সোনার হরিণ-এক

বোস্টন শহরের একটি দৃশ্য। ছবি: ইন্টারনেট
বোস্টন শহরের একটি দৃশ্য। ছবি: ইন্টারনেট

বছর দশেক আগে আমেরিকাপ্রবাসী বড় ভাই আমাদের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করেছিলেন সেই দেশে। এতটা লম্বা সময়ে ব্যাপারটা আমরা প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম। চিঠিটা যেদিন হাতে পেলাম, আরিফ তখনো অফিস থেকে ফেরেনি। খামটা খুলে নিজের চোখকেই বিশ্বাস হচ্ছিল না আমার। আমাদের অ্যাম্বাসিতে ডেকেছে।

মেয়েরা স্কুলে। বড়টা ক্লাস নাইনে। ছোটটা সেভেনে। মাশা আল্লাহ, দুজনেই পড়ালেখায় খুব ভালো। ভিকারুননিসা স্কুলে প্রথম দশজনের মধ্যেই থাকে।

আরিফকে যখন ফোন করলাম, উত্তেজনায় আমার গলা কাঁপছে—শুনছ, সাংঘাতিক ব্যাপার ঘটে গেছে। আমাদের তো আমেরিকার গ্রিন কার্ডের আবেদন মঞ্জুর হয়েছে। সামনের সপ্তাহে অ্যাম্বাসিতে যেতে হবে। অনেক কাজ, হ্যাঁ গো, তোমার স্যুটটা কি ধুতে দিতে হবে? আমি যে ইংলিশে তেমন কথা বলতে পারি না।

আমার হড়বড় করে বলা কথায় আরিফ মনে হলো কিছুই বুঝতে পারছিল না। মেয়েরা স্কুল থেকে আসার পর খবর শুনে ওদের খুশি দেখে কে? প্রাথমিক উত্তেজনার ধাক্কাটা কমে গেলে দেখলাম, আরিফ বেশ চিন্তিত।

একদিন বলেই বসল, অদিতি, আমি এই বয়সে ওখানে গিয়ে কী করব, বুঝতে পারছি না। এখানে তো ভালোই আছি আমরা।

: ভালো আছি না ছাই। বেতনের যে কটা গোনা টাকা, তাতে কিছু হয়? তুমি তো আবার কোনো উপরিও নিতে চাও না।

: নিতে না চাইলেই কি উপায় আছে তোমার যন্ত্রণায়? তা ছাড়া বাড়ি পাচ্ছি, গাড়ি, ড্রাইভার। সরকারি চাকরির কত সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা। সম্মানটা একেবারেই আলাদা।

: তুমি খালি নিজের কথাই ভাববে? মেয়েদের ভবিষ্যতের কথা ভাববে না? তুমি কি চাও, ওরাও তোমার মতো পচে মরুক এই মরার দেশে? যা কামাও, তা দিয়ে মেয়েদের বিদেশে পড়াতে পারবে?

আরিফ নিরুত্তর বসে থাকে।

একটু পরে আমি বলি, এক কাজ করো, তুমি বরং প্রথমবার চলো আমাদের সঙ্গে ছুটি নিয়ে। তারপর কয়েক দিন থেকে চলে এসো। আমি মেয়েদের নিয়ে থেকে গেলাম। আমাদের পাসপোর্ট হয়ে গেলে মেয়েদের ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে দিয়ে তারপরে নাহয় আমি চলে আসব। ওখানে শুনেছি স্টুডেন্ট লোন পাওয়া যায়।

কথাগুলো আমি হঠাৎ করে বলিনি। কদিন ধরেই আমিও আরিফের কথা ভাবছি। বড় ভাইয়ার সঙ্গে আলাপ করে খুব একটা আশার বাণী পাইনি।

আমার কথা শুনে আরিফ আহত চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, তুমি এ কথা বলতে পারলে? তুমি জানো না, তারিন আর জেরিন আমার দুই চোখের মণি, ওদেরকে দূরে রেখে আমি বাঁচব? আর তুমি? তোমাকে ছেড়েই–বা আমি থাকব কীভাবে? তোমাদেরকে রেখে দুদিনের জন্য ট্যুরে গেলেও আমার ভীষণ দুশ্চিন্তা হয়। আর কেউ না জানুক, আমি তো জানি তুমি কতটা নরম।

ওর কথায় আমি ভীষণ লজ্জা পাই। তাই তো সব জেনেও এ কথা আমি কীভাবে বললাম? এখনো মেয়েদের জ্বর হলে বাবা সারা রাত জাগে। ওদের পড়া দেখিয়ে দেয় নিয়মিত। আমি ওর আরও কাছে ঘেঁষে বসি। আদুরে গলায় বলি, তাহলে চলো সবাই একসঙ্গেই যাই। তোমার এত ভালো রেজাল্ট। এত দিনের অভিজ্ঞতা। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং তো সব দেশেই এক। তুমি নিশ্চয়ই কিছু না কিছু পেয়ে যাবে। সবাই মিলেই না হয় কষ্ট করব। আমাদের মেয়েদের ভবিষ্যৎ তো নিশ্চিত হবে। দেশে মেয়েদের নিরাপদে রাখাও খুব টেনশনের কারণ হয়ে গেছে। ড্রাইভারের সঙ্গেও ছাড়া যায় না।

মেয়েদের উত্তেজনার কাছে ওদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে শেষ পর্যন্ত হার মানল আরিফ। তারপরের দিনগুলো ভীষণ ব্যস্ততায় কেটে গেল। বাড়ির আসবাব বিক্রি করা, ব্যাংকের কাজকর্ম, লাগেজ গোছানো, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা—উফ্‌, নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। আত্মীয়স্বজন, বন্ধুমহলে এই কয়দিনেই মনে হলো আমাদের সম্মান বেড়ে গেছে। শুধু আমার বাবাকে মনে হলো মন খারাপ। শ্বশুর–শাশুড়ি কিছু বললেন না। তবে ছেলেকে নিয়ে তারাও উদ্বিগ্ন।

বড় ভাই থাকেন বোস্টনে। আমেরিকার উত্তর-পূর্বাংশের পুরোনো শহর। বেশির ভাগ সময় নাকি অনেক ঠান্ডা। আমরা যখন গিয়ে পৌঁছালাম, তখন সামার চলছে। কোথায় ঠান্ডা? বাংলাদেশের হালকা শীতের মতো আরামদায়ক আবহাওয়া। দেশের বাইরে আমার আর মেয়েদের এই প্রথম আসা। আরিফ এর আগে অফিসের কাজে ইউরোপ গেছে দুবার। যা দেখছি তাতেই তাক লেগে যাচ্ছে। এত সুন্দর ঝকঝকে তকতকে দেশ। মনে হচ্ছে কোথাও একটু ধুলো নেই। সবাই এত নিয়ম মেনে চলে। একটু–আধটু ট্রাফিক জ্যাম অবশ্য আছে। তবে ঢাকার তুলনায় কিছুই না। ঢাকার কোলাহলে অসহ্য লাগত। আর এখন এ দেশের এই সুনসান নীরবতাকে কেমন জানি ভুতুড়ে লাগছে। প্রথম কিছুদিন মনে হয় এক ঘোরের মধ্যে ছিলাম। যেন এক স্বর্গপুরে বেড়াতে এসেছি। মেয়েরাও ভীষণ খুশি। আরিফের মধ্যে খুশির উচ্ছ্বাসটা একটু কম।

ঢাকায় সরকারি বাসা ছিল বেশ বড়। রুমের সংখ্যা খুব বেশি না হলেও রুমগুলো বিশাল। বড় বড় দুটো বারান্দা। ছাদেও ওঠা যেত। এখানে ছাদ নেই, বারান্দা নেই। ভাইয়ের দুই ছেলেমেয়ের দুটো বেডরুম। এর বাইরে একটা অতিথি রুম। ভাইয়া বলেছিল, ওর মেয়ে লিসার সঙ্গে আমার মেয়েরা থাকতে পারে। আর আমরা গেস্টরুমে। দুদিন পরেই বুঝতে পারলাম, লিসা সেটা পছন্দ করছে না। হয়তো ভাইয়া চাপিয়ে দিয়েছে। এক–দুই দিনের তো ব্যাপার না, কত দিন কে জানে। তাই, আমি বুদ্ধি করে মেয়েদের আমার রুমেই নিয়ে এসেছি।

ভাইয়াকে বলেছি, ভাইয়া, ওরা রাত জেগে পড়ে। লিসার রুটিনের সঙ্গে মিলবে না। তা ছাড়া ফ্লোরিং ওদের খুব পছন্দ।

দেখতে দেখতে সামারের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে গেল। মেয়েদের স্কুলের ভর্তির ব্যবস্থা হয়ে গেছে। এ দেশে স্কুলে ভর্তির নিয়ম ভীষণ সহজ। অবাক লাগল যে তেমন কোনো পরীক্ষাই দিতে হলো না। খালি ওরা ঠিক কোন অবস্থায় আছে সেটা বোঝার জন্য কিছু টুকটাক। স্কুলের শিক্ষকেরাই ওদের সব বুঝিয়ে দিচ্ছে। নতুন দেশ, নতুন পরিবেশ, নতুন স্কুল, তারপরেও ওদের মধ্যে কোনো ভয় কাজ করছে না।

এদিকে দিন দিন কুঁকড়ে যাচ্ছে আরেকজন, আরিফ। এমনিতেই সে নার্ভাস ধরনের মানুষ, কিছুটা আলসেও। নতুন পরিবেশে কিছুতেই মানিয়ে নিতে পারছে না। প্রতিদিন পইপই করে বলেও লাভ হচ্ছে না। খেয়ে উঠে প্লেটবাটি টেবিলে রেখে উঠে যায়। গোসল করে ভেজা লুঙ্গিটা বাথরুমে ফেলে আসে। বাথরুম ভিজিয়ে একাকার। ভেজা স্যান্ডেল পরে কাঠের ফ্লোরে হাঁটতে গিয়ে আরেকটু হলে আছাড় খেত। আমি আতঙ্কে থাকি। দৌড়ে গিয়ে ওর এঁটো থালাবাসন ধুয়ে রাখি। ভেজা লুঙ্গি নিংড়ে বাথরুমের ফ্লোর মুছি।

ভাবি নিজেও চাকরি করেন। তাঁর বাসায় এসে উঠেছি। এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। বাধা দিলেও রান্না করি। কিন্তু মাস দুই যাওয়ার পরে মনের ভেতর খচখচ করে। এভাবে আর কত দিন? ভাইয়াকে বাসা ভাড়া না দিলেও অন্তত খাওয়ার খরচটা দেওয়া দরকার। এ মুহূর্তে কোনো বাসা নেওয়ার কথা ভাবা একদম সম্ভব না। বুঝি, ভাইয়াদের অসুবিধা হচ্ছে, তবু। আমি নির্লজ্জের মতো স্বার্থপর হই। তবে কিছু একটা শুরু করা দরকার। আরিফকে বলতেই থাকি। ও খুব মন খারাপ করে থাকে, কিন্তু তেমন কোনো উৎসাহ দেখি না।

আমার অনুরোধে ভাইয়া একে–ওকে বলতে থাকেন। সব কাজই হলো দোকানের বা রেস্টুরেন্টের। ও গাড়ি চালাতে পারে না। পারলে হয়তো উবার চালাতে পারত। প্রথম যেদিন ওকে রেস্টুরেন্টে কাজের কথা বললাম, সে যে কী ভীষণ কষ্ট পেল। বারবার করে বলছে, আমি একজন উপসচিব, আমি মানুষকে খাওয়া সার্ভ করব? টিপস নেব? ওর এক কথা, অড জব সে করবে না।

এই দেশে গাড়ি ছাড়া কোথাও যাওয়া এক সমস্যা। বাসে বা ট্রেনে যাওয়া যায়। কিন্তু আমরা তেমন পথঘাট চিনি না। কোথাও যেতে হলে ভাইয়া বা ভাবির শরণাপন্ন হতে হয়। ওদের অফিস কামাই যায়। অসুবিধা এমনকি বিরক্তিটাও মাঝে মাঝে প্রকাশ হয়ে যায়। তাতেও আরিফের মন খারাপ হয়। মেজাজ বিগড়ে যায়। আমার চব্বিশ ঘণ্টা গাড়ি, ড্রাইভার দাঁড়িয়ে থাকত। এখন মানুষের কাছে হাত পাত গিয়ে। এই সবকিছু নিয়ে দিন দিন খিটিরমিটির বাড়তেই লাগল। একসময় আমি হাল ছেড়ে দিয়ে ঠিক করলাম, আমিই কাজ করব। আমি এইচএসসির পরে পড়ালেখা করিনি। বিয়ে হয়ে গেল। আর পড়া হয়নি। তাতে কী? শারীরিক পরিশ্রম করতে অত শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে না। এই দুই মাসে টিভি দেখে, মেয়েদের সঙ্গে, ভাতিজা, ভাতিজির সঙ্গে বলে বলে ইংরেজিও রপ্ত করেছি কাজ চালিয়ে নেওয়ার মতো।

প্রথম যেদিন কাজে যাচ্ছি, একরাশ অবিশ্বাস নিয়ে তাকিয়ে আছে আরিফ। বড় ভাই অফিসে যাওয়ার পথে নামিয়ে দেবেন। তাঁর সামনে বিশেষ কিছু বলতে পারল না। এক ফাঁকে সবার অগোচরে আমার হাতটা ধরল একমুহূর্তের জন্য।

বললাম, দুপুরের ভাত টেবিলে ঢেকে রেখেছি।

: ঠান্ডা ভাত খাব?

আমি জানি, সে ঠান্ডা খাওয়া খেতে পারে না।

: ঠান্ডা খাবে কেন? মাইক্রোওয়েভে গরম করে নেবে।

সারাটা রাস্তা আমি ভাবছি, সে পারবে তো গরম করে খেতে? আমার বুকটা অকারণে মুচড়ে ওঠে। (চলবে...)