হেনরি ডুরলি চিড়িয়াখানায় এক দিন

চিড়িয়াখানায় পেঙ্গুইন
চিড়িয়াখানায় পেঙ্গুইন

গ্রীষ্মের দাবদাহ শেষ করে শরতের সবে শুরু শুরু ভাব। সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার লেবার ডের ছুটি, যাকে বলে লং উইক এন্ড।

ঠিক তিন বছর আগে এমনই এক লেবার ডেতে হাসপাতালের লেবার রুমে আমি ও ইফফাত ভয়, অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা ও অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছিলাম আমাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান উপহারের জন্য। জি, আমাদের একমাত্র মেয়ে লামিহার বয়স লেবার ডেতে তিন বছর হলো।

বিভিন্ন ধরনের পশুপাখি লামিহার খুবই প্রিয়। তাই গতানুগতিক কেক আর খাবারের মধ্যে জন্মদিনটাকে আটকে না রেখে এবার আমরা লামিহার প্রিয় পশুপাখির সঙ্গে সময় কাটাব বলে ঠিক করেছিলাম।

কিন্তু প্রিয় পশুপাখির সঙ্গে দেখা করতে তো আর একা একা যাওয়া যায় না। তাই লামিহা তার সবচেয়ে কাছের বান্ধবী নুহা আর তার পরিবারকেও আমরা সঙ্গী হিসেবে পেলাম।

চিড়িয়াখানার গেটের সামনে লামিয়া ও নুহা
চিড়িয়াখানার গেটের সামনে লামিয়া ও নুহা



সাত সিটের একটা গাড়ি নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বাঘ, সিংহ আর হাতি ভাইদের সন্ধানে। নর্থ ডাকোটার ফারগো থেকে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে আমরা এসে পৌঁছলাম বিশ্বের সেরা ধনকুবের ওয়ারেন বাফেটের বিখ্যাত নেব্রাস্কা অঙ্গরাজ্যের ওমাহা শহরে।

কিন্তু আমরা ওয়ারেন বাফেটের বাসায় না গিয়ে এ যাত্রায় সকাল সকাল চলে গেলাম ওমাহা চিড়িয়াখানায়, যা ‘হেনরি ডুরলি চিড়িয়াখানা ও অ্যাকুয়ারিয়াম’ নামেও পরিচিত। ১৭ হাজার পশুপাখি নিয়ে ১৩০ একর জমির ওপর নির্মিত এই চিড়িয়াখানা প্রজাতির সংখ্যার দিক থেকে আমেরিকা তথা বিশ্বের সর্ববৃহৎ চিড়িয়াখানা।

এত বড় চিড়িয়াখানা। তাই প্রথমেই আমরা তথ্যকেন্দ্র থেকে চিড়িয়াখানার মানচিত্র নিয়ে দেখে নিলাম আজকের দিনে কী কী মজার প্রদর্শনী আছে।

চিড়িয়াখানার মরুভূমি জঙ্গলে সুউচ্চ ক্যাকটাস
চিড়িয়াখানার মরুভূমি জঙ্গলে সুউচ্চ ক্যাকটাস

উল্লেখ্য, এই চিড়িয়াখানায় সপ্তাহের বিভিন্ন দিন নির্দিষ্ট সময়ে বিভিন্ন প্রাণীর শরীরচর্চা ও স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলে, যা প্রদর্শনী হিসেবে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। প্রাণীদের স্বাস্থ্য রক্ষার সঙ্গে সঙ্গে বন্য প্রাণী ও তাদের জীবন ধরনের ওপর শিক্ষামূলক কিন্তু মজাদার আলোচনা চলে এই প্রদর্শনীগুলোয়।

সেদিন ছিল পেঙ্গুইন, হাতি ও সিংহর প্রদর্শনী। যেহেতু প্রদর্শনী শুরু হতে তখনো বেশ দেরি, তাই প্রথমেই আমরা গেলাম বিখ্যাত মরুভূমি জঙ্গল (ডেজার্ট ডোম) দেখতে। গোলাকার বিশাল আকৃতির এই মরুভূমি জঙ্গলে আছে হাজারো রকমের মরুভূমির সাপ, সরীসৃপ, পাখি, বনবিড়াল, লেমুর, কচ্ছপ আর বিচিত্র ক্যাকটাসের সমাহার। খুব রুক্ষ আর শুষ্ক দেখতে কাঁটাভরা মাথা-উঁচু ক্যাকটাসের বর্ণিল গোলাপি ফুল যে এত সুন্দর হয় তা হয়তো এখানে না এলে জানাই হতো না।

মরুভূমি জঙ্গল থেকে দ্রুতই আমরা চলে গেলাম অ্যাকুয়ারিয়ামের দিকে। কারণ, একটু পরেই শুরু হবে পেঙ্গুইনের প্রদর্শনী। পেঙ্গুইনের দেখা পেয়ে লামিহা ও নুহার খুশি ছিল দেখার মতো। বাস্তবে আমি নিজেও সেদিন প্রথম পেঙ্গুইন দেখলাম। পেঙ্গুইনের রুমটা বরফ ও তুষারে আচ্ছাদিত। আর একদিকে জলধারা। দেখামাত্রই শরীরে একটা হিম হিম ভাব চলে আসবে।

হাঙর মাছের অ্যাকুয়ারিয়ামে লামিহা ও নুহা
হাঙর মাছের অ্যাকুয়ারিয়ামে লামিহা ও নুহা



পেঙ্গুইনগুলো ডানা ছড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে জলধারার দিকে আসছে। তারপর কিছু সময় যেতেই একের পর এক লাইন ধরে পানিতে ঝাঁপ দিচ্ছে। এ এক হিমশীতল সৌন্দর্য। সবচেয়ে অদ্ভুত হলো কিছু কিছু পেঙ্গুইনের গলার রং সাদা আর কিছুর রং হলদেটে। কিন্তু সব কটির ডানায় বিভিন্ন রঙের প্লাস্টিক ট্যাগ লাগানো।

কিছুক্ষণ পর মাইকে বর্ণনা দিয়ে চিড়িয়াখানার একজন কর্মী পেঙ্গুইনের প্রদর্শনী শুরু করলেন আর জানালেন, খালি চোখে ছেলেমেয়ে পেঙ্গুইন আলাদা করা প্রায় অসম্ভব। তাই প্লাস্টিক ট্যাগ দেওয়ার এটি একটি কারণ। তা ছাড়া সন্তানসম্ভবা পেঙ্গুইন অথবা অন্য কোনো বিশেষ প্রয়োজনে পেঙ্গুইনকে আলাদা করতেও এই রংবেরঙের প্লাস্টিক ট্যাগ।

আকাশ-ফেরিতে মা-বাবার সঙ্গে লামিহা
আকাশ-ফেরিতে মা-বাবার সঙ্গে লামিহা

প্রদর্শনীর একপর্যায়ে চিড়িয়াখানার দুজন কর্মী দুটি বালতি হাতে পেঙ্গুইনের রুমে প্রবেশ করতেই সব কটি পেঙ্গুইন দৌড়ে চলে গেলে তাদের দিকে। তখন যে তাদের খাবারের সময়। পেঙ্গুইনের প্রিয় খাবার হলো মাছ। সেদিনের মেনু ছিল সুস্বাদু ট্রাউট মাছ, যা পাওয়ামাত্রই পেঙ্গুইন গপ করে আস্ত গিলে ফেলছে।

পেঙ্গুইনদের সঙ্গে সময় কাটিয়ে আমরা গেলাম অ্যাকুয়ারিয়ামের অন্যদিকে। যেখানে আছে পানির সবচেয়ে ভয়ংকর হাঙর মাছ! পুরো হাঙর মাছের অ্যাকুয়ারিয়াম কাচের তৈরি, যার ভেতর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি আমরা। আর চারদিকে, এমনকি মাথার ওপর দিয়েও ভয়ংকর হাঙর (হোয়াইট সার্ক) সাঁতার কেটে যাচ্ছে। মুখে হাসি আর মনে দুরুদুরু ভয় নিয়ে কোনো রকম হাঙরের অ্যাকুয়ারিয়াম দেখা শেষ করলাম।

পরবর্তী প্রদর্শনী শুরু হতে বেশ সময় আছে। তাই আমরা কফি হাতে নিয়ে চললাম আকাশ-ফেরির (স্কাই ফেরি) দিকে। গোটা চিড়িয়াখানা ওপর থেকে দেখার সে এক মনোরম ও রোমাঞ্চকর ব্যবস্থা। পা ঝুলিয়ে বসার মতো একটি বেঞ্চ, যা একটি মোটা তারের মাধ্যমে চলাচল করছে। প্রথম দিকে এত উঁচুতে পা ঝুলিয়ে বসতে বেশ উচ্চতাভীতি কাজ করছিল। যখন একটু সামনে এগোলাম, উঁচু থেকে গোটা চিড়িয়াখানার নৈসর্গিক দৃশ্য দেখে বুঁদ হয়ে গেলাম।

আকাশ-ফেরিতে মা-বাবার সঙ্গে নুহা
আকাশ-ফেরিতে মা-বাবার সঙ্গে নুহা



আকাশ-ফেরিটি ধীরে ধীরে এগোচ্ছে। আমাদের দুদিকে বড় বড় গাছের চূড়া পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ আর নিচে এক অতিকায় জিরাফ খুব নিবিড়ভাবে ঘাস খাচ্ছে। অন্যদিকে, একপাল হরিণ ছুটে চলছে। আমি আর ইফ্ফাত দুপাশ থেকে লামিহাকে ধরে আছি। গতিময় নগরজীবনে অভ্যস্ত আমাদের সময় যেন আকাশ-ফেরিতে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে।

আকাশ-ফেরির রোমাঞ্চকর সময় কাটিয়ে আমরা ঢুকলাম আফ্রিকান তৃণভূমি (গ্রাসল্যান্ড) অংশে। এখানে আছে জিরাফ, ইমপালা, গন্ডার, হাতি ও সিংহ। একটু পরই শুরু হবে সিংহের প্রদর্শনী। বড় বড় পাথরের ছোট একটি পাহাড়ের ওপর দুটি সিংহ বসে আছে ভাবলেশহীন ভঙ্গিতে। অন্যদিকে, ছোট ছোট বাচ্চা ও তাদের মা-বাবা—আমরা বসে আছি অধীর আগ্রহ নিয়ে বনের রাজা সিংহের প্রদর্শনী দেখার জন্য।

প্রদর্শনীতে সিংহ
প্রদর্শনীতে সিংহ

চিড়িয়াখানার দুজন কর্মী শুরু করলেন প্রদর্শনী। সিংহ একধরনের বিড়াল, কিন্তু বড় বিড়াল। নেভার ট্রাস্ট আ বিগ ক্যাট। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল অন্য জায়গায়। বনের রাজামশাই কোনোভাবেই তার ছোট পাহাড় থেকে নামছেন না। ছোট বাচ্চারা তো অস্থির, কখন নামবে রাজামশাই। অবশেষে একজন কর্মী একটা মস্ত প্লাস্টিকের ড্রাম পাশের উঁচু স্থান থেকে সিংহের খাঁচায় ছুড়ে মারলেন। মুহূর্তের মধ্যেই সিংহ আমাদের সামনে হাজির। বাচ্চাদের সে কী আনন্দ আর চিৎকার!

ওই ড্রাম নাকি সিংহের খেলনা! কেশর দুলিয়ে সিংহ একবার এদিক তো আরেকবার অন্যদিকে দৌড়াচ্ছে। দয়া করে রাজামশাই তার পাহাড় থেকে নেমে আমাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য চিড়িয়াখানার কর্মী তাকে কিছু মাংস দিয়ে পুরস্কৃত করলেন। প্রদর্শনীর সময় প্রায়ই খাবার দিয়ে উৎসাহিত করা হয় বিশেষ করে যখন চিড়িয়াখানার কর্মীর নির্দেশন পালন করা হয়।

সিংহরাজের সঙ্গে দেখা করার পর আমরা গেলাম ট্রেনে চড়ে গোটা চিড়িয়াখানা দেখতে। আকাশ-ফেরি থেকে যেমন গোটা চিড়িয়াখানা ওপর থেকে দেখা যায়, তেমনি ট্রেন দিয়ে গোটা চিড়িয়াখানা ভূমিতে প্রদর্শন করার ব্যবস্থা। বিভিন্ন রঙে সজ্জিত ট্রেনটি চিড়িয়াখানার চারদিক দিয়ে ঘুরতে থাকে আর সঙ্গে আছে ট্রেনচালকের বর্ণনা।

ট্রেনে চিড়িয়াখানা দর্শন
ট্রেনে চিড়িয়াখানা দর্শন



কিছু সময় পরপর ট্রেনের পু পু হুইসিল আর সঙ্গে সঙ্গে লামিহা ও নুহার উচ্চ স্বরে চিৎকার। ট্রেনভ্রমণ শেষ করে আমরা এলাম স্থলের সবচেয়ে বড় প্রাণী হাতির কাছে। একটু পরেই শুরু হলো হাতির প্রদর্শনী। চিড়িয়াখানার কর্মী জানালেন, সেদিন যে হাতিটি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করছে, তার নাম কিকি। চিড়িয়াখানার কর্মীর কথা অনুযায়ী কিকি তার ডান ও বাঁ পা উঁচু করে আমাদের দেখাল। সঙ্গে তার শুঁড় উত্তোলন। নির্দেশনা সঠিকভাবে পালন করে কিকি হাতি পুরস্কার হিসেবে পেল আপেল, আলু আর গাজর।

চিড়িয়াখানার ট্রেন
চিড়িয়াখানার ট্রেন

প্রদর্শনী হিসেবে হাতিদের প্রদর্শনীই সেদিনের শেষ আকর্ষণ। এরপর আমরা বিক্ষিপ্তভাবে সিল মাছ, ফুলের বাগান, তোতাপাখি, রাজহাঁস, ছাগলছানাদের চারণভূমি, গন্ডার, জিরাফ, বানর, ওরাংওটাংয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এলাম।

ছোটবেলায় বাবার সঙ্গে একবার ঢাকা চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। এখনো মনে আছে, শেষবেলায় আর হাঁটতে পারছিলাম না। সারা দিন অনেক মজা ও হাঁটাহাঁটি করে লামিহা আর নুহার দিকেও তাকানো যাচ্ছিল না। অবশেষে সব সাঙ্গ করে রওনা দিলাম বাড়ির উদ্দেশে।

ফেরার পথে পুরো সময়ে লামিহা আর নুহার শুধু গল্প চলল—কোন পেঙ্গুইনটা পানিতে ঝাঁপ দিয়েছিল কীভাবে আর সিংহ কেন নামছিল না পাহাড় থেকে। লামিহা এখনো তার বই কিংবা কার্টুনে হাতি দেখলে কিকি কিকি বলে চিৎকার করে ওঠে।

শাহ মো. লিমন: সহকারী গবেষক, নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি, ফারগো, নর্থ ডাকোটা, যুক্তরাষ্ট্র।

ছবি: নুহার মা–বাবা