বেলির ঈদ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বাড়ি থেকে বেরোতেই দেরি। ধুত্তরি। নিজের মনে ফুঁসতে ফুঁসতে বাসস্ট্যান্ডের দিকে চলেছে বেলি। টিউশনিতে ঠিক সময়ে যেতে না পারলে ছাত্রীদের মায়ের মুখে কালো ছায়া নামে। হাতখরচের টাকাটা বাড়ি থেকে চাইতে মোটেও ভালো লাগে না বেলির। তাই নিজের ক্লাস সামলে সপ্তাহে তিনটা টিউশনি করে সে। তাতে হাতখরচও হয়ে যায়, বাড়িতে কিছু সাহায্যও করা যায়।

খরচ বাঁচাতে অটোরিকশা না নিয়ে বাসে যায় বেলি। এক শ টাকার মধ্যেই হয়ে যায়। সিএনজি নিলে প্রতিদিন তিন শ থেকে চার শ টাকার ধাক্কা।

ভিড় ঠেলে কোনোমতে একটা লক্করঝক্কর বাসে উঠল বেলি। বসতে না বসতেই কন্ডাক্টরের কর্কশ কণ্ঠ—ভাড়াডা দিয়েন আফা।

: আরে মামা, দিমু তো ভাড়া, বাকিতে যামুনি?

একটা ৫০ টাকার নোট বের করতে করতে বিরক্তি ঝেড়ে দিল বেলি।

প্রায় ৪০ মিনিটের রাস্তা আজ যেন ফুরাতেই চাইছে না। ট্রাফিক জ্যামের যন্ত্রণায় ঠেলাগাড়ির গতিতে চলছে বাস। সঙ্গে দুঃসহ গরম তো আছেই। গরমে অসুস্থ হয়ে কয়েকজন যাত্রী বমি করছে বাসের জানালা দিয়ে। ওড়নাটাকে আর একটু গুছিয়ে নিয়ে ঘড়ির দিকে তাকায় বেলি। আরে সর্বনাশ। বেলা তিনটা প্রায়। সাড়ে তিনটার মধ্যে পৌঁছাতে না পারলে তো জবাবদিহি করতে করতেই জীবন যাবে। দেরি হলো কেন?

মিনিট পাঁচেক পরে হঠাৎ টান লাগল বেলির ওড়নায়। পাশ থেকে ভেসে এল মিষ্টি কণ্ঠস্বর।

‘একটা চকলেট নেন না আফা।’

সামনে দাঁড়ানো ৮–৯ বছরের মেয়েটির হাতে লজেন্সের প্যাকেট। তার থেকে দুটো লজেন্স বেলির কোলে রেখে দিয়েছে সে। মেয়েটির রুক্ষ, বিবর্ণ চুলে হয়তো ঠিকমতো চিরুনি পড়ে না। শ্যামবর্ণ মুখটাও কেমন মলিন। তবে ভীষণ মায়াভরা এক জোড়া গভীর কালো চোখ। কোলে রাখা কফি ক্যানডি দুটো তুলে নিয়ে ওর হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট ধরিয়ে দিল বেলি।

পাঁচ টাকার নোটটা হাতে পেয়ে হাসিতে ভরে উঠল মেয়েটির মুখ। অন্য যাত্রীদের দিকে এগোলো সে। আরও বিক্রির আশায়। বেলির এটা দেখে ভালো লাগল যে মেয়েটি ভিক্ষা করছে না। আর অনেকেই কিনছে ওর লজেন্স।

আচমকা বেলির চোখে পড়ল মাঝবয়সী এক ভদ্রবেশী পুরুষ যাত্রী, চকলেট নেওয়ার বাহানায় খাবলে ধরেছে মেয়েটির বুকের কাছে। যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলেও সামলে নিল মেয়েটি। ততক্ষণে বাস পৌঁছে গেছে বেলির গন্তব্যে। বাস থেকে নেমেও একটু আগে দেখা দৃশ্যটি ভেবে ঘৃণায় গা গুলিয়ে উঠল বেলির। ছি! ওই বাচ্চা মেয়েটি ভদ্রলোকের নাতনির বয়সী হবে। এ কেমন মানসিক বিকারগ্রস্ত পুরুষ!

ছাত্রীদের বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়াতেই পোষা বিড়ালের ম্যাও কানে এল বেলির। এ বাড়ির গিন্নি শখে বিড়ালছানা পোষেন।

‘তুমি আজও দেরি করলে নিলুফার? এভাবে চললে আর পড়াতে আসার দরকার কী?’

সায়রা হকের হুংকারে আত্মা কেঁপে উঠলেও কিছু বোঝাল না বেলি। মুখে বলল—রাস্তায় অনেক জ্যাম তা–ই...।

বেলিকে দেখেই ছুটে এল বিনি আর রিনি। প্রায়ই আপুকে মায়ের অহেতুক বকুনি থেকে বাঁচায় যমজ দুই বোন।

‘আপুকে তুমি কিচ্ছু বলবে না’, সমস্বরে বলে উঠল বিনি–রিনি।

‘ওদের জন্য এ যাত্রা বেঁচে গেলে মেয়ে, এরপর থেকে দেরি করলে আর চাকরি থাকবে না, মাথায় থাকে যেন।’ উচ্চ স্বরে কথাগুলো বলে চলে গেলেন তিনি।

বেলি বসল দ্বিতীয় শ্রেণিপড়ুয়া দুই বোনকে নিয়ে। দুজনকে প্রায় দশটা বিষয় বোঝাতে একটু মাথার খাটুনি হয়। তবে মাস শেষে পাওয়া টাকার অঙ্কটি ওর জন্য কম নয়। বিনিকে জ্যামিতি বোঝাতে বোঝাতে নিজের একরঙা সালোয়ার–কামিজের দিকে তাকায় বেলি। ছোট বোন মিলিও বলে দিয়েছিল নতুন পোশাক নিয়ে আসতে। মাত্র এক বছরের ছোট হওয়ায় দুই বোনের একই মাপ। আজ বেতন দেওয়ার দিন। সায়রা হকের মেজাজ চড়া দেখে বেশ ভয় লাগছে বেলির।

: আপু আমার এই ইংরেজি অনুবাদটা ঠিক আছে? দেখো তো।

রিনির প্রশ্নে সংবিৎ ফেরে বেলির।

: এই তো দেখছি, দাও...।

একটু পরেই চা আর নোনতা বিস্কুটের ট্রে হাতে ঘরে ঢোকেন সায়রা হক। বেলির হাতে একটা ছোট্ট সাদা খাম ধরিয়ে ওর অগোছালো চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে চলে যান। এ মহিলার ‘দুঃখিত’ বলার এটাই নিয়ম। মায়ের স্বভাব বিনি–রিনিও জানে।

: আপু, আজ মাম্মার একটু জ্বর এসেছে তো, তাই মাম্মা ফায়ার হয়েছিল তখন। এখন দেখো মাম্মা আইস হয়ে গেছে।

বিনির কথায় হেসে ফেলে বেলি। অসুস্থ হলে আচমকা রেগে যান মিসেস হক, জানে বেলি। খামটা ব্যাগে ঢুকিয়ে, বাসে কেনা কফি ক্যানডি দুটো বিনি–রিনির হাতে ধরিয়ে সেদিনের মতো বিদায় নিল সে।

দুই দিন পর টিউশনিতে যাওয়ার পথে আবার সেই মেয়েটিকে দেখল বেলি। একইভাবে বাসে লজেন্সের প্যাকেট হাতে। সেই রুক্ষ চুল আর গভীর কালো চোখ। পরনের ফ্রকটা বেশ ছেঁড়া। বেলি ইশারায় কাছে ডাকল ওকে।

: এই মেয়ে, আমাকে আজকে দশটা লজেন্স দাও। আমার অনেক ভালো লাগে খেতে।

ভিড় বাসে নামতে না পেরে বেলির পায়ের কাছেই বসে পড়ল মেয়েটি। কথায় কথায় বেলি জানল, ওর নাম ফুলি। কাছেই বস্তিতে মায়ের সঙ্গে থাকে সে। মা আশপাশের বাড়িতে যে কাজ করে, তাতে ভদ্রসমাজ ছুটা বুয়া বলে ডাকে তার মাকে। ফুলি ভিক্ষা করতে চায় না। তাই লজেন্স বিক্রি করে সাহায্য করে মাকে। সন্ধ্যার পর যায় পথশিশুদের স্কুলে। মেয়ে জন্ম দেওয়ার অপরাধে ফুলির বাবা ওর মাকে ছেড়ে আরেকটা বিয়ে করেছে। কারণ, তার বংশের বাত্তি চাই।

: আফা, মায়ে কইসে মাইয়ারা বংশে বাত্তি দিবার পারে না, তাই বাপে আর একখান মা আনসে...।

বেলি শুনে মনে মনে রাগে ফুঁসতে থাকে। আরে এই বংশের বাত্তি পৃথিবীতে আসেই তো মাইয়াদের জন্য। সেটা কেন ভুলে যায় অকৃতজ্ঞ পুরুষেরা? ফুলির দাদিও তো মাইয়াই ছিলেন, তা–ই না? কই, বাড়িতে তো বেলির আব্বা আছেন, তিনি তো এভাবে ভাবেন না? তাঁকে তো বেলি–মিলি কেউ কোনো দিন ছেলের জন্য হাপিত্যেশ করতে দেখেনি। বেলির আম্মাও তো খুশি দুই মেয়ে নিয়ে। সেদিন ফুলির হাতে ২০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে বাস থেকে নেমেছিল বেলি। দ্বিগুণ হাসিতে ভরেছিল ফুলির মলিন মুখ।

দুদিন পরেই কোরবানির ঈদ। ঈদুল আজহায় নতুন কাপড় অনেকেই কেনে না। তবু মিলির আবদার রাখতে বিনি–রিনির বাড়ি যাওয়ার আগে কাপড়ের দোকানে ঢুকল বেলি। হাতে আড়াই হাজার টাকার মতো। খুব বেশি দামি কাপড় কোনো দিন পছন্দ নয় বেলি বা মিলির। আকাশি নীলের ভেতর সাদা ফুল ছাপ দুই সেট সেলাইবিহীন সালোয়ার–কামিজ তুলে নিল বেলি। তখনই চোখে পড়ল লালের ভেতর কালো নকশাকাটা একটা ফ্রক। বেলির চোখের সামনে ভেসে উঠল ফুলির গভীর কালো চোখ। নিজেদের কাপড়ের বাজেট থেকে কিছু টাকা কমে গেলেও বেলির মনে একটা অদ্ভুত শান্তি ভর করল ফ্রকটা কেনার পর। সেদিন বাসে ফুলির গোটা লজেন্সের প্যাকেটটা কিনে নিয়েছিল বেলি। ওটা হাতে পেয়ে বিনি–রিনির আনন্দ দেখে কে? আর ফ্রকটা দেখে কেঁদে ফেলেছিল ফুলি—‘আফা গো, মেলা দিন নতুন জামা চোখে দেহি নাই...।’ ওদের হাসিতেই পূর্ণতা পেয়েছিল বেলির ঈদ।

দ্রষ্টব্য: শ্রদ্ধা সেই সব পুরুষকে, আমার জীবনে যাঁরা কেউ শিক্ষক, কেউ ভাই, কেউবা প্রিয় বন্ধু। ভালোবাসা সেই সব নারীকে, যাঁরা শিক্ষক, বোন বা বান্ধবী হয়ে আগলে থাকেন আমায়। ভালো–খারাপ তো নারী-পুরুষ উভয় গোত্রেই থাকে। খারাপটুকু বর্জন করে আমরা কম ভালোটাই কি গ্রহণ করতে পারি না?