হায় সংসার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

রুমির বয়স যত বাড়ছে, তাঁর স্বামীর বাচ্চা বয়সে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা তত বাড়ছে। ব্যাপারটা তাহলে খুলেই বলি।

ইংল্যান্ডে বিশ্বকাপ ক্রিকেট ম্যাচ। বাংলাদেশের খেলা দেখবে বলে বন্ধুদের সামনে লাফাতে লাগলেন রুমির স্বামী। রুমি বোঝাতে চেষ্টা করল, রোজার মধ্যে বাচ্চাদের স্কুল খোলা। এবার না গিয়ে...।

স্বামীর বন্ধুরা সবাই হইহই করে উঠল। এত বছর পরও ভাবি এত প্রেম! বাচ্চা নিয়ে দিন দশেক একা থাকতে পারবেন না? আমরা সবাই যাচ্ছি।

কলিজায় দাগা দিয়ে রুমির স্বামী এমনভাবে মাথা নাড়াতে লাগল, রুমি চিকন গলায় বলল, আচ্ছা...। সবার হাততালিতে ওর করুণ গলা চাপা পড়ে গেল।

অতঃপর নাচতে নাচতে আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে চলে গেল রুমির স্বামী। ফেসবুক ভেসে গেল তার খেলার মাঠের ছবি আর টিভিতে দেখানো ভিডিওতে।

একদিন রুমি ফোন ধরে বলল, তুমি ছবি পাঠালে না আমাদের? ইমন বাবা বাবা বলে...। তার আগেই স্বামীর উচ্ছ্বসিত উত্তর, আরে, সব সময় ওয়াই–ফাই থাকে? রেস্ট নাও, গেলাম খেলা দেখতে।

রুমি ঝাঁজালো উত্তর দিল, রেস্ট নেব মানে? দুই আর চার বছরের বাচ্চা নিয়ে...তুই খালি বাসায় পা দে।

তারপর ফোনে হঠাৎ সীমাহীন নীরবতা। রুমি কি এতক্ষণ একা একা বক বক করছিল? অন্য পক্ষ অর্থাৎ রুমির স্বামী ফোন রেখে কখন সটকে পড়েছে কে জানে?

স্বামী ইংল্যান্ড থেকে ফেরার পর তাকে বাসায় কী কী কাজে সাহায্য করতে হবে, সে বিষয়ের ফিরিস্তি লিখে রুমি এয়ারপোর্টেই ওর স্বামীকে দিয়ে সেই কাগজে স্বাক্ষর করিয়ে নিল। স্বাক্ষর না করলে গ্যারেজ খালি করা হয়েছে। বিছানা রেডি সেখানে। জানাল।

রুমির স্বামী ঘরে পা দিয়েই গ্যারেজে উঁকি দিয়ে দেখল, আসলেই গ্যারেজের ফ্লোরে ম্যাট্রেস পাতা। তখন শব্দ করে নিশ্বাস ফেলে বলে ফেলল, আরে, এ তো দেখছি সাংঘাতিক মহিলা।

রুমি তেড়ে গিয়ে বলল, কী, কী বললে তুমি? এমন সময় রুমি দেখল, ব্যাগ খুলে স্যান্ডেল বের করছে তার স্বামী। বলল, দেখো তো পায়ে হয় কি না। আন্দাজে কিনেছি তো।

লেখিকা
লেখিকা

রুমি তেলে–বেগুনে জ্বলে উঠল। ৪ ফুট ৯ ইঞ্চি লম্বা আমি, তুই জানিস না, হিল ছাড়া স্যান্ডেল আমি পরতে পারি না। দামড়া লম্বা বেটা। আমি কি তোর পকেটে করে ঘুরব?

স্বামী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আচ্ছা, চুক্তির ৫ নম্বর শর্ত অনুযায়ী তোমাকে এক দিন রান্না করে খাওয়াব। তারপর কিছু খেয়ে ঘুমাতে চলে গেল। ঘুমও ঠিকমতো শেষ হলো তার।

পরের উইকএন্ডে রুমির স্বামী উচ্ছ্বসিত হয়ে ঘোষণা দিল, খাসির বিরিয়ানি রান্না করে খাওয়াবেন। তারপর কাছের হালাল দোকান থেকে ৩০ পাউন্ড মাংস কিনে হাজির। রুমি বলতে গেল, কতগুলো মানুষ খেতে পারবে এত মাংসে, তোমার কোনো আন্দাজ আছে?

কথা শেষ করার আগেই স্বামী বলে বসল, আরে, রোজ রোজ এলেবেলে রান্না করে খাওয়াও বলে মাস্টার শেফের কাজ বুঝবে? যাও যাও, পরে এসো খোঁজ নিতে।

সারা দিন ইউটিউবে এক নারীর বিকট স্বরে রান্নার বর্ণনা শুনল রুমি। ‘এখন পেঁয়াজ কেটে এভাবে কুচি কুচি করে ভেজে বেরেস্তা বানান’। ১৫ মিনিট পরে ‘এবার মাংস ধুয়ে পানি ঝরান’। আধঘণ্টা এই অত্যাচার শুনে বাচ্চা নিয়ে বাইরে ঘুরতে গেল রুমি।

বিকেল চারটার দিকে ওর স্বামীর বিকট আনন্দ চিৎকার শুনল ফোনে। চলে আসো বাসায়, যেই জিনিস বানাইছি, খাইলে আর জীবনে অন্য খাওয়া মুখে রুচবে না।

সপ্তাহের বাজার করা শেষ। বাসায় গিয়ে বাচ্চাদের সামলে বাজার গোছালেই কাজ শেষ। রুমি মনে মনে, ‘হাওয়া মে উড়তা যায়ে তেরা লাল দোপাট্টা ‘গাইতে গাইতে হাওয়ার বেগে ড্রাইভ করে বাসায় পৌঁছাল। রান্নাঘরে ঢুকেই মাথা ঘুরে পড়ে গেল। মোটামুটি এক বালতি পানির ঝটকায় হুঁশ ফিরে দেখে বিশাল লাল বালতি হাতে স্বামী আবার পানি মাথায় ঢালি ঢালি করছে।

রুমি কোনোরকমে হাত তুলে বলল, থাম, তুই যে পুরা রান্নাঘর তেল চিটচিটে করলি, এরপর বালতি বালতি পানি ঢাললি, এই রান্নাঘর পরিষ্কার করতে তো আমার দুই মাস লাগবে।

স্বামী প্রবর চলে যেতে যেতে এবং পিছলে ফ্লোরে আছাড় খেতে খেতে বলে গেল, উপকারী গাছের ছাল থাকে না।

অতঃপর রান্নাঘর পরিষ্কার করার জন্য ঘণ্টা তিনেক বাচ্চা দুটাকে তাকে রাখতে হলো স্বামীর কাছে। রাতে ঘুমাতে যাবে রুমি। এমন সময় বড় ছেলেটা এসে বলল, মা, বাবা বলেছে, বাঁদরের বাচ্চা, তোরা বড় হবি কবে?

রুমি কটমট করে তাকাতেই স্বামী বলল, বিরিয়ানি খেয়েছে, ঘুমাবে, তা না, গোসল করাও, বই পড়ো, তারপর ঘুমাবে। তুমি তো বলেছ তোমাদের পূর্বপুরুষ আমাজন থেকে এসেছে।

রুমি চোখ পাকিয়ে বলল, কী?

একটা বুড়া শিশু আর দুটি ছোট শিশু নিয়ে অতঃপর তাহারা সুখে–শান্তিতে দিন কাটাইতে লাগিল।