প্রকৃতির এক অপার বিস্ময়

ডেলিকেট আর্চের সামনে লেখক ও তাঁর সহধর্মিণী
ডেলিকেট আর্চের সামনে লেখক ও তাঁর সহধর্মিণী

ছোটবেলায় ন্যাশনাল জিওগ্রাফিকের পাতায় আর একটু বড় হয়ে উইন্ডোজের ডিফল্ট ওয়ালপেপারে মায়াময় যে জায়গাটা মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে দেখেছি, তার নাম ‘ডেলিকেট আর্চ’। একটি জায়গা কতটা সুন্দর হলে লাখো মানুষের কম্পিউটার পর্দায় শোভা পেতে পারে, ডেলিকেট আর্চ তার উত্তম উদাহরণ।

যুক্তরাষ্ট্রে পড়াশোনা করার সুবাদে এমন মোহময় জায়গা ঘুরে দেখার সুযোগ মিস করার প্রশ্নই আসে না। গ্রীষ্মে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার চাপ কম থাকে। তাই এই সময়ই ভ্রমণের জন্য সবচেয়ে উপযোগী। একটু খোঁজ করলেই বিভিন্ন এয়ারলাইনস থেকে ছাড়ে টিকিট পাওয়া যায়।

মানবাকৃতির হুডু
মানবাকৃতির হুডু

আমাদের ভাগ্য ভালো। হিউস্টন থেকে লাস ভেগাস হয়ে ইউটাহ যাওয়ার টিকিট পেয়ে গেলাম মাত্র এক সেন্টে, যা বাংলাদেশি প্রায় ৮৫ পয়সার সমান। ছাত্রজীবনে এর চেয়ে ভালো অফার আর কী হতে পারে!

মনে মনে বলেই ফেললাম, ‘একদিন ছুটি হবে, অনেক দূরে যাব, যেখানে মাটি লাল আকাশ গাঢ় নীল’। বাক্সপেটরা গুছিয়ে সামারের রৌদ্রস্নাত দিনে রওনা দিলাম যুক্তরাষ্ট্রের লাল মাটি আর গাঢ় নীল আকাশের অঙ্গরাজ্য ইউটাহর উদ্দেশে।

ব্যালান্সড রক
ব্যালান্সড রক

মূল উদ্দেশ্য ডেলিকেট আর্চের বাসস্থান আর্চেস ন্যাশনাল পার্ক ঘুরে দেখা। ইউটাহসহ আমেরিকার আরও তিনটি অঙ্গরাজ্য কলোরাডো, অ্যারিজোনা ও নিউ মেক্সিকো যে বিন্দুতে এসে মিলিত হয়েছে, তার নাম ফোর কর্নারস। এই বিন্দুটা থেকে ১৫০ মাইল ব্যাসার্ধের একটি বৃত্ত আঁকলে তার মধ্যে চমৎকার কিছু প্রাকৃতিক জায়গা পড়বে, আর্চেস ন্যাশনাল পার্ক তার একটি।

পার্কে ঢুকতেই প্রথমে যা দেখে থমকে দাঁড়ালাম, তা হলো পাথরের তৈরি মানবাকৃতির বড় বড় মূর্তি। দেখে মনে হয় শিল্পীর হাতে সুন্দর করে বানানো। আসলে পাললিক শিলা প্রাকৃতিকভাবে লাখ লাখ বছরে ক্ষয় হয়ে এই অদ্ভুত আকৃতি তৈরি করেছে। এ ধরনের শিলা-গঠনকে হুডু (Hoodoo) বলে। সন্ধ্যার আবছা আলোতে হুডু দেখে এলিয়েন কিংবা ভূত বলে মনে হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়।

একটু ভেতরে ঢুকতেই দ্বিতীয় যে হুডুর দেখা পাওয়া গেল, তার নাম ব্যালান্সড রক। পার্কের বিখ্যাত এই আইকন ১২৮ ফুট লম্বা এবং আকারে একটি বরফ ভাঙার জাহাজের সমান। একটির ওপর আরেকটি পাথর এমনভাবে রাখা যে দেখে মনে হবে, অতি দানবীয় কোনো প্রাণী অভিকর্ষ বলকে তুচ্ছ করে ভারসাম্য রক্ষার খেলা খেলেছে। হালকা একটু বাতাস এলেই বুঝি পড়ে যাবে।

মানুষের আকৃতির সঙ্গে তুলনা করলেই আর্চের আকৃতি অনুমান করা যায়। ছবিতে আর্চের ক্ষয়ে যাওয়া বাঁ দিকটা দেখা যাচ্ছে
মানুষের আকৃতির সঙ্গে তুলনা করলেই আর্চের আকৃতি অনুমান করা যায়। ছবিতে আর্চের ক্ষয়ে যাওয়া বাঁ দিকটা দেখা যাচ্ছে

হুডু দেখা শেষ করে সামনে যেতেই এই পার্কের নামকরণের সার্থকতা টের পেলাম। প্রাকৃতিক বালিপাথরে তৈরি ছোট-বড় মিলিয়ে দুই হাজারের বেশি ‘আর্চ’ বা ধনুকাকৃতির খিলান আছে এই পার্কে। আকৃতি অনুসারে তাদের নাম দেওয়া হয়েছে। ফুটবল মাঠের চেয়েও বেশি লম্বা ল্যান্ডস্কেপ আর্চ, জানালার মতো দেখতে উইন্ডো আর্চ, যমজ ডাবল আর্চ, বালিয়াড়ির তৈরি স্যান্ড ডিউন আর্চ ও বিখ্যাত নড়বড়ে ডেলিকেট আর্চ ইত্যাদি।

আর্চগুলো দেখার জন্য রয়েছে বাইকিং, হাইকিং, রক ক্লাইম্বিং কিংবা তাঁবু খাঁটিয়ে রাতের আকাশ দেখার ব্যবস্থা। বেশির ভাগ দর্শনীয় স্থান গাড়ি থেকে নেমে একটু হাঁটলেই দেখা যায়। ব্যতিক্রম শুধু ডেলিকেট আর্চ। ওখানে যেতে হলে প্রায় দেড় মাইল পাহাড়ি দুর্গম রাস্তা হাঁটতে হয়। আস্তে আস্তে পাহাড়ের এলিভেশন বেড়ে ৫০০ ফুট হয়ে যায়, যা প্রায় ৫০ তলা বিল্ডিংয়ে হেঁটে ওঠার সমান। এ কারণে পার্ক কর্তৃপক্ষ ডেলিকেট আর্চের এই ট্রেইলকে ‘সহজ’, ‘মাঝারি’ আর ‘কঠিন’ এই তিন মাপকাঠির মধ্যে কঠিন গ্রুপে ফেলেছে। সঙ্গে জারি করা আছে আরও কিছু বাড়তি সতর্কতা। মোট তিন মাইল হাইকের জন্য প্রতি হাইকারের সঙ্গে নিতে হবে দুই লিটার পানি, গ্রীষ্মে প্রখর সূর্যের তাপ থেকে বাঁচতে ক্যাপ, ঋতু অনুযায়ী কাপড় আর থাকতে হবে শারীরিক পরিশ্রমের সক্ষমতাও।

প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সেরে রওনা হয়ে গেলাম আমরা। সূর্য তখন মাথার ওপরে। অর্ধেক পথ যেতেই শক্তি প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসে। ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা দু–একটা জুনিপেরাস (Juniperus osteosperma) প্রজাতির গাছের ছায়া আর সঙ্গে থাকা পানি নতুন করে চলার প্রেরণা দেয়। বার কয়েক থেমে থেমে সব শেষে আসল পাহাড়ি সরু রাস্তা। খুব সাবধানে এগোতে হয়ে। একটুখানি পা পিছলে গেলেই বিপদ। অবশেষে হাঁপাতে হাঁপাতে পৌঁছে গেলাম কাঙ্ক্ষিত সেই ডেলিকেট আর্চে।

পার্কের প্রবেশপথে ইউটাহর বৈশিষ্ট্যসূচক লাল মাটি ও নীল আকাশের সামনে লেখক ও বন্ধু পরিবার
পার্কের প্রবেশপথে ইউটাহর বৈশিষ্ট্যসূচক লাল মাটি ও নীল আকাশের সামনে লেখক ও বন্ধু পরিবার

ডেলিকেট আর্চের সৌন্দর্য দেখার পর মনে হলো, এর জন্য জান বাজি রাখাই যায়! প্রায় নুয়ে পড়া সূর্যের আলো আর পেছনের দিগন্তজুড়ে লা স্যাল পর্বতমালা—সব মিলিয়ে লাল-সোনালি আর্চটা মনের গহিনে একটা মায়াময় আবহ তৈরি করে। চোখের তৃষ্ণা মেটানোর সঙ্গে সঙ্গে কেউ কেউ আর্চের মাটি ছুঁয়ে দেখছে, কেউ কেউ তুলে নিচ্ছে সেলফি। হয়তো এই সেলফি স্থান পাবে তাদের ফেসবুকের দেয়ালে, পারিবারিক অ্যালবামে অথবা কম্পিউটারের ওয়ালপেপারে। আমরাও ক্যামেরায় বেশ কিছু ছবি তুলে নিলাম।

আর্চের ছবির বাঁ দিকে উঁচু যে শিলাবিন্যাস দেখা যাচ্ছে, ভূতাত্ত্বিক পরিভাষায় তাকে ‘ফিন’ বলে। এই ফিন লাখ বছর ধরে ক্ষয়ে ক্ষয়ে আর্চে পরিণত হয়। নামের সঙ্গে মিল রেখে ডেলিকেট আর্চের বাঁ দিকের মাঝামাঝি অংশ ক্ষয়ে গিয়ে নড়বড়ে হয়ে গেছে। হয়তো মাঝারি কোনো ভূমিকম্পে কোনো একদিন ঢলে পড়বে সে। তাই এই আর্চ দেখতে বা ছবি ওঠাতে চাইলে এখনই সময়।

ঠিক কখন সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়েছে, টেরই পাইনি। যান্ত্রিক শহরের ইলেকট্রিকের আলো থেকে মুক্ত পরিষ্কার আকাশে একে একে তারা ফুটে উঠছে। বাইনোকুলার হাতে ক্যাম্পাররা ব্যস্ত শনি গ্রহের বলয় খুঁজতে। আমাদের এবার বাড়ি ফেরার পালা। নির্জন অন্ধকার ভেদ করে মায়াময় আর্চগুলোকে পেছনে ফেলে আমাদের গাড়ি ছুটছে। আর কানের কাছে কেউ যেন ফিসফিস করে বলছে, ‘আবার ছুটি হবে, অনেক দূরে যাব, যেখানে মাটি লাল আকাশ গাঢ় নীল।’
–––

আবদুল্লাহ আল মামুন: পিএইচডি ক্যান্ডিডেট, ইউনিভার্সিটি অব হিউস্টন, টেক্সাস, যুক্তরাষ্ট্র।