প্রবাসে দিনযাপন: ভালোবাসার একাল-ওকাল

প্যাসিফিক ফেয়ার শপিংমল
প্যাসিফিক ফেয়ার শপিংমল

জলি ডিউটিতে। গতকাল ও আজ দুদিনই ডিউটি। আমার আবার এই দুদিন অফ। স্বামী-স্ত্রী দুজন চাকরি করলে প্রবাস জীবনটা এমনই হয়। গতকাল আমাদের ছেলে অনিমের জন্মদিন গেছে। রাত সাতটার দিকে ডিউটি থেকে জলি ফোন দিয়ে বলল, ছেলেমেয়ে দুজনকে নিয়ে কোথাও ঘুরে আসো। বাইরে কোথাও কোনো রেস্টুরেন্ট বা ফাস্ট ফুডের রেস্টুরেন্টে নিয়ে যাও।

প্যাসিফিক ফেয়ার শপিংমলে ছেলের সঙ্গে লেখক
প্যাসিফিক ফেয়ার শপিংমলে ছেলের সঙ্গে লেখক

আমি জলিকে কিছু বলিনি। ভেবেছিলাম, জলি নেই, বের হব না। একটা উপন্যাসের সম্পাদনার কাজ করছিলাম। ওটা নিয়েই ব্যস্ত থাকব। কিন্তু জলি পরক্ষণই ছেলেকে ফোনে হুকুমজারি করল, আমরা যাতে অবশ্যই বের হই। ভাবলাম, নেত্রীর আদেশ, তা কি অমান্য করা যায়? তাই রাত সাড়ে সাতটার দিকে ছেলেমেয়ে দুজনকে নিয়ে তড়িঘড়ি করে বের হলাম। সরাসরি প্যাসিফিক ফেয়ার শপিংমলে।

প্যাসিফিক ফেয়ার শপিংমলটার কথা একটু বলে নিই। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত ও বাংলাদেশসহ অনেক দেশের বহু শহরে অনেক বড় বড় শপিংমল দেখেছি। প্যাসিফিক ফেয়ার সে তুলনায় অনেক ছোট একটা শপিংমল। কিন্তু প্যাসিফিক ফেয়ারের ভেতর ঢুকলে মনে হয়, আমি যেন হলিউড বা বলিউডের কোনো স্টুডিওতে ঢুকেছি। পুকুর, পুকুরের ওপর ব্রিজ। ঝুলন্ত ব্রিজ ও ঝুলন্ত সিঁড়ি। বড় একটা গাছ, গাছের চারপাশে বৃত্তাকার বেদি। ছোট্ট একটা গলফ কোর্স। রঙিন ফোয়ারা ও স্থানে স্থানে সবুজ বাগানের সমারোহ।

ওখানে গেলে আমার এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়। আসলে কী, প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে অবস্থিত পুরো গোল্ড কোস্ট শহরটাই যেন ছকে আঁকা অপূর্ব সুন্দর একটা শহর। আমি এর নাম দিয়েছি, মন ভালো হওয়া শহর।

যে কথা বলছিলাম, ছেলেমেয়েকে নিয়ে প্যাসিফিক ফেয়ার শপিংমলে গেলাম। জলি আমাদের সঙ্গে নেই বলে আমাদের বেশ খালি খালি লাগছিল। আমরা মলের ছাদে কার পার্কেই ব্রড বিচকে পেছনে রেখে কয়েকটা ছবি তুললাম। কিছু ছবি মলের ভেতর ফোয়ারার পাশে। ছেলে নতুন আরেকটা ফোন নিয়েছে। ছবি তোলায় ওর আগ্রহই বেশি।

ছবি তুলতে তুলতে আর দীর্ঘ সময় হাঁটতে হাঁটতে আমি ছেলেকে নিয়ে ভাবলাম। অনিমের জন্ম নিউজিল্যান্ডের হ্যামিলটনে। বড় হচ্ছে অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্টে। ওর ১৫ বছর হলো। ওর এখন কৈশোর ও যুবককালের সন্ধিক্ষণের বয়স। ভাবলাম, সে কি কোনো প্রেম-ট্রেম করে? আমাদের জানামতে এখনো করে না। যদিও আমি তাকে বলে দিয়েছি, ‘শালীনতা বজায়ে রেখে যা করতে চাইবে আমাদের একটু জানিও। ব্যাপারটা তোমার ও আমাদের জন্য সহজ হবে...’।

আমরা তাকে সেকেলে মনমানসিকতা নিয়ে বড় করছি না। তার সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বের সম্পর্ক। কিছুদিন আগে ছেলে হঠাৎ করেই বলে, ‘বাবা, আমাকে কি একটা গিটার কিনে দেবে?’ আমি তো এ কথা শুনে অবাক। যে ছেলে আমার গানের ধার ধারে না, সে হঠাৎ গিটার চাচ্ছে? আমি মনে মনে বেশ খুশিও হই। একটা কথা বলে রাখি, ছেলের যা চাওয়া সে আমার কাছেই চায়। সে তার মাকে একটু ভয় পায়।

প্যাসিফিক ফেয়ার শপিংমলে ছেলেমেয়ের সঙ্গে লেখক
প্যাসিফিক ফেয়ার শপিংমলে ছেলেমেয়ের সঙ্গে লেখক

জলি খুব সম্ভব তখন ডিউটিতে। জলি ডিউটি থেকে ফিরতেই তাকে কথাটা বলি। সে আমার কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ে, ‘ছেলে গিটার চায়!’ সঙ্গে সঙ্গে এই আশঙ্কাও প্রকাশ করে, ‘অনিম নিশ্চিত স্কুলে কোনো মেয়ের প্রেমে পড়েছে। নয়তো সে গিটার চায় কেন?’ আমি অনিমকে তা বলি। তাকে জিজ্ঞেস করি, বাপধন, তুমি আবার কোনো মেয়ের প্রেমে-ট্রেমে পড়নি তো? তোমার মা যে আশঙ্কা করছে...! ছেলে বলে, ‘বাবা, তুমি না...!’ কিন্তু অনিম প্রেম-ট্রেম যে করে না, এটা এখনো আমরা নিশ্চিত। সে আছে তার ক্রিকেট খেলা, গেম, জিম ও লেখাপড়া নিয়ে।

আমি ছেলে অনিমের ১৫ বছর বয়সটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে নিজের ১৫ বছরের জীবনটা নিয়ে ভাবতে বসলাম। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে আমার ১৫ বছর হয়েছিল। আমার জন্ম ও বড় হওয়া বিভিন্ন মফস্বল শহরে। আমাদের গ্রামের বাড়িও মফস্বল শহর বা উপজেলা সদরে। পরিবার, বিশেষ করে আমার মায়ের কঠিন বাধ্যবাধকতার মধ্যে আমাদের বড় হতে হয়েছে। আমার মা আমাদের ভাইবোনদের লেখাপড়া বাদে কিছুই ভাবতেন না। সে ক্ষেত্রে তিনি সার্থকও হয়েছিলেন। আমরা পাঁচটা ভাইবোনই এমএ পাস করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমার মা সেটা পুরোপুরি দেখে যেতে পারেননি। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে তিনি ক্যানসারে মারা যান।

হ্যাঁ, আমি বলছিলাম আমার ১৫ বছর বয়সটা নিয়ে। মনে পড়ে, ঠিক ১৫ বছর বয়সে আমি আমার ফুফাতো বোনের কাছ থেকে প্রথম প্রেমপত্র পাই। আমার সেই ফুপাতো বোন ছিল আমার চেয়ে মাত্র কয়েক মাসের ছোট।

আমি ফুফাতো বোনের কাছ থেকে সেদিন ঠিক প্রেমপত্র নয়, একটা গান পেয়েছিলাম। ‘বেদরদি বুঝলি না রে, মানিকে মানিক কেনে তুই কিনলি না, সোনা বন্ধু আমার...’। ফুফাতো বোন পুরো গানটা লিখে জ্যামিতি বইয়ের ভেতর রেখে আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে গিয়েছিল। এই গানটা তখন খুবই জনপ্রিয়। সোহেল রানা, রোজিনা, জাভেদ ও জুলিয়ার সেই ‘জোশ’ ছবি আমরা পূর্ণিমা হলে গিয়ে দেখে এসেছি। রেডিওতে অনুরোধের আসরে এই গানটা নম্বর ওয়ান। গান সমেত জ্যামিতি বইটা দিতে গিয়ে আমার সেই ফুফাতো বোন একটা বাঁকা হাসি দিয়ে যায়। এর আগে থেকেই আমি টের পেতাম, সে যেন কেমন-কেমন করে তাকায়।

এদিকে ফুফাতো বোনের কাছ থেকে সেই গান বা প্রেমপত্র পেয়ে আমার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া! হাত-পা খিল বা ঠান্ডা হয়ে জমে যায়। আমার মা যদি এ খবর জানতে পারেন তাহলে আমাকে শিল ও পাটার মাঝখানে ফেলে পিষে ফেলবেন। টয়লেট করতে গেলেও যে মার কাছ থেকে আমাদের পারমিশন নিতে হয়! এ ছাড়া সেই ফুফাতো বোনের সঙ্গে প্রেম করব, ওটাও কোনো দিন মাথায় আসেনি।

তারপর সেই গানের বা প্রেমপত্রের আর উত্তর দেওয়া হয়নি। ফুফাতো বোনের সঙ্গে আমার প্রেমও হয়নি। কিন্তু সেই ফুফাতো বোন ঠিকই খুব রোমান্টিক ছিল। ১৭-১৮ বছর বয়সে অন্য আরেকজনের সঙ্গে প্রেম করে পালিয়ে বিয়ে করে ফেলে। ছেলেটা শিক্ষিত হলেও আমাদের কাজী বাড়ির তুলনায় একটু নিচু ঘরের ছিল। তাই আমার ফুফু-ফুফা প্রথমে মেনে নেননি। পরে অবশ্য মেনে নেন। ওদের সুখের সংসারই হয়।

কিন্তু বিয়ের পরপর সেই ফুফাতো বোন হঠাৎ করে দেখি, আমাকে ‘আপনি’ করে বলা শুরু করেছে। আমি অবাক হয়েছিলাম। ভেবেছিলাম, সে কি কোনো কারণে আমার প্রতি অনিশ্চয়তায় ভুগছে? অথচ আমরা সব সময় একে অপরকে ‘তুই’ সম্বোধনে ডাকতাম। সেই ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বড় হয়েছি। মাত্র কয়েক মাসের বড়-ছোট। ছোটবেলায় আমাদের বড় পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে কতবার ছেলেমানুষি প্রতিযোগিতা করেছি। আমার ফুফাতো বোনটি মেয়ে বলে কখনই আমার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পারত না। সেই কতকাল আগের কথা।

২০১৭ সালে বাংলাদেশ গিয়ে সেই ফুফাতো বোনের বাসায় যাই। ফুফাতো বোন এখন একটা স্কুলের প্রধান শিক্ষক। তার বর উপজেলা সদরে একটা প্রি-ক্যাডেট স্কুল চালানোর পাশাপাশি বেশ ভালো ব্যবসাপাতি করেন। উপজেলা সদরের উপকণ্ঠেই তিন তলা আলিশান বাড়ি। কিন্তু সেই ফুফাতো বোনকে দেখলাম, বয়সের ভারে এখন ছেড়াবেড়া অবস্থা। এরই মধ্যে মেয়ে বিয়ে দিয়ে নানিও হয়েছে।

বয়স তো আমারও হয়েছে। ৫০ বছর তো কম নয়। কিন্তু ফুফাতো বোনের বয়সটা একটু বেশিই লাগছিল। তাকে সে কথা বললাম। সে মৃদু হাসল। একটা কথা কী, সে কিন্তু এখনো আমাকে ‘আপনি’ করে ডাকে। তার সেই ‘তুই’ সম্বোধনের ডাক আর শুনতে পাই না।
---

মহিবুল আলম: ইমেইল <[email protected]>