শূন্য বিন্দুতে নারী - তিন

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

স্কুল খুব ভালো লাগত আমার। অনেক ছেলেমেয়ে পড়ত সেখানে। আমরা উঠোনে খেলতাম। উঠোনের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটতাম। কিংবা সূর্যমুখীর বীজ খুব দ্রুত একের পর এক মুখে পুরে চিবাতাম। কিংবা চুইংগাম চিবিয়ে বেলুন বানিয়ে বিকট শব্দে ফাটাতাম। কিংবা কটকটি ও শুকনো ক্যারব বীজ (ক্যাকোয়ও ধরনের লেগুম গোত্রের বীজ ও ফল) কিনতাম। কিংবা যষ্টিমধু-তেঁতুল-আখের রসের শরবত খেতাম। মানে, যেকোনো কড়া স্বাদেই আমাদের যত আগ্রহ।

ফিরে ঘরদোর পরিষ্কার, চাচার কাপড়চোপড় ধোয়া, বিছানা করা, বইপত্র গুছিয়ে রাখা, এসব করতে হতো। তিনি আমাকে একটি ভারী ইস্ত্রি এনে দিয়েছিলেন। সেটি কেরোসিনের চুলায় গরম করে চাচার কাফতান ও পাগড়ি ইস্ত্রি করতাম।

সূর্যাস্তের আগে আগে তিনি আল-আজহার থেকে ফিরতেন। আমি খাবার বাড়তাম ও দুজন একসঙ্গে খেতাম। খাওয়া শেষে সোফায় গা এলিয়ে দিতাম। আর চাচা বিছানায় বসে জোরে জোরে পড়তেন। আমি মাঝে মাঝে উঁচু বিছানাটায় লাফিয়ে উঠে তাঁর পাশে বসতাম। তাঁর লম্বা-সরু আঙুলের বিশাল হাত নিজের আঙুলে জড়াতাম। তাঁর মস্ত-মোটা বইয়ের মিহি গুঁড়ি গুঁড়ি লেখার মসৃণ পাতাগুলো ছুঁয়ে দেখতাম। দুই-একটি শব্দ চেনার চেষ্টা করতাম।

কিন্তু সেগুলো রহস্যময় আঁকিবুঁকি হয়ে আমার দিকে চেয়ে থাকত। আমার মধ্যে একধরনের ভয় ধরিয়ে দিত। আল-আজহার এক চমৎকার জগৎ—পুরুষের জগৎ। চাচা সেই জগতেরই একজন—একজন পুরুষ। তিনি ভাবগম্ভীর স্বরে পড়তেন। তাঁর লম্বা-সরু আঙুলগুলোতে অদ্ভুত এক কাঁপুনি ভর করত। আমি তা আমার হাতে টের পেতাম। এই কম্পন আমার চেনা শৈশব থেকেই। এখনো যা দূরাগত স্বপ্নের মতো মনে পড়ে।

শীতের রাতগুলোতে চাচার হাত জড়িয়ে, মায়ের পেটের নিশ্চিন্ত শিশুটির মতো গুটিসুটি হয়ে থাকতাম। ঘেঁষাঘেঁষি করে একে অন্যকে উষ্ণ রাখতাম। তাঁর হাতে মুখ গুঁজতাম। মন চাইত বলি, ভালোবাসি। কিন্তু মুখে কথা সরত না। মন চাইত কাঁদি। কিন্তু চোখে জল আসত না। এভাবেই একসময় গভীর ঘুমে তলিয়ে যেতাম, একদম ভোর পর্যন্ত।

একদিন প্রচণ্ড জ্বরে পড়ি। চাচা আমার মাথাটি কোলে নিয়ে বিছানায় বসে থাকেন। আমার সারা মুখে মস্ত লম্বা আঙুল বুলিয়ে দেন। আর আমিও সারা রাত তাঁর হাত ধরেই ঘুমাই।

---

যেদিন প্রাইমারি স্কুলের সার্টিফিকেট হাতে পাই, সেদিন চাচা আমাকে ছোট্ট একটি হাতঘড়ি উপহার দেন ও রাতে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যান। সিনেমায় এক মেয়েকে নাচতে দেখি। ঊরু খোলা। আরও দেখি ছেলেমেয়ের জড়াজড়ি, ঠোঁটে চুমু খাওয়ার দৃশ্য। আমি হাত দিয়ে মুখ লুকাই। চাচার দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারি না। পরে তিনি বলেছিলেন, নাচানাচি নাকি পাপ, চুমু খাওয়াও, কিন্তু ওই মুহূর্তে কিছুতেই চাচার চোখের দিকে তাকাতে পারিনি। রাতে বাড়ি ফিরলে, বরাবরের মতো বিছানায় তাঁর পাশে না বসে, আমার ছোট সোফাটার ওপর বরং হাঁসের পালকের লেপ–মুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকি।

কিছুক্ষণ পর চাচার মস্ত-লম্বা আঙুলগুলো এগিয়ে এসে চুপিসারে লেপের কোনা তুলে ধরলে, আমার সারা শরীর কাঁপতে থাকে। সমস্ত সত্তা গ্রাস করে নেয় এক ব্যাখ্যাতীত অনুভূতি। তাঁর ঠোঁট দুটো আমার গাল ছুঁয়ে, ঠোঁটে চেপে বসে। আর তাঁর কম্পিত-অনুসন্ধিৎসু আঙুল আমার ঊরু হাতড়াতে হাতড়াতে ধীরে ধীরে উঠে আসে আরও ওপরে।

একটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটতে থাকে আমার মধ্যে। অদ্ভুত। কারণ এ রকম ব্যাপার আগে কখনো ঘটেনি বা বরাবরই ঘটে আসছে, অনন্তকাল ধরে। অনেক আগে হারিয়ে যাওয়া কোনো সুখানুভূতি, আমার শরীরের এক দূরাগত বিন্দু থেকে যেন নতুন করে জেগে উঠছে। কিংবা এটি অজানা ও অনির্বচনীয় এক আনকোরা সুখানুভূতি। উৎসবিন্দুটি যেন আমার শরীরের মধ্যে না বা বহুদিন ধরে আমার সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন।

---

চাচা অনেক ঘন ঘন বাইরে যাওয়া শুরু করলেন। ঘুম থেকে উঠে দেখতাম বেরিয়ে গেছেন। আর রাতে যখন ফিরতেন ততক্ষণে আমি গভীর ঘুমে। পানির গ্লাস বা খাবারের থালা এগিয়ে দিলে তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই, হাত বাড়িয়ে নিয়ে নিতেন। লেপ–মুড়ি দিয়ে, কান খাড়া করে, তাঁর হাঁটাচলার শব্দ শুনতাম। দম আটকে ঘুমের ভান করে অপেক্ষা করতাম। কখন তাঁর আঙুল আমার শরীর ছুঁতে আসবে। অপেক্ষার সময়টা অনন্ত মনে হতো। কিন্তু শেষাবধি কিছুই হতো না। বিছানার ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে টের পেতাম তিনি শুয়ে পড়েছেন। আর কিছুক্ষণ পর যথারীতি ভেসে আসত নাক ডাকার শব্দ। তখনই কেবল বুঝতাম, তিনি ঘুমিয়ে গেছেন।

তিনি অনেকটাই বদলে গেলেন। ঘুমাতে যাওয়ার সময় আগের মতো আর বই নিয়ে বসেন না। গায়েও চড়ান না জোব্বা-কাফতান। স্যুট-টাই পরা শুরু করেন বরং। ওয়াক্ফ মন্ত্রণালয়ে কাজ নেন। আর বিয়ে করেন আল-আজহারের তাঁরই এক শিক্ষকের মেয়েকে।

চাচা আমাকে মাধ্যমিক স্কুলে ভর্তি করে দেন। আমি চাচা-চাচির সঙ্গে তাঁদের নতুন বাসায় থাকতে শুরু করি। চাচি গোলগাল, খাটো ও ফরসা মতো এক নারী। হাঁটলে তাঁর থলথলে শরীরটা এদিক-ওদিক দুলতে থাকত। যা হৃষ্টপুষ্ট হাঁসের চলনের কথা মনে করিয়ে দিত। মোলায়েম তাঁর কণ্ঠস্বর। কিন্তু সেটি ভদ্রতার কারণে না। ওই কোমলতার জন্ম বরং নিষ্ঠুরতায়। বড় কালো চোখ দুটো নির্জীব-ভাবলেশহীন-নিকষ কালো দিঘি যেন।

তিনি কখনো চাচার পা ধুয়ে দিতেন না। চাচাও কখনো তাঁর গায়ে হাত তুলতেন না বা গলা চড়িয়ে কথা বলতেন না। চাচা তাঁর সঙ্গে অসম্ভব মিষ্টি ব্যবহার করতেন। পুরুষেরা নারীদের সঙ্গে যে রকম বিদঘুটে ভদ্রতা দেখায়, যেখানে সত্যিকারের শ্রদ্ধা পুরোপুরি অনুপস্থিত, ঠিক তেমনটি। আমার মনে হতো, স্ত্রীকে তিনি মোটেও ভালোবাসেন না, অনেকটা ভয়ই বরং পান। কারণ সেই নারী চাচার তুলনায় সমাজের উঁচুতলার। শ্বশুরবাড়ির লোকজন বেড়াতে এলে, চাচা মুরগি-গোশত কিনে আনতেন। আর বাড়িটি তাঁর হাসির শব্দে ক্ষণে ক্ষণে প্রকম্পিত হতো। কিন্তু যখন গ্রামের বাড়ি থেকে তাঁর ফুফু এসে হাজির হতেন, গায়ে মলিন-ঢোলা-লম্বা কুর্তা, আস্তিনের ফাঁক গলে দেখা যেত ফাটা-রুক্ষ হাত, চাচা তখন এক কোনায় গুটিয়ে যেতেন। মুখে ফুটত না কোনো কথা বা একটু হাসিও।

দাদি বিছানায় আমার পাশে বসে নীরবে চোখের জল ফেলতেন আর নিজের গলার সোনার হার বিক্রি করে চাচার আল-আজহারে পড়ার খরচ জোগানোর কথা মনে করে আফসোস করতেন। যত্ন করে নিয়ে আসা মুরগি, ডিম ও পিঠা ভরা বাক্সটি পরদিন সকালে খালি করে, সেটি বগলদাবা করে চলে যেতেন।

আমি বরং তাঁকে বলতাম, ‘আর একটা দিন থেকে যান না, দাদু।’ কিন্তু চাচা-চাচি থাকতেন একদম নিশ্চুপ।

প্রতিদিন স্কুলে যেতাম। ফিরে এসে ঘর ঝাঁট দেওয়া, মেঝে-বাসনকোসন-কাপড়চোপড় ধোয়া, এসব করতে হতো। চাচি শুধু রান্নাটাই করতেন। কিন্তু সমস্ত হাঁড়িপাতিল ঘষামাজা ছিল আমার ঘাড়ে। পরে চাচা ছোট একটি কাজের মেয়ে বাড়ি নিয়ে এলে তার ঠাঁই হয় আমার কামরায়। বিছানা আমার জন্য বরাদ্দ। তাই সে মেঝেতে ঘুমাত। এক কনকনে শীতের রাতে, আমি তাকে বিছানায় উঠে শুতে বলি। কিন্তু কামরায় ঢুকে তা দেখতে পেয়ে চাচি মেয়েটিকে বেদম মার লাগান। তারপর আমাকেও ধরে পেটান।

---

একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি, চাচা আমার ওপর খুব খেপে আছেন। চাচিরও একই অবস্থা। যত দিন পর্যন্ত না চাচা আমাকে তল্পিতল্পাসহ মেয়েদের বোর্ডিং স্কুলে রেখে আসেন, তত দিন এমনটি চলতেই থাকে। বোর্ডিং স্কুলেই আমার ঠাঁই হয়। সপ্তাহ শেষে মেয়েদের মা–বাবা ও অন্য আত্মীয়স্বজন তাদের দেখতে আসত। কিংবা বৃহস্পতি ও শুক্রবার একসঙ্গে কাটাতে সঙ্গে করে বাড়ি নিয়ে যেত। আমি উঁচু দেয়ালের ওপর দিয়ে তাদের যাওয়া-আসা দেখতাম। জেলখানার বন্দীরা যেমন প্রাচীরের ওপারে মুক্ত জীবনের দিকে চাতক পাখির মতো তাকিয়ে থাকে, ঠিক তেমনি।

সবকিছুর পরও স্কুল ভীষণ ভালো লাগত আমার। নতুন নতুন বইপত্র, নিত্যনতুন পাঠ, আর নতুন সমবয়সী সহপাঠী। আমাদের মধ্যে নিজেদের জীবন নিয়ে আলাপ হতো। হতো গোপন কথার বিনিময়। নিজেদের অকপটভাবে মেলে ধরতাম আমরা। শুধু সুপারিনটেনডেন্ট ছাড়া ঝামেলা পাকানোর আর কেউ ছিল না। তিনি দিনে-রাতে সব সময় পা টিপে টিপে হোস্টেলময় ঘুরে বেড়াতেন। আমাদের ওপর গোয়েন্দাগিরি করতেন। আর আড়ি পেতে শুনতেন কে কী বলে। এমনকি আমরা ঘুমালে, তিনি যেন আমাদের স্বপ্নের ওপরও নজরদারি করতেন। স্বপ্নেও কেউ যদি দীর্ঘশ্বাস ফেলেছি, কোনোরকম নড়াচড়া বা টুঁ–শব্দটি করেছি তো রক্ষে নেই, সঙ্গে সঙ্গে শিকারি পাখির মতো ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

ওয়াফিয়া, আমার বান্ধবী। আমার পাশের বিছানায় ঘুমাত। রাতে বাতি নিভিয়ে দেওয়া হলে, আমার বিছানাটি চুপিসারে ওর কাছে টেনে নিয়ে মাঝরাত অবধি একসঙ্গে দুজন গল্প করতাম। সে তার এক চাচাতো ভাইয়ের গল্প করত। তার প্রেমিক। আর আমি বলতাম ভবিষ্যৎ নিয়ে আমার স্বপ্নের কথা। অতীত বা শৈশব নিয়ে আমার বলার মতো কিছু ছিল না। ছিল না বর্তমানের কোনো প্রেমের গল্পও। কাজেই যা কিছু বলার, সবটাই ভবিষ্যৎ ঘিরে। কারণ, আগামীর দিনগুলো ইচ্ছেমতো সাজানো তখন পুরোপুরি আমার হাতে। মুক্ত-স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক আমি, প্রয়োজনে কিছু পরিবর্তনেরও।

কখনো ভাবতাম ডাক্তার হব। কখনো ইঞ্জিনিয়ার। কখনো উকিল বা জজ। একদিন স্কুলের সবাই, সরকারবিরোধী বিশাল এক আন্দোলনে রাস্তায় নামে। হঠাৎ করেই আবিষ্কার করি, অন্য মেয়েদের ঘাড়ের ওপর বসে আমি স্লোগান দিচ্ছি, ‘সরকার নিপাত যাক!’

স্কুলে যখন ফিরি, ততক্ষণে আমার গলার স্বর ভাঙা, চুল এলোমেলো, আর জামাকাপড় জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। কিন্তু সেই রাতজুড়ে নিজেকে এক বিশাল নেত্রী বা রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে কল্পনা করতে থাকি।

জানতাম, মেয়েরা রাষ্ট্রপ্রধান হয় না। কিন্তু আমি তো অন্য মেয়েদের মতো না। এমনকি সহপাঠীদের মতোও না, যারা সারাক্ষণ প্রেম বা ছেলেদের আলাপে ব্যস্ত। আমার মুখ দিয়ে কখনোই এসব নিয়ে কোনো কথা বের হতো না। যেকোনো কারণেই হোক, মেয়েগুলো যেসব নিয়ে ভাবত, সেসবে আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ ছিল না। এবং তাদের কাছে যা গুরুত্বপূর্ণ, আমার কাছে সেসব মনে হতো তুচ্ছ।

এক রাতে ওয়াফিয়া আমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘তুমি কখনো প্রেমে পড়নি, ফেরদৌস?’

জবাব দিই, ‘না, ওয়াফিয়া। কখনো না।’

সে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে, ‘কী অদ্ভুত!’

‘অদ্ভুত কেন?’ আমি জিজ্ঞেস করি।

‘দেখে তো মনে হয়, তুমি কাউকে ভালোবাসো।’

‘চেহারা দেখে কি এমনটা বলা যায়?’

সে মাথা নেড়ে বলে, ‘কী জানি। আমার মনে হলো, তোমার মতো মেয়ের অন্তত প্রেম ছাড়া বাঁচা সম্ভব না।’

‘কিন্তু দিব্যি তো বেঁচে আছি।’

‘তাহলে নির্ঘাত ভান ধরে বেঁচে আছ বা বেঁচেই নেই।’

কথাটি বলেই সে ঘুমে তলিয়ে যায়। আর আমার চোখে তখন এক ফোঁটা ঘুম নেই। সারা রাত অন্ধকারে তাকিয়ে থাকি। রাতের আঁধার থেকে ধীরে ধীরে দূরাগত, আধা-বিস্মৃত কিছু খণ্ড স্মৃতি ভেসে আসতে শুরু করে। দেখতে পাই খোলা ছাপরার নিচে, খড়ের গাদায় শুয়ে আছে মোহাম্মাদাইন। নাকে খড়ের গন্ধ ভেসে আসে এবং শরীরজুড়ে টের পাই তার হাতের ছোঁয়া। দূরাগত তবু যেন ভীষণ চেনা এক সুখানুভূতিতে থরথরিয়ে কেঁপে উঠি। সেই সুখানুভূতির জন্ম-অজানা কোনো উৎস থেকে, আমার সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন অনির্ণীত কোনো এক বিন্দু থেকে। কিন্তু তারপরও নিজের শরীরের ভেতরেই কোথাও উৎসবিন্দুটি অনুভব করি। সেখান থেকে ভেসে আসা, মৃদু সুখানুভূতি নিয়ে শুরু হওয়া প্রতিটি স্পন্দন যেন পরিণতি পাচ্ছে মৃদু যন্ত্রণায়। ক্ষণিকের জন্য হলেও আমি তা ধরে রাখতে চাই, চাই ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু সেটি বাতাসের মতো, ভোজবাজির মতো, কিংবা ভাসতে ভাসতে মিলিয়ে যাওয়া স্বপ্নের মতো হারিয়ে যায়। ঘুমের মধ্যে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি আমি। কোনো কিছু যেন প্রথমবারের মতো হারাতে যাচ্ছি, যদিও তা হারিয়েছি বহুকাল আগেই।

বোর্ডিং স্কুলের রাতগুলো ছিল দীর্ঘ। দিনগুলো দীর্ঘতর। রাতের শেষ ঘণ্টা বাজার বেশ আগেই আমার পড়াশোনা শেষ হয়ে যেত। তাই একদিন স্কুলের লাইব্রেরিটি খুঁজে নিই। পেছনের উঠোনের কোনায় চরম অবহেলায় পড়ে থাকা ছোট্ট একটি কামরা। বইয়ের ওপর ধুলোর পুরু আবরণ। তাকগুলো খসে খসে পড়ছে। আমি ন্যাকড়া দিয়ে ধুলো মুছে, মিটমিটে প্রদীপের আলোয়, ভাঙাচোরা একটা চেয়ারে বসে বই পড়তাম।

বইয়ের প্রতি আমার ভালোবাসা জন্মে। কারণ, প্রতিটি বই থেকেই নতুন কিছু না কিছু জানতে পারতাম। এই যেমন ইরানি, তুর্কি ও আরবদের কথা, রাজা ও শাসকদের অপকর্মের কাহিনি, যুদ্ধ-বিগ্রহ ও সাধারণ মানুষের কথা, বিপ্লব ও বিপ্লবীদের জীবনগাথা। প্রেমের গল্প, কবিতাও। কিন্তু শাসকদের কাহিনি বেশি টানত।

এক শাসকের নাকি নারী-ভৃত্য ও রক্ষিতার সংখ্যা ছিল তার গোটা সেনাবাহিনীর সমান। আরেকজনের একমাত্র আগ্রহের বিষয় ছিল মদ, নারী আর দাস-দাসীদের চাবকানো। তৃতীয়জনের নারী আসক্তি তেমন ছিল না কিন্তু নেশা হলো যুদ্ধ, হত্যাকাণ্ড আর মানুষজনের ওপর বিকৃত অত্যাচার চালানো। আরেকজনের নেশা খাবারদাবার, টাকাপয়সা, আর সীমাহীন সম্পদের পাহাড় গড়া। আবার আরেকজন নিজের মাহাত্ম্যে এতটা আত্মমগ্ন থাকত যে, দুনিয়ার আর কাউকেই তার চোখে পড়ত না। এমন একজনও ছিল, যে ষড়যন্ত্র ও চক্রান্ত-তত্ত্বে এতটা বুঁদ হয়ে থাকত যে, তার পুরো শাসনামলটাই কাটে ইতিহাস-বিকৃতি করে করে প্রজাদের ধোঁকা দেওয়ার চেষ্টায়।

আবিষ্কার করি, এসব শাসকদের সবাই-পুরুষ। সবাই বিকৃত মানসিকতার। এবং সবার অপরিসীম লোভ-অর্থ, নারী ও সীমাহীন ক্ষমতার। এরাই দুনিয়াতে দুর্নীতির বীজ বোনে এবং জনগণকে লুটে খায় নিজেদের জোরালো কণ্ঠের মিষ্টি কথার জাদু আর বিষাক্ত তির দিয়ে। তাই সব গুমর ফাঁস হয় কেবল এদের মৃত্যুর পর। এবং এ কারণেই আমার ধারণা, নির্বোধ-একগুঁয়ের মতো ইতিহাস বারবার ফিরে ফিরে আসতে থাকে।

লাইব্রেরিতে খবরের কাগজ ও পত্রপত্রিকা নিয়মিত আসত। সেসব পড়া ও ছবিতে চোখ বোলানো আমার একরকম অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। ফলে প্রায়ই ছবিতে, শুক্রবারের জুম্মায় এসব শাসক গোত্রীয় কারও না কারও হাজির থাকার দৃশ্য চোখে পড়ত চোখের পাতা খুলছে আর বন্ধ করছে, পাতার ফাঁক দিয়ে গভীর-বিনম্র-আন্তরিক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বুঝতে পারতাম, জনগণকে যেভাবে ধোঁকা দেয়, আল্লাহকেও এরা একইভাবে বোকা বানাতে চাইছে। চারপাশ ঘিরে আছে অনুচরবর্গ। ইমামের প্রতিটি কথায় তারা ভক্তিভরে মাথা দোলাচ্ছে, চাপা ফ্যাস ফ্যাসে কণ্ঠে সর্বশক্তিমান আল্লাহ তালার নেকনজর ভিক্ষা করছে, সেই সঙ্গে হাত কচলাচ্ছে, চারপাশে নজর বোলাচ্ছে এবং আশপাশে ঘটে চলা সবকিছু মাপছে সতর্ক-অনিশ্চিত-চোরা চাহনিতে। সেই চাহনি-ছোঁ মারতে উদ্যত, আগ্রাসী, আবার একই সঙ্গে অদ্ভুত রকম সন্ত্রস্ত।

দেখতাম দুর্ভিক্ষে, মহামারিতে প্রাণ হারানো জনগণ কিংবা যুদ্ধে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনায় তাদের আকুল প্রার্থনা। দেখতাম, তাদের কপাল মাটি স্পর্শ করছে এবং নিতম্ব উঁচু হচ্ছে-চর্বি ও ভয়ে স্ফীত, স্থূল, গোল নিতম্ব। তাদের মুখে ‘দেশপ্রেম’ শব্দটা শুনলেই আমি ঠিক ঠিক টের পেতাম, তাদের অন্তরের অন্তস্তলের কোথাও বিন্দুমাত্র খোদা-ভীতি নেই এবং ভেতরে-ভেতরে তারা মনে করে, মাতৃভূমি রক্ষার মানেই হলো, জমিজমা-ধনীদের জমিজমা-রক্ষায় প্রজাদের বেঘোরে প্রাণ হারানো। প্রজারা যে ভূমিহীন, তা আমি জানতাম।

ইতিহাসের পাতায় পাতায় একই কাহিনি পড়তে পড়তে, একই ছবি, একই দৃশ্য দেখতে দেখতে একঘেয়েমিতে পেয়ে বসলে, নিচে গিয়ে খেলার মাঠে একা বসে থাকতাম। রাতগুলো বেশির ভাগ সময়ই থাকত অমাবস্যার মতো অন্ধকার, জোছনাহীন; চারদিক গভীর নিস্তব্ধতায় ডুবিয়ে, রাতের শেষ ঘণ্টাটি যেন বেজে গেছে বহু আগেই। চারপাশের জানালা একে একে বন্ধ হয়ে যেত, বাতিগুলো একে একে সব নিভে যেত, তবু সেই আঁধারে একা বসে থাকতাম, আর আকাশ-পাতাল ভাবতাম। আমার ভবিষ্যৎ কী? আমার কি বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হবে? চাচা আমাকে যেতে দেবেন?

এক রাতে, আমার এক শিক্ষক, সেখানে আমাকে দেখে ফেলেন। অন্ধকারে মানুষের মতো দেখতে অনড় এক অবয়ব দেখে, মুহূর্তের জন্য তিনি ভয় পেয়ে যান। কাছে আসার আগেই চিৎকার করে জানতে চান:

‘কে বসে আছে ওখানে?’

দুর্বল, ভীত কণ্ঠে জবাব দিই, ‘আমি, ফেরদৌস।’

কাছে এলে আমায় চিনতে পেরে তিনি অবাক হন। কারণ আমি তাঁর ক্লাসের সেরা ছাত্রীদের একজন, আর ভালো ছাত্রীরা তো রাতের ঘণ্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমাতে যায়।

বললাম, কিছুটা দুশ্চিন্তায় আছি, ঘুম আসছে না। শুনে তিনি পাশে এসে বসেন। তাঁর নাম ইকবাল। খাটো মতো, মাথাভর্তি ঝাঁকড়া লম্বা কালো চুল, কালো চোখ। অন্ধকারের ভেতরেও দিব্যি তাঁর চোখ দেখতে পাচ্ছিলাম, আমাকে মাপছেন। চোখ দুটো আমার ওপর এমনভাবে সেঁটে আছে, যেন আমার সব নড়াচড়াই সেই দৃষ্টির গোচরে। এমনকি দুই হাতে মুখ ঢাকলেও, আঙুল ভেদ করে আমাকে ঠিকই দেখে নিচ্ছেন।

হঠাৎ করেই আমি নিয়ন্ত্রণ হারাই। কান্নায় ভেঙে পড়ি। আমার হাতের আড়ালে, গাল বেয়ে অশ্রুধারা নামতে থাকে। তিনি আমার হাত দুটো স্পর্শ করেন এবং মুখের ওপর থেকে টেনে সরিয়ে দেন।

তাঁকে বলতে শুনি, ‘ফেরদৌস, ফেরদৌস, কাঁদে না।’

‘একটু কাঁদতে দিন।’

‘আগে তো কখনো তোমায় কাঁদতে দেখিনি। কী হলো?’

‘কিছু হয়নি, কিচ্ছু না।’

‘হতেই পারে না। কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে।’

‘না। আসলেই কিছু হয়নি, মিস ইকবাল।’

‘তাহলে বুঝি কোনো কারণ ছাড়াই কাঁদছ?’ তাঁর কণ্ঠে খানিকটা বিস্ময়।

‘কারণটা কী নিজেই বুঝতে পারছি না। নতুন করে কিছু তো আর আমার সঙ্গে হয়নি।’

তিনি চুপচাপ আমার পাশে বসে রইলেন। তাঁর কালো চোখের দৃষ্টি রাতের আঁধারে ঘুরপাক খাচ্ছিল, আর চোখের কোলে জমে ওঠা কান্না চিকচিক করছিল। তিনি ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরেন, সশব্দে ঢোক গেলেন এবং হঠাৎ করেই তাঁর চোখের দ্যুতি নিভে যায়। ক্ষণে ক্ষণে তা ফের জ্বলে ওঠে, আবার পরমুহূর্তেই নিভে যায়। রাতের আঁধারে দুটো মশাল যেন বারবার জ্বলছে আর নিভছে। একটা সময় আসে, যখন ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরা, আর সশব্দে ঢোক গেলায়ও কাজ হয় না, দুই ফোঁটা অশ্রু ঠিকই চোখে রয়ে যায়। অশ্রুবিন্দু দুটো তাঁর নাকে এসে পড়ে, দুই পাশ বেয়ে নামতে থাকে। তিনি এক হাতে মুখ ঢেকে, অন্য হাতে রুমাল বের করে নাক ঝাড়েন।

জিজ্ঞেস করি, ‘আপনি কাঁদছেন, মিস ইকবাল?’

‘না’ বলে তিনি রুমালটা লুকিয়ে, সশব্দে একটি ঢোক গিলে, আমার দিকে হেসে তাকান।

আমাদের ঘিরে থাকা রাতটি স্থির, গভীর, নিস্তব্ধ-কোথাও কোনো শব্দ বা নড়াচড়ার আভাসমাত্র নেই। সবকিছু গাঢ় অন্ধকারের চাদরে ঢাকা, কোনো আলোকরশ্মি তা ভেদ করে আসছে না। কারণ আকাশে সূর্য নেই, নেই চাঁদও। আমরা দুজন মুখোমুখি। তাঁর চোখের দিকে তাকাই। দেখি-নিকষ কালো দুটো বৃত্ত ঘিরে ধবধবে সাদা দুটো চক্র আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়, কালো বৃত্ত দুটো যেন আরও ঘন কালো, আর সাদা চক্র দুটো শুভ্র থেকে শুভ্রতর হচ্ছে। মর্ত্য তখন রাতের চাদরে ঢাকা এবং স্বর্গেও নেই কোনো আলো দেওয়ার মতো চাঁদ বা সূর্য। তবুও স্বর্গেরও না, মর্ত্যেরও না-এমন অজানা জাদুকরি কোনো উৎস থেকে উৎসারিত আলো যেন সেই চোখের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

তাঁর চোখে চোখ রেখে, হাত দুটো নিজের হাতে টেনে নিলাম। সেই স্পর্শের অনুভূতি-অদ্ভুত, আকস্মিক। তা আমার শরীরজুড়ে গভীর ও দূরাগত এক সুখের কাঁপুনি ধরিয়ে দেয় আমার আজীবন স্মরণের সীমারেখার চেয়েও দূরাগত, জীবনভর বয়ে বেড়ানো সচেতন বোধের সীমানা ছাড়িয়েও গভীর। আমি সেটি নিজ শরীরের এমন কোনো বিন্দুতে অনুভব করছিলাম, যা নিয়ে আমি জন্মেছি ঠিকই কিন্তু বেড়ে উঠতে পারিনি। যেন আমার সত্তারই এমন একটি অংশ, যা কোনো এককালের চেনা কিন্তু জন্মাবধি বিস্মৃত। যেন কোনো একটা কিছুর ধোঁয়াটে-সচেতন বোধ, যা আমার জীবনে ধরা দিতে পারলেও, কখনো ধরা দেয়নি।

ওই মুহূর্তে একটি স্মৃতি মনে পড়ে। ঠোঁট দুটো কেঁপে ওঠে কিন্তু মুখে কথা সরে না, যেন মনে পড়তে না পড়তেই তা আবার বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে গেছে। আমার হৃৎস্পন্দন এলোমেলো হয়ে যায়, তোলপাড় শুরু হয় এই ভয়ে যে, দুষ্প্রাপ্য কোনো সম্পদ যেন হারাতে যাচ্ছি কিংবা মাত্রই চিরতরে হারিয়ে বসে আছি। তাঁর হাত দুটো এমন প্রবলভাবে আঁকড়ে ধরে থাকি, দুনিয়ার কোনো শক্তি নেই তাঁকে আমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে। (চলবে)

ধারাবাহিক এ উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন