প্রবাসীর নির্ঘুম এক রাত

রাতের শেষ প্রহরে ডিউটিতে যাওয়ার দৃশ্য
রাতের শেষ প্রহরে ডিউটিতে যাওয়ার দৃশ্য

ট্যাক্সি থেকে নেমে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি, রাত সাড়ে ১২টা। ট্যাক্সিভাড়া মিটিয়ে দিয়ে গেটের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছি কী করা যায়। আমার ডরমিটরিতে প্রবেশ সময় রাত ১২টা পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। এরপরও প্রবেশ করা যাবে। কিন্তু ডরমিটরির নিরাপত্তাকর্মীরা দেরি করার ঘটনা নোট আকারে কোম্পানির এইচআরের কাছে পাঠাবে।

বছরে তিনবারের বেশি রাত ১২টার পর ডরমিটরিতে ফিরলে কোম্পানি থেকে ওয়ার্নিং লেটার ধরিয়ে দেওয়া হয়। আর ওয়ার্নিং লেটার মানে সে বছরে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, পদোন্নতি—সবকিছুতে প্রভাব পড়বে।

আমি এর আগেও দুই রাত ১২টার পর ডরমিটরিতে প্রবেশ করেছিলাম। তাই আজ আর ঝুঁকি নিতে চাচ্ছি না। আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি পূর্ণ জ্যোৎস্না। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম এদিক-ওদিক ঘুরেফিরে রাতটা পার করে দেব। ভোরে কোম্পানির বাসে চড়ে ডিউটিতে চলে যাব।

মধ্যরাত। নীরবতার চাদরে ঢেকে আছে শহর। আর আমি একাকী হেঁটে চলেছি নিঃশব্দ, অপরূপ মায়াবী নগরীতে। আমার সঙ্গী আমার নিঃসঙ্গতা, কষ্ট আর হিসাবের গরমিল। আকাশের জ্যোৎস্না আর রাস্তার ল্যাম্পপোস্টের আলোয় এক অপরূপ রূপে সেজেছে চারপাশ। একটু পরপর হুস হুস শব্দ করে ছুটে চলেছে গাড়িগুলো।

আনমনে একটি উঁচু দালানের সামনে এসে দাঁড়ালাম। কী সুন্দর নীরবে দাঁড়িয়ে আছে। শতপ্রাণ তার বুকে আশ্রয় নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। আরেকটু সামনে এগিয়ে একটি বাজারের সামনে এসে দাঁড়াই। যেখানে প্রতিদিন সন্ধ্যারাতে শত শত মানুষের পদচারণে মুখর হয়। এখন সেখানে একটি কুকুর শুয়ে আছে। অদূরে দুটি বিড়াল ম্যাও ম্যাও করছে।

এই রাত আর বাজারের সঙ্গে প্রবাসীদের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রবাসীরা যখন প্রতি মাসে দেশে টাকা পাঠায়, তখন তার কদর বেড়ে যায়। দেশে গেলে পরিবার-আত্মীয়রা তার আশপাশে ভিড় জমায়। কিন্তু যখন শূন্য হাতে দেশে ফেরে, তখন তার আশপাশে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না।

আনমনে আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই ভাগ্য পরীক্ষার দোকান। যেখানে সকাল–বিকেল স্বপ্নবাজ লোকগুলো লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে সংখ্যা পূরণ করে। সেই দোকান এখন মানবশূন্য। দোকানটি বন্ধ। সংখ্যার মাধ্যমে ভাগ্য পরীক্ষাকারীরা বিছানায় শুয়ে বিনা পরিশ্রমে স্বল্প সময়ে ধনী হওয়ার স্বপ্ন দেখছে।

আমি দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবি, এই একাকী নির্ঘুম রাতে মন কী চায়! একটু চোখ বন্ধ করে ভাবতেই এই বেহায়া মন চাচ্ছে স্ত্রীর সাহচর্য, সন্তানদের বুকে জড়িয়ে ভালোবাসায় চুমু খেতে। অসুস্থ বাবার পাশে বসে একটু গল্প করতে।

লেখক
লেখক

একদিন ঠিকই ছুটি দেব এই স্বপ্নের শহরকে। একদিন নাই হয়ে যাব এই শহর থেকে। বুকে জড়িয়ে নেব দেশের ধুলো। ভালোবাসায় জড়িয়ে নেব স্ত্রীকে, আদরে চুমু খাব সন্তানদের, পরম শ্রদ্ধায় অসুস্থ বাবার সেবা করব। কিন্তু কবে আসবে সেদিন?

আজগুবি সব ভাবতে ভাবতে হাঁটছি। চারপাশে জ্যোৎস্নার মাখামাখি। ইচ্ছে করছে জ্যোৎস্না পুরো শরীরে মেখে নিই। তথ্যপ্রযুক্তির যুগে আমার হাতে এখন স্মার্টফোন। মোবাইলের ক্যামেরা অন করে ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। খানিক পড়ে মনে হলো এই ছবি তোলা মানে তো অপরূপ এই সৌন্দর্য বন্দী করে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা। আসলেই কি সৌন্দর্য বন্দী করে রাখা যায়? তা কোনো দিনও সম্ভব নয়। মোবাইলটা পকেটে রেখে চারপাশের সৌন্দর্য প্রাণভরে উপভোগ করতে থাকি।

হাঁটতে হাঁটতে প্রায় ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ লেকের পাড়ে এসে দাঁড়াই। লেকের পাড় জনমানবশূন্য। অথচ প্রতিদিন সকাল, বিকেল, সন্ধ্যায় এখানে শত শত স্বাস্থ্যসচেতন লোক হাঁটাহাঁটি করে। সিঙ্গাপুরের স্থানীয় বাসিন্দারা খুবই স্বাস্থ্যসচেতন। এরা সময় পেলেই সপরিবারে হাঁটাহাঁটি করতে বের হয়ে পড়ে।

লেকের জলে জ্যোৎস্নার আলো প্রতিফলিত হয়ে এক মায়াবী পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এখান থেকে নড়তে ইচ্ছে করছে না। আমি মুগ্ধ হয়ে চারপাশ উপভোগ করছি।

আস্তে আস্তে সামনে এগিয়ে যাই। আমার ডরমিটরির কাছাকাছি একটি গাছের নিচে এসে দাঁড়ালাম। সেখানে খালি বোতল, শূন্য সিগারেটের প্যাকেট অবহেলায় পড়ে আছে।

গাছের নিচে বসে কল্পনারাজ্যে সুখ রচনা করতে করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। পথচারীদের পদশব্দে ও গাড়ির শব্দে উঠে বসে এদিক-ওদিক তাকাই। দেখি, আমার মতো শত শত অভিবাসী ঘুম ঘুম চোখে ব্যস্তভাবে উঠছে তাদের নির্দিষ্ট যানে। রাতের শেষ প্রহরে ডিউটিতে যাওয়ার দৃশ্য। পরিবারের স্বপ্নপূরণে তাদের বেশ তাড়া।

আমিও গা ঝাড়া দিয়ে উঠে তাদের পিছু পিছু ছুটে চলি। সারা রাত যা ভেবেছি, সব ধুলোয় মিশে গেল মানুষের পদচারণে আর গাড়ির আওয়াজে।