ঝরা পাতার ভালোবাসা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

ট্রেন চলেছে সেন্ট্রাল লন্ডনের দিকে। নিনিদ নামবে ব্যাংক স্টেশনে। সেখান থেকে বদলি ট্রেন ধরে অ্যাঞ্জেল স্টেশন যাবে। যে সময়ে নিনিদ ট্রেন ধরেছে সেই সময়টায় ট্রেন একটু ফাঁকা থাকে। অন্য সময় হলে লোকে গিজগিজ করত। দাঁড়িয়ে যেতে হতো। আর এখন বসে যাচ্ছে।

কী এক দেশে এসে পড়েছে নিনিদ। কত ধরনের মানুষ এখানে। নিনিদের শরীর ঘেঁষে বসে আছে বিশালাকৃতির এক আফ্রিকান মানব। ট্রেন এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে থামতেই ওই আফ্রিকান প্রায় নিনিদের শরীরের ওপরে এসে পড়েছে। এখানে এখন বেশ গরম পড়েছে। গরমে আফ্রিকান লোকটার শরীর থেকে ঘামের উদ্ভট গন্ধ নিনিদের নাকে এসে লাগছে। পেট কেমন যেন গুলিয়ে আসছে সেই গন্ধে। বমি বমি ভাব হচ্ছে।

নিনিদের ঠিক উল্টো দিকে বসে আছে সাদা চুল আর নীল চোখের এক তরুণী। হলদে রঙের টপ আর জিনস পরেছে। নিনিদের দৃষ্টি আপাতত সেদিকে এখন। একটু স্বস্তি লাগছে মেয়েটিকে দেখে। তার পাশেই বসা সাদা আর কালো মিশ্রণের একটি ছেলে। যাদের এখানে হাফকাস্ট বলে। হাফকাস্ট মানে বাবা সাদা (ইংলিশ), মা আফ্রিকান। আবার উল্টোও হতে পারে। বেশ উঁচু লম্বা শরীর। ধবধবে সাদা দাঁত। সে মোবাইল টিপে যাচ্ছে।

ঠিক তার পাশে আরেকজন আফ্রিকান নারী। এই আফ্রিকান নারীকে মানবই মনে হচ্ছে। অসম্ভব সুন্দর লাগছে তাকে। কালো মানুষও যে এত সুন্দর হয় তা নিনিদ যেন এই প্রথম দেখছে। মসৃণ মুখ অবয়ব। একটা দাগও যেন নেই। লম্বা নাক। পাতলা ঠোঁট। ধবধবে সাদা দাঁত। যেন কোনো দাঁতের মাজনের বিজ্ঞাপনের মডেল।

আফ্রিকান নারীর পাশেরজন মনে হচ্ছে ভারতীয়। ট্রেনে রাখা ফ্রি নিউজ পেপার পড়ছেন। মধ্যবয়সী। পাশে তাঁর প্রেগন্যান্ট স্ত্রী। পত্রিকা পড়া বন্ধ করে একটু পরপর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করছেন, ঠিক আছে কিনা।

নিনিদের পাশে বসে আছে আরও চার-পাঁচজন। দুজন চায়নিজ ছেলেমেয়ে আর একজন বাংলাদেশি হবে। চায়নিজ মানুষজন চেনা খুবই সহজ। মাছির চোখের মতো চোখ আর লেপটানো নাক। আর বাঙালি লোকও চেনা অতিসহজ নিনিদের জন্য। তার একমাত্র কারণ লোকটি ট্রেনে বসে বসে পান চিবোচ্ছে। বলতে গেলে যাবর কাটছে। পানের পিক বেরিয়ে পড়ছে চোয়াল বেয়ে।

সবাইকে দেখতে দেখতে একের পর এক স্টেশন ছাড়িয়ে যাচ্ছে নিনিদ। এরই মধ্যে কখন যে আফ্রিকান লোকটা নেমে পড়েছে তা সে খেয়ালই করতে পারেনি। ট্রেন যেই মাত্র ব্যাংক স্টেশনে এল সে দেখল অন্য একজন বসে আছে তার পাশে। যেসব যাত্রী ছিল তাদের অনেকেই নেমে পড়ল এই স্টেশনে। তাদের মধ্য নীল চোখের মেয়েটিও। নিনিদও নামল। বদলি ট্রেনের দিকে ছুটছে নিনিদ। এত মানুষের মাঝে কোথায় যেন হারিয়ে গেল এতক্ষণ চোখে চোখে রাখা সেই মেয়েটি।

অনেক নিচে নেমে বদলি ট্রেন ধরতে হবে। এখানে স্টেশনে সাইন বোর্ড দেওয়া থাকে। কোন ট্রেন কোন দিকে যাবে। কাউকে ছেড়ে দিলে সে আপনা–আপনি চলে যেতে পারবে তার গন্তব্যে।

অ্যাঞ্জেল স্টেশনে ট্রেন থেকে নেমে লিফট কিংবা এস্কেলেটর নিয়ে ওপরে যেতে হয়। নিনিদ এস্কেলেটর ধরেছে। স্টেশন থেকে বের হতে তার চোখে পড়ল ফুলের দোকান আর সঙ্গে ফ্রি পত্রিকা স্ট্যান্ড। একজন দাঁড়িয়ে তা বিলি করছে। তার থেকে একটু দূরে একজন গিটার বাজাচ্ছে। লোকটির সামনে একটা কাপড়ের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা আছে কিছু কয়েন। গান ভালো লাগছে তো পথচারীদের মধ্যে কেউ কেউ পকেটে হাত দিয়ে দু-একটা কয়েন ঢিল মেরে দিয়ে যাচ্ছে। এই দেশে এটাকে ভিক্ষাবৃত্তি বললেও খারাপ শোনায়। কারণ, লোকটা হাত না পেতে গান শোনাচ্ছে। তার বিনিময়ে দুই-চার পয়সা পাচ্ছে।

নিনিদ দু-একজনের দেখাদেখি পকেটে হাত দিল। যদি দু-একটা কয়েন দেওয়া যায়। পকেটে হাত দিয়ে দেখে ভাঙতি কয়েন নাই। এক পাউন্ড আছে। এক পাউন্ড দেখে সে আর দিল না। কারণ, এখানে এক ঘণ্টা কাজ করলে সে পায় আট পাউন্ড। হিসাবনিকাশের এই জীবনে এক পাউন্ড অনেক।

এখানকার আকাশের কোনো ভরসা নেই। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। তবে এ দেশে বেশ প্রচলিত একটা কথা আছে। কথাটি হলো তিন ডব্লিউতে কোনো ভরসা নেই। তিন ডব্লিউ মানে-weather, wealth and woman. এই তিনটা যে কখন কার কিংবা কখন কী হয় বোঝা মুশকিল।

একটু আগেও রোদ ছিল। আর এখন হঠাৎ করে কালো হয়ে আসছে আকাশ। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামবে। তবে এতে বেশ মানিয়ে নিয়েছে ব্রিটিশ লোকজন। সব সময়ই তারা ছাতা বহন করে।

নিনিদ ভাবতেই না ভাবতে বৃষ্টি নামল। একদম ঝুমবৃষ্টি। এই বৃষ্টিতে নিনিদ দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল পাশের কফি শপে। কফি শপের জানালায় ফোটা ফোটা বৃষ্টির পানি লেগে আছে। নিনিদের দৃষ্টি জানালার বাইরে। সেই আগন্তুক গিটার বাজানো যুবকের দিকে। বৃষ্টিতে কাকভেজা হয়ে সেও ঢুকে পড়ল কফি শপে। শার্টের হাতা গুটিয়ে নিচ্ছে সে। নিনিদ দেখল ছেলেটির হাত ভর্তি কয়েন।

নিনিদ স্মিত হাসি দিয়ে হ্যালো বলল। হাত বাড়িয়ে দিয়ে হ্যান্ডশেক করে নিজের নাম বলল। ওর নাম হ্যারি রমিজ। নিনিদ নিজেকে নিনিদ বলে পরিচয় দিল। নিনিদ কথা বাড়ায় তুমি তো দেখি অনেক সুন্দর গিটার বাজাও। হ্যারি দুই কাঁধ উঁচু করে দুই ঠোঁট উল্টো করে বোঝাল এটা তেমন কিছু না। হ্যারি রমিজের ব্যাপারে কৌতূহল জাগল নিনিদের। ধবধবে সাদা লোকের নাম কীভাবে রমিজ হয়। কোনো হিসাব মিলাতে পারছে না সে।

এরই মধ্যে হ্যারি নিনিদকে জিজ্ঞেস করল, হোয়্যার আর ইউ ফ্রম? নিনিদ উত্তর দিল বাংলাদেশ। হ্যারি পাল্টা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে, ঢাকা না সিলেট? এখানে সবাই বাংলাদেশ বলতে ঢাকা-সিলেট ছাড়া অন্য কিছু বোঝে না। সিলেটের বাংলাদেশি লোকও নিনিদকে অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে এই প্রশ্ন। নিনিদ উত্তর দেয় আমি ঢাকা-সিলেট না, আমি বান্দরবান থেকে এসেছি। ভ্রু কুঁচকে হ্যারি জিজ্ঞেস করে, ইজ ইট ইন বাংলাদেশ? নিনিদ মাথা নেড়ে উত্তর দিল হ্যাঁ। সিলেট যেমন বাংলাদেশের একটি ডিস্ট্রিক্ট। বান্দরবানও তেমনি একটি ডিস্ট্রিক্ট।

নিনিদ প্রশ্ন করে, আচ্ছা হ্যারি তুমি কি এখানকার মানে ব্রিটিশ। হ্যারি উত্তর না দিয়ে প্রশ্ন ছুড়ে দেয় কেন? আমাকে দেখে কি মনে হয় না? না তোমার নামের শেষটুকু দেখে একটু কৌতূহল জাগল। ও আচ্ছা সে আর নতুন কী। তোমার আগে বহুবার এই নামকরণের ব্যাখ্যা করতে হয়েছে। রমিজ মুসলিম নাম তাই না। কিন্তু আমি খ্রিস্টান। ক্যাথলিক খ্রিস্টান। বাবা পাকিস্তানি। তবে এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন, কিছুই জানি না। মায়ের বিয়ে হওয়ার দ্বিতীয় বছরের মাথায় আমার জন্ম হয়। আর জন্মের পরে বাবা নিরুদ্দেশ। তবে বাবার নামের সঙ্গে মিল রেখে মা আমার নাম রেখেছেন।

দুই.

দুজনের কথা বেশ জমে উঠেছে। নিনিদ পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে হ্যারির দিকে তাকিয়ে তার বাবার পুরো নাম কী জানতে চাইল। হ্যারি জানাল, বাবার পুরো নাম তার মনে নেই। রমিজ, পাকিস্তানি লিখে গুগলে সার্চ দিল নিনিদ। প্রথম যে ছবিটা এল তা হলো পাকিস্তানি ক্রিকেটার রমিজ রাজার। নিনিদ জিজ্ঞেস করল, বাবার কোনো ছবি দেখেছে কিনা? হ্যারি বলল, সেই ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছে পুরোনো একটি ছবি। বাবার লম্বা চুল ছিল। তেমন উঁচু লম্বা ছিল না। মোটামুটি লম্বা ছিল। নিনিদ রমিজ রাজার ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল, দেখ তো চিনতে পার কিনা। হ্যারি অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে উত্তর দিল, না। একটু একটু লাগছে কিন্তু এই লোক না।

হ্যারি কৌতূহলী হয়ে ছবির লোক সম্পর্কে জানতে চাইল। নিনিদ বলল, ওনার নাম রমিজ রাজা। পাকিস্তানের সাবেক ক্রিকেটার। বর্তমানে টেলিভিশনে ধারাভাষ্য দেন। এই আর কী। এই বলে বাইরের দিকে তাকায় নিনিদ। এতক্ষণ ধরে যে আকাশ থেকে বৃষ্টি ঝরছিল সে আকাশে এখন রোদের আভা দেখা যাচ্ছে। কী এক অদ্ভুত আবহাওয়া এখানকার। এই রোদ তো এই বৃষ্টি। মাঝে মাঝে আবার ঠান্ডা বাতাস।

হ্যারি কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখা গিটার কাঁধে তুলে আবারও বেরিয়ে পড়ল তার অজানা গন্তব্যে। নিনিদকে বাই বলে বেরিয়ে গেল। নিনিদ তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবাহীন এক যুবক কাঁধে গিটার নিয়ে দিগ্‌বিদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। স্টেশনে নয় তো রাস্তার মোড়ে গান গেয়ে চলেছে দিনের পর দিন। কী অদ্ভুত জীবন।

নিনিদের এই মুহূর্তে মনে পড়ছে তার বাবার কথা। আজন্ম পিতৃহীন নিনিদ একা একা বড় হয়েছে এতিমখানায়। জীবনের বেশ কিছু বছর কেটেছে এতিমখানায়। এখনো মনে পড়ে আজগর মুনশির কথা। এতিমখানার বাবা। এতিমখানার বাবা মানেই এই আজগর মুনশি এসব ছেলেদের মা–বাবা বনে যান কোনো ধরনের হিসাবনিকাশ ছাড়া। নিজের খেয়ে নিজের পয়সায় এতিমখানা চালাতেন। জীবনসংসার বলতে কিছুই ছিল না আজগর মুনশির। তিনিও একা একা রেল কলোনিতে মানুষ হয়েছেন। নিজের জীবনসংগ্রাম থেকে এতিমদের জন্য কিছু করার তাড়না জোগায় মুনশিকে। তারপর নিজের ঘামের পয়সা দিয়ে মুনশির হোস্টেল নামে এতিমখানা তৈরি করেন। এক এক করে নিনিদের মতো ১৫ জন এতিম দিয়ে যাত্রা শুরু হয় মুনশি হোস্টেলের। ফাদার রিংকু কস্তা নামে এক ভদ্রলোকের যাতায়াত ছিল মুনশি হোস্টেলে। ফাদার মাসে দুই-তিনবার করে আসতেন হোস্টেলের ছেলেদের বাংলা-ইংরেজি পড়াতে। নিনিদের আচার-ব্যবহার প্রথম থেকেই ফাদারকে মুগ্ধ করেছিল।

একদিন হঠাৎ ফাদার একজন ভদ্রমহিলাকে সঙ্গে নিয়ে আসেন। নাম ছায়া লাল হালদার। দেখতে শুনতে বেশ সুন্দর। কী সুন্দর করে বাংলা বলেন। নিনিদেরা এ ধরনের বাংলা এর আগে শোনেনি।

ছায়া লাল হালদার বেশ বিত্তশালী মধ্যবয়স্ক একজন নারী। বিপুল অর্থবিত্তের মাঝেও একা। বড্ড একা। একা বলতে কেউ-ই নেই। থাকবে কীভাবে? ছায়া লাল হালদার চিরকুমারী। বাবা মায়ের রেখে যাওয়া সম্পদের একমাত্র উত্তরাধিকারী। সকাল-দুপুর-বিকেল তাঁর সবই কাটে একা একা।

ছবি আঁকতে আর গল্পের বই পড়তে বেশ পছন্দ। বাড়িতে চার-চারজন কেয়ারটেকার আছে। তাদের কাজ পুরো বাড়ি পরিষ্কার করে রাখা আর ছায়া লাল হালদারের দেখভাল করা।

ছায়া লাল হালদারের দিন শুরু হয় ক্ল্যাসিক্যাল গান দিয়ে। এরপর খবরের কাগজ। খবরের কাগজে এখন আর তাঁকে খুব একটা টানে না। খবরের কাগজ খুললেই গুম-খুন আর ধর্ষণের খবর পড়তেই হয়।

একবার হঠাৎ করে শরীর খারাপ করে ছায়ার। প্রেশার হাই হয়ে যায়। কারণ আর কিছুই না। সেই খবরের কাগজ। সুবর্ণচরে এক গৃহবধূকে দল বেঁধে ধর্ষণ করেছে কয়েকজন লোক। মুমূর্ষু অবস্থায় হসপিটালে নেওয়ার পথে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয় সেই গৃহবধূর। এ খবর শুনে তাঁর শরীর অত্যধিক খারাপ করে এবং বেশ কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে বসেছিলেন। সেদিন দুপুরে খাবার খেতে পারেননি। ভীষণ বমি হয়। তারপর ফাদার রিংকুকে ফোন করলে তিনি ডাক্তার নিয়ে এসে দেখেন ব্লাডপ্রেশার অত্যধিক মাত্রায় বেড়ে আছে। যেকোনো সময় স্ট্রোক হতে পারত।

ডাক্তার তাকে দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করেছেন আর মানুষের সঙ্গে বেশি বেশি চলাফেরা আর কথা বলতে বলেছেন। কারণ, তিনি একা একা থাকতে থাকতে তাঁর ভেতরে একধরনের সিনড্রোম বাসা বেঁধেছে। যাকে মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায় বলা হয় অটো ফোবিয়া। বিষণ্নতা অবসাদ আর দুশ্চিন্তা এই সিনড্রোমের অন্যতম কারণ। আর এসব সিনড্রোম থেকে শরীরে প্রেশার বেড়ে চলেছে। তার সঙ্গে আজেবাজে দুশ্চিন্তা আছেই। ফাদার রিঙ্কুর সঙ্গে ছায়া লাল হালদারের পরিচয় অনেক পুরোনো। পুরোনো বলতে প্রায় ৩০ বছর। ফাদার রিংকু তাঁর বাবার অত্যন্ত ভালো বন্ধু। তাঁদের বাড়িতে ফাদারের বেশ আসা-যাওয়া ছিল। এখনো আছে। আর ছায়ার পরিচিত বলতে বর্তমানে ফাদার ছাড়া তেমন কেউই নেই।

ফাদার ডাক্তারকে বিদায় দিয়ে ছায়াকে বিশ্রাম নিতে বললেন। দুশ্চিন্তা করতে নিষেধ করে তিনি আবার দুই–চার দিন পর দেখতে আসবেন বলে বিদায় নিলেন।

তিন.

ছায়া এই মুহূর্তে বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে বসে পা দোলাচ্ছেন। হাতে একটি গল্পের বই। নাম ‘দে স্টল মাই ইনোসেন্স’। টনি ম্যাগুরির লেখা। এই বইয়ে অরফানেজে একটি মেয়েকে কীভাবে হেনস্তা করা হয় এবং পরবর্তী সময়ে মেয়েটি কীভাবে বেঁচে ছিল তার ভিত্তিতে লেখা। ছায়া বারান্দায় ইজি চেয়ারে শরীর ছেড়ে দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছেন। এই মুহূর্তে তিনি তাঁর একা জীবন নিয়ে কেমন যেন সুখ খুঁজে বেড়াচ্ছেন। অথচ বইয়ের অসহায় সেই ছোট্ট মেয়ে দিনের পর দিন অরফানেজের কর্তাব্যক্তির দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ছায়ার খুব মন চাইছে সেসব শিশুকে দেখতে। তাদের সঙ্গে কথা বলতে। তাদের জীবনের গল্প শুনতে। একটি শিশু কতটুকু অসহায় হলে অরফানেজ আসে। ইশ্‌ কল্পনা করতে কেমন যেন শরীর শিউরে ওঠে।

শীতের বিকেল খুবই ছোট। তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নেমে আসে। চারপাশ অন্ধকার হয়ে যায় খুব দ্রুত। এখানকার এক নিত্যকার দুর্দশা হলো সন্ধ্যায় বিদ্যুৎ না থাকা। বিশাল দালানে বিদ্যুৎ না থাকলে কেমন জানি ভুতুড়ে ভুতুড়ে লাগে। এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না। মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। সন্ধ্যার পরই নিজের রুমের দরজা-জানালা বন্ধ করে ছায়া মেডিটেশন করেন। গত পাঁচ বছর একই রুটিনে এভাবেই চলছে ছায়ার জীবন। চোখ বন্ধ করে বসে বসে মনের বাড়িতে বিচরণ করেন। তারপর ঘুরে বেড়ান নিজের মনের বাড়িতে। কিন্তু না আজ কোনোভাবে তিনি মনস্থির করতে পারছে না। চোখ বন্ধ করলেই ‘দে স্টল মাই ইনোসেন্স’-এর মেগডেলিনা যেন ছায়াকে ছুঁয়ে দেখতে চাইছে। কিছু একটা বলতে চাইছে।

যেই চোখ খুললেন তখনই যেন এই জগতে ফিরে আসেন ছায়া। খুব বিরক্ত লাগছে আজ তাঁর। আজ মেডিটেশন করবেন না তিনি। উঠে দাঁড়িয়ে বারান্দার দিকে হাঁটতে থাকেন। বারান্দায় গিয়ে দেখেন একটু একটু শীত পড়ছে। গত বছর কলকাতা থেকে একটি কাশ্মীরি শাল কিনেছিলেন। দুই দিন আগে নামিয়ে রেখেছেন মাঝ রাতে শীত পড়ে দেখে। বারান্দা থেকে আবার ঘরে ঢুকে শাল নিয়ে আবার বারান্দায় আসেন ছায়া। শরীরে জড়িয়ে নিয়ে তিনি তাকিয়ে থাকেন হ্যাজাক বাতির আলোর দিকে। গলির মোড়ে চা দোকানদার হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়েছে। অন্ধকারে রিকশাগুলো বেল বাজিয়ে গলি পার হচ্ছে। এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করছে মানুষজন। বারান্দা থেকে সবকিছু দেখছে। চা দোকানে বসে বসে চা-সিগারেট খাচ্ছে সবাই। বেশ ভালোই লাগছে মানুষজনের চলাচল আর আড্ডাবাজি দেখে। মন চাইছে যদি তিনি নিচে গিয়ে এক কাপ চা আর একটি সিগারেট টানতে পারতেন।

ছায়ার এ সময় মনে পড়ল তাঁর একমাত্র বান্ধবীর কথা। একসঙ্গে স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। প্রেম করে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু স্বামীর পরকীয়ায় নিজেকে ধরে রাখতে পারেননি। রশিতে ঝুলিয়ে নিজেকে শেষ করে দিয়েছেন। অথচ কী হাস্যোজ্জ্বলই না ছিল লতা। ছায়া প্রথম সিগারেট টেনেছিলেন লতাদের ছাদে। তখন সবেমাত্র কলেজে উঠেছেন।

চার.

লতা মারা যাওয়ার কথা শুনে পুরো একদিন রুম বন্ধ করে ছিলেন ছায়া। আজ লতাকে খুব মিস করছেন তিনি। লতা থাকলে একসঙ্গে বসে সিগারেট টানতে পারতেন।

ছায়ার এখন তীব্র সিগারেটের নেশা পেয়েছে। তার ওপর মেজাজ খিটখিটে হয়ে আছে। এই প্রথম মেডিটেশন করতে পারছেন না ছায়া। বাসার রতনকে ডেকে পাঠিয়েছেন নিচে গিয়ে এক কাপ চা আর একটা সিগারেট নিয়ে আসতে। মিনিট বিশেক পর ডেনিস কনডেন্স মিল্কের পটে এক কাপ চা আর সিগারেটের প্যাকেটের সিলভার কাগজে মুড়িয়ে একটি বেনসন সিগারেট নিয়ে ছায়ার রুমে সামনে দাঁড়িয়ে আছে রতন। সে দিদি দিদি বলে ডাক হাঁকাচ্ছে। ছায়া দরজা খুলে সিগারেট হাতে নিয়ে রতনকে চায়ের কাপ নিয়ে তাঁর সঙ্গে আসতে বলেন। দেশলাইয়ের কথা বলতে ভুলে গেলেও রতন ঠিকই রান্নাঘর থেকে নিয়ে এসেছে।

ছায়া বারান্দায় চেয়ারে বসে চা খাচ্ছেন আর একটু পর পর সিগারেট টানছেন। ফাদার রিংকুকে ফোন করার কথাও ভাবছেন। ফাদারকে নিয়ে যদি কোনো অরফানেজে যাওয়া যায় তাহলে হয়তো একটু ভালো লাগবে তাঁর। অরফানেজের বাচ্চাদের সঙ্গে কথা বলতে, তাঁদের জীবনের গল্প শুনতে খুব ইচ্ছা করছে তাঁর। যে কথা সেই কাজ। ফাদারকে সকাল সকাল ফোন করে নিজের ইচ্ছার কথা জানালেন ছায়া। ফাদারও তাঁর ইচ্ছেয় সায় দিয়ে মুনশি হোস্টেলে নিয়ে যাওয়ার কথা বললেন। ঠিক দুই দিন পরে ফাদার আর ছায়া হাজির হলেন মুনশি হোস্টেলে। আজগর মুনশির সঙ্গে দেখা হতেই ছায়ার কেমন যেন সেই মেয়েটির কথা মনে পড়ল। যে মেয়েটি প্রতিনিয়ত যৌন নির্যাতনের শিকার হতো আজগর মুনশির মতো অন্য একজনের দ্বারা। কিন্তু আজগর মুনশি যেন একটু ব্যতিক্রম। খুবই আন্তরিক। ছেলেদের সম্পর্কে বর্ণনা দিচ্ছেন।

নিনিদকে ফাদার যখন ছায়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন তখন তিনি নিনিদ সম্পর্কে অনেক অনেক প্রশংসা করলেন। আর নিনিদকে ছায়ার সঙ্গে সঙ্গে থাকতে বললেন ছায়ার দেখভাল করার জন্য। নিনিদ আগে থেকেই ফাদারের ভক্ত। গুরু-শিষ্যের সম্পর্কে মতো হলেও নিনিদের সুপ্ত হৃদয়ে ফাদারের জন্য ভালোবাসা আছে। মানুষ তো এ রকমই। যেখানে ভালোবাসা পাবে সেখানেই ছুটে যেতে চায়। তা যতই কঠিন হোক না কেন? পুরো দিন ছায়ার সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে ছিল নিনিদ। কখন কী লাগবে। কী আনতে হবে।

এই প্রথম ছায়ার কেমন জানি ভিন্ন অনুভূতি কাজ করতে লাগল। নিজের যদি এ রকম একটা ছেলে থাকত। তাহলে এতগুলো বছর আর একা একা কাটাতে হতো না। ওকে নিয়েই জীবনের সব ব্যস্ততাকে সাজাতে পারতেন। কতই না সুন্দর হতো।

সবকিছুই বড্ড দেরি মনে হচ্ছে। দিন শেষে সবার গল্প শুনে বেশ অবাকই হয়েছেন ছায়া।

মুনশি হোস্টেল থেকে বাসায় ফেরেন ছায়া। কিন্তু মন যেন পড়ে আছে সেখানে। নিনিদ ছেলেটার চোখে কী যে মায়া। শান্ত প্রকৃতির নির্ভেজাল একটি ছেলে অথচ ওর জীবনের গল্প কী ভয়াবহ। মা–বাবা, আত্মীয়পরিচয়হীন হয়ে হয় ট্রেনের বগিতে বগিতে কিংবা রঙ–বেরঙের ঢাকা শহরে ঘুরত। প্রথম কমলাপুরে তারপর আজ সাত বছর মুনশি হোস্টেলে। মেঝেতে বিছানা পেতে গাদাগাদি করে সবাই একসঙ্গে ঘুমায়। কী অমানবিক জীবন তাদের। কিন্তু এতেই ওদের চোখেমুখে যে আনন্দ, তা যেন এই প্রসাদসম দালানের কোথাও নেই। দালানের প্রতিটি কোনায় যেন শোক আর শোক। যেন মৃত মানুষের আত্মা ভর করা মৃত্যুপুরী। অথচ মুনশি হোস্টেল। টিনশেডের মাটির বিছানায় পনেরোজন গাদাগাদি করে কী আনন্দ নিয়ে ঘুমাচ্ছে।

ছায়ার খুব মায়া হয়, এতিম শিশুদের জন্য। মনে মনে ভাবেন ইশ্‌ এরা যদি তাঁর বাসায় এসে থাকতে পারত কিংবা কাউকে তিনি দত্তক নিতে পারতেন। ফাদার রিংকুর সঙ্গে কথা বলে দেখবেন কিছু একটা করা যায় কিনা।

পাঁচ.

কার জীবন কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়? কেউ কি জানে? জানে না। সেই মুনশি হোস্টেল থেকে নিনিদকে ছায়া নিয়ে এলেন তাঁর মস্ত বড় বাড়িতে। দত্তক হিসেবে। দত্তক নেওয়ার সে এক লম্বা কাহিনি। অবিবাহিত মানুষ নাকি দত্তক নিতে পারেন না। যাক সেসব কথা। ছায়া ব্যস্ত। খুব ব্যস্ত। ঘর গোছানোর লোক থাকলেও ছায়া নিজ হাতে ঘর গোছাচ্ছেন। নিনিদের ঘর। যে নিনিদ এত দিন মেঝেতে অন্য সবার সঙ্গে গাদাগাদি করে তেলচিটে বালিশের বিছানায় ঘুমাত। অথচ আজ সে নিজের রুমে ঘুমাবে। সবকিছু একেবারে অন্য রকম এখানে। বিছানার চাদর আছে। দুটি বালিশ রাখা আছে বিছানায়। টেবিলে ক্যান্ডেল স্ট্যান্ড দেওয়া।

খুব তাড়াহুড়ো করছে ছায়া। বেশ বড়সড় রুম দিয়েছে নিনিদকে। রুমের সঙ্গে ঝুল বারান্দা আছে। যে বারান্দায় দু-চারটি অর্কিড ঝুলিয়েছে নিজের বারান্দার মতো। নিজের বারান্দার মতো এই বারান্দায় সে একটি রকিং চেয়ার দিয়েছে। যাতে নিনিদ সারা দিনের সব ক্লান্তি ঝেড়ে ফেলতে পারে রকিং চেয়ারে বসে।

বিকেল চারটার দিকে ফাদার নিনিদকে নিয়ে হাজির হলেন ছায়ার বাসায়।

নিনিদকে সারা বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছেন ছায়া। ফাদারকে এখন যেতে হবে। তাই তিনি বিদায় নিয়ে ফিরে গেলেন। নিনিদ আর ছায়া এখন ছাদে। ইশ্‌ ছাদ থেকে ঢাকা শহর কত সুন্দর। এই প্রথম ঢাকা শহরে বিল্ডিংয়ের ছাদে উঠেছে নিনিদ। নিজেকে জীবন্ত ড্রোন মনে হচ্ছে। বিল্ডিং আর বিল্ডিং। নিচে তাকালে কেমন যেন ভয় করে। পেট গুলিয়ে আসে। তবু সে ছায়ার হাত ধরে নিচে তাকায়। নিচের মানুষজন এদিক–ওদিক ছোটাছুটি করছে। ওপর থেকে মানুষগুলোকে কেমন যেন ছোট ছোট লাগছে। না নিচে আর তাকিয়ে থাকতে পারছে না সে। প্রচণ্ড রকমে প্রস্রাবের বেগ পেয়েছে তার। ছায়ার বুঝতে কষ্ট হলো না, নিনিদের হাইট ফোবিয়া আছে।

নিনিদের রাত কাটে নির্ঘুম। বড্ড একা একা লাগে। হারিকেন জ্বালানো নেই কোথাও। অথচ নিনিদ মুনশির এতিমখানায় কোরবান, আশরাফুল, পিন্টুদের সঙ্গে একসঙ্গে ঘুমাত।

মানুষ অভ্যাসের দাস। একদিনে কি অভ্যাস পরিবর্তন হয়।

কাল স্কুলে ভর্তি হবে নিনিদ। সে কথা বলে গিয়েছেন ছায়া আন্টি। নিনিদ ছায়াকে ছায়া আন্টি ডাকে সেই মুনশি হোস্টেল থেকে। ছায়াও তেমন আপত্তি জানাল না।

নির্ঘুম রাতের শেষে ভোরের দিকে চোখ লেগে এসেছিল নিনিদের। ছায়া রুমে জানালার পর্দা সরিয়ে দিচ্ছে। সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠল নিনিদের রুম। সে ঘুমিয়ে আছে। শরীরে দেওয়া কাঁথা মেঝেতে পড়ে আছে। মাথার বালিশ পায়ের কাছে। বিছানায় কাঁথা-বালিশ উঠিয়ে রাখতে ঘুম ভেঙে গেল নিনিদের। সে উঠে বসল। ছায়া নিনিদকে জড়িয়ে ধরলেন। এই প্রথম নিনিদ যেন মাতৃত্বের স্বাদ পেল। নিশ্চয়ই মা থাকলে এমন করে ধরত। নিনিদ ছায়াকে জড়িয়ে ধরে জানায় তাঁকে মা বলে ডাকবে। ছায়া নিনিদকে তাঁর যা মন চায় তাই ডাকতে বললেন।

ছায়া নিনিদকে তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাশতার টেবিলে চলে আসতে বলে রুম ছেড়ে নাশতার টেবিলে চলে এলেন। নাশতার পর তাদের দুজনের গন্তব্য ফাদারের স্কুলের দিকে। এখন থেকে ওখানেই পড়বে নিনিদ। ক্লাস সিক্সে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো তাকে। (চলবে)