নদীর ওপারে সাগর দেশ

নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট মাঙ্গানুই শহর
নিউজিল্যান্ডের মাউন্ট মাঙ্গানুই শহর

ছোটবেলায় আমি ছিলাম বাবার খুব নেওটা। ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে পড়াকালেও আমি বাবার কাঁধে উঠে ঘুরেছি। অষ্টম শ্রেণিতে বাবার কাঁধে উঠেছিলাম কি না মনে নেই। ভাগ্যিস, স্কুল মাধ্যমিক পরীক্ষা পর্যন্ত আমি ছোটখাটো মানুষ ছিলাম।

আমি যখন মাধ্যমিকের পরীক্ষার্থী, তখন এক আত্মীয় আমাদের বাড়িতে এসে আমাকে দেখে মাকে বলেছিলেন, ও ভাবি, একি, লিটন দেখি বামুন্যা! এর বিয়ের জন্য তো মেয়ে খুঁজে পাবেন না।

আমি হাতে–পায়ে লম্বা হই কলেজে ওঠার পর।

গোমতী নদী ছিল আমাদের বাড়িসংলগ্ন। ছোটবেলায় বাবা বাড়িতে এলে তিনি বিকেলবেলা প্রায়ই আমাকে কাঁধে তুলে গোমতী নদীর তীরে হাঁটতে যেতেন। গোমতী নদী বেয়ে দূরে-বহুদূরে বিকেলের লাল টকটকে সূর্যটা টুপ করে ডুবে যাওয়া দেখতে কী চমৎকারই না লাগত।

একবার বর্ষায় গোমতীর ওপারে নদী-আইলের ভাঙন হয়। ভরাট বর্ষার জলে নদীর ওকূল পুরোপুরি ভেসে যায়। ঠিক তখনই বাবা তাঁর কর্মস্থল সিলেট থেকে বাড়িতে আসেন। এক বিকেলে বাবা আমাকে কাঁধে তুলে গোমতী নদীর আইল ধরে হাঁটতে বের হন। নদীর ওপারের পাড়-ভাঙা দিগন্তবিস্তৃত থইথই জল দেখে, ঝুঁকে বাবাকে জিজ্ঞেস করি, বাবা, নদীর ওপারে এত পানি, এত ঢল, এরপর কী আছে?

বাবা উত্তর দেন, নদীর ওপারে সাগর দেশ আছে।

আমি বাবার কথা বিশ্বাস করি। ভাবি, সত্যি বুঝি নদীর ওপারে সাগর দেশ আছে। কিন্তু বাংলাদেশ থাকতে আমার কখনো সাগর দেখা হয়নি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিতে গেলেও আমার কখনো পতেঙ্গা বা কক্সবাজারে যাওয়া হয়নি। পরে তো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই লেখাপড়া করি। দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় একবার সুযোগ হয়েছিল, কিন্তু সাহস হয়নি। কলেজে পড়ার সময় একই অবস্থা।

আমি মনে হয় একটু ভিতু ছিলাম। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সমুদ্র দর্শন করতে যাব, ওটা মাথাতেই আসেনি। অথচ আমার পিঠাপিঠি ছোট ভাই নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বন্ধুদের নিয়ে কক্সবাজারে সমুদ্র দর্শন করে আসে। আসার সময় আমার জন্য বার্মিজ ফতুয়া নিয়ে আসে। মা ও বোনদের জন্য ঝিনুকের মালা। আমি বিপন্ন দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়েছিলাম। আমার আর কখনই কক্সবাজার দেখা হয়নি। আজও না।

বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া শেষ করার পরপরই ১৯৯৭ সালে নিউজিল্যান্ডে চলে আসি। তখন ইন্টারনেটের যুগ ছিল না। তাই গুগলে সার্চ দিয়ে কোনো কিছু দেখার উপায়ও ছিল না। আসার আগে আমি দেশে বসে নিউজিল্যান্ড সম্বন্ধে ভাবতাম, দেশটা বুঝি সম্পূর্ণভাবে বরফে ঢাকা। ব্রিটিশ কাউন্সিল বা কোথাও একটা বইতে নিউজিল্যান্ডকে খুঁজতে গিয়ে তেমনই কয়েকটা বরফ ঢাকা ছবি দেখেছিলাম। আমার মামা আগে থেকেই নিউজিল্যান্ডে থাকতেন। তিনিও বাংলাদেশে বরফের গায়ে হেলান দিয়ে একটা ছবি পাঠিয়েছিলেন। সেই বদ্ধমূল ধারণা নিয়ে নিউজিল্যান্ডে আসি।

নদীর ওপারে সাগর দেশ
নদীর ওপারে সাগর দেশ

১৯৯৭ সালের জানুয়ারির ৫ তারিখ বাংলাদেশ ছেড়ে জানুয়ারির ৮ তারিখ মধ্যদুপুরে নিউজিল্যান্ডে পৌঁছাই। আগে থেকেই মামা বলে রেখেছিলেন তাঁর এক বন্ধুর কথা। তিনি অকল্যান্ড শহরে থাকেন। আমি অকল্যান্ড বিমানবন্দর থেকে প্রথমে মামার সেই বন্ধুর বাসা যাই। সেখানে রাতের খাবার খেয়ে সেদিন রাতেই সরাসরি মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরে মামার বাসায় চলে আসি।

বন্ধুরা, মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরটা সম্বন্ধে একটু বলে নিই। আমার দেখা এযাবৎ সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর একটা হলো মাউন্ট মাঙ্গানুই। খুব বেশি বড় নয়। পাশের তাওরাঙ্গা শহরটাকে আলাদা করলে মাউন্ট মাঙ্গানুই বেশ ছোটই। একটা সমুদ্রসৈকত এবং একটা পাহাড়কে কেন্দ্র করে শহরটা গড়ে উঠেছে। লোকসংখ্যাও খুব বেশি নয়। কিন্তু পৃথিবীর সেরা দশটা সমুদ্রসৈকতের একটা হলো মাউন্ট মাঙ্গানুই। বড়দিন ও ইংরেজি নববর্ষের সময় শহরের লোকসংখ্যা চার-পাঁচ গুণ বেড়ে যায়। শহরটা তখন গমগম করে। বছরের বাকি সময়টা নিস্তব্ধ শহর হিসেবে পড়ে থাকে। যদিও আজকাল মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরের পরিধি বিস্তর বেড়েছে।

ও হ্যাঁ, যে কথা বলছিলাম। অকল্যান্ড বিমানবন্দরে নামার পর আমার ধারণা পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে যায়। কোথায় বরফ, কোথায় কী? তখন নিউজিল্যান্ডে গ্রীষ্মকাল চলছিল। চারদিকে চকচকে সোনালি রোদ। আসার সময় বরফের দেশ ভেবে বঙ্গবাজার থেকে মোটা মোটা জ্যাকেট কিনে লাগেজে ভরে এনেছিলাম। কিন্তু দক্ষিণের দুয়ার থেকে এমন নরম উষ্ণ বাতাস আসছিল যে ওগুলোর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম।

সে রাতে মাউন্ট মাঙ্গানুই ফিরে দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তিতে মামার বাসায় শুধু রাতেই নয়, পরদিন সারাটা সময় ঘুমাই। এর পরের দিন বিকেল বা রাতে কোথাও বের হইনি। তার পরদিন মধ্য বিকেলে মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরটা দেখতে মামার বাসা থেকে বের হই। একাই। ছোট্ট শহর। মামার বাসা ছিল শহরের ঠিক উপকণ্ঠে। টিনাইও রোডে। টিনাইও রোড থেকে মাউন্ট মাঙ্গানুই সৈকত ছিল মাত্র পাঁচ মিনিটের হাঁটার পথ।

অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের কোলানগাট্টা শহর
অস্ট্রেলিয়ার কুইন্সল্যান্ডের কোলানগাট্টা শহর

আমি মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরটা ঘুরে সমুদ্রসৈকতে যখন আসি, তখন সূর্যটা অনেকটাই পশ্চিমে হেলে পড়েছে। চারদিকে হিল হিল গ্রীষ্মের নরম বাতাস আর বিকেলের বিছিয়ে থাকা সোনালি নরম রোদ। আমি সৈকতঘেঁষা একটা বড় পাথরের ওপর বসি। সমুদ্রে তখন জোয়ারের টান ছিল। প্রশান্ত মহাসাগরের জল পাথরে এসে আছড়ে পড়ছিল—ছলাৎ ছলাৎ, ছলাৎ ছলাৎ। আমার দৃষ্টির সামনে দিগন্তবিস্তৃত জল আর ঢেউয়ের পর ঢেউ।

আমার সেই প্রথম সমুদ্র দেখা। তা–ও আবার বিদেশ–বিভুঁইয়ে। দূর দেশের এক শহরে। পাথরে বসে থাকতে থাকতেই সূর্যটা টকটকে লাল হয়ে একসময় টুপ করে সাগরের জলে ডুব দেয়। আমি সেদিন খুব আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলাম। আমার চোখে জল ছিল কি না জানি না। আমার তখন ডুবন্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে বাবার কথা মনে পড়েছিল। ভেবেছিলাম, এই বিশাল সমুদ্রের ওপারে কী? নিশ্চয়ই সাগর দেশ। বাবার বলা সেই নদীর ওপারে সাগর দেশ...!

বন্ধুরা, সেই বাইশ বছর আগের এত ফিরিস্তি কেন করলাম, তা একটু পরে বলি। এখন খানিকটা অন্য প্রসঙ্গে যাই। কয়েক দিন আগে বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের পিকনিক হয়ে গেছে অদূরবর্তী কোলানগাট্টার কিররা বিচ-হিল লুক আউট ও কমিউনিটি সেন্টারে। তাদের বার্ষিক পিকনিক। গোল্ড কোস্টে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে দুটো গ্রুপ। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন গোল্ড কোস্ট ও বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্ট।

গোল্ড কোস্টে পাঁচ-ছয় শ বাঙালিদের মধ্যে কেন দুটো গ্রুপ, তা আমি জানি না। আমি আসার বেশ আগে থেকেই দুটো গ্রুপ। অথচ মাত্র পঞ্চাশ মিনিটের পথ ব্রিসবেনে বিশাল বাঙালি কমিউনিটিতে একটা গ্রুপ। কিন্তু অবাক ব্যাপার যে গোল্ড কোস্ট শহরের বাংলাদেশি কমিউনিটির সেই দুই গ্রুপের মানুষই ঈদে-পার্বণে এক প্লেটে ভাত খায়। সব ধরনের অনুষ্ঠানে সবাই যায়। তাদের পারস্পরিক আন্তরিকতা দেখে আমি খুবই মুগ্ধ হই। এমন তো নয় যে কেউ সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক হওয়ার জন্য পাগল। কাউকে ডেকেও কোনো পোস্ট দেওয়া যায় না। এখানে সবাই ব্যস্ত। নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো সময় কারও নেই।

বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের বার্ষিক পিকনিকে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের বার্ষিক পিকনিকে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

গোল্ড কোস্টে আসার পর যেকোনো কারণেই হোক কমিউনিটি প্রোগ্রামগুলোতে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন ইন গোল্ড কোস্ট আমাদের আগ বাড়িয়ে টেনে নেয়। একসময় আমাদের পারিবারিক বন্ধু ও সুহৃদ পলাশ ভাই ও মণিকা ভাবি অনেকটা অধিকার খাটিয়েই বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য বানিয়ে দেন। আমরাও ভাবি, অ্যাসোসিয়েশনের সব অনুষ্ঠানেই অংশগ্রহণ করছি, সদস্য হয়ে গেলেই ভালো হয়।

সেই অর্থে বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্ট থেকে তেমনভাবে কেউ এগিয়ে আসেননি। তাদের কোনো প্রোগ্রামেও আমাদের তেমনভাবে যাওয়া হয়নি। অথচ আলাদাভাবে সবার সঙ্গেই আমার ও আমার পরিবারের সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ আগে বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের সভাপতি মোহাম্মদ ইকবাল ভাই আমাকে কয়েকবার ফোন দেন এবং সাক্ষাতে অনুরোধ জানান, আমি ও আমার পরিবার যেন তাঁদের বার্ষিক পিকনিকে যাই। যেখানে আমাদের সবার মধ্যে এত সৌহার্দ্যপূর্ণ ও আন্তরিক সম্পর্ক, তাই ইকবাল ভাইয়ের অনুরোধ সাদরেই গ্রহণ করি।

বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের বার্ষিক পিকনিকটা আক্ষরিক অর্থেই সুন্দর ও বিভিন্নভাবে গোছালো ছিল। তাদের প্রতিটা ইভেন্ট চমৎকার ও উপভোগ করার মতো ছিল। তাদের প্রচেষ্টাও ছিল দেখার মতো। পিকনিকে শুধু খাওয়াদাওয়াটাই তো আসল নয়। এর বাইরেই অনেক কিছু থাকে। বড়দের বিভিন্ন খেলা, ছোটদের বিভিন্ন খেলা, নারীদের জন্য আলাদাভাবে ইভেন্ট এবং সবশেষে পুরস্কার বিতরণী। কীভাবে যে সারাটা দিন পেরিয়ে বিকেল হয়ে এসেছিল, আমরা টেরই পাইনি।

বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের বার্ষিক পিকনিকে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের বার্ষিক পিকনিকে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

আমার ছেলে অনিম ক্রিকেটার। সে তার বন্ধুবান্ধবকে নিয়ে কিররা কমিউনিটি হলের প্রশস্ত মাঠে ক্রিকেট খেলায় ব্যস্ত ছিল। মেয়ে অবন্তী ব্যস্ত ছিল মেয়েদের খেলায়। সে দিনের শেষে পুরস্কারও পায়। সহধর্মিণীরা কেউ ব্যস্ত ফটো তোলায়, কেউ লুডু খেলায়। বড়দের কেউ দাবা খেলায়, কেউ ক্যারম খেলায়, কেউবা দল বেঁধে কার্ড খেলায় ব্যস্ত ছিল। আমি অবশ্য এসব কোনো ইভেন্টেই অংশগ্রহণ করিনি। আমার ভেতর ছিল অন্য মুগ্ধতা। আমি বেশির ভাগ সময়ই কমিউনিটি হলের দীঘল খোলা বারান্দায় একাকী বসে ছিলাম। এভাবে একাকী বসে থাকাটাই আমার প্রিয় সময়।

এবার বাইশ বছর আগের ফিরিস্তির কথা এবার শুনুন। কিররা লুক আউট ও কমিউনিটি হলটা যে কোলানগাট্টা শহরে, সেই শহরটা দেখতে আমার কাছে অনেকটা সেই মাউন্ট মাঙ্গানুই শহরের মতোই মনে হয়। বিশেষ করে দীর্ঘ মেরিন প্যারেডের সমান্তরালে সারি সারি নরফক পাইনগাছ। মেরিন প্যারেডের এক পাশে উঁচু উঁচু বিল্ডিং তো অন্য পাশে বিভিন্ন পার্ক, লুক আউট পয়েন্ট, দীঘল বালিয়াড়ির সৈকত। কোথাও আবার উঁচু পাহাড় থেকে নেমে আসা বিশাল বিশাল পেট বের করা পাথর। পাথরের ওপর সমুদ্রের আছড়ে পড়া ফেনিল ঢেউ।

অনবরত জলের শব্দ—ছলাৎ ছলাৎ, ছলাৎ ছলাৎ। পয়েন্ট ডেঞ্জার, পয়েন্ট ডেঞ্জার লাইট হাউস, কিররা সৈকত, কোলানগাট্টা সৈকত, স্ন্যাপার রক, রেইনবো বে, গ্রিন মাউন্ট সৈকত, ক্যাপ্টেন কুক মেমোরিয়াল লাইট হাউসসহ আরও কত কী! আরেকটা উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, গোল্ড কোস্ট জেলায় অবস্থিত এই কোলানগাট্টা শহর দিয়েই কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের শেষ এবং নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের শুরু। নিউ সাউথ ওয়েলসের যে শহরটা কোলানগাট্টার পাশে, ওটার নাম টুইড হেড।

বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের বার্ষিক পিকনিকে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ
বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের বার্ষিক পিকনিকে অংশগ্রহণকারীদের একাংশ

কোলানগাট্টা ও টুইড হেড দুই প্রদেশের দুটো শহর হলেও একত্রে এই শহর দুটোকে বলে টুইন টাউন। রাস্তার এপাশ-ওপাশ আর টুইড নদী দিয়ে শহর দুটোকে ভাগ করা হয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, এই শহর দুটো পাশাপাশি অবস্থিত হলেও দুটো শহরের চরিত্র সম্পূর্ণ আলাদা। দুই শহরের পুলিশ আলাদা ইউনিফর্ম পরে। পুলিশের গাড়ির রং আলাদা। গাড়ির সাইন ভিন্ন রকম। রাস্তার সাইন দুই রঙের। রাস্তার গতিসীমা আলাদা। এমনকি সময়ের হিসাবও আলাদা।

টুইড হেডের সময় কোলানগাট্টার সময়ের চেয়ে এক ঘণ্টা এগিয়ে থাকে। এ জন্য ইংরেজি নববর্ষের সময় বিভিন্ন শহর ও দূরদূরান্ত থেকে মানুষজন কোলানগাট্টা এবং টুইড হেডে হুমড়ি খেয়ে পড়েন। এর পেছনে চমৎকার সমুদ্রসৈকতগুলোই একমাত্র কারণ নয়। এই টুইন টাউনে এলে তারা একই দিনে এক ঘণ্টার ব্যবধানে দুবার নববর্ষ পালন করতে পারেন। কুইন্সল্যান্ড প্রদেশের সময়ে হিসাবে একবার। নিউ সাউথ ওয়েলস প্রদেশের সময়ের হিসাবে এক ঘণ্টা এগিয়ে দ্বিতীয়বার।

আমি জলি ও বাচ্চাদের নিয়ে বেশ কয়েকবার এই টুইড হেড ও কোলানগাট্টায় বেড়িয়ে গিয়েছি। যতবারই টুইড হেড ও কোলানগাট্টায় এসেছি, দুই প্রদেশের সীমারেখায় দাঁড়িয়ে বারবারই মনে হয়েছে, আমি যেন দুই দেশের নো ম্যানস ল্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছি। সত্যি তো, অস্ট্রেলিয়ার একেকটা প্রদেশ যেন ঠিক প্রদেশ নয়। যেন সীমা-পরিসীমাহীন বিশাল আকৃতির দেশ। যেখানে অস্ট্রেলিয়া একটা দেশই একটা মহাদেশ!

বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের বার্ষিক পিকনিক
বাংলাদেশ সোসাইটি ইন গোল্ড কোস্টের বার্ষিক পিকনিক

বন্ধুরা, ধান ভানতে গিয়ে শীবের গীত গাওয়ার মতোই যেন এক কথা থেকে আরেক কথায় চলে যাচ্ছি। যে কথা বলছিলাম, আমি যখন কিররা কমিউনিটি হলের দোতলার দীঘল বারান্দায় বসে ছিলাম, তখন সারাক্ষণ আমার চোখের সামনে প্রশান্ত মহাসাগরের ঢেউ দোল খাচ্ছিল। কিররা কমিউনিটি হলটা একটা পাহাড়ের ওপর। পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতেই ঠিক পাদদেশে প্রশান্ত মহাসাগর। পাহাড়ের ওপর থেকেই বিস্তৃত সবুজ জলের ফেনিল স্রোতের আছড়ে পড়া দেখা যাচ্ছিল, আর জলের শব্দ শোনা যাচ্ছিল—ছলাৎ ছলাৎ, ছলাৎ ছলাৎ। কী মুগ্ধ করা শব্দ!

কমিউনিটি হলের দোতলায় বসেই আমি বিস্তৃত সমুদ্রের জল দেখতে দেখতে বিকেলটা পড়ে আসতে দেখলাম। ঘরে ফেরার মুহূর্তে সূর্যটা লাল হয়ে উঠেছিল। আমরা যখন কোলানগাট্টা থেকে সমুদ্রের পাড় ধরে গাড়ি চালিয়ে আসছিলাম, ঠিক তখন বিস্তৃত সাগরের জলে সূর্যটা টুপ করে ডুবে গেল। আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বাইশ বছর আগের স্মৃতিতে যেন ক্ষয়ে গেলাম। বাবার কথা আমার তখন মনে পড়ে গিয়েছিল। সত্যি তো, নদীর ওপারে একটা সাগর দেশ আছে। আমাদের নিঃসীম দৃষ্টির ভেতর সেই সাগর দেশ। যে সাগর দেশে আমরা ভবিষ্যতের পানে ছুটে যেতে বর্তমানকে নিয়ে বসবাস করছি...!
–––

মহিবুল আলম, ই–মেইল: <mohibulalam.k@gmail,com>