জীবন্ত গল্প

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: মাসুক হেলাল
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ছবি: মাসুক হেলাল

চারতলা বাড়ির দোতলায় আমরা থাকি। সামনে দিয়ে বয়ে গেছে স্যার অ্যান্ডারসন খাল। এখন এটি কুরুলিয়ার খাল নামে পরিচিত।

অনার্স সেকেন্ড ইয়ার ফাইনালের আর মাত্র পনেরো দিন বাকি। এদিকে মায়ের শরীরটা ভালো নেই। গত তিন মাস হাসপাতাল আর বাসা, সময়টা বেশ অস্থির যাচ্ছে। আমার পরীক্ষার কথা ভেবে রানু আপা চলে এলেন। সার্বক্ষণিক মায়ের দেখাশোনা নিয়ে ব্যস্ত। যেকোনো সময় জীবনের সবচেয়ে মর্মান্তিক খবরটা চলে আসবে। ডাক্তার তা-ই বলে দিয়েছেন।

এই কদিনে এত বড় সিলেবাস কোনোভাবেই পড়ে শেষ করা সম্ভব নয়। কী আর করা। জীবনটা অনেক চাপের মধ্য দিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে। তাই এটুকু পড়ার চাপ কোনো ব্যাপারই নয়। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, সিলেবাস শেষ করা যেহেতু সম্ভবই না, তাই ভালো কোনো বই পড়ে মনটা ভালো রাখাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। মন ভালো থাকলে পরীক্ষা ভালো হতেও পারে। মাঝে মাঝে মনকে মনের কাছে ছেড়ে দিতে হয়।

‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ বইটা যখন পড়া শুরু করি, তখন সূর্যোদয় হচ্ছিল। কয়েক পৃষ্ঠা পড়েই দেখি কী এক মুগ্ধতা যেন আমায় টেনে নিয়ে যাচ্ছে অবিরাম। পড়ার যে আনন্দ দেহমনে অনুভব করি, তাতে শিহরিত হয়ে উঠছে আমার চোখ দুটো। পরীক্ষা চুলোয় যাক। এ বই শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমি পরীক্ষার্থী নই। এমনকি আমি ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের ছাত্রও নই। এক শ দশ-এগারো পৃষ্ঠায় এসে দেখি, আমার প্রাণের নদ তিতাস অববাহিকার জল-মাটি-মানুষে মিশে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর হৃদয়।

বইটা বন্ধ করে বেরিয়ে পড়ি। অস্তিত্বের ইতিহাসের সূত্র ধরে পথচলার রোমাঞ্চে। এক নতুন চোখে আমার আমিকে দেখছি। তখন সকাল সাড়ে নয়টা। প্রণব, মাহি, আমির, খোকন কাউকে ফোন দিইনি। ইচ্ছে করছে না। ওরা যদি শোনে, খুব মন খারাপ করবে। করুক। আজকের এই দিনে, এ বই যে পড়েনি, সে আমাকে বুঝবে কেমন করে? তাই তো পাঠকের মন চিরকালই একা। এই মন নিজেই নিজের বন্ধু। তাই আমি সবার অজান্তে আমার মনের যত্ন নিই।

একটা নৌকা সারা দিনের জন্য ভাড়া করি। নৌকায় বসে মাঝিকে বললাম, চলো। কৃষ্ণনগর চলো।

কুরুলিয়ার খাল ধরে তিতাসের শাখা পাগলা নদীর অববাহিকায়, নবীনগর মহকুমার (বর্তমানে উপজেলা) একটি গ্রাম কৃষ্ণনগর। ওই গ্রামের হাইস্কুলটি উদ্বোধনের জন্য রফিকুল হোসেন এক সভার আয়োজন করেছিলেন। সেখানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু ও তখনকার ফুড ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর জেনারেল এন এম খান।

আরও ছিলেন আমাদের লোকসংগীতের কিংবদন্তি শিল্পী আব্বাসউদ্দীন, তাঁর দুই ছাত্র সোহরাব হোসেন ও বেদারউদ্দিন আহমেদ।

কৃষ্ণনগর হাইস্কুল উদ্বোধন শেষে শুরু হয় গানের অনুষ্ঠান। রাতে রফিক সাহেবের বাড়িতেও চলে গানের আসর।

পরদিন নৌকায় চেপে বঙ্গবন্ধু যখন শিল্পীদের সঙ্গে নিয়ে আশুগঞ্জ রেলস্টেশনে যাচ্ছিলেন, তখন পাগলা, তিতাস আর মেঘনা নদী রোমাঞ্চিত হয়েছিল আব্বাসউদ্দীনের গানে। বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘মনে হচ্ছিল, নদীর ঢেউগুলোও যেন মুগ্ধ হয়ে শুনছে তাঁর গান।’

গান শুনে মুগ্ধ বঙ্গবন্ধু সেদিন আব্বাসউদ্দীনের ভক্ত হয়েছিলেন। সেদিন আব্বাসউদ্দীন বাংলার এই অপ্রতিরোধ্য নেতাকে বলেছিলেন, ‘মুজিব, বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা না হলে বাংলার কৃষ্টি, সভ্যতা সব শেষ হয়ে যাবে। আজ যে গানকে তুমি ভালোবাসো, এর মাধুর্য ও মর্যাদাও নষ্ট হয়ে যাবে। যা কিছুই হোক বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করতেই হবে।’

তিতাস অববাহিকায় চিরজাগ্রত অসমাপ্ত আত্মজীবনীর এই জীবন্ত ইতিহাসের ভেতর চোখ দুটো ভিজিয়ে আমার নৌকাটি যখন আশুগঞ্জ স্টেশনের কাছে এসে থামে, তখন বেলা সাড়ে তিনটা। ব্লুটুথ স্পিকারে তখনো আব্বাসউদ্দীনের গান বেজেই চলেছে। এ গানের ভেতর দিয়ে এবারের মতো আবার মেঘনার দিকে তাকাই। সহসা এক অতৃপ্ত ব্যাকুলতা বুকের ভেতর কেঁদে ওঠে...। বঙ্গবন্ধু, আমি তোমাকে দেখিনি। আজ তোমার এই ভালো লাগা নদীপথে তোমাকে অনুভব করেছি। আজকের দিনটি জীবনের খাতায় অক্ষয় হয়ে রইল।

স্টেশনে যাওয়ার পথে পকেট থেকে মুঠোফোনটা বের করে দেখি, রানু আপার নম্বর থেকে ষোলোটা মেসেজ আর একত্রিশটা কল।

ইসহাক হাফিজ: সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।
ই–মেইল: [email protected], ফেসবুক: Ishaque Hafiz