ক্যানবেরায় কাব্য কথনের ভিন্নধর্মী পরিবেশনা

কাব্য কথনের ভিন্নধর্মী পরিবেশনা কবি কথা
কাব্য কথনের ভিন্নধর্মী পরিবেশনা কবি কথা

অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় হয়ে গেল কাব্য কথনের দ্বিতীয় অনুষ্ঠান ‘কবি কথা’। চিরাচরিত কবিতা ছেড়ে এ অনুষ্ঠান সাজানো হয়েছিল ক্যানবেরায় বসবাসরত বাংলা ভাষায় যাঁরা সাহিত্যচর্চা করেন, তাঁদের নিয়ে।

বিদেশে বাস করেও অনেকে হৃদয়ে বাংলাদেশকে ধারণ করেন। নানা ব্যস্ততার মাঝেও তাঁরা বাংলা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করে চলেছেন। কাব্য কথন ক্যানবেরাপ্রবাসী সবাইকে অনুরোধ করেছিল কবিতা দেওয়ার জন্য। অনেকে তাদের ডাকে সাড়া দিয়েছেন। তাঁদের কবিতা নিয়ে সাজানো হয় কবি কথা, যা ছিল কবিতা ও গানের এক মেলবন্ধন।

এই কবিরা হলেন তুষার রায়, মধুমিতা আয়েঙ্গার লোধ, জাহিদুল হক, ফাহমিদা সোমা, আবেদ চৌধুরী ও শাহাদাত মানিক।

কাব্য কথনের কবি কথার আয়োজন করা হয়েছিল গত ৩ আগস্ট টেইলর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অডিটোরিয়ামে। পরিবেশিত হয় দুই পর্বে। প্রথম পর্বে ছিল ক্যানবেরার কবিদের কবিতা নিয়ে কাব্য কথনের বাচিকশিল্পীদের পরিবেশনা। দ্বিতীয় পর্বে ছিল প্রধান অতিথির বক্তব্য ও কবি সম্মাননা।

যথাসময়ে শুরু হয় অনুষ্ঠান। প্রথমেই শামসুদ্দিন শাফি বিপ্লব তাঁর ভরাট কণ্ঠে আবৃত্তি করেন তুষার রায়ের ‘বাংলার কবি’ শীর্ষক কবিতা। এরপর শ্রাবণী পাল পুরকায়স্থ ‘তুমি কেমন করে গান করো হে গুণী’ রবীন্দ্রসংগীতটি খালি গলায় গেয়ে শোনান। তারপর সাদিয়া, বুশরা ও শামসুদ্দিন শাফি বিপ্লবের আবৃত্তির মাঝে আশরাফের গান ‘আমি ঘরের হইনি, বাহির আমায় টানে’ সবাই বেশ উপভোগ করেন।

মধুমিতা আয়েঙ্গার লোধের কবিতা ‘হতে পারত মেয়েটি’ শ্রাবণী পাল বেশ ভালোভাবেই উপস্থাপন করেছেন। বুশরার গলায় ‘মেয়ে মানুষ’ কবিতার সঙ্গে আশরাফের গান ‘আমি শুনেছি সেদিন তুমি’ বেশ ভালোই মেলবন্ধন হয়েছিল। সাদিয়া তাঁর মিষ্টি গলায় যখন ‘তোমাকে চিঠি’ পড়ছেন এবং শ্রাবণী গাইছেন ‘কি লিখি তোমায়? প্রিয়তম...’ হলজুড়ে এক অন্য রকম আবহ সৃষ্টি করে। ‘ভিখারিনি দুর্গা’ কবিতার পর আশরাফ পরিবেশন করেন ‘মানুষ মানুষের জন্য’ গান।

জাহিদুল হক তাঁর কবিসত্তায় একটু ভিন্ন মেজাজের। জনপ্রিয় লেখক হ‌ুমায়ূন আহমেদ'র ‘হিমু’ চরিত্রের দ্বারা বিশেষভাবে প্রভাবিত হয়ে তৈরি করেছেন নিজের আরেক প্রতিবিম্ব জাহিদ। চারপাশের অনিয়ম আর কপটতায় কখনোবা নির্লিপ্ত থাকে তার মাঝে বাস করা হিমু আর কখনোবা সে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পরে বাস্তবিক জাহিদের সঙ্গে। জাহিদুল হকের হিমু ভাবনার ‘বাংলায় গালি’ এবং ‘মুখ ও মুখোশ’-এর সঙ্গে ‘সহজ মানুষ ভজে দেখ না রে মন দিব্যজ্ঞানে’ সত্যি অসাধারণ ছিল।

কবি কথা সাজানো হয় তুষার রায়, মধুমিতা আয়েঙ্গার লোধ, জাহিদুল হক, ফাহমিদা সোমা, আবেদ চৌধুরী ও শাহাদাত মানিকের কবিতা নিয়ে
কবি কথা সাজানো হয় তুষার রায়, মধুমিতা আয়েঙ্গার লোধ, জাহিদুল হক, ফাহমিদা সোমা, আবেদ চৌধুরী ও শাহাদাত মানিকের কবিতা নিয়ে

সেই সাত বছর বয়সে পেছনে ফেলে আশা বাংলাদেশের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতি, জীবনের নানাবিধ সম্পর্কগুলোর সংজ্ঞা, মা-আর বন্ধুদের প্রতি তার দুর্নিবার টান ফাহমিদা সোমার কবিতাগুলোতে সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। ফাহমিদা সোমার কবিতা বেশ সহজ ও প্রাঞ্জল। তাঁর কবিতা ‘বন্ধু’ শ্রাবণী বেশ ভালোভাবেই উপস্থাপন করেছেন। সঙ্গে বাড়তি পাওনা ‘বন্ধু চল’ গানটি। সাদিয়ার আবৃত্তি ‘রাতের গল্প’ ও বুশরার ‘তুমি তো আমার মা’ ভীষণ ভালো লেগেছে।

বিজ্ঞানী আবেদ চৌধুরীর কবিতায় আমরা খুঁজে পাই কানিহাটি-মাধকুণ্ডের গল্প, খুঁজে পাই শাশ্বত প্রেমের গল্প, অসাম্প্রদায়িকতার আহ্বান। তাঁর ভাষায়, কবিতা লিখতে হয় না, বরং লেখা হয়ে থাকে। আবেদ চৌধুরীর কবিতা ‘এ দেশ বুদ্ধের’ ও ‘যদি দেখা হয়’ দর্শকদের হৃদয়ে নাড়া দিয়েছে।

সর্বশেষ কবি শাহাদাত মানিকের পর্ব শুরু হয় প্রেমের কবিতা ‘মালিনী’ দিয়ে। শ্রাবণীর গলায় কবিতাটি ও রাজীবের খালি গলায় ‘মিলন হবে কত দিনে’ ভীষণ উপভোগ্য ছিল। তাঁর ‘হ্যালো ব্রাদার’ কবিতাটি, যা ২০১৯ সালের নিউজিল্যান্ড ক্রাইস্টচার্চ হত্যাকাণ্ডের ওপর রচিত দর্শকদের মনে ভালোই দোলা দিয়েছে।

প্রবাসে কবিদের নিয়ে পুরো দুই ঘণ্টার অনুষ্ঠান করা কোনো মামুলি ব্যাপার নয়। আমার মতো অনেকেই সেদিন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন কাব্য কথনকে উৎসাহ দিতে ও তারা ক্যানবেরার কবিদের নিয়ে কী করে, দেখার জন্য। কাব্য কথন অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি উপহার দিয়েছে। যদিও শামসুদ্দিন শাফি বিপ্লব বারবার করে সবাইকে মনে করিয়ে দিচ্ছিলেন, তাঁরা কেউই পেশাদার বাচিকশিল্পী নন, কিন্তু আমাদের তা মনে হয়নি। বরং অনুষ্ঠানজুড়েই তাঁদের ছিল পেশাদারির ছাপ।

অনুষ্ঠানে কবিদের কাব্য কথনের উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানানো হয়
অনুষ্ঠানে কবিদের কাব্য কথনের উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানানো হয়

প্রধান অতিথি অস্ট্রেলিয়াতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুফিউর রহমান তাঁর বক্তব্যে কাব্য কথনকে তাদের এই অনন্যধর্মী আয়োজনের জন্য সাধুবাদ জানান। পরে তিনি কবিদের কাব্য কথনের উত্তরীয় পরিয়ে সম্মান জানান।

কবিতার শব্দমালার সুবচনের লক্ষ্যেই সৃষ্টি আবৃত্তির। আর সেই আবৃত্তি শিল্পকে হৃদয়ে ধারণ করে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায় কয়েকজন বাচিকশিল্পীকে নিয়ে কাব্য কথনের যাত্রা শুরু হয় ২০১৮ সালের ১৭ নভেম্বর। কবিতাকে শুধু প্রথাগত আবৃত্তিতে সীমাবদ্ধ না রেখে, সেটাকে নিয়ে আরও বিশ্লেষণের মাধ্যমে তার সঙ্গে সুর আর গানের মেলবন্ধনই এর অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য। পেছনে ফেলে আসা কৃষ্টি ও সংস্কৃতি ও বিদেশ বিভুঁইয়ের সংস্কৃতির সমন্বিত সহাবস্থানই তাদের লক্ষ্য।

কাব্য কথন ২০১৮ সালের তাদের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান দিয়ে ক্যানবেরার বাংলাদেশি মহলে ভালোই সাড়া ফেলেছিল। বর্তমানে ক্যানবেরায় প্রায় তিন হাজার বাংলাদেশি বাস করেন। বাংলাদেশিদের বেশ কয়েকটি সাংস্কৃতিক সংগঠন আছে, যারা সবাই মূলত গান করে থাকে। এর মধ্যে কাব্য কথন ব্যতিক্রম। তারা মূলত বাচিক সংগঠন, কিন্তু শুধু কবিতা আবৃত্তিতেই সীমাবদ্ধ না থেকে তারা কবিতা ও গান নিয়ে নিরীক্ষা করে থাকে। এই ব্যতিক্রমী প্রয়াস বেশ প্রশংসা কুড়িয়েছে তাদের প্রথম অনুষ্ঠানে। কাব্য কথনের সদস্যরা হলেন; শ্রাবণী পাল পুরকায়স্থ, সাদিয়া আফরিন, বুশরা খানম, রাজীব পাল ও শামসুদ্দিন শাফি বিপ্লব।