আমেরিকার সবচেয়ে সুন্দর ছোট শহরে

প্রিস্ট লেকে সূর্যাস্ত
প্রিস্ট লেকে সূর্যাস্ত

একটি বিখ্যাত এশিয়ান প্রবাদ আছে—‘Better to see something once than hear about it a thousand times.’

এ বছরে আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস পড়েছিল বৃহস্পতিবারে। ৪ জুলাই আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস। মাঝে শুক্রবারে ছুটি নিয়ে আমরা ঠিক করলাম চার দিনের উত্তর আইডাহো ভ্রমণ করব।

আগে থেকেই পরিকল্পনামতো গাড়ি ও এয়ারবিএনবি ঠিক করা ছিল। কোন কোন স্থানে যাব, তা ঠিক করে ফেললাম।

ম্যানিটো পার্কে
ম্যানিটো পার্কে

পরিকল্পনা মতো বৃহস্পতিবার সকালে সবকিছু গুছিয়ে আমরা রওনা দিলাম স্পোকেনি, ওয়াশিংটনের উদ্দেশে। আড্ডা, গান, চারদিকের মনোরম পরিবেশ দেখতে দেখতে এগিয়ে চলছিলাম আমরা।

এ দেশে একটু পরপরই লেখা দেখা যায় সামনে সিনিক ভিউ বা হিস্টরিক্যাল ভিউ। বয়েসি থেকে স্পোকেনি যাওয়ার প্রথম দিকের পথটা পুরোই গড়ের মাঠ! এত এত জমি এখানে খালি পড়ে আছে দেখলে আর নিজের দেশের কথা মনে পড়লে আসলেই দুঃখ হয়। কী হতো যদি এই খালি জমিগুলোর অর্ধেকও আমাদের দেশের থাকত? কী জানি। আল্লাহ হয়তো কিছু ভেবেই এমনভাবেই বণ্টন করেছেন।

ম্যানিটো পার্কে
ম্যানিটো পার্কে

সে যা হোক, দুপুরের খাবার খাওয়ার জন্য আমরা উমাটিলা মেরিনা পার্কে গেলাম। এখানে আপনি মাছ ধরতে, শিকার ও ওয়াটার স্কিইং করতে পারবেন। এখানের মূল আকর্ষণ হচ্ছে কলম্বিয়া নদীটি। ওখানে আমার রান্না করা মোটামুটি খাওয়ার যোগ্য খিচুড়ি আর রানু আপুর রান্না করা চিকেন দিয়ে খেয়ে, শক্তি সঞ্চয় করে আবারও রওনা দিলাম।

স্পোকেনিতে আমাদের ঠিক করা এয়ারবিএনবিতে গিয়ে কিছুক্ষণ রেস্ট নিয়ে আমরা আবারও বেরিয়ে পড়লাম রিভার সাইড স্টেট পার্কে। পার্কটি ওয়াশিংটনের দ্বিতীয় বৃহত্তম স্টেট পার্ক। যার আয়তন ১১ হাজার ১৬২ একর। পাহাড়ে বাইক চালানো থেকে শুরু করে ঘোড়সওয়ার, রক ক্লাইম্বিং ও হাইকিং, রিভারসাইডে সব আছে। ৫৫ মাইল হাইকের রাস্তা আছে এখানে।

এর পাশেই আছে রিভার ফ্রন্ট স্টেট পার্ক। এখানে আমরা ৪ জুলাইয়ের ফায়ার ওয়ার্কস (আতশবাজি) দেখব। এটি ৪৫ বছর আগে এক্সপো ৭৪৮–এর জন্য তৈরি করা হয়েছিল। এটি একটি বিশ্ব ফেয়ার ইভেন্ট।

স্যান্ড পয়েন্টে
স্যান্ড পয়েন্টে

পার্কটির বৈশিষ্ট্যটি হলো প্যাভিলিয়ন। যা ১৪৫ ফুট লম্বা (৪৪ মিটার) একটি ধাতব ফ্রেম ও তারের শেল দিয়ে চিহ্নিত রয়েছে, যা এক্সপো ’৭৪৮–এর সময় মার্কিন প্যাভিলিয়ন তাঁবুটি গঠন করেছিল এবং ১৫৫ ফুট (৪৭ মিটার) ঘড়ি টাওয়ার, এখন একটি স্পোকেন আইকন।

মূলত গ্রেট নর্দান রেলওয়ে ডিপোর একাংশ। ১৯০২ সালে সম্পন্ন হয় ও ১৯৩৩ সালে ভেঙে ফেলা হয়। এর ‘দৈত্য দাদুর ঘড়ি’ সপ্তাহে একবার হাত দিয়ে ধরা হয়। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা প্রায় ১ হাজার ৯০০ ফুট (৫৮০ মিটার)। স্পোকেন নদী বয়ে গেছে শতবর্ষী ট্রেল পার্কের মধ্য দিয়ে।

সবাই মিলে পার্কে বসে আমরা উপভোগ করলাম আমেরিকার স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সংগীতানুষ্ঠান ও মনোরম আতশবাজি। সব দেখে বাড়ি ফিরে রাতের ডিনার করলাম কারিশমা আপুর তৈরি অসাধারণ ভর্তা, গরুর মাংস আর রানু আপুর রান্না করা সবজি দিয়ে। এভাবেই শেষ হলো আমাদের ভ্রমণের প্রথম দিন।

পালাউস জলপ্রপাতে
পালাউস জলপ্রপাতে

পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতা করে, দুপুরের জন্য ডিম সেদ্ধ, আপেল, স্যান্ডউইচ নিয়ে আমরা চলে গেলাম টিউবস হিলসে। টিউবস হিলটি প্রায় ১২০ একরের বেশি এবং পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্ব দিকের লেক কোওর ডি এলিনের সঙ্গে সীমাবদ্ধ। পাহাড়ে বেশ কয়েক মাইল হাইকিং ট্রেল রয়েছে। প্রত্যেকের উপভোগ করার জন্য দর্শনীয় দৃশ্যের ব্যবস্থা করা আছে। টিউবস হিলের পশ্চিম পাশে ট্রেল হেডটি ম্যাকউইন পার্কের দক্ষিণ পশ্চিম কোণে অবস্থিত।

ম্যাকউইন পার্ক দেখে টিউবস হিলটির প্রায় দুই মাইল হাইক করে আমরা চলে গেলাম কোওর ডি এলিনের এক প্রান্তে সাঁতার কাটতে। আহা, সে কী সাঁতার। অনেক দিন পরে সাঁতার কেটে বেশ আনন্দ লাগল। সাঁতারের পর দুপুরের খাওয়া শেষ করে আমরা একে একে ঘুরে দেখলাম জাপানিজ গার্ডেন, রোজ গার্ডেন, লিলাক গার্ডেন, পোস্ট ফলস পার্ক, ম্যানিটো পার্ক। ম্যানিটো পার্কটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯০৪ সালের এপ্রিল মাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।

এরপর আমরা গেলাম রুমা আপুর বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের বড় আপু, ডালিয়া আপু ও নির্ঝর ভাইয়ার বাসায়। আপু ও ভাইয়া আমরা যাওয়ার আগেই বলেছিলেন, পুরো ট্যুরের সময়টা যেন আমরা তাদের বাসায় থাকি। সেটা আর হয়ে ওঠেনি। আপুদের বাসায় গিয়ে আপুর হাতের মজাদার বিরিয়ানি, ইলিশ মাছ আর চিকেন খেতে খেতে আড্ডা চলছিল। সবশেষে আপু, ভাইয়া আর ছোট্ট মানহার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম নিজেদের স্থানে।

পরদিন সকালে রুমা আপুর রান্না করা মাছ আর সবজি দিয়ে সকালের নাশতা করে মেয়েরা শাড়ি পরে রওনা দিলাম স্যান্ড পয়েন্টে। স্যান্ড পয়েন্ট হলো যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহোর বোনার কাউন্টির বৃহত্তম শহর। স্যান্ড পয়েন্টটি আইডাহোর বৃহত্তম হ্রদের তীরে অবস্থিত। ৪৩ মাইল লম্বা লেক পেন্ড ওরিলি এবং এর চারপাশে তিনটি প্রধান পর্বতশ্রেণি, সেলকির্ক, মন্ত্রিপরিষদ ও বিটাররোট রেঞ্জ দ্বারা বেষ্টিত।

উমাটিলা মেরিনা পার্কে
উমাটিলা মেরিনা পার্কে

এটি আইডাহোর বৃহত্তম স্কি রিসোর্ট। শোয়েইজার মাউন্টেন রিসোর্ট, আন্তর্জাতিক সেলকির্ক লুপ ও দুটি ন্যাশনাল সিনিক বাইওয়ে (ওয়াইল্ড হর্স ট্রেইল ও পেন্ড ওরেইল সিনিক বাইওয়ে) রয়েছে। ২০১১ সালে স্যান্ড পয়েন্ট দেশের ‘সবচেয়ে সুন্দর ছোট শহর’ হিসেবে খ্যাতি পায়।

স্যান্ড পয়েন্টের সৌন্দর্য উপভোগ করে দুপুরের খাবার খেয়ে আমরা গেলাম প্রিস্ট লেকে। এই হ্রদের উত্তর প্রান্তটি কানাডা-মার্কিন সীমান্তের ১৫ মাইল (২৪ কিলোমিটার) পর্যন্ত প্রসারিত। হ্রদের ইতিহাসটি শেষ বরফযুগের শেষ থেকে প্রায় ১০ হাজার বছর আগের।

ডালিয়া-নির্ঝরের বাসায়
ডালিয়া-নির্ঝরের বাসায়

যুক্তরাষ্ট্রে সবচেয়ে বড় লেক ট্রাউট (মাছ) ধরা পড়েছিল ১৯৭১ সালে স্পোকেনের লাইল ম্যাকক্লিউর হাতে। তার ওজন ছিল ৫৭ পাউন্ডের কাছে। প্রিস্ট লেকে ধরা হয়েছিল এই মাছ। প্রিস্ট লেকে বসে শিঙাড়া খেতে খেতে সূর্যাস্ত দেখেছিলাম আমরা। কথায় বলে না, ‘Never go too long without watching a sunset’—Atticus. সূর্যাস্ত দেখে আবারও সাময়িক নীড়ে ফেরা। রাতের খাবার খেলাম রুমা আপুর রান্না করা মজাদার মাছ আর সবজি দিয়ে।

পরের দিন সকালে আমরা আমাদের সবকিছু নিয়ে স্পোকেনিকে বিদায় জানালাম এবং বয়েসির উদ্দেশে রওনা হলাম। পথিমধ্যে আমরা দেখলাম পালাউস জলপ্রপাত। এরপরে আমরা গেলাম লিয়নস ফেরি স্টেট পার্ক। শক্তিশালী বরফযুগের বন্যার কারণে খোদাই করা প্রাকৃতিক দৃশ্যে পালাউসের পাহাড়গুলো আপনাকে মুগ্ধ করবেই।

রাতের মধ্যেই আমরা আমাদের শেষ গন্তব্য বয়েসিতে ফিরলাম। ফিরে অর্পার বাসায় সবাই মিলে খেয়ে যে যার নীড়ে ফিরে গেলাম। আর এরই মধ্য দিয়ে শেষ হলো আমাদের চার দিনের উত্তর আইডাহো ভ্রমণ।

রাস্তা
রাস্তা

শেষ করব মজার একটি ঘটনা দিয়ে। ট্যুরের চার দিন ধরে রানু আপু, কারিশমা আপু ও রুমা আপু মিলে আমাকে নোয়াখালীর ভাষা শিক্ষা দিয়েছিল। চার দিন পরে আমার যখন পরীক্ষা নেওয়া হলো, আমি সগর্বে সেই পরীক্ষায় ফেল করেছিলাম। আমার অবস্থা ছিল ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ টাইপের মতো।

পরিশেষে নাজমুল ভাই, রানু আপু, তামিম ভাই, কারিশমা আপু, ইমদাদ ভাই ও রুমা আপুকে অসংখ্য ধন্যবাদ ট্যুরটা আয়োজন করার জন্য।