ঝরা পাতার ভালোবাসা-দুই

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সময় গড়িয়ে যায়। ছায়ার চুলে পাক ধরেছে। শরীরের চামড়া ঢিলে হয়ে এসেছে। চোখে চশমা লেগেছে। মোটা ফ্রেমের চশমা। নিনিদ কলেজ শেষ করে এখন পরিণত যুবক। নাকের নিচে কালো কালো গোঁফ আর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি গজিয়েছে।

ছায়ার জীবনের একমাত্র সম্পদ বলতে এখন নিনিদ। ছায়া নিনিদকে ব্যারিস্টার বানাবে। নিনিদ ব্যারিস্টারি পাস করে এ দেশের জন্য কিছু একটা করবে। যে দেশ, যে মাটি ওকে এত কিছু দিয়েছে। সে মাটি ও মানুষের কাছে নিনিদের অনেক ঋণ। এ ঋণ শোধ করতে হবে। ছায়া সেভাবেই মানুষ করিয়েছে ওকে। দুঃখী দুঃখের সঙ্গী হতে। হাত বাড়িয়ে দিতে অসহায় মানুষের দিকে।

ছায়া অনেক ধনসম্পদের মালিক হলেও নিনিদকে বড় করেছে জীবনের বাস্তবতায়। অনেক ধনসম্পদ থাকলেও কষ্ট দিয়ে বড় করেছে নিনিদকে। জীবনের মূল্য বুঝতে। নিনিদও শিখেছে কষ্ট করে বড় হতে। যাতে মাটি ও মানুষের সঙ্গে একটা সম্পর্ক থাকে।

কলেজ শেষ করে এদিক-ওদিক ব্যস্ত হওয়ার আগে ছায়া খবর নেয় কীভাবে ব্যারিস্টারি পড়তে পারবে নিনিদ। প্রথমে লতে অনার্স পড়তে হবে। তারপর এলএলএম করে বিপিটিসি করতে হবে। এ সবই লন্ডনে করাতে চাচ্ছে। এখন যে কাজ তা হলো আইইএলটিএস করতে হবে। ব্রিটিশ কাউন্সিল ভালো বলে নিনিদকে সেখানেই ভর্তি করে দিল।

মাস তিনেক পর আইইএলটিএস পরীক্ষা। বেশ ভালো করল নিনিদ। তারপর আরও ছয় মাস পর। ১ সেপ্টেম্বর ২০০৭ সালের ভোরে নেমে পড়ল লন্ডন হিথরো বিমানবন্দরে। প্লেন থেকে নামার পর নিনিদের শীত করছিল। ভাগ্যিস মা হাত লাগেজে একটি সোয়েটার দিয়েছিলেন। হাত লাগেজ থেকে সোয়েটার বের করে পরে নিল। সোয়েটারের দুই সাইডে দুটি পকেটে। পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখে মায়ের হাতের লেখা চিঠি।

তাতে লেখা—‘কী, লন্ডনে খুব শীত? তা–ই না? দেখেছ হাত লাগেজে কেন আমি সোয়েটার দিয়েছি। আমার সঙ্গে শুধু শুধু ঘ্যানর ঘ্যানর করেছ। এখন কি মাকে সরি বলবে আর থ্যাংক ইউ দেবে? ঠিক আছে আর দিতে হবে না।’

চিঠিতে আরও লেখা—‘আর শোনো, অঞ্জন দত্ত নামে আমার দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের কথা তোমাকে আগেও বলেছি, আবারও বলছি। উনি বিমানবন্দরে থাকবেন তোমাকে রিসিভ করতে। ওনার বাসায় দু–এক দিন থেকে নিজে নিজে একটি বাসা ঠিক করে নিজের বাসায় উঠবে। আর ওনার সঙ্গে দেখা হলে নমস্কার দেবে। তোমার হাত লাগেজের সামনের পকেটে একটি সাদা খাম আছে। ওটা তাঁকে দেবে আর পারলে ওনার ফোন থেকে আমাকে একটি কল করবে। তবে অবশ্যই আগে অনুমতি চেয়ে নেবে। আবারও বলছি, বেশি দিন ওদের ওখানে থাকবে না। যতই কষ্ট হোক নিজে নিজে বাসা খুঁজে নিজের বাসায় উঠবে। ভালো থেকো।—ইতি মা।’

সাত.

নিনাদ পার্কের বেঞ্চে বসে আছে। কাঁধের ব্যাগটি পাশে রাখা। ইউনিভার্সিটি শুরু হয়েছে। দুদিন ক্লাসও করেছে। ক্লাসে চারজন বাংলাদেশি। বাকি সবাই বিদেশি। বিদেশি বলতে পাকিস্তানি, ভারতীয়, নাইজেরিয়ান আর ইউরোপিয়ানই বেশি।

এদের মধ্যে একদম ব্যতিক্রম কেবল একজন। নাম ইসাবেলা। সে এসেছে স্পেন থেকে। উঠেছে ইউনিভার্সিটির হোস্টেলে। সুন্দর করে সবার সঙ্গে পরিচিত হলো সেই প্রথম।

নিনিদের সঙ্গে ক্লাসের পর দুই–চারবার দেখা হয়েছে। প্রতিবারই ‘হাই’, ‘হ্যালো’ হয়েছে।

ইসাবেলার সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা যেন নিনিদ ভুলতেই পারছে না। তুলতুলে হাত। হাত বাড়িয়েছে সে নিজের নাম ইসাবেলা বলে পরিচয় দিয়েছে। বলেছে, সে স্পেন থেকে এসেছে। তারপর নিনিদও যেন তাকে কপি করে বলল, নিনিদ। ফ্রম বাংলাদেশ। তারপর কে কোথায় থাকে ব্যস ওই পর্যন্তই।

পার্কের বেঞ্চে বসে অন্যমনস্ক হয়ে কেন যেন হঠাৎ ইসাবেলার চেহারাই মনে পড়ছে। মেয়েটি দেখতে অসম্ভব সুন্দর। সোনালি চুল। চুলের রাবার ব্যান্ড দিয়ে পেছন দিকে টান টান করে বেঁধে রাখে সব সময়। উঁচু লম্বা। সরু নাক। পাতলা ঠোঁট। খুব সুন্দর মুখাবয়ব। সবচেয়ে সুন্দর ওর চোখ। সবুজ চোখের মণি।

ইসাবেলাকে নিনিদের খুব মনে ধরেছে। ওর সঙ্গে বন্ধুত্ব করতেই হবে। যেভাবেই হোক। বেঞ্চ থেকে উঠে ব্যাগ কাঁধে নিয়ে হাঁটতে শুরু করল ক্যাম্পাসের দিকে। পার্ক ওদের ক্যাম্পাসের সঙ্গে। ইসাবেলার সঙ্গে দেখা সিঁড়িতে। স্বভাবতই ইসাবেলা হাই দিল। নিনাদ হ্যালো বলে ওকে থামাল। তারপর নানা বিষয়ে নানা কথা বলতে লাগল। নিনিদ কথায় কথায় জোকস বলে। ইসাবেলা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে। গালে টোল পড়া নিয়ে আরেকটি জোকস বলে। এবার হাসতে হাসতে যেন মাটিতে গড়াগড়ি করবে এমন অবস্থা। এরপর দুজনে একসঙ্গে ক্লাসে প্রবেশ করে। ইসাবেলা অন্যদেরও হাই–হ্যালো বলছে। নিনাদ তার সামনে পাওয়া চেয়ারে কাঁধের ব্যাগ নামিয়ে রাখে। তার ঠিক পাশের চেয়ারে বসে ইসাবেলা।

নিনিদ মনোযোগহীন অবুঝ বালকের মতো প্রেম নিয়ে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে যায় আর ইসাবেলা খুবই মনোযোগী। না বুঝলে হাত উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করে প্রফেসরকে।

ক্লাস শেষে ইসাবেলা নিনিদকে প্রশ্ন করে ক্লাসের লেকচারের ওপরে। নিনিদ যেন আকাশ থেকে পড়ল। কারণ পুরো ক্লাসে সে কল্পনার রাজ্যে বিভোর ছিল। কিন্তু ইসাবেলাকে কোনো কিছুই বুঝতে না দিয়ে অন্য একটি প্রশ্ন করে নিনিদ। তারপর অন্য প্রসঙ্গে চলে আসতেই অন্য একটি জোকস বলে। ইসাবেলা আবারও হাসতে থাকে। ইসাবেলা নিনিদের নতুন নাম দিয়েছে জোকার অব দ্য ওয়ার্ল্ড ফ্রম বাংলাদেশ।

দিন গড়ায়। নতুন দিন আসে। নিনিদ আর ইসাবেলার বন্ধুত্ব দিন দিন গাঢ় হতে থাকে। ছেলেদের এই এক সমস্যা। বন্ধুত্ব একটু গাঢ় হলে মনে করে মেয়েটি মনে হয় তাকে ভালোবেসে ফেলেছে।

নিনিদ ক্লাবিং করে। এদিক-ওদিক ঘোরাঘুরির করে ইসাবেলাকে নিয়ে। একদিন সময় আসে ইসাবেলাকে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়ার। নিনিদ ধরেই নিয়েছিল উত্তর হিসেবে ‘হ্যাঁ’ উত্তর দেবে। কিন্তু না। সব হিসাব বদলে সে ‘হ্যাঁ’ উত্তর দেয়নি। সে না বলেছে। সঙ্গে যোগ করেছে ভালো বন্ধুত্ব মানেই যে প্রেম করতে হবে তা নয়। ইসাবেলাকে একটু গম্ভীর দেখায়। অন্যমনস্ক হয়ে যায় সে। তারপর চোখ বেয়ে নেমে আসে জল। খুবই অবাক হয়েছে নিনিদ। এখানে চোখের জল আসার মতো তেমন কিছুই সে বলেনি। কিন্তু ইসাবেলার চোখের জলে যেন অতীতের কোনো ঘটনার ইঙ্গিত খুঁজছে নিনিদ।

এই মুহূর্তে ইসাবেলার কোনো কিছু ভালো লাগছে না। সে তার হোস্টেলে ফিরে যেতে চাইছে। এই বলে উঠে দাঁড়াল। সঙ্গে নিনিদও। নিনিদ পাল্টা কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করল না। কারণ মানুষের যখন দুঃখ হয় তখন তাকে একা থাকতে দিতে হয়। আর কান্না কিংবা চোখের জল দুঃখ নিবারণের মোক্ষম হাতিয়ার তখনকার সময়ের জন্য।

অতি দুঃখে কিংবা সুখে মানুষ কেন কাঁদে? এটা হয় যখন মানুষ আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে মানুষের চোখের অক্ষর নামক এন্ডোক্রিন সিস্টেমের কারণে। এ জন্য হরমোনে কান্নার কারণ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে বহু জায়গায়।

নিনিদ ট্রেন ধরেছে বাসায় ফিরবে। ইসাবেলার জন্য খুবই খারাপ লাগছে। প্রেমে প্রত্যাখ্যান হয়েও এত খারাপ লাগছে না তার। কিন্তু ওর চোখের জল যে ওর সব ধরনের খারাপকে কেড়ে নিয়েছে। অথচ কী হাসিখুশি একটি মেয়ে। ওকে দেখলে কী মনে হবে, ওর জীবনেও দুঃখ থাকতে পারে। মানুষকে দেখে বোঝার উপায় নেই, কখন কার জীবনে কী চলছে। এ জন্যই মনে হয় এ কথাটি প্রযোজ্য ‘don't Judge the Book by Cover’.

আট.

হাওয়া বদলালে নাকি মন বদলায়। নিনাদের সাপ্তাহিক ছুটি শনি–রোববার। নিনাদ একটি কফি শপে কাজ করে ১৬ ঘণ্টা। নতুন কাজ নিয়েছে। মঙ্গলবার বিকেল চারটা থেকে রাত ১১টা আর বুধবার বেলা ২টা থেকে রাত ১১টা। বাকি দিনগুলো ক্লাস থাকে। আর উইকএন্ড ফ্রি।

নিনাদ মনে মনে ঠিক করে এই উইকএন্ডে লন্ডনের বাইরে ঘুরতে যাবে। লেক ডিস্ট্রিক্ট। পাঁচ ঘণ্টা লাগবে বাসে। ট্রেনে একটু কম লাগবে। কিন্তু ট্রেনের টিকিটের অনেক দাম। এখনো টিকিট কাটেনি। টিকিট কাটার আগে কী সে ইসাবেলাকে বলে দেখবে, যাবে কি না?

হাতে ফোন নিয়ে নিনিদ ইসাবেলাকে ফোন দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ইসাবেলা ফোন ধরে। ইসাবেলা বলে, কী ব্যাপার? নিনিদ বলে, ফোনে তোমাকে এত তাড়াতাড়ি পাব তা ভাবতেও পারিনি। সাধারণত ফোন করলে দুই–চারবার চেষ্টা করার পর তোমাকে পাওয়া যায়।

: না, তোমাকে ফোন দেব বলে হাতে ফোন ছিল।

: কী সৌভাগ্য আমার। তুমি আমাকে ফোন করবে অথচ দেখো আমি তোমাকে ফোন দিলাম। মনের মিল। সবই মনের মিল।

ইসাবেলা হুম বলে সায় দেয়।

নিনিদ বলে, I am sorry for that day.

: আরে না, না, কী বলছ। sorry কেন?

ইসাবেলা তারপর বলে, দেখ, একটা ব্যক্তিগত ব্যাপারে তোমার সঙ্গে শেয়ার করব। কাউকে না বলে পারছি না।

নিনিদ বলে, আচ্ছা তোমার সব কথা শুনব। আগে আমি একটা কথা বলে নিই।

ইসাবেলা উত্তর দেয়, বল।

নিনিদ বলে, মন খারাপের গাড়িকে দূরে সরিয়ে দিয়ে আসি।

: মানে?

: মানে...চল ঘুরতে যাই।

: কোথায়?

: লন্ডনের বাইরে।

: কখন যাবে?

: এই উইকএন্ডে। তোমার কোনো আপত্তি না থাকলে।

: না, না আমিও ফ্রি।

: ও দ্যাটস গ্রেট।

: কোথায় যাবে ঠিক করেছ?

: লেক ডিস্ট্রিক্ট।

: কী আছে ওখানে?

: চারপাশে আঁকাবাঁকা উঁচু-নিচু রাস্তা। পাহাড়। পাহাড়ের মাঝে মাঝে ঝরনা। হঠাৎ জলরাশি। এক অনন্য সুন্দর জায়গা।

: তো বেশ চল।

: আমি টিকিট কাটব বাসের। খরচ কম পড়বে আর থাকব লজে।

: লজে কেন?

: খরচ কম।

: না, এক কাজ করো। তুমি বাসের টিকিট কাটো আর থাকার ব্যবস্থা আমার ওপর ছেড়ে দাও।

: ওকে, ঠিক আছে আমি তাহলে টিকিট কাটলাম।

কথা শেষ হলে দুজন ফোন রেখে দেয়।

ইসাবেলার সঙ্গে কথা বলে নিনিদের মনে পড়ে অনেক দিন মাকে ফোন দেওয়া হয়নি। নিনিদ মাকে ফোন করে। মায়ের শরীরের কথা জিজ্ঞেস করে। ওষুধ খেয়েছে কি না, জানতে চায়। নানান কথা নানান জিজ্ঞাসা। ফোনের ওপাশ থেকে নিনিদ মায়ের চাপা কান্না শুনতে পায়। একসময় কথা শেষ হয়।

পৃথিবীতে পালা জিনিসের মায়া এত বেশি কেন? নিনিদ জানালার দিকে তাকিয়ে থাকে আর ভাবে, মা–বাবাহীন কমলাপুর স্টেশন থেকে মুনশি হোস্টেলে যাওয়ার কথা। তারপর ছায়া হালদারের কাছে আশ্রয়। ছায়া একটি দিন একটি ক্ষণের জন্য নিনিদকে বুঝতে দেয়নি নিনিদ তার পালক পুত্র। নিনিদও ছায়াকে বুঝতে দেয়নি সে ছায়ার আশ্রিত নাকি নিজের সন্তান।

নয়.

রাত নয়টায় নিনিদ দাঁড়িয়ে আছে ভিক্টোরিয়া বাসস্টেশনে। ইসাবেলা এখনো এসে পোঁছায়নি। দশটায় বাস ছাড়বে। নিনিদ এদিক-ওদিক দেখছে। টিকটিক করে সময় এগিয়ে চলছে। মানুষজন লাইনে দাঁড়িয়েছে বাসে ওঠার জন্য। সময় এখন ৯টা ৩০ মিনিট। নিনিদ এর আগে দুবার ইসাবেলাকে ফোন করেছে। দুবারই তাকে পায়নি। ইসাবেলা খুব সম্ভবত ট্রেনে। এখানকার অধিকাংশ ট্রেনই মাটির নিচে চলে। নিনিদ পায়চারি করতে থাকে। বাসের লাইনে দাঁড়ানো যাত্রীর সংখ্যা কমে এসেছে। টিকিট চেকার একে একে টিকিট দেখছে আর যাত্রীদের বাসে ওঠাচ্ছে।

নিনিদ অস্থির হয়ে বারবার ঘড়ি দেখতে থাকে। আর মাত্র ১০ মিনিট আছে বাস ছাড়ার। এখনো ইসাবেলার আসার খবর নেই। এমন সময় নিনিদ দেখল ইসাবেলা দূর থেকে হাত তুলে তাকে হাই দিচ্ছে। নিনিদের স্বস্তি বোধ হলো ওকে দেখে। ইসাবেলা নীল রঙের ফতুয়া পরেছে আর তার সঙ্গে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। নিনিদ ইসাবেলাকে ইশারায় লাইনের দিকে আসতে বলল। নিনিদ লাইনে দাঁড়িয়ে গেছে। কাঁধের ব্যাগ হাতে ধরে আছে সে। ইসাবেলা নিনিদের কাছে এসে তাকে হাগ দিল। এরপর ঠিক নিনিদের পেছনে দাঁড়িয়ে গেল।

টিকিট চেকার টিকিট চেক করে বাসে বসতে বলল। ইসাবেলা জানালার ধারে বসেছে আর নিনিদ তার পাশে। ইসাবেলা নিশ্বাস নিচ্ছে অনেক বড় বড় করে। অনেকটা পথ তাড়াতাড়ি করে আসতে হয়েছে বলে হাঁপিয়ে উঠেছে সে। নিনিদ পানি খাবে কি না, জিজ্ঞেস করল। ইসাবেলা মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে। নিনিদ ব্যাগ থেকে পানি বের করে দেয়। ইসাবেলা ঢগঢগ করে পুরো বোতল শেষ করে ফেলে। এরপর নিনিদের কাঁধে মাথা রেখে সরি বলে। নিনিদ বলে আর সরি বলার কী আছে। তুমি তো লেট করোনি।

কিছুক্ষণ পর বাস চলতে শুরু করে তার গন্তব্যের পথে। এর আগে চালক সবাইকে স্বাগত জানিয়ে আরও কিছু কথা বলেন। ইসাবেলা নিনিদকে ওই দিনের জন্য সরি বলে। তারপর তার মন খারাপের কথাগুলো শোনায়। নিনিদ সুবোধ বালকের মতো সব কথা শোনে। ইসাবেলা জানায়, তার আর ফ্লোরিনের জীবনে প্রেম এসেছিল। ফ্লোরিনকে জীবনের সবকিছু দিতে চেয়েছিল সে। কিন্তু ফ্লোরিন যেন অন্য কিছুতে নিজেকে জড়িয়েছে। রাত–দিন ড্রাগস নিত আর যেকোনো নারীর প্রতি ছিল তার দুর্বলতা। ইসাবেলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালেই সে আরও দুজনের সঙ্গে বিছানায় যেত। একদিন তো হাতেনাতে ধরা পড়ে। তারপর থেকে ইসাবেলা নিজেকে সরিয়ে নিয়েছে। নিজেকে ফ্লোরিনের কাছ থেকে সরিয়ে নিলেও অবিশ্বাস সরিয়ে নিতে পারছে না। ছেলেদের প্রতি তার একটা অবিশ্বাস জন্ম নিয়েছে। সে দিনের ঘটনার জন্য আমি দুঃখিত। সেদিন তা না করলেও পারতাম। তবে নিনিদ জানো, ভাঙা ঘরের মানুষ আকাশে কোনো মেঘ দেখলে ভয় পায়। তোমাকে এই কয় দিনে যতটুকু দেখেছি তাতে আমার একজন ভালো বন্ধু হিসেবে ভেবেছি। তাই প্রেমে জড়িয়ে তোমাকে হারাতে চাইনি।

নিনিদ চুপচাপ ইসাবেলার কথা শোনে। এতক্ষণ পর্যন্ত কোনো কথা বলেনি। এই কথা বলার পর নিনিদ পাল্টা প্রশ্ন করে। ইসাবেলাকে জিজ্ঞেস করে, তোমার কি আমাকে ফ্লোরিনের মতো মনে হয়। আমি তো ভিন্ন দেশি ভিন্ন মানুষ। তুমি কি এই কয় দিনেও বুঝতে পারোনি।

ইসাবেলার গলায় কেমন যেন নরম সুর। পাশ্চাত্যের মেয়েদের মাঝে এই ধরনের অনুভূতি শূন্য থাকে। কিন্তু এ যেন অন্য এক প্রাচ্যের মেয়ে। একদম আবেগপ্রবণ বাঙালি মেয়েদের মতো। নিনিদের কাঁধে মাথা রেখে এবার নিনিদের বাঁ হাতের কবজিকে তার দুই হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে সে। নিনিদের কাছে অভয় চাইছে ওকে যেন ছেড়ে না যায় সে। নিনিদ তার বাঁ হাত দিয়ে ইসাবেলাকে জড়িয়ে ধরে অভয় দেয়।

পৃথিবীর শান্ত এক বিড়াল ছানার মতো ইসাবেলা নিনিদকে আরও শক্তভাবে জড়িয়ে ধরে রাখে। অপ্রত্যাশিত এক প্রেম নিবেদনে মৌনতার সম্মতি পেয়ে নিনিদ ভেতরে–ভেতরে আনন্দে আত্মহারা। ইশ, ফুল ছাড়া প্রেম, তা–ও আবার প্রতীক্ষিত প্রেম জোড়া লেগেছে। নিনিদ এই মুহূর্তটাকে ধরে রাখতে চাইছে। ইসাবেলাকে সোজা হয়ে বসতে বলে নিনিদ তার কপালে চুমু খায়। ইসাবেলাও সাড়া দেয়। পৃথিবীর সব কিছুকে হার মানিয়ে যুগলবন্দী হয় ওরা। বাস চলতে থাকে গন্তব্যের পথে। রাতের অন্ধকার থেকে যেন দিনের পৃথিবী বেরিয়ে আসছে একটু একটু করে। নিনিদ আর ইসাবেলা নির্ঘুম গল্পে রাত শেষ করে। এক সময় চালক মাইক্রোফোনে জানান বাস পৌঁছে যাওয়ার কথা।

জানালার কাচে তখনো ভোরের কুয়াশা লেপ্টে ছিল। হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখতে গিয়ে যেন টলমলিয়ে গড়িয়ে পড়ল সেগুলো। এ যেন লজ্জাবতী লতার গায়ে হাত ছোঁয়ানো।

আলস্যে ভরা ঘুম চোখজুড়ে। এখনো রাজ্যের ঘুম। বাসের জানালার সীমানা ছাড়িয়ে চোখ যায় দূরের সবুজ ঘাসে। সোনা ঝরানো চিকচিকে রোদ এসে ঘাসে মাখামাখি করছে। তার পাশে সারি সারি ফুলকুমারি বা পর্তুলিকা। অনেকে এটাকে বলত নয়টার ফুল। নিনিদ ভাবে এমন বলারও কী কোনো কারণ ছিল। ছিল হয়তো। খুব সম্ভবত নয়টায় ফুটত বলে। কে জানে? হয়তোবা এটা লোকের বানানো কোনো নাম। কারণ ফুল কি আর ঘড়ির কাঁটা বোঝে।

একটি পাখি উড়ে এসে ঘাসের ডগার কুয়াশাকে গিলে নিচ্ছে। নিনিদ দেখল হঠাৎ আরেকটি চড়ুই পাখি তার শরীরে এসে বসল। যেন সহ্য হচ্ছিল না প্রথম পাখির একা একা কুয়াশা গিলে খাওয়া। এরপর চিৎকার–চেঁচামেচি। কী অদ্ভুত ব্যাপার, ওরা কী ঝগড়া করে? ওদের ঝগড়ায় সব ঘাসের বুক থেকে টপটপ করে ঝরে পড়ছে ভোরের কুয়াশারা। অথচ একটু আগেও কী সুন্দর সোনা ঝরা চিকচিকে রোদ ছিল কুয়াশামাখা ঘাসে।

পৃথিবীতেও কি এমন কিছু লোকজন আছে? যারা দ্বিতীয় পাখি! সমস্ত ভালো লাগাগুলোকে ম্লান করে দেয় নিমেষে। নিনিদ ডাকল ইসাবেলাকে। অন্যমনস্ক ইসাবেলা যেন ভাবনার জগৎ থেকে ফিরে এল। নিনিদ আর ইসাবেলা নেমে পড়ে।

কোথায় থাকা হবে এ বিষয়ে ইসাবেলাকে কিছুই জিজ্ঞেস করেনি নিনিদ। ইসাবেলাও কিছু বলেনি। যেন রহস্যের আবরণে রেখেছে। ইসাবেলা ব্যাগ থেকে একটি কাগজ বের করে পোস্ট কোড দেয় নিনিদকে। নিনিদ ট্যাক্সি ডাকে। ট্যাক্সি আসতে পাঁচ মিনিট লাগবে। নিনিদ মোবাইলে চারপাশের ছবি ক্যামেরাবন্দী করল। কাঁচা রোদ উঠেছে। সাতসকালের রোদ। পেছনে ফিরতে ইসাবেলা যেন হাঁ হয়ে তাকিয়ে আছে পাহাড়ঘেরা লেকের দিকে। অসম্ভব সুন্দর একটা মুহূর্ত যেন পুরো সকালটা সুন্দর করে দিল।

ট্যাক্সি এসে পড়ল। মিনিট পনেরোর দূরত্ব। চারপাশে পাথরঘেরা উঁচু দেয়াল। মোটামুটি ট্যাক্সি ঢোকার মতো গেট। সারি সারি কটেজ। ইসাবেলা চালককে বলল, একদম কোণার কটেজে যাওয়ার কথা। (চলবে)

ধারাবাহিক এ রচনার আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন