বৃষ্টিভেজা শেষ প্রহর

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

নিজের নতুন ঘরের বিছানায় চুপচাপ বসে আছে সোহা। মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে তার বিয়ে হয়েছে। অথচ এ নিয়ে তার শরীর বা মনে কোনো উত্তেজনা নেই। আঠারো বছর আগের সেই ঘটনাটা একটু পরপর চোখের সামনে ভেসে উঠছে।

সেই ঘটনাটা ছোট্ট সোহার মনে এত তীব্র ভীতির জন্ম দিয়েছিল যে আজ এই পঁচিশ বছরের সোহা এখনো কোনো পুরুষকে ভালো ভাবতে পারে না। কোনো ছেলে তার আশপাশে এলে তার গা ঘিনঘিন করে। তাদের নোংরা মনে হয়। কদিন আগে পর্যন্ত সোহা ভাবতেও পারেনি, সে কোনো ছেলের সঙ্গে থাকতে পারবে।

কিন্তু মায়ের একান্ত মিনতিতে বাধ্য হয়ে তাকে এই বিয়েটা করতে হয়েছে। মা কাঁদতে কাঁদতে বলেছিলেন, সব পুরুষ মানুষকে এক দাঁড়িপাল্লায় বসিয়ে বিচার করা ঠিক না মা। আমার ওপর ভরসা রাখ। যার সঙ্গে বিয়ে দিচ্ছি সে তোকে কখনো অসম্মান করবে না। তোর মনের ভুল ধারণাগুলো ভেঙে দেবে। নিজের জীবনকে একটা সুযোগ দে। কী বা এমন হয়েছে তোর সঙ্গে? কত মেয়ে কত খারাপ পরিস্থিতির শিকার হয়। আল্লাহ তো আমাদের ওপর অনেক মেহেরবান ছিলেন যে তোর কোনো বড় সর্বনাশ হয়নি। যেটা হয়েছিল সেটা কিছুই না মা। তুই ভুলে যা ওটা। এসব মনে পুষে রেখে কষ্ট পাস না। তোর কাছে আমি আর কিছু চাই না। শুধু আমার প্রতি এটুকু বিশ্বাস রেখে এই বিয়েটা করে ফেল মা। বয়স পেরিয়ে গেলে এ রকম ছেলে আর পাব না। বাপ মরা মেয়েকে সেধে এরপর কেউ বিয়ে করতে আসবে নারে। আমাদের সমাজটা বড্ড খারাপ। তোর যোগ্যতা কেউ দেখবে না। সবাই আইবুড়োই বলবে। সারা জীবন একা তোকে মানুষ করেছি। এখন আর আমার সেই শক্তি নেই যে আমি আর কষ্ট নিতে পারব। আমার প্রতি এটুকু দয়া কি তোর হবে না?

এরপর আর সোহা কিছু বলতে পারেনি। সত্যি তো মা সারা জীবন অনেক কষ্ট করেছেন। অনেক সংগ্রাম করেছেন। এখন যদি একটু শান্তি পেতে চান, মাকে তো দোষ দেওয়া যায় না। নিজের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাই সোহা এই বিয়েতে মত দিয়েছে।

এখন পর্যন্ত ছেলেটার চেহারা দেখেনি সোহা। তার বিন্দুমাত্র আগ্রহও হয়নি। শুনেছে এই ছেলে নাকি ভার্সিটি লাইফ থেকে তাকে পছন্দ করে। ওর দুই বছরের সিনিয়র। মায়ের কাছে অনেকবার এসেছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। ফ্যামিলি খুব ভালো। ছেলেও ভালো চাকরি করে। মা সব দেখেশুনে কথা বলে খুব পছন্দ করেছেন। তারাও এসেছিল মেয়েকে আংটি পরাতে।

তখনো সোহা চোখ তুলে তাকায়নি। তার সারাক্ষণই ভয় লেগেছে তাকালেই যদি ওই নোংরা লোকটার মতো বড় বড় চোখ দিয়ে গিলে ফেলা টাইপ কারও মুখ দেখতে হয়। ওই চাহনি সে কিছুতেই ভুলতে পারে না। আজ বসে বসে সে এটাই ভাবছিল। যতক্ষণ না মন থেকে সত্যিকার সাহস অর্জন করতে পারবে ততক্ষণ সে তাকাবে না। আর হাতজোড় করে ছেলেটিকে, যে কিনা এখন তার স্বামী, তাকে অনুরোধ করবে, সোহাকে কিছুটা সময় দেওয়ার জন্য। দরকার হলে কারণটা পুরোটাই সে খুলে বলবে। নতুন জীবন যখন শুরু করতেই হচ্ছে তখন মিথ্যা বলে বা কিছু লুকিয়ে কেন? সত্যি কথা দিয়েই শুরু হোক।

সাত বছর বয়সের সোহার ঠোঁট দুটোতে যে বাজে লোকটা আঘাত করে সোহার মনে একটা ক্ষত তৈরি করেছিল, তাকে সোহা কাকু বলে ডেকেছিল। সোহার বাবা ছিল না। তাই বাবার বয়সী সব পুরুষের মধ্যে বাবার ছায়া খোঁজার চেষ্টা করত সে। বাড়িওয়ালা কাকু ওকে কোলে নিয়ে গালে পিঠে কোমরে হাত বোলাতেন। সোহা ভাবত আর সবার মতো এই কাকুও বুঝি তার বাবা নেই জেনে তাকে বেশি বেশি করে স্নেহ করছেন। কাকুর দুই মেয়ে ওর ভীষণ বন্ধু ছিল। আর কাকিমাও খুব আদর করেন। আর সব দিনের মতো সেদিনও গিয়েছিল খেলতে। গিয়ে শুনল ওরা ওদের মামার সঙ্গে মার্কেটে গেছে।

কাকিমা বললেন, ওরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে যাবে, তুই বস। গরম-গরম পিঠা ভাজছি, খেয়ে যা। সোহা ঘাড় নেড়ে আচ্ছা বলে রিদাদের রুমে গিয়ে বসল। তখনই কাকু ভেতরে এসে ঢুকলেন। কী হে পরি, খিদে লেগেছে নাকি খুব? বলতে বলতে বিশ্রীভাবে হেসে উঠলেন। তারপর সোহার গাল দুটি টিপে দিলেন। এত জোরে যে সোহা ব্যথা পেয়ে উফ করে উঠল। অস্পষ্টভাবে কোনো রকমে ঘাড় নেড়ে বলল, না, খিদে পায়নি। আমি রিদা–রিফার জন্য অপেক্ষা করছি। কাকিমা এখানে বসতে বললেন।

ওহ, তাই নাকি? তা বেশ। এসো, তাহলে আজ তোমাকে একটু বেশি আদর করে দিই বলে, আচমকা ওর চুলের মুঠি শক্ত করে ধরে ওর ঠোঁট দুটো নিজের হিংস্র ঠোঁটের মধ্যে পুরে ফেলল লোকটা। অসহ্য যন্ত্রণায় সোহা চিৎকার করতে চাইল। পারল না। সোহা বুঝতে পারল, ওর ঠোঁট কেটে রক্ত বেরোচ্ছে। ভীষণ জ্বালা করছে সেখানে। লোকটাকে হাত দিয়ে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চেষ্টা করল। কিন্তু শক্তিতে পেরে উঠল না। এমনভাবে ওকে আটকে ফেলেছে যে কিছুতেই নিজেকে ছাড়াতে পারছে না সোহা। ওর পা দুটি ধরে ওকে জোর করে বিছানায় শুইয়ে দিতে চাইছে লোকটা।

সোহা কিছুই বুঝতে পারছে না। মানুষটা এমন কেন করছে? সোহা কাঁদতে কাঁদতে বলল, কাকু ছেড়ে দাও...আমি মার কাছে যাব। লোকটা আরও একবার হো হো করে হেসে বলল, যাবে যাবে, এত মিষ্টি মেয়ে তুমি, একটু আদর করতে দেবে না আমাকে।

সোহা কোনো উত্তর দেওয়ার আগে একটি পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল। কোনো রকমে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে সে দেখতে পেল হাতে খাবারের প্লেট নিয়ে বিস্ফোরিত চোখে কাকিমা দাঁড়িয়ে আছেন। কাকিমাকে দেখে লোকটা লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর কিছু না বলে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

সোহা কাঁদতে কাঁদতে কাকিমা বলে ডেকে উঠল। কাকিমা জবাব দিলেন না। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলেন, ঠায় দাঁড়িয়ে রইলেন। সোহা আবার ডেকে উঠল কাকিমা, ও কাকিমা, ‘আমি মায়ের কাছে যাব।’

সোহা দেখল, কাকিমার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। সে এবার বলে উঠল, কাকিমা, কাকু খুব খারাপ। উনি থাকলে তোমাদের এই বাসায় আমি আর কোনো দিন আসব না। দেখ, আমার ঠোঁট কেমন করে কামড়ে দিয়েছে। ভীষণ জ্বালা করছে। আমার হাত দুটো এমনভাবে চেপে ধরেছে যে হাতগুলো মনে হয় ভেঙে গেছে। একটু ধরো না আমায়। আমি মায়ের কাছে যাব তো!

কাকিমা আর পারলেন না, দৌড়ে এসে সোহাকে জড়িয়ে ধরলেন।

---

লেখিকা
লেখিকা

খুট করে দরজার শব্দ হলো। সোহার চিন্তায় ছেদ পড়ল। অতীতে হারিয়ে যাওয়া সোহা বর্তমানে ফিরে এল। বুঝল তার স্বামী রুমে ঢুকেছে। অদ্ভুত এক ভয়ে তার বুকের ভেতর ঢেঁকির পাড়ের মতো শব্দ হওয়া শুরু করল। অনেক কষ্টে সোহা নিজেকে সংযত করার চেষ্টা করল। মনে মনে যখন গুছিয়ে এনেছে কীভাবে কথা শুরু করবে, ঠিক তখনই মানুষটা বলে উঠল, এসির মধ্যেও এত ঘামছ কেন সোহা? তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে?

কণ্ঠস্বরে উদ্‌গ্রীব ভাব স্পষ্ট। সোহা ওই কোমল গলা শুনে মনে মনে যা ঠিক করে রেখেছিল সব ভুলে গিয়ে কোনো রকমে মাথা নেড়ে জানাল সে ঠিক আছে।

তার স্বামী এবার বলে উঠল, তোমাকে দেখে খুব ক্লান্ত লাগছে। তুমি একটু রিলাক্স করো বরং। ফ্রেশ হয়ে এসো...এটা তোমার নিজের ঘর। অস্বস্তির কিছু নেই।

: না, আসলে আমার আপনাকে কিছু কথা বলার ছিল...।

: অবশ্যই বলবে। সারা জীবন তো রয়েই গেল কথা বলার জন্য। আজ না হয় তুমি আরাম করো। আমি তো আছিই কথা শোনার জন্য। আর হ্যাঁ, আমি তন্ময়। আমাকে এই নামটা ধরে ডাকতে পারো। নামটা পুরোনো, কিন্তু খুব খারাপ না।

বলেই ছেলেটি হেসে উঠল। কী আশ্চর্য! কোনো এক অজানা কারণে হাসিটা শুনতে তার ভালো লাগছে। কিছু কিছু হাসির শব্দ এমন হয় যা মানুষের ক্লান্তি দূর করে মনটাকে হালকা করে দেয়। তন্ময়ের হাসিটা ঠিক তেমন। মানুষটাকে পুরোপুরি না দেখে, না চিনে, না জেনেও সেই মুহূর্তে সোহার মনে হলো, এই মানুষটা হাসি দিয়ে যেকোনো দূরত্ব মিটিয়ে দিতে পারে। অস্বস্তি কাটিয়ে নিতে পারে।

: কী হলো, উঠবে না? আমার বকবক শুনে রাগ হচ্ছে না তো? প্লিজ, রাগ কোরো না। একটা সত্যি কথা বলি? আমি কিন্তু ভীষণ নার্ভাস, তাই বকবক করে নার্ভাসনেস কাটাতে চাইছি। তুমি যে সত্যি আমাকে বিয়ে করেছ এখনো ঠিকমতো বিশ্বাসই হচ্ছে না। গত পাঁচ বছরে যে তুমি একবার আমার দিকে ফিরেও তাকাওনি, সেই তুমি আজ আমার স্ত্রী। ব্যাপারটা স্বপ্নের মতো লাগছে।

: আমি তাকাইনি কেন সেই কারণটাই বলতে চাই। কথাটা খুব জরুরি। আমি মনে করি প্রথমেই সেটা বলে নেওয়া দরকার।

: কারণ তোমাকে বলতে হবে না, আমি জানি। মা বলেছেন।

সোহা এবার ভয়ংকরভাবে চমকে গেল। কোনোমতে বলল, মা বলেছেন!

: হ্যাঁ, অনেক দিন আগেই বলেছেন। তোমার মনে যে ছোটবেলা থেকে একটা ভয় ঢুকে গেছে পুরুষ মানুষের প্রতি, একজন মানুষের অন্যায় অশ্লীল কর্মের দায় তুমি এত দিন ধরে বয়ে বেড়াচ্ছ, একজন বিকৃত রুচির পুরুষের নোংরা আচরণের জন্য তুমি আর কোনো ছেলেকে বিশ্বাস করতে পারো না, চোখ তুলে কারও দিকে তাকাতেই সাহস পাও না, এর সবটাই আমার জানা সোহা।

: সব জেনেও আপনি?

: আমি কী? মহত্ত্ব দেখাতে চাইছি? তাই বলবে তো? নাহ, মহত্ত্ব কেন দেখাব বল? ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পেতে চাওয়াকে কি মহত্ত্ব বলে? বলে না। হ্যাঁ, স্বার্থপর বলতে পারো আমাকে। কারণ, তুমি বিয়ে করতে চাও না জেনেও আমি তোমাকে বিয়ে করতে চেয়েছি। বারবার তোমার কাছে ছুটে গেছি। জোর করে তোমার মায়ের কাছে নিজেকে, নিজের ভালোবাসাকে প্রমাণ করতে চেয়েছি।

: কিন্তু আমি আপনাকে আপনার সেই ভালোবাসা ফেরত দিতে পারব কি না, আমি সত্যিই জানি না। এটা জেনেও কেন আপনি আমাকে বিয়ে করলেন?

: আমি কি একবারও বলেছি আমি আমার ভালোবাসা ফেরত চাই? তুমি আমার সঙ্গে আছ, আমার পাশে আছ এটুকুই আমার জন্য যথেষ্ট।

: এখন আপনার এ রকম মনে হচ্ছে। কিন্তু একসময় আমাকে আপনার অসহ্য লাগতে শুরু করবে। আমাকে মানসিক রোগী মনে হবে...চরম বিরক্তি নিয়ে আপনি আমার দিকে তাকাবেন।

তন্ময় এবার হো হো করে হেসে উঠল। হাসতে হাসতেই বলল, আচ্ছা, সেটা না হয় আমার ওপরেই ছেড়ে দাও। পরে কী হবে তার জন্য বর্তমানটা খারাপ করার কোনো মানে আছে? আমি কিন্তু আগেই স্বীকার করে নিয়েছি আমি ভীষণ স্বার্থপর ছেলে। এত সাধনা করে তোমাকে বউ বানিয়েছি, আমাকে এখন প্রাণ ভরে একটু এই খুশিটা অনুভব করতে দাও। ভবিষ্যৎ যেটা কখনোই দেখা যায় না, যেটা কী হবে কেউ জানে না, সেটার কথা ভেবে কেন এখন কষ্ট পেতে চাও বলো তো? আর কী জানি বললে? মানসিক রোগী! তুমি যদি মানসিক রোগী হও তাহলে আমি আরও বড় মানসিক রোগী। তুমি যেমন তোমার ভয়ের কাছে বারবার আত্মসমর্পণ করে যাচ্ছ, আমিও তেমনি আমার ভালোবাসার কাছে হেরে যাচ্ছি। কোনটার যে শক্তি বেশি বুঝে উঠতে পারি না। মাঝেমধ্যে মনে হয় আমাদের মধ্যে একটা অলিখিত কম্পিটিশন চলছে। চলো দেখি শেষ পর্যন্ত কোনটা জেতে। তোমার ভয় না আমার ভালোবাসা!

দুই.

সোহা তন্ময়ের দাম্পত্য জীবনের কাল ছয় মাস পুরা হবে। সোহার মা সেই উপলক্ষে আগামীকাল দুজনকে তার বাড়িতে দাওয়াত দিয়েছেন। সোহা তন্ময়কে অফিসে ফোন করে মায়ের দাওয়াতের কথা জানিয়ে জিজ্ঞেস করল, কালকে তন্ময় নিজের অফিস থেকে একটু তাড়াতাড়ি বের হয়ে সোহাকে সোহার অফিস থেকে পিক করতে পারবে কি না। দুজন একসঙ্গে গেলে মায়ের ভালো লাগবে।

উত্তরে তন্ময় একটু দ্বিধার সঙ্গে বলল, দেখি। একটু ব্যস্ত আছি, পরে জানাচ্ছি তোমাকে।

সোহা প্রচণ্ড অবাক হলো। এই কয়েক মাসে তন্ময়কে সে যতটা চিনেছে তাতে এত সামান্য ব্যাপারে চিন্তা বা দ্বিধা করার মতো ছেলে সে নয়। তার চেয়েও বড় কথা, সোহা একটা কথা বলবে আর সেটা তন্ময় সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেবে না এটাও কখনো হয়নি। মনের কাছে কিছুই অগোচরে নেই। সোহা বুঝতে পারে একটু একটু করে সে তন্ময়কে নিজের করে ভাবতে শুরু করেছে। তন্ময় আশপাশে না থাকলে ওর জন্য অস্থির লাগে। সকালে উঠে তন্ময়ের গলা না শুনলে সারা দিন মন খারাপ লাগে। কথা বলতে বলতে তন্ময় যখন সজোরে হেসে ওঠে, সোহার হৃৎস্পন্দন বেড়ে যায়। এই কয়েক মাসে খুব স্পষ্টভাবে ওর চোখে চোখ রাখা হয়নি ঠিকই, কিন্তু তাকাব না তাকাব না করেও কতবার ওর দিকে তাকানো হয়ে যায়। হ্যাঁ, এটা ঠিক যে মুহূর্তেই সোহা চোখ নামিয়ে নেয়। সাহস করে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারে না। তবু ওর মনে হয় তন্ময়ের চোখে–মুখে কোনো অসততা নেই, সে সত্যিই সোহাকে ভালোবাসে। এই কয়েক মাসে একজন সত্যিকার সঙ্গীর মতো সোহার পাশে সে থেকেছে।

বিয়ের পরদিন সকালে তন্ময় খুব গম্ভীর হয়ে সোহাকে বলেছিল শোনো সোহা, এত দিন তুমি একা একা একটা বিশ্রী স্মৃতির সঙ্গে লড়ে এসেছ। এখন আমি তোমার সঙ্গে আছি। আমরা দুজন মিলে তোমার মন থেকে ওই অপ্রিয় স্মৃতিটা মুছতে চেষ্টা করব। একজন পুরুষ মানে মেয়েদের প্রতি তার শুধুই শারীরিক আকর্ষণ বা নোংরা দৃষ্টি, তোমার এই ভ্রান্ত ধারণা কাটাতে আমার পক্ষে যতখানি সম্ভব আমি করব। তুমি যত দিন সময় চাও, নাও। আমি কোনো দিন নিজে থেকে তোমার কাছে আসব না। জোর করে কোনো অধিকার ফলাব না। সেটা তুমি নিশ্চিন্তে থাকতে পারো। ভেব না আমি কোনো সন্ন্যাসী। তোমার মতো এত অসম্ভব সুন্দর একটা মেয়ের পাশে নিজেকে সাধু বানানোর কোনো শখ আমার নেই। তবু আমি নিজেকে সংযত করব, কারণ এখানে প্রশ্ন ভালোবাসার। শরীর অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু সেই চাহিদা কখনোই ভালোবাসার চেয়ে বড় নয়। এটাই শুধু আমি তোমাকে জানাতে চাই।

তন্ময় তার কথা রেখেছে। গত ছয় মাসে একটিবার, একটি মুহূর্তের জন্যও সে সোহার ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করেনি। অথচ একই বাড়িতে এত কাছাকাছি তারা থাকে। উচ্ছল হাসিখুশি প্রাণখোলা মেজাজের তন্ময়কে যে সোহার কবে এত ভালো লেগে গেল সোহা নিজেও টের পায়নি। এক অদম্য আকর্ষণ আর এক অজানা মায়ায় তন্ময় তাকে বেঁধে ফেলেছে। ইদানীং তন্ময় কাছাকাছি এলেই ওকে ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। শরীরের মধ্যে এক অদ্ভুত শিহরণ খেলা করে।

কী নাম এর? সোহা জানে না। কিংবা জেনেও হয়তো না জানার অভিনয় করে। বন্ধুর মতো যেভাবে আছে। বেশ তো কেটে যাচ্ছে জীবন। যে ভালোবাসে বলে দাবি করে সেই যখন এ রকম নির্লিপ্ত হয়ে দিব্যি আরামে আছে। সোহা কেন অন্য কিছু ভাবতে যাবে তাহলে? এক অজানা অভিমান ইদানীং প্রায়ই সোহার মনের জগতে গোলমাল করছে। এর মধ্যে আজকে তন্ময়ের এই অদ্ভুত আচরণ সোহার মনে আরেক আশঙ্কার জন্ম দিল। তবে কি সোহা প্রথমে যা ভেবে রেখেছিল তাই হলো শেষ পর্যন্ত? তন্ময় কী ধৈর্য হারিয়ে ওর প্রতি বিরক্ত হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে? ওকে কি আর তন্ময়ের ভালো লাগছে না? তন্ময়ের ফিলিংস কি শুধুই মোহ ছিল তাহলে? এই কয় মাস এক ছাদের নিচে থেকে তা কেটে গেছে?

এই যদি হওয়ার ছিল তাহলে কেন খামোখা মিথ্যা মায়ায় জড়াল! বিশ্বাসটা জাগাল বুঝি চিরতরে ভেঙে দেওয়ার জন্যই। কেন এমন হলো? কেন? মনের মধ্যের অব্যক্ত যন্ত্রণাগুলো এই কেনর মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকল আর সোহাকে ভেতরে-ভেতরে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতে লাগল। জীবনে কত দুঃখের সময় এসেছে কিন্তু আজকের মতো এ রকম অসহ্য কষ্টের মধ্যে দিয়ে মনে হয় সোহা কোনো দিন যায়নি।

অনেক রাতে যখন তন্ময় বাড়ি ফিরল, দেখল সোহা বাতি নিভিয়ে মাটিতে বসে আছে। বাইরে তখন ঝুমবৃষ্টি। তাড়াতাড়ি বাতি জ্বালিয়ে সোহার কাছে বসে জিজ্ঞেস করল কী হয়েছে সোহা? শরীর ঠিক আছে তো? এভাবে অন্ধকারে বসে আছ কেন?

সোহা যেভাবে বসেছিল সেভাবেই বসে রইল। শুধু একবার অপ্রকৃতিস্থের মতো তন্ময়ের দিকে তাকাল শুধু। সেই দৃষ্টিতে কোনো প্রাণ ছিল না। সোহাকে এ রকম দেখে তন্ময় অস্থির হয়ে এবার সোহার কনুই দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে বলে উঠল, কী হয়েছে সোহা? কী হয়েছে? প্লিজ, আমাকে বলো, এমন করছ কেন? কী হয়েছে?

সোহা এবার অস্পষ্ট স্বরে আস্তে আস্তে বলল, শেষ হয়ে গেল সব, তা–ই না? মন উঠে গেছে? আর পারছ না পরীক্ষা দিতে। বিরক্ত হয়ে গেছ, ছেড়ে দিতে চাইছ।

: কী বলছ? কিসের পরীক্ষা? কে কী ছেড়ে যাচ্ছে? কী হলো তোমার?

: আমার না, তোমার। সব তো তোমারই করা...পুরো ঘটনা তুমি সাজিয়েছ। তুমি খেলেছ। খেলতে খেলতে আগ্রহ হারিয়ে গেছে। এখন খেলনাতে বিরক্তি এসে গেছে।

এই প্রথম সোহা তন্ময়কে তুমি করে বলল। সে নিজেই সেটা টের পেল না। এই মুহূর্তে সে আলো–অন্ধকারের এক আশ্চর্য জগতে আছে।

তুমি সম্বোধন শুনে তন্ময়ের হৃৎপিণ্ডটা খুব জোরে লাফিয়ে উঠেছিল। উত্তেজিত হয়ে সোহার কাঁধে হাত রেখে আবার প্রশ্ন করে উঠল, আমাকে বলছ সোহা? আমি তো কারও সঙ্গে কোনো খেলা খেলিনি। আজকে কী হয়েছে তোমার?

: খেলেছ তো...আমাকে বলেছিলে আমাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে। কে জেতে তুমি দেখতে চাও...দেখা হয়ে গেছে তো? জিতে গেছ তুমি। আমি হেরে গেছি। খুব খুশি না? খেলা শেষ, জেতা শেষ...তাই এখন অন্য কিছু নিয়ে ব্যস্ত।

: ব্যস্ত? ওহ, দুপুরের কথা বলছ? ওটা তো অফিসে বিরাট একটা ঝামেলা হয়েছে, সে জন্য খুব বিরক্ত ছিলাম। বস সামনে বসেছিল তাই ওভাবে ফোন রেখে দিতে হলো। সারাটা দিন যা ঘটে গেল অফিসে। এই গ্যাঞ্জামটার জন্যই তো ফিরতে এত রাত হলো। না হলে এত দেরি আমার কখনো হয়? বের হয়েই তোমাকে কল দিতাম, কিন্তু দেখলাম অনেক দেরি হয়ে গেছে। তুমি ঘুমাচ্ছ ভেবে আর ডিস্টার্ব করতে ইচ্ছা করল না।

: না–না, তুমি না, আমি তোমাকে ডিস্টার্ব করছি। আমি সবাইকে ডিস্টার্ব করি। আমার জীবনটাই এ রকম উল্টাপাল্টা। আমার সঙ্গে থাকলে তোমার সবকিছু খারাপ হবে। আরও ঝামেলা হবে। তুমি আরও বেশি বিরক্ত হবে...।

বাড়ি এসে সোহাকে এ রকম অবস্থায় অনেক বেশি অস্থির হয়ে গিয়েছিল দেখে সোহার সবগুলো কথার অর্থ তন্ময় বুঝে উঠতে পারেনি। তাই পাগলের মতো বারবার জানতে চাইছিল কী হয়েছে। সোহার শেষ কথাগুলো শুনে হঠাৎ করেই পুরো ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়ে গেল তন্ময়ের কাছে। বুঝল সোহা একটা ঘোরের মধ্যে আছে। ভালোবাসার যে মায়াজালে সে সোহাকে বাঁধতে চেয়েছিল, সেটাতে সোহা বাধা পড়েছে। কিন্তু সেটা নিজেই বিশ্বাস করতে পারছে না। সে কারণেই আজ সামান্য একটু দূরত্বের আশঙ্কায় এতটা অসহায় আর বিচলিত হয়ে পড়েছে। তন্ময় সোহার এত কাছে ওর কাঁধে হাত রেখে বসে আছে অথচ সোহা ওর হাত সরিয়ে নিচ্ছে না। ওকে তুমি করে ডাকছে। কিন্তু সেটা সোহা নিজেও টের পাচ্ছে না। নিজ মুখে স্বীকার করছে ও হেরে গেছে। অথচ জয়টা যে ভালোবাসার হয়েছে সেটা বুঝতে পারছে না।

তন্ময় আবার সোহাকে ঝাঁকি দিতে চেষ্টা করল। গাঢ় স্বরে বলল, সোহা, তুমি হারোনি। আমরা দুজনই জিতে গেছি। তোমার মধ্যে এখন আর কোনো অতীতের দুঃস্বপ্ন নেই, কষ্ট নেই, বাজে স্মৃতি কিছুই অবশিষ্ট নেই। তোমার সুখ–দুঃখ, কান্না, অভিমান, ভয় সবকিছু এখন তোমার ভালোবাসাকে ঘিরে। বুঝতে পারছ তুমি? আমাদের ভালোবাসার জয় হয়েছে সোহা। আমরা জিতে গেছি।

এবার সোহার সংবিৎ ফিরে এল যেন...রুদ্ধকণ্ঠে বলে উঠল, সত্যি বলছ? আমরা দুজনই জিতে গেছি?

ভালোবাসার বিশেষ মুহূর্তগুলোর আলাদা একটা আবেদন থাকে, ভাষা থাকে।। তারা মানুষকে দিয়ে এমন অনেক কিছু করিয়ে নেয়, বলিয়ে নেয় যার জন্য মানুষ নিজেও হয়তো প্রস্তুত থাকে না। আজ হয়তো সেই বিশেষ মুহূর্তেই তন্ময়কে সোহার ভালোবাসার আরাধ্য বানিয়ে দিল। আর তাই তন্ময় সোহার একদম কাছ ঘেঁষে বসে সোহার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, চোখটা মুছে একবার আমার চোখের দিকে তাকাও। আমি জানি, আজ তুমি শুধু আমাকেই দেখবে, তোমার ভয়কে না।

সোহা তাকাল। তন্ময় ঠিকই বলেছে। আজ আর সোহার অতীতের কিছু মনে পড়ল না। সে মুগ্ধ হয়ে শুধু তন্ময়ের দিকেই তাকিয়ে রইল। এত ভালোবাসা কী করে কারও চোখে থাকতে পারে! সে হাত বাড়িয়ে তন্ময়কে স্পর্শ করল। তন্ময় আস্তে করে সোহাকে নিজের কাছে টেনে নিল। সোহার নিশ্বাস ভারী হয়ে এসেছিল, তার তৃষ্ণার্ত ঠোঁট প্রেম চাইল। তন্ময় গভীর ভালোবাসায় সেখানে ঠোঁট রাখল।

অনেক বছর আগে একজন বিকৃত মনের মানুষ এই নিষ্পাপ ঠোঁট দুটোতে আঘাত করে একটি বালিকার মনের দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল। আর আজ একজন সত্যিকার প্রেমিক পুরুষ তার হৃদয়ের সবটুকু আবেগ ও প্রেম দিয়ে দিয়ে ওই ঠোঁট দুটোতে নিজের ভালোবাসা এঁকে একটি নারীর হৃদয়ে চিরতরে জায়গা করে নিল।
–––

সারা বুশরা দ্যুতি: বেডফোর্ড, ইংল্যান্ড।