফ্রাউ না হলে বাঙালি ‘মান’দের নাকি মান-ইজ্জতই থাকবে না। কিন্তু শ্যামা মেয়ের দেশে পাইকারি হারে চাকভুম সুন্দরী কই মিলবে? হাজার ব্যাঙের ঘ্যাঙর ঘ্যাঙেও তো বাংলার আকাশ থেকে আপেল গাল, পটোল চোখ ফ্রাউ-বৃষ্টি হবে না। তাই দেশি মান-ফ্রাউয়ের তেল-জল আর মিশ খেয়ে উঠছে না। এখন ভাবছি, পাত্র হিসেবে এই বিদেশি বুড়োগুলো সে তুলনায় খারাপ কী!

চিন্তায় ছেদ ফেলে পেরুভিয়ান কলিগ ওলগা কোত্থেকে এসে এক তাড়া কাগজ গুঁজে দিয়ে বলল, ‘এগুলো একটু সেক্রেটারি পেত্রার কাছে পৌঁছে দেবে? এক অফিসেই তো বসো তোমরা, তাই না?’ একটু থেমে হাসিখুশি চেহারার মহিলা আবার বলল, ‘আজকে মজার মাছ আছে, আসছ তো দুপুরে?’

আকর্ণ হেসে সায় দিলাম, ‘আলবৎ, আর বলতে!’ এক হাতে কফি, আরেক হাতে কাগজের তাড়া—এই সুযোগে ওলগা কনুই দিয়ে পেটে হালকা গুঁতো মেরে শিস ভাঁজতে ভাঁজতে কাজে ফিরে গেল। ফাইলগুলো কোনো রকমে বগলদাবা করতে করতে দেখি, পাশ কেটে রেলগাড়ি বুড়ো খালি বগিগুলো নিয়ে ফেরত যাচ্ছে। যেতে যেতেই একটা হাঁক ছাড়ল, ‘তোমার দেশের ফ্রাউ কিন্তু একটা জোগাড় করে দিতেই হবে, হা-হা-হা...।’
---
ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার: গবেষক, ইনস্টিটিউট অব প্যাথোলজি, স্কুল অব মেডিসিন, টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি মিউনিখ, জার্মানি।