জানালার ওপাশে

ঈদের দিন লেখকসহ প্রবাসীরা। ছবি: লেখক
ঈদের দিন লেখকসহ প্রবাসীরা। ছবি: লেখক

আমি কোলনের ট্রেনস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি ট্রেনের অপেক্ষায়। মাত্র ভোরের আলো ফোটা শুরু করছে। ‘লোকজন ঘর থেকে বের হওয়া শুরু করেছে’ না বলে ‘স্টেশনে জড়ো হওয়া শুরু করেছে’ বলাই ভালো।

পাশের ক্যাথেড্রালের ঘণ্টার শব্দ শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু ঘড়িতে সময় দেখতে ইচ্ছে করছে না। উল্টো দিকে কতগুলো কবুতর ছোট্ট একটা রুটি নিয়ে ঠোকরাঠুকরি করছে। আর দূরে ট্যাক্সিচালকেরা অলস সময় কাটাচ্ছেন।

প্ল্যাটফর্মে আমি যেখানে দাঁড়িয়ে, সেদিক থেকে রাইন নদী দেখা যায়। দিনের প্রথম আলোতে নদীর পানি ঝলমল করছে।

১২ ঘণ্টার বেশি হয়ে গেছে বাসার বাইরে আছি। আরও কতক্ষণ লাগবে বুঝতে পারছি না। সারা রাত না ঘুমিয়ে কাজ করার কারণে সকাল সকাল এখন একটু ক্লান্ত লাগছে। এর মধ্যে মনে হচ্ছে, ট্রেন দেরি করবে। ভাবতেই ক্লান্তিগুলো আরও বেশি ভর করল।

অনেকক্ষণ কবুতরগুলোর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। খুব হিংসা হচ্ছিল ওদের স্বাধীন জীবন দেখে। ওদের মতো ডানা থাকলে তো আমাকে এখানে অপেক্ষা করতে হতো না। সারা রাত না ঘুমানোর কারণে চোখ এমনিতেই ফুলে আছে। এর ওপর পায়ের জোর আস্তে আস্তে কমে আসছে। বলা যায় মনের জোরে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি। আর কেউ একটা বিছানা পেতে দিলে এখানেই ঘুমাতে পারব।

আনমনে কিছু একটা ভাবছিলাম। হঠাৎ মনে হলো সূর্য আর নদী দুটোই ফুঁড়ে আসছে আমার ট্রেন। ট্রেনের নম্বর দেখতে পারছি না। কারণ, রাইন নদীর ঝলমলে পানি আমার চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। কাছে আসতেই বুঝতে পারলাম। অবশেষে এখন পাখির তার নীড়ে ফিরে যাওয়ার সময় হয়েছে। তবে গোধূলি লগনে নয়, প্রভাতফেরিতে।

আচ্ছা, একটা জিনিস তো কখনো খেয়াল করিনি। সূর্য ওঠার আর সূর্য ডোবার আবহ প্রায় একই রকম। কী অদ্ভুত! সকালবেলার বাতাসে একধরনের সজীবতা আছে।

ট্রেনের বগিতে উঠে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছি। অনেক দূরে দূরে বাড়িঘর আর বিস্তীর্ণ গমখেতের মধ্যে দিয়ে শাঁই শাঁই করে ছুটছে ট্রেন। সারা রাত দাঁড়িয়ে কাজ করার কারণে আমার হাত-পায়ের ব্যথাটা একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে। তীব্র ব্যথায় একধরনের ঘোরের মতো লেগে এল।

ঘোরের মধ্যেই আমার আমি জেগে স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম। হঠাৎ মনে হলো আজ না ঈদ? আচ্ছা, আমার এতক্ষণ কেন মনে এল না? হয়তো আমার অবচেতন মন ঈদ নিয়ে ভাবছে। আর মস্তিষ্ক সব সময় বাধা দিচ্ছে যেন আমি এটা নিয়ে না ভাবি।

আচ্ছা, একটা মানুষ কোনটি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত? অনেক সময়ই মনে হয়, হিমু কি কোনো দিন মিসির আলী হতে পারে না অথবা মিসির আলী কি কোনো দিন হিমু হতে পারবে না? দুটি সত্তা একসঙ্গে নিয়ে কি বেঁচে থাকা সম্ভব নয়? লজিক অথবা অ্যান্টিলজিকের বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে আমার মন তখন বাংলাদেশে।

সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে গোসল করে রেডি হচ্ছি। বাবা বারবার তাগাদা দিচ্ছেন ঈদের নামাজ শুরু হয়ে যাবে। ডাইনিংরুমে যেতেই দেখলাম মা পায়েস রান্না করে রেখেছেন। সকালে নামাজ পড়ার আগে মিষ্টিজাতীয় কিছু খাওয়া সুন্নত। আর মায়ের হাতের পায়েস খাওয়ার মজাই আলাদা।

ঈদের নামাজের পর সবার সঙ্গে কোলাকুলি শেষ করে বাসায় ফিরতেই দেখি টেবিলভর্তি খাবার। কোনটা রেখে কোনটা খাব। তাড়াতাড়ি খাওয়াদাওয়া শেষ করে বাইরে বের হলাম। সব বন্ধু একত্র হয়ে একেকজনের বাসায় যেতে হবে। কয়েক ঘণ্টা পর সব বন্ধু মিলে বাসায় চলে এলাম। অনেক গল্পগুজব, খাওয়াদাওয়া, ঘোরাঘুরি আর হাসিঠাট্টার মধ্যে দিনের সময়টুকু চলে গেল।

রাত্রিবেলায় সব আত্মীয়স্বজন আমাদের বাসায় এল। এত বড় হওয়ার পরেও আমি ঘুরে ঘুরে ঈদের সেলামি জোগাড় করলাম। বড় হলে এক সমস্যা। সেলামি কমে যায়। ছোট কাজিনগুলো একটু পরপর ঘ্যানর ঘ্যানর করছে ওদের সেলামি দিতে হবে। আমি যতই দুই টাকার চকচকে নোটগুলো দিই না কেন, ওদের বড় নোট লাগবে। কী এক যন্ত্রণা! অগত্যা কী আর করা, বড় নোট দিতেই আমার কাছ থেকে পালাল। যতই বলি আমার কাছ থেকে সেলামি নিলি, কিন্তু সালাম তো আর করলি না। কে শোনে কার কথা। সেলামি নেওয়ার যেমন একটা মজা যাচ্ছে, তেমনি সেলামি দেওয়ারও একটা মজা আছে। নিজেকে বড় বড় মনে হয়।

পিচ্চিগুলোর চিৎকার–চেঁচামেচির মধ্যেই হঠাৎ ট্রেনের হুইসিলের শব্দে আমার তন্দ্রা ভেঙে গেল। আধো আধো চোখ খুলতেই বুঝতে পারলাম পরের স্টেশনে আমাকে নামতে হবে। অবচেতন মন আবার তন্দ্রায় ফিরে যেতে যাচ্ছে। কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে, এখন মাকে ফোন দিতে হবে। আজ বাংলাদেশে চাঁদরাত, সবাই মহাব্যস্ত।

আমি নিশ্চিত, ফোন দিতেই মা জিজ্ঞেস করবেন ঈদে কী খেয়েছি না খেয়েছি। আর আমাকে সত্যমিথ্যা মিলে একটা উত্তর দিতে হবে যে এইটা বেঁধেছি, ওইটা রেঁধেছি। মোটকথা, মাকে আশ্বাস দেওয়া যে আমি ভালোই খাচ্ছি।

অবশেষে ট্রেন থেকে নেমে প্রায় ২০ মিনিট হেঁটে বাসায় পৌঁছালাম। এত সকালে সাধারণত বাসের কোনো কানেকশন থাকে না। আমার বাসার খুব কাছেই একটা মসজিদ আছে। ঈদের নামাজে যাব। হাতে খুব বেশি সময় নেই। তাড়াহুড়া করে গোসল করলাম। পাঞ্জাবি পরে নামাজের জন্য রেডি হয়ে ঘর থেকে বের হব, ঠিক তখনই থমকে দাঁড়ালাম। কেন জানি আমার অবচেতন মন বলছে, পাশের ডাইনিং টেবিলে আম্মুর হাতের রান্না করা পায়েস আছে। দরজার বাইরে আব্বু অপেক্ষা করছেন একসঙ্গে নামাজে যাওয়ার জন্য।