চীনের উহান সাবওয়ে: শিল্পকলার এক জাদুঘর
উহান শহরের ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র হানকু। জামা-জুতো আর ব্যবহারের নানা পণ্য কিনতে এখানে ভিড় করেন স্থানীয় মধ্যবিত্তরা। পড়াশোনার সুবাদে দুই বছর ধরে আমার বসবাস এই নগরে। তাই বেশ কয়েকবার যাওয়া হয়েছে কেনাকাটার কাজে।
বর্ষার এক বিকেলে যখন প্রথম গিয়েছিলাম, আকাশে তখন তামাটে মেঘের গুমোট উপস্থিতি। তবুও হানকু যাওয়া নিয়ে খুব একটা আশঙ্কা ছিল না।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে লাগোয়া দুটি আন্ডারগ্রাউন্ড সাবওয়ে স্টেশনের প্রবেশপথ। এর একটিতে ঢুকে গেলেই নিশ্চিন্ত। তাই অন্ধকার গুরুগম্ভীর আকাশকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাঁচ মিনিট হেঁটেই পৌঁছে গেলাম জিয়াদাকু স্টেশনে। সেখান থেকে মাটির তলার মেট্রোতে ২০ মিনিটে হানকুর সাবওয়ে স্টেশন হানঝেং স্ট্রিটে।
মেট্রো থেকে বেরিয়ে নিচতলার এস্কেলেটর ধরে দোতলায় উঠতেই চমকে গেলাম। ওপরে তাকাতেই দেখি তামাটে মেঘের ছিটেফোঁটাও নেই। গুমোট ভাব কেটে গিয়ে আকাশে তখন রোদের ছটা। ভাসছে তুলোর মতো মেঘ, যেন শরতের আকাশ।
এমনিতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা হচ্ছিল, উপরন্তু খানেক আগেও আকাশে ছিল ভারী বর্ষণের ইঙ্গিত। এমন সময় ঝকঝকে আকাশের দেখা পাওয়া জাদুকরি আলামত বলেই মনে হলো।
দোটানায় পড়ে গিয়ে ভাবতে ভাবতে শেষমেশ আবিষ্কার করলাম, যা দেখছি তা সত্যিকারের আকাশ নয়। স্টেশনটির সৌন্দর্যে ভিন্ন মাত্রা দিতে সিলিং-জুড়ে সাঁটানো বিরাট এক কৃত্রিম আকাশ আলোছায়ার খেলা আর শিল্পের স্পর্শে এতটাই নিখুঁত হয়ে ফুটেছে যে, প্রথম দেখায় ভুল হতেই পারে।
সংবিৎ ফিরে পেয়ে ঝটপট ক্যামেরায় বন্দী করলাম প্রথম দেখা শরতের কৃত্রিম আকাশ। হানঝেং স্ট্রিটের মতো শিল্পের এমন অভাবনীয় নানা উপাদান ছড়িয়ে আছে উহান সাবওয়ে জুড়ে। সবকিছু বর্ণনা এক লেখায় শেষ করার নয়। আজকের লেখার আলোকপাত সাবওয়ের বিশেষ বিষয়গুলো নিয়েই।
অন্য রকম জাদুঘর
গেল এপ্রিলে এক চীনা বন্ধুর আমন্ত্রণে গিয়েছিলাম শহরের হানইয়াং এলাকায়। সঙ্গে ছিল পর্তুগিজ বন্ধু আন্দ্রে। ফেরার পথে হুজুগের বশে দুজন নেমে পড়লাম নর্থ ইন্টারন্যাশনাল এক্সপো সেন্টারের মেট্রো স্টেশনটিতে।
ট্রেন থেকে বেরিয়ে কয়েক কদম এগোতেই সিলিংয়ের দিকে আঙুল তাক করে আমার দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করল আন্দ্রে। আঙুল লক্ষ্য করে মাথা ঘুরিয়ে ওপরে তাকাতেই খুঁজে পেলাম সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো জলরাশি। হুট করে দেখে মনে হলো মাথার ওপর ভাসছে আস্ত এক সাগর। পরে বুঝলাম এটিও আসলে ওয়েটিং এরিয়ার সিলিংজুড়ে ঢেউয়ের অবয়বে বানানো অনন্য শিল্পকর্ম।
চকচকে মেঝেতে ঢেউয়ের প্রতিবিম্ব দেখতে দেখতে ওপরে উঠে আসতেই হাতের ডানপাশের দীর্ঘ দেয়ালজুড়ে দেখলাম এক মস্ত অ্যাকুয়ারিয়াম। ডলফিনসহ নানা রকম সামুদ্রিক মাছের ছোটাছুটি সেখানে। হঠাৎ দেখে ওয়াটার ওয়ার্ল্ড বলে চিৎকার করে উঠল আন্দ্রে। একটু কাছে যেতেই বুঝলাম, কাচের দেয়ালে আঁকা নিখুঁত একটি চিত্রকর্ম এটি। আলোছায়ার খেলায় হয়েছে জীবন্তপ্রায়!
নর্থ ইন্টারন্যাশনাল এক্সপো সেন্টারের এই স্টেশন লাইন সিক্সে অবস্থিত। এই লাইনের বেশির ভাগ স্টেশন দেখলে ছবি তোলার শখ জাগবে যে কারও। যেমন ডাজি রোডের স্টেশনটির কথাই ধরা যাক। এর প্রবেশপথ ধরে নিচে নেমে আসতেই আছে চমক।
দেখবেন রাজকীয় ঢঙে বাঁকানো সিলিংয়ের নিচে অপেক্ষমাণ চীনা রেলগাড়ির পুরোনো মডেলের মস্ত ইঞ্জিন। তবে এটি কোনো চিত্র বা শিল্পকর্ম নয়। একেবারে সত্যিকারের রেললাইনের ওপর রাখা আস্ত এক বাষ্পচালিত রেলইঞ্জিন।
পুরোনো বলেই জাদুঘরে প্রদর্শনীর আদলে সাজিয়ে রাখা। প্রথমবার দেখলেই ছবিতে বন্দী করার খায়েশ জাগবে অনেকের। একটু সামনে এগোলেই ডিজিটাল প্রবেশদ্বার। তার বাঁ-পাশের দেয়ালে দেখা মিলবে কাঠের তৈরি রেলগাড়ির একটি অনন্য শিল্পকর্ম। একপাশে চীনা পুরোনো রেলগাড়ি অন্যপাশে আধুনিক বুলেট ট্রেনের প্রতিচ্ছবির মিশেলে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এটি।
ডাজি স্টেশনে প্রথমবার গেলে অনেকের মনে হতে পারে কোনো ছোটখাটো রেল জাদুঘরে ঢুকে পড়েছেন। লাইন সিক্সে মোট স্টেশন আছে ২৭টি। আর পুরো উহান মেট্রোতে এখন চালু আছে ১০টি লাইন। মোট স্টেশন সংখ্যা ২২০। এর সব কটি ঘুরে দেখতে কয়েক মাস লেগে যেতে পারে।
তবে উহান শহরে গত দুই বছরে চলাচলের সময় আমার অন্তত ৫০টি সাবওয়ে স্টেশন দেখার সুযোগ হয়েছে। আধুনিকতা, পরিচ্ছন্নতা আর শৃঙ্খলার পাশাপাশি এসবের অধিকাংশেই চোখে পড়েছে নান্দনিকতা আর শিল্পের সমৃদ্ধ আয়োজন।
চীনের নানা ইতিহাস ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে গুরুত্ব দিয়ে সাজানো এসব সাবওয়ে স্টেশনে আধুনিক শহরের প্রতিচ্ছবি থেকে শুরু করে ঠাঁই পেয়েছে হাজার বছরের পুরোনো চীনা গ্রামীণ সমাজ। কখনো এসব শিল্প ফুটে উঠেছে দেয়ালচিত্রে কখনো বা ভাস্কর্যে। আছে চিত্রকর্ম, নানা রকম ম্যুরাল আর রিলিফের বিচিত্র সব সৃষ্টি।
বাংলাদেশি চিত্রশিল্পী ইব্রাহিম মাহমুদ উচ্চশিক্ষা নিতে উহানে আছেন প্রায় দুই বছর। তাঁর মতে, উহান মেট্রোতে যেসব শিল্পকর্ম স্থান পেয়েছে তার বেশির ভাগই শিল্পমানের বিচারে বিশ্বের উন্নত রুচিশীল যেকোনো শিল্পকর্মের সমতুল্য।
তিনি বলেন, ‘পোড়ামাটি, সিমেন্ট, স্টেইনলেস স্টিল, ফাইবার, তামা নয়তো পাথর দিয়ে বানানো শিল্পকর্মগুলোর পেছনে একটি বিহাইন্ড স্টোরি লক্ষ করেছি। আলোছায়া আর উপস্থাপনার চোখধাঁধানো ঢঙে এসব শিল্পকর্মে আনা হয়েছে ভিন্নমাত্রার আবহ। ম্যুরাল, ভাস্কর্য, চিত্রকর্ম আর সামগ্রিক সাজসজ্জা মিলিয়ে উহান মেট্রো আমার কাছে একটি আর্ট গ্যালারি।’
ভাস্কর্যে-ম্যুরালে গল্প আর ইতিহাস
একটি সবুজ নারীমূর্তি। শরীর থেকে আকারে বড় অসাড় ও অচল তার পা দুখানা সামনে ছড়ানো। হাতে সদ্য ফোঁটা একটি ফুলের বোঁটা। সামনে পড়ে আছে আরও বেশ কটি ফুল আর পাপড়ি। শিল্প সমঝদার যে কেউ দেখলে বুঝে নেবেন মূর্তিটি নারীর পরাধীনতা আর স্বপ্নভঙ্গেরই একটি গল্প।
উহান সাবওয়ের লাইন ইলেভেনের গুয়াংগু ফিফথ রোড স্টেশনের প্রবেশপথ ধরে নেমে এলেই দেখা মিলবে এমন নারী ভাস্কর্যের। এটির শিল্পমান দেখলেই বোঝা যায় কোনো প্রসিদ্ধ শিল্পীর হাতে গড়া অনবদ্য এক সৃষ্টি।
ভাস্কর্য ছাড়াও উহান মেট্রোর ম্যুরালগুলোতেও নানা গল্প আর ইতিহাস তুলে ধরার প্রয়াস আছে। এদের শিল্পমান আর নিখুঁত উপস্থাপনায় অতীত ফুটে উঠেছে প্রাণবন্ত হয়ে।
লাইন ফোরের রেনহে রোড স্টেশনের ম্যুরাল এটির উপযুক্ত উদাহরণ। দোতলা স্টেশনের ওপরতলার দেয়ালে প্রায় ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যের ম্যুরালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে চীনা কমিউনিস্ট বিপ্লবের ইতিহাস। শ্বেত পাথরে খচিত এই ভাস্কর্যে কমিউনিস্ট বিপ্লবে মাও সেতুংয়ের (মাও জে দং) নেতৃত্ব আর শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধের চিত্র আপনাকে নিয়ে যাবে ১৯৫০-এর দশকে।
বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা এতটাই নিখুঁত যে উত্তাল চীন বিপ্লব জীবন্ত হয়ে ধরা দেবে আপনার অনুভূতি ও আবেগে। ম্যুরালটি প্রথমবার দেখে আমার অন্তত সেই ধরনের অভিজ্ঞতাই হয়েছিল।
মূলত এ দুটি শিল্পকর্ম উহান সাবওয়ের শখানেক ভাস্কর্য আর ম্যুরালেরই প্রতিনিধিত্ব করে। এমন অনেক শিল্পোত্তীর্ণ ভাস্কর্য আর দেয়ালচিত্রের দেখা মিলবে শহরের নানা মেট্রো স্টেশন ঘুরে। এর মধ্যে কোথাও আছে কাঠের তৈরি ভাস্কর্য, কোথাও দেখা যাবে লোহায় বানানো অনন্য ডিসপ্লে।
মেট্রো স্টেশনের শোভা বাড়াতে ভাস্কর্য আর ম্যুরালে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ফুলের বাগান, লেকের ধারে পাখিদের মেলা, উহানের ইতিহাস, মানুষ, প্রকৃতি নয়তো চীনা কমিউনিস্ট পার্টির প্রোপাগান্ডা।
মাটির নিচে বাড়ছে শহর
চীনের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও যাতায়াত কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হুবেই প্রদেশের রাজধানী উহান। বিশ্বের বড় ও আধুনিক শহরগুলোর মতো এখানেও চলাচলের জনপ্রিয় মাধ্যম সাবওয়ে। উহান মেট্রোর বেশ কিছু চমকপ্রদ তথ্য দিলেন এর নির্বাহী কর্মকর্তা ঝান ইয়াং। জানালেন, চীনের সবচেয়ে বড় পাঁচটি মেট্রো ব্যবস্থার একটি হলো উহান মেট্রো, যার দৈনিক গড় যাত্রী ৩৫ লাখ।
মূলত আন্ডারগ্রাউন্ড এই মেট্রো ব্যবস্থা কিছু কিছু ক্ষেত্রে মাটির ওপর দিয়েও শহরে ছড়িয়ে আছে, যার বিস্তৃতি ৩১৮ কিলোমিটার। ঝান ইয়াংয়ের তথ্যমতে, বিশাল এই যাতায়াতব্যবস্থা নির্বিঘ্ন করতে প্রায় ১৪ হাজার দক্ষ জনবল কাজ করছে।
উহান মেট্রোর ভবিষ্যৎ নিয়ে ঝান বলেন, ‘আগামী পাঁচ বছরে মেট্রোর পরিসর দ্বিগুণ করতে দিনরাত চলছে আমাদের কর্মযজ্ঞ। শহরের তলদেশ দিয়ে মাইলের পর মাইল কাটা হচ্ছে টানেল। মাটির কয়েক শ ফুট খুঁড়ে বসানো হচ্ছে মেট্রো লাইনের ভিত্তি। ২০২৪ সালের মধ্যে নতুন আরও চারটি লাইন বাড়িয়ে সাবওয়ের দৈর্ঘ্য ৬০৬ কিলোমিটার করার পরিকল্পনা রয়েছে। আছে নান্দনিকতা আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় উহান মেট্রোকে বিশ্বের প্রথম সারির সাবওয়েতে রূপান্তরের মাস্টার প্ল্যানও।’
লেখক: পিএইচডি গবেষক, সেন্ট্রাল চায়না নরমাল বিশ্ববিদ্যালয়, উহান, চীন।