তারাদের সঙ্গে একটা সন্ধ্যা

সিনেমা শুরুর অপেক্ষা। ছবি: লেখক
সিনেমা শুরুর অপেক্ষা। ছবি: লেখক

প্রবাসে হাতে গোনা কিছু ব্যক্তি ছাড়া বেশির ভাগ প্রবাসীকে কর্মব্যস্ত জীবন কাটাতে হয়। যেমন আমাকে সপ্তাহের পাঁচ দিন ভোর ছয়টায় ঘুম থেকে উঠতে হয়। তারপর বাচ্চাদের তৈরি করে সাড়ে ছয়টায় চাইল্ড কেয়ারে নামিয়ে অফিস যেতে হয় সকাল আটটার মধ্যে।

অফিসে আমাদের বস ডেভিড সিম্পসন। তাঁকে আমরা সিমো নামে ডাকি।

একদিন তাঁকে বললাম, বস, সকালবেলায় উঠতে আমার বেশ কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।

শুনে তিনি বললেন, তুমি কয়টার সময় ঘুম থেকে ওঠো।

আমি বললাম, সকাল ছয়টায়।

আমার উত্তর শুনে তিনি বললেন, আমি কয়টার সময় ঘুম থেকে উঠি জানো?

আমি উৎসুক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকালাম। তখন তিনি বললেন, আমি উঠি ভোর চারটায়।

সিনেমার পুরো সময়টায় আকাশে ছিল পূর্ণিমার চাঁদ। ছবি: লেখক
সিনেমার পুরো সময়টায় আকাশে ছিল পূর্ণিমার চাঁদ। ছবি: লেখক

এ কথা শুনে আমি অবাক হয়ে তাঁর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তখন তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা কখন ঘুমাতে যাও।

আমি বললাম, সবকিছু গুছিয়ে ঘুমাতে যেতে রাত ১২টা তো বেজেই যায়।

তিনি বললেন, তোমাদের উচিত রাত পৌনে নয়টা বা নয়টার মধ্যে ঘুমিয়ে যাওয়া। তাহলে দেখবে সকালে উঠতে আর সমস্যা হচ্ছে না। আর ঠিকভাবে ঘুম হলে দিনেরবেলায় কাজেও মনোযোগ দিতে পারবে।

আমি সব সময় ভাবতাম, মানুষ সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও সময়কে কখনোই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কিন্তু অস্ট্রেলিয়া আসার পর আমার সেই ভুল ভেঙে গেছে। সময়কেও মানুষ তার বশে এনেছে। বছরের একটা সময় ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে দেওয়া হয়। আবার একটা সময় পিছিয়ে দেওয়া হয়। তাই এ দেশে কখনো সূর্যাস্ত হয় রাত আটটায়। আবার কখনো সূর্যাস্ত হয় বিকেল পাঁচটায়। সেই মোতাবেক সারা দেশ পরিচালিত হয়। এমনকি বাচ্চাদের জন্য যে এবিসি কিডস চ্যানেল আছে, সেটাও বন্ধ হয়ে যায় সন্ধ্যার পরপরই।

এখানে এমনই ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে বাঁধা জীবনযাত্রা। তবে রাত জাগার বা ঘড়ির কাঁটার বাইরে গিয়ে জীবনযাপনের সুযোগ আসে বছরে বেশ কয়বার। তেমনই একটা সুযোগ পেয়েছিলাম আমরা গত শনিবার (১৪ সেপ্টেম্বর)। সিডনির অস্ট্রেলিয়ান বোটানিক গার্ডেনে দেখানো হচ্ছিল সিনেমা ‘দ্য ইনক্রেডিবলস ২’। প্রতিবছর সেখানে ছবি দেখার আয়োজনটা করা হয়। উৎসবটাকে বলা হয় ‘সিনেমা আন্ডার দ্য স্টার’। গত বছর দেখানো হয়েছিল ‘মিয়ানা’।

কনকনে ঠান্ডায়ও বাচ্চারা আইসক্রিম খাচ্ছে। ছবি: লেখক
কনকনে ঠান্ডায়ও বাচ্চারা আইসক্রিম খাচ্ছে। ছবি: লেখক

অস্ট্রেলিয়ায় যেকোনো আয়োজনই করা হয় অত্যন্ত সুচারুভাবে। যেমন এই আয়োজনের জন্য যে পরিমাণ বেশি গাড়ি আসবে, সেটার জন্য বাড়তি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হয়। আবার পার্কিংয়ে যেতে যাতে কারও অসুবিধা না হয়, সে জন্য রাস্তায় কিছু দূর পরপর ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে থাকে লাল লাইটের দণ্ড হাতে নিয়ে।

এবার সেখানে আমাদের একটু যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিল সংসারের কাজকর্ম সেরে। বোটানিক গার্ডেনে ঢোকার মুখেই তাহিয়া ক্যাঙারু ক্যাঙারু বলে চিৎকার করে উঠল। এই ক্যাঙারুগুলো বোটানিক গার্ডেনে থাকলেও সারা দিন বের হয় না। বিকেলে পরিবেশ একটু ঠান্ডা হয়ে এলে বাইরে বের হয়ে আসে। তখন ভাগ্য ভালো হলে দেখা মেলে।

যা হোক, ট্রাফিক পুলিশের দেখানো রাস্তা অনুযায়ী পার্কিংয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। পার্কিংয়ে ঢোকার মুখেই একজন ট্রাফিক পুলিশ জিজ্ঞেস করলেন, তোমার সঙ্গে কি বাচ্চাকাচ্চা আছে। আমি জানালাম, আছে। তখন তিনি আমাদের কাছাকাছি একটা জায়গা দেখিয়ে বললেন, তোমরা ভাগ্যবান, এইমাত্র একটা গাড়ি বেরিয়ে গেল। ওখানে গিয়ে গাড়ি রাখতে পারো। আমরা সেখানে গাড়ি পার্কিং করে রওনা দিলাম। আমাদের ছেলে রায়ান স্টলারে বসা। আমাদের মেয়ে তাহিয়ার কাঁধে বসার জন্য দুটো ফোল্ডিং চেয়ার আর গিন্নির হাতে স্ন্যাক্সের ব্যাগ। আমরা সিনেমার স্পটের দিকে যাওয়ার সময় সেই ট্রাফিক পুলিশ ভদ্রলোককে আবারও ধন্যবাদ দিলাম। তিনি বললেন, তোমাদের সাহায্য করতে পেরেছি, আমি খুশি।

সিনেমার স্পটের আগেই খাবারের স্টলগুলো। তার সামনেই একজন মি. ইনক্রেডিবলস সেজে সবাইকে লম্বা ফোলানো বেলুন দিয়ে বিভিন্ন রকমের খেলনা বানিয়ে দিচ্ছিল। অনেক মানুষ বাচ্চাকাচ্চাসহ তার সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। লাইন বড় দেখে আমরা সরাসরি সিনেমার স্পটেই চলে গেলাম। সেখানে মাঝামাঝি একটা জায়গা ফাঁকা পেয়ে পাশের পরিবারটাকে জিজ্ঞেস করলাম, তাদের কেউ আছে কিনা?

এটা এখানকার খুবই স্বাভাবিক ভদ্রতা। পাশ থেকে একটা চেয়ার নিতে গেলেও পাশের ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞেস করতে হয়।

গতবার আমরা একটু পেছনের দিকে বসেছিলাম। সিনেমা দেখতে সমস্যা হয়নি। কারণ জায়গাটা ধীরে ধীরে উঁচু হয়ে বোটানিক গার্ডেনের শীর্ষের দিকে চলে গেছে। কিন্তু আমরা ডায়ালগগুলো মিস করে যাচ্ছিলাম। তাই এবার মাঝামাঝি বসা।

গত বছর এখানে আসার পর বন্ধু হাবিব, বন্ধুপত্নী এনি আর তাদের দুই ছেলেমেয়ে সারিতা ও সাফিনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে বসে ছবি দেখেছিলাম আর এনি ভাবির আনা খাবার সাবাড় করেছিলাম। সন্ধ্যার পরপরই শীতের তীব্রতা বেড়ে যায়। তখন আমরা কফি খেয়ে নিজেদের চাঙা রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু বাচ্চাদের কোনো কিছুই আটকাতে পারেনি। তারা সেই ঠান্ডাতেও আইসক্রিমের বায়না ধরলে অগত্যা তাদের সেটা কিনে দিতে হয়েছিল। তারা তাদের স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই সময়টা পার করেছিল।

এবার গিন্নিও আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। সিনেমার স্পটে পৌঁছেই গিন্নি বলল, ক্ষুধা পেয়েছে। বায়ানকে তার সঙ্গে রেখে আমি আর তাহিয়া খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লাম। খাবারের সব কটি দোকানের সামনেই তখন কম-বেশি ভিড়। তাহিয়া বলছিল, সসেজ খাবে। কিন্তু সেখানে নগদ টাকা লাগবে। তাই একটা বার্গারের দোকানের সামনে আমি লাইনে দাঁড়ালাম। বার্গারের অর্ডার দিয়ে অপেক্ষা করতে গিয়ে বুঝলাম সেটা পেতে অনেক দেরি হবে। কারণ তখন কেবল সার্ভ করছে ৫১ নম্বর আর আমাদের নম্বর ৭৫।

মি. ইনক্রেডিবলস খেলনা বিতরণ করছেন। ছবি: লেখক
মি. ইনক্রেডিবলস খেলনা বিতরণ করছেন। ছবি: লেখক

মেয়ে তাহিয়া ইতিমধ্যেই খুঁজে বের করে ফেলেছে খাবারের দোকানের ফাঁকে একটা এটিএম বুথও আছে। তাই আমাকে তাগাদা দিচ্ছিল টাকা তুলে তাকে সসেজ কিনে দিতে। এটিএম বুথের সামনে যেতেই সবুজ পোশাক পরা একজন তরুণী বললেন, দুঃখিত এটা কাজ করছে না। ঠিক করার জন্য আমরা লোক ডেকে পাঠিয়েছি। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে। তবে তোমরা চাইলেই কার্ড দিয়ে যেকোনো দোকান থেকে কেনাকাটা করতে পারো। কারণ সব দোকানেই ইফটপস আছে আর পপকর্ন বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। এ কথা বলে তিনি ঠিক পাশের দোকানটা দেখিয়ে দিলেন। আমি তাড়াতাড়ি পপকর্নের লাইনে গিয়ে দাঁড়িয়ে দুই প্যাকেট পপকর্ন নিয়ে নিলাম। তারপর তাহিয়াকে পাঠিয়ে আরও দুই প্যাকেট নিয়ে নিলাম। কারণ আমরা মানুষ চারজন।

এরপর পপকর্ন সমেত তাহিয়াকে আমাদের বসার জায়গায় রেখে এলাম। কারণ মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ছবি শুরু হবে বলে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। আমি তাহিয়াকে বললাম, তুমি দেখতে থাকো। আমি ফিরলে আমাকে বর্ণনা কোরো। তারপর আবার বার্গারের দোকানের সামনে অপেক্ষা করতে থাকলাম। সেখানে অপেক্ষা করতে করতে অনেকের সঙ্গেই আলাপ হলো। একজন ভদ্রলোক তাঁর বাচ্চা মেয়েটাকে নিয়ে খাবারের অপেক্ষায় রয়েছেন। আমি তাঁকে জানালাম, বিনা মূল্যে দিচ্ছে। তুমি পপকর্ন নিয়ে এসে বাচ্চাটাকে দিতে পার।

ভদ্রলোক এটা জানতেন না। আমার কথা শুনে অবাক হয়ে বললেন, পপকর্ন বিনা মূল্যে দিচ্ছে! আমি বললাম, হ্যাঁ, আমি একটু আগেই নিয়ে এসেছি। তখন তাঁরা পপকর্ন নিয়ে এলেন। তিনি আমাকে ধন্যবাদ দিলেন। আরও এক ভদ্রলোক তাঁর বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছেন। তাকেও আমি বিনা মূল্যের পপকর্নের কথা বললাম। তিনি তার ছেলেকে নিয়ে পপকর্ন আনতে চলে গেলেন।

যা হোক, খাবার নিয়ে এসে দেখি তাহিয়া একটা চেয়ারে বসেছে। আর রায়ানকে কোলে নিয়ে গিন্নি অন্য চেয়ারটায় বসেছে। আমি সঙ্গে আনা মাদুরে বসলাম। কিন্তু সামনের সারিতে সবাই চেয়ারে বসে ছবি দেখছিল। ফলে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না। তখন আমাদের পাশের ভদ্রলোক আমাকে তাদের একটা চেয়ার দেখিয়ে সেখানে বসতে বললেন। তারা চারটা চেয়ার এনেছিলেন। তারাও চারজন। তাদের একটা চেয়ার ফাঁকা থাকায় সেটাতেই আমাকে বসতে বলেছেন। আমি সেখানে বসে সিনেমাটার বাকিটা উপভোগ করলাম।

এ বছরও গত বছরের মতোই অনেক ঠান্ডা ছিল। গায়ের জামাকাপড়ে মনে হচ্ছিল, কেউ যেন ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে।

তবে এবার সবচেয়ে উপভোগ্য বিষয় ছিল সেদিনের ভরা পূর্ণিমা। সিনেমা শুরু হওয়ার একটু আগেই পূর্ণিমার চাঁদটা পুব আকাশে দেখা দিল। সেদিন আকাশ মেঘমুক্ত থাকার কারণে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তার আলোর উজ্জ্বলতা আরও বেড়ে গেল। পূর্ণিমার আলোতে সবকিছুই মায়াময় দেখায়। তাই সেদিনও আশপাশের সবকিছু এমনকি সিনেমাটাও অসাধারণ লাগছিল। আমাদের দ্য ইনক্রেডিবলস বেশ কয়েকবার দেখা ছিল। তাই আমাদের বুঝতে তেমন কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। তবে প্রথমটার থেকে ধীরগতির ছিল।

যা হোক, ছবি দেখা শেষ হলে আমি ফোল্ডিং চেয়ারটা ভাঁজ করে ভদ্রলোকের ব্যাগে ঢুকিয়ে ফেরত দিলাম। তাঁর কোলে তাঁদের মেয়ে ঘুমাচ্ছিল। আমি তার বসার চেয়ারটাও ভাঁজ করে ব্যাগে ভরে দিলাম। তাঁরা আমাদের অনেক ধন্যবাদ দিলেন। প্রত্যুত্তরে আমরাও তাঁদের অনেক ধন্যবাদ দিলাম।

এই উৎসবটার নাম ‘সিনেমা আন্ডার দ্য স্টার’ হলেও পূর্ণিমার কারণে সেটা আসলে হয়ে উঠেছিল ‘সিনেমা আন্ডার দ্য মুন’। আর সিনেমাগুলো সব বয়সী মানুষের কথা মাথায় রেখেই ঠিক করা হয় বলে এই উৎসবগুলো হয় সবার জন্যই উপভোগ্য। তবে আমার কাছে উৎসবের সবচেয়ে লক্ষণীয় দিক হচ্ছে মানুষে মানুষে মিথস্ক্রিয়া। যেকোনো উৎসবই আসলে মানুষে মানুষে মেলবন্ধন তৈরির একটা উপলক্ষ। একেবারে সম্পূর্ণ অপরিচিত মানুষের সঙ্গে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা কত সহজেই তাদের আপন করে নিতে পারি, উৎসবগুলোতে এলে সেটা আবারও প্রমাণিত হয়। আরও একবার মানুষ ও মানবতার প্রতি বিশ্বাস ফিরে পাই।
---

মো. ইয়াকুব আলী। ই-মেইল: <[email protected]>