শূন্য বিন্দুতে নারী - চার

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সেই রাতের পর যখনই আমাদের দেখা হতো, প্রতিবারই কিছু বলার জন্য আমার ঠোঁট কেঁপে উঠত। কিন্তু বলার আগেই কী বলতে চাইছি, তা ভুলে যেতাম। ভয়ে বা তেমনই এক অনুভূতিতে আমার বুক ধড়ফড় করত। আমি তাঁর সান্নিধ্য চাইতাম, চাইতাম হাত দুটো ধরতে। কিন্তু তিনি ক্লাসে ঢুকতেন ও ক্লাস শেষে বেরিয়ে যেতেন। যেন আমাকে চোখেই পড়েনি। কখনো-সখনো আমার দিকে চোখ পড়লেও সেটি আর দশজন ছাত্রীর দিকে তাকানোর মতোই।

ঘুমানোর আগে বিছানায় শুয়ে বিড়বিড় করছিলাম—মিস ইকবাল কি আমায় ভুলে গেছেন?

মুহূর্তের মধ্যে ওয়াফিয়া তার বিছানা কাছে টেনে এনে জিজ্ঞেস করে: ‘কী ভুলে গেছেন?’

‘জানি না, ওয়াফিয়া।’

‘তুমি কল্পনার জগতে বাস করছ, ফেরদৌস।’

‘মোটেও না, ওয়াফিয়া। তুমি তো ঘটনাটা জানো।’

ওয়াফিয়া জিজ্ঞেস করে, ‘কোন ঘটনা?’

তাকে বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি। কিন্তু ভাষা খুঁজে পাই না। কিংবা সত্যি বলতে, কোনো কিছু বলার আগ্রহ পাই না। যেন কিছু ঘটেইনি বা ঘটলেও মনে নেই।

চোখ বন্ধ করে দৃশ্যটি মনে করার চেষ্টা করি। ধীরে ধীরে ভেসে ওঠে—দুটো ঘন কালো বৃত্ত ঘিরে থাকা ধবধবে সাদা দুটো চক্র। যতই তাকিয়ে থাকি, সেগুলো ততই বড় হতে থাকে, আমার চোখের সামনে। কালো বৃত্তগুলো বড় হতে হতে পুরো পৃথিবী গ্রাস করে নেয়। আর সাদা দুটো চক্র বড় হতে হতে চোখধাঁধানো সূর্যের আকার ধারণ করে। আমার চোখ, সাদা ও কালোর পরিধিতে একাকার হয়ে যায়। সেগুলোর তীব্রতায় একসময় ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে সেসব যেন আর দেখতে পায় না। চোখের সামনের দৃশ্যপট এলোমেলো হয়ে যেতে থাকে। বাবা-মা, চাচা-মোহাম্মাদাইন, ইকবাল-ওয়াফিয়া কারও চেহারাই আর আলাদা করে চিনতে পারি না। অন্ধ হয়ে পড়ার আতঙ্কে আমি বিস্ফারিত চোখে তাকাই। অন্ধকারে ওয়াফিয়ার মুখের অবয়ব সামনে ভেসে ওঠে। সে তখনো সজাগ।

তাকে বলতে শুনি, ‘ফেরদৌস, তুমি কি মিস ইকবালের প্রেমে পড়েছ?’

অবাক হয়ে বলি, ‘আমি?’

‘হ্যাঁ, তুমি। নয়তো আর কে?’

‘কক্ষনো না, ওয়াফিয়া।’

‘তাহলে প্রতি রাতে তুমি কেন তাঁর কথা বলো?’

‘আমি? তার কথা বলি! কক্ষনো না। তুমি বড্ড বাড়িয়ে বলো, ওয়াফিয়া।’

‘মিস ইকবাল দারুণ পড়ান’, সে মন্তব্য করে।

‘তা ঠিক’, আমি একমত হই। ‘কিন্তু তিনি তো নারী। আমি নিজে মেয়ে হয়ে কীভাবে আরেক মেয়ের প্রেমে পড়ব?’


তখন ফাইনাল পরীক্ষার আর অল্প কয়েক দিন বাকি। ওয়াফিয়া প্রেমিকের গল্প বলা ছেড়েছে। রাতের ঘণ্টাও আগের মতো আর তাড়াতাড়ি বাজে না। প্রতিদিন অনেক রাত পর্যন্ত ওয়াফিয়াসহ অন্য মেয়েদের সঙ্গে পড়ার ঘরে কাটাই। আমরা ঠিকমতো পড়াশোনা করছি কি না, তা দেখার জন্য হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্ট ক্ষণে ক্ষণে টহল দেন। ঠিক যেমনটি তিনি রাতেরবেলা পা টিপে টিপে ঘুরে ঘুরে আমাদের ঘুম, এমনকি স্বপ্নও পাহারা দিতেন। দম নিতে বা আড়মোড়া ভাঙতে কেউ একটু ঘাড় সোজা করলেই আর রক্ষে নেই। তৎক্ষণাৎ তিনি এসে উদয় হতেন। মুহূর্তের মধ্যে আমাদের ঘাড় নিচু করে ফের বইয়ে মুখ গুঁজতে হতো।

সুপারিনটেনডেন্টের কড়া নজরদারি ও অন্য সবকিছুর পরও আমার কিন্তু ক্লাস, পড়াশোনা ভালোই লাগত। ফাইনাল পরীক্ষার ফল বের হলে জানা গেল, আমি স্কুলের মধ্যে দ্বিতীয় ও সারা দেশের মেধাতালিকায় সপ্তম হয়েছি। সার্টিফিকেট বিতরণ উপলক্ষে এক সন্ধ্যায় বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বিশাল হলঘরজুড়ে ছাত্রীদের মা, বাবা ও পরিজনের সমাগমের মধ্যে প্রিন্সিপাল আমার নাম ঘোষণা করলে সার্টিফিকেট নিতে কেউই এগিয়ে যায় না। হলঘরজুড়ে হঠাৎ নীরবতা নেমে আসে। প্রিন্সিপাল দ্বিতীয়বারের মতো আমার নাম ঘোষণা করেন। আমি উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করি, কিন্তু পায়ে কোনো শক্তি পাই না। আমার আসনে বসেই অস্ফুট স্বরে কোনোমতে বলি, ‘উপস্থিত, ম্যাডাম।’

হলঘরের সব মাথা একযোগে আমার দিকে ঘুরে যায়। সব চোখ আমার দিকে ফিরে চায়। আমার সামনের অসংখ্য চোখ-অজস্র কালো বৃত্ত ও অগুনতি সাদা চক্রে পরিণত হতে থাকে। সেগুলো একযোগে বৃত্ত চাপ রচনা করে আমার চোখে এসে স্থির হয়।

প্রিন্সিপাল কঠিন স্বরে আদেশ করেন, ‘বসে কেন জবাব দিচ্ছ, উঠে দাঁড়াও!’

কালো বৃত্ত ও সাদা চক্রগুলো একযোগে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে আরও একবার আমার চোখে এসে স্থির হলে সেগুলোর গতিবিধি দেখে টের পাই—আমি উঠে দাঁড়িয়েছি।

প্রিন্সিপাল আবারও বাজখাঁই গলায় হেঁকে ওঠেন, ‘অভিভাবক কোথায় তোমার?’ কথাটি আমার কানে এমন জোরে প্রতিধ্বনি তোলে, যেমনটি জীবনেও শুনিনি।

হলজুড়ে গভীর নীরবতা নেমে আসে। এ নীরবতাও যেন চারদিকে একধরনের অনুরণন তুলে কানে বাজতে থাকে। অদ্ভুত শব্দ তুলে হলের বাতাস কাঁপতে থাকে। অসংখ্য পাঁজরের ছন্দময় শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ, জনাকীর্ণ হলঘরের পেছনে আমার কানে এসে পৌঁছে। সব কটি ঘাড় এক ঝটকায় সামনের দিকে ঘুরে যায়। আর আমি ঠায় সেখানটায় দাঁড়িয়ে। সারি সারি শিরদাঁড়া সোজা করে বসে থাকা পিঠগুলো দেখতে থাকি।

দুটো চোখ-দুটো মাত্র চোখ শুধু আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি যতই এদিক-ওদিক তাকাই, মাথা এদিক-ওদিক ফেরাই না কেন, সেই চোখের দৃষ্টি নিবিড়ভাবে আমার প্রতিটি নড়াচড়া খেয়াল করতে থাকে। বজ্র আঁটুনির মতো আমার ওপর সেঁটে থাকে। সবকিছু ক্রমবর্ধমান আঁধারে ডুবে যেতে থাকে। কোথাও আলোর লেশমাত্র নেই। শুধু চোখে পড়ে ঘন কালো বৃত্ত ঘিরে ধবধবে সাদা দুটো চক্র। আমি যতই সেদিকে তাকিয়ে থাকি, বৃত্ত ও চক্রের প্রখরতা ততই বাড়তে থাকে। সেগুলো যেন কোনো অজানা, জাদুকরী উৎস থেকে আলো সঞ্চয় করছে। কারণ, হলঘরে তখন নিকষ কালো অন্ধকার আর বাইরের আঁধারও তরল কয়লার মতো।

মনে হচ্ছিল, অন্ধকারে হাত বাড়িয়ে তাঁর হাত টেনে নিয়েছি বা তিনি হাত বাড়িয়ে আমার হাত টেনে নিয়েছেন। এই আচমকা স্পর্শ আমার শরীরজুড়ে এক যন্ত্রণার স্রোত বইয়ে দেয়। সেই যন্ত্রণা এত গভীর, তা যেন অনেকটা সুখের কাছাকাছি। কিংবা এমনও হতে পারে, এটি সুখানুভূতি। যার গভীরতা যন্ত্রণার সীমারেখায় পৌঁছে গেছে। অতল গহ্বর থেকে উঠে আসা অশরীরী সুখানুভূতিটির জন্ম যেন বহুকাল আগে। স্মৃতির সীমারেখার চেয়েও দীর্ঘ, জীবনের যাত্রাপথের স্মরণযোগ্য সময়ের চেয়েও পুরোনো। যা মনে পড়তে না পড়তেই বিস্তৃত। এটি যেন জীবনে একবার ধরা দিয়েই মহাকালের গর্ভে চিরতরে হারিয়ে গেছে বা আদৌ কখনো ধরাই দেয়নি।

আমি মুখ খুলে তাঁকে সব বলতে যাই।

কিন্তু তিনি আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘কিছু বলো না, ফেরদৌস।’

তিনি আমার হাত ধরে, হলের সারি সারি মানুষজনের মধ্য দিয়ে হেঁটে গিয়ে মঞ্চে ওঠেন। যেখানটায় প্রিন্সিপাল দাঁড়িয়ে। প্রাপ্তি স্বীকারে সই করে আমার সার্টিফিকেট ও মেধা-সনদ বুঝে নেন। প্রিন্সিপাল প্রতিটি বিষয়ে আমার নম্বর ঘোষণা শুরু করলে হলঘরে মৃদু গুঞ্জন শুনতে পাই। অনেকটা প্রশংসাধ্বনির মতো যেন। সবুজ রেশমি ফিতায় বাঁধা, রঙিন কাগজে মোড়ানো একটি বাক্স আমার দিকে প্রিন্সিপাল বাড়িয়ে দেন। আমি নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতে চাই। কিন্তু হাত দুটো যেন অনড়, অবাধ্য। মিস ইকবাল প্রিন্সিপালের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন দেখতে পাই। প্রিন্সিপালের হাত থেকে বাক্সটি গ্রহণ করে, আবার সেই সারি সারি মানুষের মধ্য দিয়ে আমাকে তিনি আমার আসনে পৌঁছে দেন। আমি কোলের ওপর সার্টিফিকেট রেখে তার ওপর বাক্সটি চাপা দিয়ে বসে পড়ি।


শিক্ষাবর্ষ শেষ হয়। মেয়েদের নিতে বাবা ও অভিভাবকেরা আসতে শুরু করেন। প্রিন্সিপাল আমার চাচাকে টেলিগ্রাম পাঠালে তিনি কয়েক দিন পর এসে হাজির হন। সেই সার্টিফিকেট বিতরণের রাতের পর থেকে আমি আর মিস ইকবালকে দেখিনি। সেদিন বাতি নেভানোর ঘণ্টা বাজার পরও আমার চোখে ঘুম ছিল না। চুপিসারে উঠানে নেমে অন্ধকারে একা একাই বসে থাকি। প্রতিবার দূর থেকে ভেসে আসা কোনো শব্দ বা কোনো কিছুর নড়াচড়ার আভাস পেলেই ঝট করে ফিরে তাকাই। একসময় দরজার মুখে মানুষের মতো কিছু একটা নড়তে দেখি। লাফিয়ে উঠে দাঁড়াই। বুক ধড়ফড়াতে থাকে, মাথা ঝাঁঝাঁ করতে থাকে। মনে হয়, অবয়বটি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। আমি উঠে ধীরে ধীরে আগাই। আমার সারা শরীর তখন ঘামে চুপচুপে, এমনকি হাতের তালু ও চুলের গোড়া পর্যন্ত। আমি একা অন্ধকারে। ভয়ের মৃদু কাঁপুনি অনুভব করি। ডাকি ‘মিস ইকবাল’, কিন্তু সেই ফিসফিসে, ক্ষীণ কণ্ঠ আমার নিজের কানেই পৌঁছে না। আমি কিছুই শুনতে পাই না, আর এতে আতঙ্ক আরও বাড়ে। কিন্তু অন্ধকারে তখনো সেই অবয়ব ভাসছে।

‘কে ওখানে?’ হেঁকে উঠলে এবার নিজের কণ্ঠ ঠিকঠাক শুনতে পাই।

ঘুমের ঘোরে কথা বলে উঠলে যেমন ঘুম ভেঙে যায়, তেমনি কানে নিজের কণ্ঠ শুনে আমার হুঁশ ফিরে আসে। অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে এলে মানুষের উচ্চতার একটি আস্তরবিহীন ইটের দেয়াল দেখতে পাই। এই দেয়াল আগেও দেখেছি কিন্তু ওই মুহূর্তে মনে হলো, হঠাৎ যেন গজিয়েছে।

স্কুল ছাড়ার সময় আমি শেষবারের মতো চারপাশ, প্রতিটি দেয়ালের আনাচকানাচ, প্রতিটি দরজা, প্রতিটি জানালায় আঁতিপাঁতি করে খুঁজি। মনে হয়, এই বুঝি ঝট করে কোনো জানালা-দরজা খুলে যাবে। আর তাঁর চোখ দুটো দেখতে পাব। আমায় দেখছেন, হাত নেড়ে বিদায় জানাচ্ছেন। আমি একনাগাড়ে উদ্‌ভ্রান্তের মতো খুঁজতে থাকি। প্রতি মুহূর্তেই নিরাশ হই। আবার পরক্ষণে আশায় বুক বাঁধি। আমার দৃষ্টি অস্থিরভাবে ওপর-নিচ, এদিক-ওদিক ঘুরতে থাকে। বুকজুড়ে আবেগের ঝড়।

সদর দরজা পার হতে গিয়ে আমি ঝট করে ধরা গলায় চাচাকে বলি, ‘একটু দাঁড়ান।’

পরক্ষণেই আবিষ্কার করি, চাচার পিছে পিছে রাস্তায় হাঁটছি ও আমাদের পেছনে দরজাটি ততক্ষণে বন্ধ। কিন্তু ক্ষণে ক্ষণে ফিরে ফিরে তাকাই, এই বুঝি পাল্লাগুলো এক ঝটকায় খুলে যাবে। মনে হচ্ছিল, সদর দরজার পেছনে নিশ্চিত কেউ দাঁড়িয়ে, যেকোনো মুহূর্তে কপাট খুলে ধরবে।


আমি ভারী পায়ে চাচার পিছে পিছে যেতে থাকি। মনে তখনো গেঁথে আছে সদর দরজার বদ্ধ পাল্লা দুটোর ছবি। খাবারের সময়, পানাহারের সময় বা ঘুমাতে গেলে সেটি আমার চোখের সামনে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে ওঠে। জানতাম, ফিরে এসেছি চাচার বাসায়, গৃহকর্ত্রী তাঁর স্ত্রী ও ঘরময় দৌড়ে বেড়ানো বাচ্চাগুলো তাদেরই। আর এই বাসায় আমার ঠাঁই শুধু খাবার আর শোয়ার ঘরের মাঝখানের পাতলা দেয়ালে ঠেস দিয়ে রাখা, খাবার ঘরের এক কোনায় কাঠের একটি ছোট কাউচে (দিনের বেলায় বসা অথবা শোয়ার জন্য গদি-আঁটা আসন)। ফলে প্রতি রাতেই দেয়ালের ওপাশ থেকে তাদের চাপা কণ্ঠের কথাবার্তা কানে আসত।

‘মাধ্যমিক স্কুলের সার্টিফিকেট সম্বল করে চাকরি জোটানো এই জমানায় এত সোজা না।’

‘ওর কী গতি করা যায় তাহলে?’

‘কিচ্ছু না। এসব মাধ্যমিক স্কুলগুলো ছেলেমেয়েদের কিছুই শেখায় না। ওকে কারিগরি প্রশিক্ষণে পাঠানো উচিত ছিল।’

‘কী করা উচিত ছিল তা বলে আর কী লাভ। এখন কী করা যায় তাই বলো।’

‘একটা চাকরি জোগাড় করে দেওয়া পর্যন্ত এখানে থাকুক।’

‘তাতে তো কয়েক বছর লেগে যেতে পারে। এমনিতেই বাসাটা ছোট, তার ওপর একটা বাড়তি মানুষ পালার খরচও অনেক। আর সে আমাদের যেকোনো বাচ্চার তুলনায় খায়ও দ্বিগুণ।’

‘ও তো তোমার সঙ্গে ঘরবাড়ি আর বাচ্চাকাচ্চা সামলানোর কাজেও হাত লাগায়।’

‘সেসবের জন্য কাজের মেয়ে আছে, আর রান্নাটা আমি নিজেই করি। ওকে দরকার নেই।’

‘আর ও যদি তোমাকে রান্নায় সাহায্য করে?’

‘তার রান্না আমার পছন্দ না। জাহাঁপনা, আপনি তো জানেন, রান্না হলো ওতে ফুঁ দেওয়া আত্মা। আর রান্নায় সে যা ফুঁ দিয়ে মেশায়, তা আমার মোটেও পছন্দ না। মনে নেই, সে যে একবার ঢ্যাঁড়স রেঁধেছিল, আর খেয়ে তুমি বলেছিলে, আমার রান্নার মতো হয়নি।’

‘সাদিয়ার বদলে ওকে রাখলে কাজের মেয়ের বেতনটা তো অন্তত বাঁচে।’

‘ওকে দিয়ে সাদিয়ার কাজ হবে না। সাদিয়া গায়েগতরে হালকা-পাতলা। হাত চালিয়ে-মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করে। তার ওপর খাবারদাবারে লোভ নেই। আর ঘুমায়ও কম। কিন্তু এই মেয়ে চলাফেরায় তো একেবারে ঢিলেঢালা। তার মধ্যে আন্তরিকতা বা সহানুভূতির লেশমাত্র নেই।’

‘তাহলে কী করি?’

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠিয়ে তাকে ঘাড় থেকে নামানো যায়। সেখানে মেয়েদের হোস্টেলে থাকতে পারবে।’

‘বিশ্ববিদ্যালয়ে? ছেলেদের পাশে বসে পড়াশোনা? আমার মতো ধার্মিক-সম্মানিত শেখের ভাতিজি করবে ছেলেদের সঙ্গে মেলামেশা! তা ছাড়া তার থাকা-খাওয়া, বইপত্র, কাপড়চোপড়ের এত খরচই বা আসবে কোত্থেকে? ইদানীংকালের বাজারের অবস্থা তো তুমি জানো। সবকিছুর দাম বাড়ছে হুহু করে। অথচ আমাদের মতো সরকারি চাকুরের বেতন বাড়ছে কয় পয়সা?’

‘দারুণ একটা বুদ্ধি এসেছে মাথায়, জাহাঁপনা।’

‘কী বুদ্ধি?’

‘আমার চাচা শেখ মাহমুদ খুব পরহেজগার লোক। মোটা অঙ্কের পেনশন পান। বাচ্চাকাচ্চা নেই। আর গত বছর বউ মারা যাওয়ার পর থেকে আছেনও একা। উনি ফেরদৌসকে বিয়ে করলে ফেরদৌসের জীবনটাও ভালো কাটবে। আর তাঁরও জুটবে অনুগত স্ত্রী। যে তাঁর ফাইফরমাশ খাটবে। আবার একাকিত্বও ঘোচাবে। ফেরদৌস আর কচি খুকিটি নেই জাহাঁপনা। ওর বিয়ে দেওয়া দরকার। এখন ওর স্বামী ছাড়া একা থাকাটা নিরাপদও না। সে মেয়ে ভালো বটে, কিন্তু দুনিয়াটা তো ইতরে ভরা।’

‘মানলাম, কিন্তু শেখ মাবুদ ওর তুলনায় অনেক বুড়ো না?’

‘কে বলল বুড়ো! তিনি তো এই বছর মাত্র অবসরে গেলেন। আর ফেরদৌসেরই বা বয়স কম কোথায়। ওর বয়সী মেয়েরা এত দিনে বিয়েথা করে বাচ্চা পয়দা করে ফেলেছে। তা ছাড়া ছেলেছোকরা বিয়ে করে নাজেহাল হওয়া বা সকাল-বিকেল মার খাওয়ার চেয়ে বয়স্ক-নির্ভরযোগ্য পাত্র ঢের ভালো। তুমি আজকালকার ছেলেপেলেদের তো চেন।’

‘মানলাম। কিন্তু তুমি নিশ্চয়ই তাঁর চেহারার মারাত্মক বিকৃতির কথা ভুলে যাওনি।’

‘বিকৃতি? বিকৃতি কোথায় পেলে? তা ছাড়া জানেনই তো জাহাঁপনা, কথায় বলে, পুরুষের লজ্জা শুধু খালি পকেটে।’

‘আর ফেরদৌস যদি রাজি না হয়?’

‘হবে না কেন? এটাই তো ওর বিয়ের মোক্ষম সুযোগ। ওর উদ্ভট নাকের কথাও ভুলে যেয়ো না যেন। টিনের মগের মতো বিরাট আর কুৎসিত একটা নাক। তার ওপর না আছে কোনো সহায়-সম্পত্তি, না আছে নিজের আয়-রোজগার। ওর জন্য শেখ মাহমুদের মতো অত যোগ্য পাত্র আর খুঁজে পাব না।’

‘তোমার কি মনে হয়, শেখ মাহমুদ আগ্রহী হবেন?’

‘আমি বললে নিশ্চয়ই হবেন। তাঁর কাছে বড় অঙ্কের যৌতুক চাওয়ার ইচ্ছা আছে আমার।’

‘কত?’

‘এক শ পাউন্ড, চাই কি দুই শ, যদি আদায় করা যায় আর কী।’

‘এক শ পেলেই আলহামদুলিল্লাহ। দুই শর লোভে পড়ার দরকার নেই।’

‘আমি দুই শ থেকেই শুরু করব। জানোই তো, পাঁচ মিলিমের (১ দিনার = ১০০০ মিলিম) জন্য তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা দরাদরি করতে পারেন। আর এক পিয়াস্তারের (১ পাউন্ড = ১০০ পিয়াস্তার) জন্য আত্মহত্যা করতেও রাজি।’

‘এক শ পাউন্ড পেলে তা-ই আল্লাহর রহমত। ওতেই সব দেনা মিটিয়ে কয়েকটা অন্তর্বাস কিনতে পারব। ফেরদৌসের জন্য দু-একটা জামাও হয়ে যাবে। তার পোশাকের যা ছিরি, এগুলো গায়ে তো বিয়ে দেওয়া যায় না।’

‘কনের পোশাক, আসবাব, আর হাঁড়িকুড়ি নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে না। শেখ মাহমুদের বাড়িতে সবই আছে। তাঁর বউয়ের রেখে যাওয়া আসবাব এখনো যথেষ্ট ভালো-মজবুত, আজকালকার জিনিসপত্রের মতো ঠুনকো না।’

‘তা অবশ্য মিছে বলোনি।’

‘খোদার কসম বলছি, শেখ মাহমুদ রাজি হলে আপনার ভাতিজির ওপর আল্লাহর রহমত নেমে আসবে, জাহাঁপনা।’

‘কী মনে হয়, রাজি হবেন?’

‘মানাই-বা করবেন কেন? ধার্মিক-সম্মানিত শেখের সঙ্গে আত্মীয়তা করার এই তো সুযোগ। রাজি হওয়ার জন্য এটাই কি যথেষ্ট না?’

‘হতে পারে না, ধনী পরিবারের মেয়ে খুঁজছেন? জানোই তো তিনি কেমন টাকার কাঙাল।’

‘জাহাঁপনা কি নিজেকে গরিব ভাবেন? আল্লাহর রহমতে অনেকের চেয়ে ভালো আছি।’

‘অবশ্যই, আমাদের সবকিছু তাঁর অসীম কৃপায়। সর্বদা সব প্রশংসা তাঁর। সর্বশক্তিমান আল্লাহর অসীম নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।’

কাউচে শুয়ে থেকে শুনতে পাই, চাচা নিজ হাতে দ্রুত দুবার চুমু খেতে খেতে আবারও বলছেন, ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহকে তাঁর অসীম নেয়ামতের জন্য কৃতজ্ঞতা জানাই।’


কল্পনায় আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাই, তিনি হাতের তালুতে একটা চুমু খেয়ে দ্রুত হাতটা ঘুরিয়ে, উল্টো পিঠে আরেকটা চুমু খাচ্ছেন। পাতলা দেয়াল ভেদ করে চুমু দুটোর শব্দ একে একে আমার কানে এসে পৌঁছে। একটু বিরতির পর আবার শুরু হয়। কিন্তু এবার তাঁর ঠোঁট স্ত্রীর হাতে বা পায়ে। আর আমি তা টের পাই চাচির প্রতিবাদের শব্দে।

চাচার কবল থেকে নিজের হাত কিংবা পা ছাড়িয়ে নিতে নিতে তিনি বলে ওঠেন, ‘না, জাহাঁপনা, না।’

চাচার হিসহিসে, তরল, চাপা, চুম্বনমিশ্রিত কণ্ঠ ভেসে আসে, ‘এই বেটি, না মানে?’

দুটো শরীরের নিচে বিছানাটা ককিয়ে ওঠে। আমি তাঁদের এলোমেলো, হাঁপ ধরা নিশ্বাসের শব্দ শুনতে পাই। সঙ্গে আবারও প্রতিবাদ।

‘না, জাহাঁপনা, নবীর দোহাই লাগে। পাপ হবে।’

চাচা আড়ষ্ট কণ্ঠে আবারও হিসহিসিয়ে ওঠেন, ‘ওই বেটি ওই… কিসের পাপ, আর কিসের নবী? আমি তোর জামাই আর তুই আমার বউ।’

দুটো ভারী শরীরের বিচ্ছিন্ন ও একত্র হওয়ার ক্রমাগত ধস্তাধস্তিতে বিছানাটি সজোরে আর্তনাদ করতে থাকে। ধীরলয়ে শুরু হয়ে ক্রমশ গতি বাড়তে বাড়তে এক অদ্ভুত পাগলাটে ছন্দ-বিছানা থেকে শুরু করে মেঝে, আমাদের মধ্যকার পাতলা দেয়াল, এমনকি আমি যে কাউচে শুয়ে আছি, সেটি পর্যন্ত কাঁপাতে থাকে। কাউচের সঙ্গে সঙ্গে আমার শরীরও কাঁপছে টের পাই। আমার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসে। কিছুক্ষণের মধ্যে আমিও একই উন্মত্ত ছন্দে হাঁপাতে শুরু করি। পরে ধীরে ধীরে তাঁদের নড়াচড়া ও শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ থেমে গেলে সেই সঙ্গে আমিও শান্ত হই। শ্বাসপ্রশ্বাস নিয়মিত লয়ে নেমে আসে এবং সারা শরীরে জবজবে ঘাম নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। (চলবে)

ফারহানা আজিম শিউলী: কানাডার টরন্টোপ্রবাসী।