শূন্য বিন্দুতে নারী-এক

নাওয়াল আস-সাদাবি, ভাষান্তর: ফারহানা আজিম শিউলী
মাসুক হেলাল
মাসুক হেলাল

সারসংক্ষেপ: শূন্য বিন্দুতে নারীর কেন্দ্রীয় চরিত্র ফেরদৌস। সত্য ঘটনা অবলম্বনে এই উপন্যাসের কাহিনির উন্মোচন ঘটে মিসরের কানাতির জেলে, ফেরদৌসের ফাঁসির আগের দিন, কারাপ্রকোষ্ঠে।

এক মনোরোগ বিশেষজ্ঞ (লেখক) ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত এক নারী (ফেরদৌস) শেষাবধি ফাঁসির আগের দিন মুখোমুখি হন। পৃথিবীর বুকের শেষ রাতটিতে ফেরদৌস তার গল্প বলার সিদ্ধান্ত নেয়। বলে সারা জীবনের নির্যাতন, প্রতারণা, বঞ্চনা ও ঘুরে দাঁড়ানোর ইতিহাস।

মিসরের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্ম ফেরদৌসের। শৈশব থেকেই দারিদ্র্য, পারিবারিক অবহেলার মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠে সে। দেখে, মার ওপর বাবার অত্যাচার-অবহেলা। মুসলিম পরিবারে জন্ম নেওয়া ফেরদৌস দেখতে পায়, হাজারো অন্যায় কাজে যুক্ত থাকা মানুষগুলোর ধর্মের নামে ভণ্ডামি। দেখে, ক্ষমতাবান শাসকগোষ্ঠীর অত্যাচার-অবিচার। খুব ছেলেবেলাতেই শিকার হয় চাচার যৌন নিপীড়নের। মেয়েদের যৌন অবদমনের মিসরীয় প্রথা অনুযায়ী শৈশবেই তার ভগাঙ্কুর কেটে নেওয়া হয়।

ছেলেবেলায় মা-বাবা মারা যাওয়ার পর চাচার সঙ্গে রাজধানী কায়রোতে শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়। চাচির গঞ্জনায় বাসা ছেড়ে বোর্ডিং স্কুলে যেতে হয় তাকে। নানা রকম প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করেও সে অত্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়। অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আর না পড়িয়ে ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের সঙ্গে তার প্রবল অনিচ্ছায় বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়।

প্রথমে চাচা-চাচির কাছ থেকে, পরে অত্যাচারী স্বামীর কাছ থেকে পালিয়েও তাঁর শেষ রক্ষা হয় না। এ যেন ঘটনার শুরু কেবল। মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট সম্বল করে কোনোমতে একটা কাজ জুটিয়ে খুব সাধারণ ভদ্রস্থ জীবন যাপন করতে চাইলেও তা আর হয়ে ওঠে না তার। যাকেই আঁকড়ে ধরতে চেয়েছে, প্রত্যেকেই তাকে ঠকিয়েছে, সুযোগ নিয়েছে, তার শরীর সম্ভোগ করেছে।

একপর্যায়ে বেশ্যাবৃত্তিতে জড়িয়ে পড়ে ফেরদৌস। একসময় এই জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে মরিয়া ফেরদৌস চাকরি নেয় এক কোম্পানিতে। উদয়াস্ত খেটে সেখানেও নারী হিসেবে বৈষম্যের শিকার হয়। আর প্রতারণার শিকার হয় এক সহকর্মীর প্রেমে পড়ে। চরম মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থা থেকে একসময় উত্তরণ ঘটে তার। এবার সে আত্মপ্রকাশ করে শহরের অন্যতম নামীদামি বেশ্যা হিসেবে। এক ভয়ংকর দালালের খপ্পরে পড়ে। এখানেও প্রতারণা, নির্যাতনের শিকার হয়ে শেষমেশ খুন করে বসে সে। ফাঁসির আদেশ হয় তার।

কিন্তু শত অমর্যাদা, অপমান, নিপীড়নের মধ্যেও বিপন্ন ফেরদৌস বারবার মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চায়, রুখে দিতে চায়, বাঁচতে চায় আত্মমর্যাদা নিয়ে। কখনো চায় পালিয়ে বাঁচতে। কিন্তু প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় সে তা করে উঠতে না পেরে ধর্মীয় ও সামাজিক ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করে দিয়ে শেষমেশ মৃত্যুকেই আলিঙ্গন করে।

ফেরদৌসের বিপন্ন-বিভীষিকাময় জীবনে তলিয়ে গিয়ে তার আশাভঙ্গের বেদনা আমরাও যেন একইভাবে অনুভব করি।

নাওয়াল আস-সাদাবির চিত্রিত মিসরীয় সমাজ আমাদের অতিপরিচিত ঠেকে। জীবনভর প্রতারণা-বঞ্চনা-নিপীড়নের শিকার হয়েও ঋজু, আপসহীন, হার না-মানা, মৃত্যুঞ্জয়ী ফেরদৌস হয়ে ওঠে-দেশ-কাল ভেদে নির্যাতিতা-প্রতিবাদী নারীর বলিষ্ঠ অনন্য কণ্ঠস্বর।

লেখকের ভূমিকা  

কানাতির জেলখানায় এক নারীর সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র ধরে আমি উপন্যাসটি লিখি। এর কয়েক মাস আগে আমি মিসরীয় মহিলাদের নিউরোসিস (এক ধরনের মানসিক রোগ) নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিলাম। তখন বেকার থাকায় এই গবেষণায় সময়ও দিতে পারছিলাম বেশ। ১৯৭২ সালের শেষদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আমাকে হেলথ এডুকেশনের পরিচালক ও ‘হেলথ’ ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে অব্যাহতি দেন। এটি ছিল সরকারকে বিব্রত করে এমন নারীবাদী লেখক ও ঔপন্যাসিক হয়ে ওঠার ফল।

যা হোক, এতে বরং চিন্তাভাবনা, গবেষণা, লেখালেখি ও আমার নারী রোগীদের সঙ্গে সেশনগুলোর জন্য আরও বেশি সময় হাতে আসে। ১৯৭৩ সালে আমার জীবনে এক নতুন অধ্যায় সূচিত হয়। ওই বছরে আমার ‘ফেরদৌস’/‘উইমেন অ্যাট পয়েন্ট জিরো’ উপন্যাসটি লেখার বীজ রোপিত হয়।

নানা রকম মানসিক রোগের উৎস ও কারণ নিয়ে নারীদের পরামর্শ দিতে ও সাহায্য করতে গিয়ে মূলত গবেষণার ধারণাটি আসে। নিউরোসিসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্য থেকে কয়েকজনকে আমি গবেষণার জন্য বেছে নিই এবং সে জন্য নিয়মিত হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোতে যাতায়াত শুরু করি।

‘জেলখানা’ আমাকে সব সময়ই টানত। জেলের ভেতরের জীবন, বিশেষ করে নারী কয়েদিদের জীবন আমাকে ভাবাত। আমারই দেশে, আমার চারপাশের অনেক প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবীর ‘রাজনৈতিক মামলায়’ বিভিন্ন মেয়াদে জেল খাটা হয়তো আমার এই কৌতূহলের কারণ। আমার স্বামী ‘রাজনৈতিক বন্দী’ হিসেবে দীর্ঘ ১৩ বছর জেলে আটক ছিলেন। কানাতির মহিলা জেলখানার ডাক্তারের সঙ্গে একবার ঘটনাচক্রে দেখা হয়ে গেলে, তাঁর সঙ্গে এসব বিষয়ে আলোচনার লোভ সামলাতে পারিনি। এর পর থেকে তাঁর সঙ্গে দেখা হলেই আলাপ হতো। বিভিন্ন অপরাধে বন্দী নারীদের নানান বিষয়ে তিনি আমাকে জানাতেন, বিশেষ করে যারা মানসিক রোগে আক্রান্ত ও কানাতির জেল-হাসপাতালের মেন্টাল ক্লিনিকের সাপ্তাহিক সভাগুলোতে নিয়মিত আসত, তাদের ব্যাপারে।

আমার আগ্রহ দিন দিন বাড়তে থাকে ও জেলখানায় গিয়ে রোগীদের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা ধীরে ধীরে জাগতে থাকে। জেলখানার জীবন সম্পর্কে আমার জ্ঞানের দৌড় ছিল ‘রাজনৈতিক চলচ্চিত্রে’ দেখা দৃশ্য পর্যন্তই। কিন্তু এবার সত্যিকারের জেলখানা দেখার সুযোগ হলো। আমার আগ্রহ আরও তীব্র হয় যখন আমার বন্ধু, জেল হাসপাতালের ডাক্তার আমাকে এমন এক নারী কয়েদির কথা সবিস্তারে জানান, যে একজন মানুষ খুন করে ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত। মানুষ খুন করতে পারে এমন মহিলা আমি আগে কখনো দেখিনি।

ডাক্তার কথা দেন আমাকে সেই নারী ও অন্য মানসিক রোগগ্রস্ত কয়েদিদের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেবেন। তাঁর মাধ্যমে কানাতির জেলখানায় প্রবেশের ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে নারী কয়েদিদের জিজ্ঞাসাবাদের বিশেষ অনুমতিপত্র জোগাড় করি। তিনি আমার কাজের ব্যাপারে এতই আগ্রহী হয়ে ওঠেন যে আমার সঙ্গে জেলখানায় পর্যন্ত যান ও সবকিছু ঘুরিয়ে দেখান।

সদর দরজা দিয়ে ভেতরে পা ফেলামাত্র গুমোট দালান, লোহার গরাদ আঁটা জানালা ও সামগ্রিক রুক্ষ পরিবেশ আমাকে মুহূর্তের মধ্যে বিষণ্ন করে তোলে। শরীর বেয়ে কাঁপুনি নেমে আসে। তখন কী আর জানতাম, ১৯৮১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর, সাদাতের জারি করা আদেশে একদিন এই গেট দিয়েই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে না, কয়েদি হিসেবে আরও ১০৩৫ জনের সঙ্গে আমাকেও ঢুকতে হবে! কিন্তু ৭৪ সালের শরতের সেই সকালে, এমন উঁচু হলদেটে রুক্ষ দেয়ালের মাঝে আবদ্ধ থাকার কথা মনের ধারেকাছেও আসেনি। ভেতরের আঙিনা পার হওয়ার সময় নারী কয়েদিদের মুখগুলো চোখে পড়ছিল—লোহার গরাদের ফাঁক দিয়ে বন্দী পশুর মতো উঁকিঝুঁকি মারছে, তাদের সাদা ও বাদামি আঙুলগুলো কালো গরাদ আঁকড়ে আছে।

ফেরদৌস প্রথমে আমার সঙ্গে তার সেলে দেখা করতে রাজি হয়নি। কিন্তু পরে রাজি হয়। একটু একটু করে তাকে তার কাহিনি শোনাতে রাজি করাই—তার জীবনকাহিনি। ভয়াবহ, আবার একই সঙ্গে দারুণ কাহিনি। সে নিজেকে আমার কাছে মেলে ধরলে তাকে ক্রমে আরও ভালোভাবে জানতে শুরু করি। আমার দেখা পরিচিত নারীদের থেকে সে এতটাই আলাদা ছিল যে তার প্রতি আমার একরকম আবেগ-সমীহ সৃষ্টি হয়। তাই পরবর্তী সময়ে একটা সময়, আমি ‘উইমেন অ্যাট পয়েন্ট জিরো’ বা ‘ফেরদৌস’ উপন্যাসটি লেখার কথা ভাবা শুরু করি।

কিন্তু ওই সময়টায় আমার ডাক্তার বন্ধুর পরিচয় করিয়ে দেওয়া বেশ কয়েকজন রোগী ও মেন্টাল ক্লিনিক নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। এর ওপর ভিত্তি করেই আমার গবেষণালব্ধ ২০টি বিস্তারিত কেস স্টাডি নিয়ে ১৯৭৬ সালে ‘মিসরের নারী ও মনোরোগ’ শিরোনামে বইটি প্রকাশিত হয়।

ফেরদৌসের কথা কিন্তু একদমই আলাদা। তার মৃত্যুর পর কাগজে-কলমে আমি তাকে পুনর্জন্ম দেওয়া পর্যন্ত অন্য সবাইকে ছাপিয়ে সে আমার মধ্যে থেকে থেকেই আলোড়ন তুলত কিংবা সুপ্ত থাকত। যদিও ৭৪ সালের শেষ দিকে তার ফাঁসি হয় এবং সেটাই আমাদের শেষ দেখা। তবুও সে সর্বদাই আমার চোখের সামনে বিরাজ করত। চোখের সামনে ভাসত তার চেহারা, তার কপাল, তার ঠোঁট, তার চোখ, তার গর্বিত চলার ভঙ্গি। ১৯৮১ সালের শরতে আমি গরাদের ভেতর থেকে অন্য নারী কয়েদিদের যখন দেখতাম মাঝখানের আঙিনা পার হচ্ছে, আমি যেন তাকেই খুঁজতাম—তার মাথা উঁচু করে হেঁটে চলা, তার সাবলীল-সমাহিত হাত নাড়ার ভঙ্গি বা তার বাদামি চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। বিশ্বাসই হতে চাইত না সে আর নেই।

আমার তিন মাসের কারাবাসকালে আমি আরও খুনের দায়ে অভিযুক্ত নারী দেখেছি। তাদের কেউ কেউ আমাকে ফেরদৌসের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে ঠিকই, কিন্তু তারা কেউই তার মতো ছিল না। সে একেবারেই আলাদা। শুধু যে তার বাহ্যিক গড়ন, চলাফেরা, তার সাহস, কিংবা গভীর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকানো, তাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে, তা-না। করে তার জীবন ছেড়ে যাওয়ার অবিচল প্রতিজ্ঞা, মৃত্যুভয়ের সম্পূর্ণ অনুপস্থিতিও।

‘ফেরদৌস’ নিরাশার গভীরতম কোণে ধাবিত এক নারীর কাহিনি। জীবনের সব নিরাশা-দুর্দশা সত্ত্বেও এই নারী আমার মতো যারা তাকে তার শেষ সময়ে দেখেছে, তাদের মধ্যে প্রেরণা জাগায়। প্রেরণা জাগায় বাঁচার, ভালোবাসার বা সত্যিকারের স্বাধীনতার মতো মানবিক অধিকারে বাধা দেয়, এমন সব শক্তিকে রুখে দেওয়ার, অতিক্রম করার।—নাওয়াল আস-সাদাবি


শূন্য বিন্দুতে নারী-এক 

এটি সত্য ঘটনা। এক নারীর জীবনকাহিনি। বছর কয়েক আগে কানাতির জেলে তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। আমি তখন বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত বা দণ্ডপ্রাপ্ত এবং মানসিক রোগগ্রস্ত নারী কয়েদিদের নিয়ে গবেষণা করছি।

জেলের ডাক্তারের কাছে শুনতে পাই, এক লোককে হত্যার দায়ে এই নারীকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে জেলের অন্য খুনি নারীদের সঙ্গে একে ঠিক মেলানো যায় না।

ডাক্তার বলেন, ‘জেলের ভেতরেই হোক বা বাইরে, এ রকম আর দ্বিতীয়টি আপনি কোথাও খুঁজে পাবেন না। সে কোনো দর্শনার্থীকে দেখা দেয় না, কারও সঙ্গে কথাও বলে না। খাবার ছুঁয়ে দেখে না, সারা রাত দুই চোখের পাতা এক করে না। কারারক্ষী মাঝে মাঝে দেখে, সে এক জায়গায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আনমনে কোথাও তাকিয়ে আছে। একদিন সে রক্ষীর কাছ থেকে কাগজ-কলম চেয়ে নিয়ে, অনেক ঘণ্টা ধরে একটানা সেগুলোর ওপর উপুড় হয়েছিল। চিঠি লিখছে না অন্য কিছু, কারারক্ষী তা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিল না। আদৌ কিছু লিখছিল কি না, কে জানে!’

ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করি, ‘সে আমাকে দেখা দেবে?’

‘বলে দেখতে পারি, একটু সময়ের জন্য হলেও। আপনি যে মনোরোগ বিশেষজ্ঞ, সরকারি উকিলের সহকারী না, এটুকু বুঝিয়ে বলতে পারলে হয়তো রাজি হতে পারে। আমি কিছু জিজ্ঞেস করলে তো মুখে কুলুপ এঁটে থাকে। প্রেসিডেন্টের কাছে মৃত্যুদণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের দরখাস্তে পর্যন্ত সে সই করেনি।’

জিজ্ঞেস করি, ‘দরখাস্তটা লিখল কে?’

‘আমি। আসলে আমার কখনো মনে হয়নি সে সত্যি সত্যি কাউকে খুন করতে পারে। আপনি যদি তার চোখ-মুখের দিকে ভালোভাবে তাকান, আপনারও বিশ্বাস হবে না, এমন ভদ্র চেহারার কেউ খুন করতে পারে।’

‘কে বলেছে, খুন করতে ভদ্র হতে হয় না?’

তিনি মুহূর্তের জন্য আমার দিকে হতবাক হয়ে তাকান এবং পরক্ষণেই কিছুটা অপ্রস্তুত হাসি হেসে ওঠেন।

‘কেন, আপনি কয়টা খুন করেছেন?’

বলি, ‘আমি ভদ্রমহিলা নাকি?’

তিনি মাথা একদিকে কাত করে একটা ছোট্ট জানালার দিকে ইশারা করে বলেন, ‘ওইটা ওর সেল। দেখি, সে আপনার সঙ্গে কথা বলতে রাজি হয় কি না।’

কিছু সময় পর তিনি একাই ফিরে আসেন। রাজি হয়নি ফেরদৌস।

ওই দিন আরও কয়েকজন নারী কয়েদির সঙ্গে সাক্ষাতের কথা থাকলেও কারও সঙ্গে দেখা না করে গাড়িতে উঠে বাড়ির পথ ধরি।

বাড়ি ফিরে কোনো কিছুতেই আর মন বসাতে পারি না। আমার সদ্য লেখা বইটির খসড়া আবার দেখার কথা ছিল। কিন্তু কিছুতেই তাতে মনোযোগ দিতে পারি না। আমার সমস্ত চেতনা আচ্ছন্ন করে রাখে ফেরদৌস নামের নারীটি—১০ দিন বাদে যার ফাঁসি।

পরদিন খুব ভোরে আবার জেলগেটে হাজির হই। ফেরদৌসের সঙ্গে দেখা করা যাবে কি না, জিজ্ঞেস করি কারারক্ষীকে। কিন্তু রক্ষী বলে, ‘কোনো লাভ নেই ডাক্তার আপা। সে কিছুতেই রাজি হবে না।’

‘কেন?’

‘ওরা আর কয়দিন বাদেই তো তাকে ফাঁসিতে লটকাবে। আপনার বা দুনিয়ার অন্য কারও সঙ্গে তার আর লেনদেন কিসের? তাকে নিজের মতো থাকতে দিলে কী এমন ক্ষতি!’

কারারক্ষী নারীর কণ্ঠে ক্রোধ ফেটে পড়ছিল। সে এমন রোষ নিয়ে আমার দিকে তাকাল, যেন কয়েক দিন বাদে আমিই ফেরদৌসকে নিজ হাতে ফাঁসির দড়ি পরাতে যাচ্ছি।

আমি বলি, ‘দেখো, এখানকার বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার কোনো রকম সম্পর্ক নেই।’

কারারক্ষী রেগেমেগে বলল, ‘এমনটাই সবাই বলে।’

‘এত খেপে আছ কেন?’ জিজ্ঞেস করি। ‘তুমি কি মনে করো, ফেরদৌস নির্দোষ, সে আসলে খুন করেনি?’

কারারক্ষী আরও ক্ষিপ্ত হয়ে জবাব দেয়, ‘খুন করুক আর না-ই করুক, সে নিষ্পাপ। তার ফাঁসি হবে কেন? ফাঁসি বরং হওয়া দরকার ওদের।’

‘ওদের? কাদের কথা বলছ?’

রক্ষী সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ঠিকমতো বলেন তো, আপনি কে? আপনাকে কি ওরাই পাঠিয়েছে?’

‘আচ্ছা, “ওরা” বলতে কাদের বোঝাতে চাইছ?’ আবার জিজ্ঞেস করি।

চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি মেলে, অনেকটা ভয়ে ভয়েই সে খানিকটা পিছিয়ে যায়।

‘ওদের… আপনি বলতে চাইছেন, ওদের আপনি চেনেন না?’

আমি বললাম, ‘না।’

কারারক্ষী ছোট্ট একটা শ্লেষাত্মক হাসি দিয়ে চলে গেল। তাকে বিড়বিড় করে বলতে শুনলাম, ‘ওদেরকে ইনিই শুধু চেনেন না, এ-ও সম্ভব?’

---

এরপরও আরও কয়েকবার জেলখানায় গিয়েছি কিন্তু ফেরদৌসের সঙ্গে দেখা করার সমস্ত চেষ্টা বিফলে যায়। ভয় হচ্ছিল, আমার গবেষণা বুঝি পণ্ড হতে চলেছে। সত্যি বলতে, নিজের পুরো জীবনটাই ব্যর্থ মনে হচ্ছিল। আত্মবিশ্বাস বাজেভাবে নাড়া খেয়েছিল। সব মিলিয়ে কঠিন একটা সময় পার করছিলাম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল, এই নারী খুন করে ফাঁসির আসামি হওয়া সত্ত্বেও, মানুষ হিসেবে আমার চেয়ে ঢের ভালো। তার তুলনায় আমি যেন অগণ্য পোকামাকড়ের মধ্যে, পৃথিবীর বুকে হামাগুড়ি দিয়ে বেড়ানো সামান্য ক্ষুদ্র কীট মাত্র।

ফেরদৌসের ব্যাপারে আলাপের সময়, কারারক্ষী বা জেলের ডাক্তারের চোখে-মুখে অন্য আর সবকিছুর ব্যাপারে ফুটে ওঠা নিস্পৃহতা, গোটা দুনিয়া থেকে ফেরদৌসের নিজেকে গুটিয়ে রাখা, তার ওপর বারবার আমার সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া—এসব মনে পড়লেই নিজেকে বড় অসহায় ও তুচ্ছ মনে হচ্ছিল। একটি প্রশ্ন আমার ভেতরে ক্রমাগত ঘুরপাক খাচ্ছিল, সে কী ধাতের নারী? আমার সঙ্গে দেখা করতে রাজি না হওয়ার মানে কি এই যে, সে মানুষ হিসেবে আমার চেয়ে শ্রেয়? কিন্তু ওদিকে তো আবার প্রেসিডেন্টের কাছে মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি মওকুফের আবেদন পাঠাতেও রাজি হয়নি। তার মানে কি এই দাঁড়ায়, সে রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়েও শক্তিধর?

ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন হলেও ধীরে ধীরে আমার মনে প্রায় নিশ্চিত একধরনের উপলব্ধি শিকড় গাড়তে শুরু করে যে, সে আসলেই আমরা সচরাচর যেসব নারী-পুরুষের কথা শুনি, দেখি বা জানি, তাদের সবার থেকে উত্তম।

সব ভুলে ঘুমাতে চেষ্টা করলেও নতুন আরেক চিন্তা আমায় পেয়ে বসে। আমার সঙ্গে দেখা করার প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়ার সময় সে কি আমার পরিচয় জানত? নাকি না জেনে করেছে?

পরদিন সকালে আরও একবার জেলখানায় হাজির হই। তবে ফেরদৌসের সঙ্গে দেখা করার আশায় না। তত দিনে আশা ছেড়ে দিয়েছি। আমি কারারক্ষী বা ডাক্তারকে খুঁজছিলাম। ডাক্তার তখনো এসে পৌঁছাননি কিন্তু কারারক্ষীর দেখা মেলে।

তাকে জিজ্ঞেস করি, ‘তোমাকে কি ফেরদৌস বলেছে, সে আমাকে চেনে?’

‘না, সে আমাকে কিছুই বলেনি,’ রক্ষী জবাব দেয়। ‘কিন্তু আপনাকে ঠিকই চেনে।’

‘তুমি সেটা জানলে কেমন করে?’

‘আমি তাকে বুঝতে পারি।’

আমি পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকি। কারারক্ষী আমাকে রেখে নিজ কাজে ফিরে যায়। আমি গাড়ির দিকে আগাতে চেষ্টা করেও পারি না। একটা গুরুভার যেন হৃৎপিণ্ড ও শরীরে চেপে বসে আমার দুই পায়ের চলার শক্তি কেড়ে নিয়েছে। এই গুরুভার গোটা পৃথিবীর ওজনের চেয়েও ভারী—আমি যেন পৃথিবীপৃষ্ঠে দাঁড়িয়ে নেই বরং এর নিচে কোথাও চাপা পড়ে আছি। আকাশটাও তাল মিলিয়ে বদলে গেছে। পৃথিবীর মতো সে-ও কৃষ্ণবর্ণ ধারণ করেছে এবং পৃথিবী-আকাশ দুটোই একযোগে আমার ওপর চেপে বসেছে।

এ রকম অনুভূতি আর একবারই হয়েছিল, বহু বছর আগে। একজনের প্রেমে পড়েছিলাম কিন্তু সে আমাকে ভালোবাসেনি। মনে হয়েছিল, শুধু সে-ই আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে তা-না—এই বিশাল পৃথিবীর লাখ-কোটি মানুষের একজন শুধু না, প্রত্যাখ্যান করেছে বরং পৃথিবীর প্রতিটি জীবন্ত প্রাণী, গোটা পৃথিবীটাই।

শিরদাঁড়া টান টান করে, যতটা সম্ভব সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে, গভীর একটা শ্বাস নিই। এতে মাথার ভার কিছুটা হালকা হয়। চারপাশে তাকাই এবং সাতসকালে জেলখানায় নিজেকে আবিষ্কার করে অবাক হই। কারারক্ষী তখন উপুড় হয়ে করিডরের টাইলগুলো ঘষামাজা করছে। তার প্রতি স্বভাববিরুদ্ধ প্রচণ্ড অবজ্ঞা অনুভব করি। সে জেলখানার মেঝে সাফরত সামান্য এক নারী ছাড়া তো কেউ না। না-পারে লিখতে, না-পারে পড়তে, আর না-বোঝে মনস্তত্ত্বের ছিটেফোঁটা। তো, সে যা ভেবেছে, তা-ই সঠিক, এটি আমি কেমন করে এত সহজে বিশ্বাস করলাম?

ফেরদৌস আসলে বলেনি যে সে আমাকে চেনে। কারারক্ষী আন্দাজ করেছে মাত্র। তার মানে কি এই দাঁড়ায়, ফেরদৌস আমাকে সত্যি সত্যিই চেনে? আর না চিনেই যদি ফিরিয়ে দিয়ে থাকে, তাহলে তো আমার কষ্ট পাওয়ার কিছু নেই। সে শুধু যে আমাকেই প্রত্যাখ্যান করছে তা-না, করছে গোটা পৃথিবী ও এর প্রতিটি মানুষকেও।

ফিরে আসার জন্য গাড়ির দিকে আগাতে শুরু করি। এমন আবেগসর্বস্বতায় বিলীন হওয়া কোনো বিজ্ঞান গবেষকের মানায় না। গাড়ির দরজা খুলতে গিয়ে নিজে নিজে প্রায় হেসে ফেলি। দরজার স্পর্শে আমার সামাজিক অবস্থান, আত্মমর্যাদাবোধ আবার জেগে ওঠে। পরিস্থিতি যা-ই হোক, খুনের কারণে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কোনো নারীর চেয়ে একজন ডাক্তার সব সময়ই বাঞ্ছনীয়। নিজের প্রতি আমার সহজাত দৃষ্টিভঙ্গি (যা সচরাচর আমার নিত্যসঙ্গী) আবার ধীরে ধীরে ফিরে আসে। ইঞ্জিন চালু করে, এস্কেলেটরে পা ঠেসে ধরি। হঠাৎ করে কোনো দুর্বল মুহূর্তে, নিজেকে যখনই অগণ্য পোকামাকড়ের ভিড়ে পৃথিবীর বুকে হামাগুড়ি দেওয়া আরও এক নগণ্য কীট মনে হয়, তখনই সেসব ভাবনা এভাবেই পায়ে পিষে ফেলি। ইঞ্জিনের শব্দ ছাড়িয়ে পেছন থেকে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে আমার কানে।

‘ডাক্তার, ডাক্তার!’

কারারক্ষী। হাঁপাতে হাঁপাতে আমার দিকে ছুটে আসছে। তার হেঁচকি তোলা কণ্ঠস্বর, প্রায়ই স্বপ্নে শোনা কণ্ঠস্বরগুলোর কথা মনে করিয়ে দেয়। তার মুখ বিস্ফোরিত ও হাঁপানির দমকে ঠোঁট দুটো ফুলে ফুলে ওঠে, কালবৈশাখীর কবলে পড়া দরজার কপাটের মতো বারবার খুলছে আর বন্ধ হচ্ছে।

কানে আসে, ‘ফেরদৌস, ডাক্তার! ফেরদৌস আপনার সঙ্গে দেখা করতে চায়!’

তার বুক হাপরের মতো ওঠানামা করছে, শ্বাসপ্রশ্বাস হেঁচকিতে পরিণত হয়েছে, কিন্তু চোখে-মুখে তীব্র উত্তেজনা। প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টও যদি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়ে তাকে দিয়ে তলব করাতেন, তবুও বোধ হয় সে এতটা উত্তেজিত হতো না।

আমার শ্বাসপ্রশ্বাসও দ্রুততর হতে থাকে, অনেকটা সংক্রমণের মতো। আরও পরিষ্কার করে বললে, রীতিমতো শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। হৃৎস্পন্দন অনেক বেড়ে যায়, যেমনটি আগে কখনো হয়নি। নিজের অজান্তেই কখন যেন দ্রুত গাড়ি থেকে নেমে, কারারক্ষীকে এত কাছ থেকে অনুসরণ করেছি যে, মাঝে মাঝে রীতিমতো ছাড়িয়ে যাচ্ছিলাম। এমন অনায়াস-ক্ষিপ্র পদক্ষেপে হেঁটে চলছি, যেন আমার পা দুটো কোনো ওজনই বইছে না। আমি দারুণ আবেগে আপ্লুত-গর্বিত, উল্লসিত, সুখী। আকাশের সবটুকু নীল আমার চোখে। হাতের মুঠোয় সারা বিশ্ব। এ রকম অনুভূতি জীবনে একবারই হয়েছিল, বহু বছর আগে। আমার প্রথম ভালোবাসার মানুষটির সঙ্গে প্রথমবার দেখা করতে যাওয়ার সময়।

ফেরদৌসের সেলের সামনে দম নিতে এক মুহূর্ত থামি এবং জামার কলার ঠিক করে নিই। আসলে এই সুযোগে খানিকটা ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করছিলাম। চেষ্টা করছিলাম, যতটুকু পারি স্বাভাবিক হয়ে, আমি যে একজন বিজ্ঞান-গবেষক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ বা ওই রকমই কিছু একটা—ওই বোধটুকু ফিরিয়ে আনতে। তালা খোলার অসহ্য ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ কানে এলে আমি সংবিৎ ফিরে পাই। হাতে ধরা চামড়ার ব্যাগটি জোরে খামচে ধরি। আমার ভেতর থেকে কে যেন বলে ওঠে, ‘এই ফেরদৌসটা আবার কে? সে তো কেবল…।’

কিন্তু খুব দ্রুতই ভাবনার রাশ টানতে হয়—আমরা ততক্ষণে মুখোমুখি। আমি মেঝেতে দাঁড়িয়েই থাকি, নীরব, স্থির। নিজের হৃৎস্পন্দন শুনতে পাই না। শুনতে পাই না পেছনের ভারী দরজায় তালা লাগানোর শব্দও। তার চোখে চোখ পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমি যেন আর দুনিয়ায় নেই। খুন করার জন্য চোখের এই দৃষ্টিই যথেষ্ট স্থির, ছুরির মতো ধারালো, অন্তর্ভেদী। চোখের পাতায় নেই সামান্য একটুখানি কাঁপন। কাঁপন নেই মুখের পেশিতেও।

একটি কণ্ঠস্বর আচমকা আমাকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনে। তার কণ্ঠস্বর দৃঢ়, ছুরির পাতের মতো শীতল, ফালি ফালি করে দেওয়ার মতো ধারালো। কোনো রকম ওঠানামা নেই তাতে। স্বরে নেই কোনো তারতম্য।

তাকে বলতে শুনি, ‘জানালা বন্ধ করুন।’

আমি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের মতো এগিয়ে গিয়ে জানালা আটকে দিই। হতবিহ্বল হয়ে তাকাই চারদিকে। সেলটি একদম ফাঁকা। না আছে বিছানা, না আছে চেয়ার, আর না আছে বসার মতো কিছু একটা।

সে বলে: ‘মেঝেতে বসে পড়ুন।’

আমার শরীর ঝুঁকে, নিচু হয়ে, মেঝেতে ঠাঁই নিই। তখন জানুয়ারি মাস, মেঝেতেও কিছু বিছানো নেই। কিন্তু তারপরও কোনো রকম ঠান্ডা অনুভব করি না। অনেকটা যেন ঘুমের ঘোরে হাঁটার মতো। আমার নিচের মেঝে ঠান্ডা, সেই একই শৈত্য, সেই একই নগ্ন শৈত্য। তবুও তা আমাকে স্পর্শ করতে পারে না, আমার কাছে পৌঁছাতে পারে না। স্বপ্নে দেখা সমুদ্রের শীতল জলের মতো যেন। সেই জলে আমি সাঁতার কাটি। আমি নগ্ন, জানা নেই সাঁতারও। তবুও আমি এর শৈত্য অনুভব করি না, এতে ডুবেও যাই না। তার কণ্ঠস্বরও স্বপ্নে শোনা কণ্ঠস্বরগুলোর মতো। এত কাছে তবু যেন দূর থেকে ভেসে আসা, এত দূর থেকে বলা তবু যেন কাছ থেকে ভেসে আসা। এর উৎপত্তিস্থল বোঝা যায় না, ডানে না বামে, কাছে না দূরে। হতে পারে মর্ত্যের গভীর থেকে উঠে আসছে, চাঁদ থেকে খসে পড়ছে বা স্বর্গ থেকে নেমে আসছে। এমনও হতে পারে, দশ দিগন্তে এর বিচরণ, বাতাসের অণুর মতো যা কানে এসে পৌঁছে।

কিন্তু এটি তো স্বপ্ন না। কানে ভেসে আসা বাতাসের কোনো অণু না। আমার সামনে, মেঝেতে বসে থাকা নারীটি বাস্তব। এবং এই দরজা-জানালাবদ্ধ ছোট্ট সেলে প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরটি আর কারও না-ফেরদৌসের। (চলবে)

লেখক পরিচিতি 

নাওয়াল আস-সাদাবি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন লেখক ও ঔপন্যাসিক। নারী অধিকার আন্দোলনের একনিষ্ঠ যোদ্ধা হিসেবে তিনি মিসর ও মিসরের বাইরে খ্যাত। তিনি আরব অঞ্চলের সিমন দ্য বোভোয়া নামে পরিচিত।

১৯৩১ সালে কায়রোর অদূরে কাফর তাহলা গ্রামে নাওয়াল আস-সাদাবির জন্ম। প্রথম উপন্যাস ‘ডায়েরি অব এ চাইল্ড কলড সাউদ’ লেখেন মাত্র ১৩ বছর বয়সে। ভাইদের পাশাপাশি তিনি ও তাঁর বোনেরাও প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা সম্পন্ন করেন, যা ছিল ওই সময়কার প্রচলিত রীতিবিরুদ্ধ। ইউনিভার্সিটি অব কায়রো মেডিকেল স্কুল থেকে ১৯৫৫ সালে তিনি চিকিৎসাবিজ্ঞানে পড়াশোনা শেষ করেন মনোরোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে। এরপর দুই বছর ডাক্তারি করেন।

১৯৬৩ থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত সাদাবি মিসর সরকারের পাবলিক হেলথ এডুকেশনের প্রধান পরিচালক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এই সময়কালে তিনি নিউইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন ও ১৯৬৪ সালে পাবলিক হেলথে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭২ সালে রাজনৈতিক চাপের মুখে তাঁকে সরকারি চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ও তাঁরই সম্পাদনায় তিন বছরের বেশি সময় ধরে প্রকাশিত 'হেলথ' ম্যাগাজিনটিও সেই সময় বন্ধ করে দেওয়া হয়।

১৯৭৩ থেকে ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত সাদাবি হাই ইনস্টিটিউট অব লিটারেচর অ্যান্ড সায়েন্সে কর্মরত ছিলেন। এ সময় আরব নারীদের জীবনের নিপীড়ন ও সংগ্রাম নিয়ে ফিকশন ও নন-ফিকশন লিখতে শুরু করেন, যা তাঁকে খ্যাতি এনে দেয়। তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত বই ‘উইমেন অ্যাট পয়েন্ট জিরো’ বৈরুত থেকে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত হয়। তাঁর আরও দুটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ ‘গড ডাইজ বাই দ্য নাইল' (১৯৭৬) ও আরব নারীদের ওপর গবেষণাভিত্তিক বই ‘দ্য হিডেন ফেইস অব ইভ’ (১৯৭৭)।

১৯৮১ সালে আনোয়ার সাদাতের একদলীয় সরকারের প্রকাশ্য সমালোচনার কারণে নাওয়াল আস-সাদাবি গ্রেপ্তার হন ও জেল খাটেন। সাদাত হত্যাকাণ্ডের এক মাস পর তিনি ছাড়া পান। ১৯৮২ সালে তিনি হারাব উইমেন্স সলিডারিটি অ্যাসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ১৯৯১ সালে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। হোসনি মোবারক সরকারের শাসনামলে বেশ কয়েক বছর তাঁকে নির্বাসনে থাকতে হয়। এ সময়কালে তিনি ইউরোপ ও আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এর মধ্যে ডিউক ইউনিভার্সিটি ও ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি উল্লেখযোগ্য। সাদাবি মিসরে ফেরেন ১৯৯৬ সালে। মানবাধিকার-গণতন্ত্র-নারীমুক্তির প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে নাম লেখান। কিন্তু পরের বছরের জুলাই মাসে সরকারের প্রচণ্ড চাপের মুখে তাঁকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করতে হয়।

নাওয়াল আস-সাদাবি তাঁর কাজের জন্য আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তিনি বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত। এর মধ্যে ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্ক, শিকাগোর ইলিনয় ইউনিভার্সিটি, ন্যাশনাল অটোনোমাস ইউনিভার্সিটি অব মেক্সিকো অন্যতম। পেয়েছেন অনেক পুরস্কার, সম্মাননা ও স্বীকৃতি। এর মধ্যে দ্য কাউন্সিল অব ইউরোপ নর্থ-সাউথ প্রাইজ (২০০৪), দ্য উইমেন অব দ্য ইয়ার অ্যাওয়ার্ড ইউকে (২০১১), দ্য শওন ম্যাকব্রাইড পিস প্রাইজ আয়ারল্যান্ড (২০১২), ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল অর্ডার অব মেরিট (২০১৩) উল্লেখযোগ্য। তাঁর বই বিশ্বের ৪০টিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বইগুলো পাঠ্য।