ভদ্রতার বিড়ম্বনা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

চুপচাপ এক জায়গায় গুম হয়ে বসে থাকা আমার স্বভাববিরুদ্ধ। যেখানেই যাই বন্ধু বানিয়ে বসে থাকি। কাজে, রোগী দেখার ফাঁকে ফাঁকে অনেকের সঙ্গে জানের দোস্তি। এটা একে অন্যের সাপোর্ট সিস্টেমও। দেশি-বিদেশি যার সঙ্গেই মিশি, ভদ্রতার দণ্ড তাদের দিতে হয়েছে কোনো না কোনো সময়ে।

ধরা যাক ময়ূরীর স্বামীর কথা। বাসায় তেমন একটা সাহায্য করে না সে। ৮-৫টা অফিস করে। সপ্তাহে দুই দিন ছুটি। অন্য স্টেট থেকে চার বছর ধরে তার দূর সম্পর্কের মামাতো ভাইয়ের বউ তাকে ফোন করে যখন-তখন। ময়ূরীর সঙ্গে কখনোই তার কথা হয় না। ময়ূরীর স্বামী তার মামাতো ভাইয়ের বউয়ের অনুযোগগুলো মন দিয়ে শোনে।

যেমন তার স্বামী ঠিকমতো ওষুধ খেতে চায় না। শ্বশুরবাড়ির লোকজন তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করে। বাচ্চা নিয়ে একা থাকে। তার খুব কষ্ট ইত্যাদি।

গত রোজার ঈদে টেক্সাস সময় রাত ১২টায় ময়ূরীর স্বামীকে মামাতো ভাইয়ের বউ ফোন করে বলেছে ঈদ মোবারক ভাইয়া। তারপর যথারীতি কত কষ্ট করে একা একা ঈদ পালন করতে হয়েছে, শুনিয়েছে সেই কাসুন্দি।

ওই ভদ্রমহিলা ফোন রাখা মাত্র ময়ূরী তার স্বামীকে ভয় দেখিয়েছে বাইরে বের করে দরজা বন্ধ করে দেওয়ার।

ময়ূরীর স্বামীকে বললাম, ভাই ওই মেয়েকে বুঝিয়ে বললে কী হয়, অন্যের সংসারে ঝামেলা না করে কিছু স্থানীয় মেয়ে বান্ধবী বানিয়ে নিতে। তিনি কীভাবে বলেছেন জানি না। তিনি বহুবার আমাকে বলতে চেয়েছেন, তার অন্য নারীর প্রতি কোনো আগ্রহ নেই। তারপরও ময়ূরী কেন এত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত।

ময়ূরীর স্বামী আরও কিছু কাজ করতেন। যেমন কোনো ক্লাসমেট মেয়ে একা বেড়াতে এলে ময়ূরীকে বাদ দিয়ে তাকে পুরো শহর ঘুরিয়ে দেখানো বা অন্য নারীর অতিরিক্ত বেশি ছবি তোলা ইত্যাদি।

তাকে বললাম, ভালোবাসা না থাকলে আর ব্যাপারটা ডিসেন্সির বাইরে না হলে ময়ূরী তো বলত না, তাই না? তবে ময়ূরী জানিয়েছে আপাতত আপদ বন্ধ হয়েছে। বাইরের নারীর প্রতি অতি ভদ্রতা কমিয়ে ঘরে মন দিয়েছে তার স্বামী।

দুই.

এক বান্ধবীর নতুন বয়ফ্রেন্ড হয়েছে। মোটামুটি সুখের ভেলায় ভেসে চলেছে তারা। এর মাঝে মুখ অন্ধকার করে একদিন সু বলল, ওর বয়ফ্রেন্ডের ডিভোর্সড বউয়ের পরিবার তাকে (বয়ফ্রেন্ড)) দাওয়াত করে আর ও যায়। সুর বয়ফ্রেন্ডের রিক। তাকে জিজ্ঞেস করলাম, কেন যাও? রিক বলল, খারাপ লাগে বয়স্ক মানুষকে না করতে।

রিকও নাকি ব্রোকেন ফ্যামিলির ছেলে। কিন্তু ওর মা-বাবার মাঝে সম্পর্ক খুব ভালো ছিল।

রিককে বললাম তাদের কষ্ট না দিতে চেয়ে তোমার ভবিষ্যৎ সন্তানের মাকে কষ্ট দিচ্ছ?

রিক চলে গেল সেদিন। কয়েক দিন পর সু বলেছে, রিক আর যাবে না বলেছে ওর আগের ইন ’লদের কাছে। হঠাৎ এ পরিবর্তনে সু কী যে খুশি।

লেখিকা
লেখিকা

তিন.

এডের প্রেম চলছে লির সঙ্গে বহুদিন ধরে। গত মাসে বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে বলল, এড লিকে হাওয়াইয়ের বিগ আইল্যান্ডে বেড়াতে নিয়ে গিয়ে বিয়ের জন্য প্রোপোজ করবে। কী খুশি তার কাজে প্রতিদিন। যাওয়ার সপ্তাহখানেক আগে এড দেখলাম কাঁদো কাঁদো চেহারা করে বলছে, লি ওর সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান ক্যানসেল করেছে আর যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে দুই দিন হলো।

কাজের বিভিন্ন পার্টিতে দেখা আর গল্প হওয়াতে লির সঙ্গে আমার ভালোই বন্ধুত্ব। কল করে জিজ্ঞেস করলাম কী হয়েছে লি? বলল এডের প্ল্যান সে আগেই টের পেয়েছে। এডকে সে ভালোও বাসে। কিন্তু এডের মার ছেলের ওপর অধিকার ফলানোর চেষ্টা দেখে সে ভয় পেয়েছে। চাইনিজ গোঁড়া সংস্কৃতি লিকে খুব ভাবিয়ে তুলেছে। ভদ্রতার মুখোশ সরিয়ে এডকে কষ্ট দিতে চায় না সে।

বললাম লি প্লিজ এডের সঙ্গে কথা বলো। ওর চেহারার দিকে তাকানো যায় না। মাসখানেক পরে এড দেখলাম খুব খুশি। বলল ওর মাকে সে খুব আদর করে বুঝিয়েছে তার জীবনে লির প্রয়োজনীয়তা মার চেয়ে কম কিছু না। আপাতত তাদের বিয়ের দাওয়াত পাওয়ার অপেক্ষায় আছি।

চার.

ভার্জিনিয়ার এক ডাক্তার দম্পতির সঙ্গে এক ডাক্তারদের গেট টুগেদারে দেখা। এত সুন্দর দুজন। কিন্তু কেমন কঠিন সুরে কথা বলছেন।

বললাম শম্পা কী হয়েছে? কাজের স্ট্রেস তো নেই এখন, বেড়াতে এসেছ।

বলল, দেখ না আপু, আমরা দুজনেই মেডিসিনের ডাক্তার। দেশ থেকে মেয়েলিবিষয়ক রিপোর্টের বিষয়ে ও মেয়েলি সমস্যার কথা শুধু সুজনকেই (ওর স্বামী) বলে। শুধু তাই না, তার দূরসম্পর্কের আত্মীয়রা ইনসিস্ট করে সুজন যেন ওসব রিপোর্ট গাইনি বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলাপ করে তাদের জানায়। শম্পার কাছে পরামর্শ নিলেও তারপর সুজনের সঙ্গে ভ্যারিফাই করে।

হাসলাম একটু। বললাম, শম্পা এটা একটা মাইন্ড গেম আপু। তোমাকে ওরা খুব হিংসা করে, তোমার সাফল্য দেখতে পারে না। দেশে প্রতিভাবান নারী রোগবিশেষজ্ঞের কোনো অভাব নেই। দশ-বারোটা ডাক্তার শপিং ওদের করা। তোমাকে পাত্তা না দিয়ে রাগিয়ে সংসারে অশান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আর সংসার ভেঙে দিতে পারলে তো ওদের পোয়াবারো তাই না? গেমটা খেল না। সুজন ওর ভদ্রতার বাইরে গিয়ে ওদের না করতে পারছে না। সেবা করার চিন্তায় গেমটা বুঝতেও পারছে না। তুমি নিজের যোগ্যতায় পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ দেশে ডাক্তার। ওদের রিকগনিশন না পেলে কী যায় আসে?

পরে অর্গানাইজারদের সঙ্গে নিয়ে এ ঘটনা দিয়ে নাটক বানিয়ে ফেললাম। প্রতিবার শম্পা কতটা হার্ট হয় লজ্জাহীনভাবে নারীবিষয়ক সমস্যা নিয়ে সুজন ডিল করলে। সেটা শম্পা অভিনয়ে খুব সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলল। পরে শুনলাম সুজন বন্ধুদের বলেছে, আসলে এত প্রতিভাবান বউ থাকার পরে তার কষ্ট বা অসম্মান হয় এমন কিছু না বুঝে করলে। সুজন বলল, ভবিষ্যতে কখনই করব না। আমার সবচেয়ে কাছের মানুষকে কষ্ট দিয়ে সমাজসেবা হয় না।

পাঁচ.

কিছুদিন আগের কথা। নুরের স্বামী নীলকে দেখি খুব মন খারাপ করে থাকে। একদিন নীল আমাকে জিজ্ঞেস করল এ দেশে তার মায়ের চিকিৎসার সুযোগ কেমন। তাকে বললাম যেহেতু সে সিটিজেন, তার মার গ্রিন কার্ড অল্প সময়ে হবে। তারপর সরকারি ইনস্যুরেন্সে চিকিৎসা হবে। নীল বলল, নুর কিছুতেই তার মাকে আসতে দেবে না। একমাত্র ছেলে হওয়া সত্ত্বেও নীলের পুরো পড়াশোনার খরচ ওর মা-বাবা দেওয়া সত্ত্বেও নুর চায় না নীলের মা-বাবা এ দেশে আসুক।

নুর নিজে কাজ করে না। নুরের মা-বাবা এ দেশে কয়েকবার এসেছেন। বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতেও গেছেন। নীল নিয়ে গেছে।

নুরকে বললাম, তাকে ফেয়ার হতে হবে। নীলের মা-বাবা এলে বাচ্চাদের দেখে নুরকে কিছু সাহায্যও তো তারা করতে পারবেন। এ ছাড়া তাঁদের নাতি-নাতনি তাঁরা দেখতেও তো আসতে পারেন। নুর একতরফাভাবে নীলের ভদ্রতার সুযোগ কেন নেবে?

নুরকে বোঝালাম ডাক্তার হিসেবে। ওদের কত টাকা বেঁচে যাবে এ দেশে ইনস্যুরেন্সসহ নীলের মা-বাবার চিকিৎসা হলে। অবশেষে তাঁরা এসেছেন। চিকিৎসা চলছে। শুনেছি নুর যখন-তখন শাশুড়ির কাছে বাচ্চা রেখে ঘুরতে চলে যায়। তারা তারপরও খুব খুশি। রক্তের টান অনেক কঠিন জিনিস।