বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তাচেতনার পরিপন্থী

মো. ফজলুল করিম, পিটার্সবার্গ (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে
মো. ফজলুল করিম, পিটার্সবার্গ (যুক্তরাষ্ট্র) থেকে

অর্থনৈতিকভাবে আমাদের দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার মানের দিক দিয়ে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এটা আমরা সবাই বলছি। বিশেষ করে ইদানীং বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার মান নিয়ে বেশ কথা হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অভিন্ন নীতিমালার কথা আমরা বলছি। কিন্তু এ কথা আমরা বুঝতে চেষ্টা করছি না, পৃথিবীর কোথাও অভিন্ন নীতিমালা ও সরকারি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় চলে না।

আমরা বরাবর বলে আসছি, শিক্ষক নিয়োগের শর্তসমূহ কখনো একই রকম হতে পারে না। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় আছে। সব বিশ্ববিদ্যালয় একই নিয়মে চলতে পারে না। প্রয়োজন অনুসারে চাহিদার স্কেল ওঠানামা করতে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। এ জন্যই বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাদা বিশেষজ্ঞ দল থাকে, যারা নির্ধারণ করে ওই বিশেষ ফিল্ডের জন্য কী রকম শিক্ষক দরকার এবং তাদের কী কী যোগ্যতা থাকতে হবে।

আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরির ক্ষেত্রে এন্ট্রি পোস্ট হলো প্রভাষক। কিন্তু বাইরে বেশির ভাগ দেশে এই পদ শুরু হয় সহকারী অধ্যাপক থেকে। পৃথিবীর কোথাও সহকারী অধ্যাপক পদে চাকরির যোগ্যতা হিসেবে স্কুল-কলেজের রেজাল্ট দেখা হয় না। আমি নিচে কিছু বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক পদের সার্কুলারের লিংক দিচ্ছি।

এই সার্কুলারগুলোর কোথাও স্কুল-কলেজের কথা বলা হয়নি। শিক্ষক হওয়ার জন্য প্রথমেই দেখা হয়েছে পিএইচডি আছে কি না। তারপর জোর দেওয়া হয়েছে বিশ্বমানের জার্নালে প্রকাশনা আছে কি না। অনেক ক্ষেত্রে প্রার্থীর শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। কিন্তু কেউ দেখে না প্রার্থী স্কুল বা কলেজে কেমন ছিলেন। এটাই বিশ্ববিদ্যালয়ের সৌন্দর্য।

আমরা যখন বলি, বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর সব শিক্ষার্থীর শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা আছে, তখন স্কুল–কলেজের ফলাফল টেনে এনে একটি শ্রেণিকে এমনিতেই বাদ দিচ্ছি। এটা তো একধরনের বৈষম্য। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর সব ছাত্রকে শিক্ষক হওয়ার সুযোগ দিতে হবে। আর এটা করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর তিনি কত ভালো করলেন, তার ভিত্তিতে।

আমরা যখন বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় চিন্তা করছি, তখন আমরা বিদেশে থাকা খুব ভালো গবেষকদের জন্য কোনো সুখবর এই নীতিমালার মাধ্যমে দিতে পারছি না। এটা খুবই হতাশাজনক। বিশ্বমানের বিশ্ববিদ্যালয় তৈরি করতে হলে বিশ্বমানের গবেষক নিয়োগ দিতে হবে। কিন্তু নতুন অভিন্ন নীতিমালা তৈরি হলে বিদেশে বসবাসরত কোনো ভালো গবেষক বাংলাদেশে ফিরে আসবেন না। অনেকেই আছেন, যাঁদের স্কুল-কলেজে খুব ভালো রেজাল্ট নেই। কিন্তু তাঁরা তাঁদের ফিল্ডে অনন্য। তাঁরা কোনো দিনই এই নতুন নীতিমালার কারণে ফিরতে পারবেন না।

অভিন্ন নীতিমালা তৈরি করবার আগে অনেক কিছু ভাবার আছে, যা আমরা একদমই ভেবে দেখিনি। আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি খাঁচার মধ্যে বন্দী করবার চিন্তা করছি। বিশ্ববিদ্যালয় শব্দটির যে ব্যাপকতা, সেখান থেকে সরে এসে আমরা চাইছি একটি নিয়ন্ত্রিত কাঠামো। এটার মাধ্যমে কখনোই বিশ্ববিদ্যালয় বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গায় থাকবে না।

আমরা তো অবশ্যই চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের পরিবর্তন ঘটুক। আমরা চাই ভালো শিক্ষক আসুন। কিন্তু এর জন্য বিশ্বমানের চিন্তাচেতনা থাকতে হবে সব জায়গায়। নতুন নীতিমালা পদে পদে সেই চিন্তার পরিপন্থী।

বঙ্গবন্ধু যখন স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন ’৭৩ অধ্যাদেশের মাধ্যমে, তখন কিন্তু এর চেয়েও অনেক বেশি ভালো চলেছে বিশ্ববিদ্যালয়। তখন যাঁরা উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন সর্বজনশ্রদ্ধেয়। এই সেদিন পর্যন্তও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেছি, প্রথম–দ্বিতীয় না হলে শিক্ষক হওয়া যায় না। এখন সেখানে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন সব ধরনের নিয়োগে রাজনৈতিকীকরণ হয়। এখন উপাচার্য নিয়োগ থেকে শিক্ষক নিয়োগ—সব জায়গায় একটা রাজনৈতিক চাপ থাকে। যখন ভালো প্রোফাইলের চেয়ে আনুষঙ্গিক বিষয় নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রাধান্য পায়, তখন ভালো শিক্ষক পাওয়া কঠিন।

আবার শুধু ভালো শিক্ষক নিয়োগ দিলেই সবকিছু পাওয়া সম্ভব নয়। পরিচর্যা না করলে ভালো শিক্ষার্থীর পক্ষে ভালো শিক্ষক হওয়া সম্ভব নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন শিক্ষকদের মান উন্নয়নে ইউজিসির অনেক কিছু করার আছে, যা প্রতিষ্ঠানটি মোটেও করছে না। এখন শিক্ষকেরা নিজেদের উন্নত করছেন নিজের যোগ্যতায়। বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা থেকে শুরু করে সবকিছুই অর্জন করতে হচ্ছে ব্যক্তিগত উদ্যোগে।

আসলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মান উন্নতি করতে হলে আমাদের আরও যুগোপযোগী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নিজ নিজ ফিল্ডে যাঁরা খুব ভালো গবেষক, তাঁদের আকৃষ্ট করতে আরও ভালো প্যাকেজের কথা চিন্তা করতে হবে। স্কুল-কলেজের ফলাফল দিয়ে শিক্ষক হওয়া যায় না—এই সত্য উপলব্ধি করতে হবে। আর এই পরিবর্তনগুলো আনতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতর থেকেই।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা অপ্রতুল হওয়া সত্ত্বেও শিক্ষকতা করতে খুব মেধাবী শিক্ষার্থীরা ছুটে আসেন শুধু সম্মানের জন্য। বর্তমানে যেভাবে আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় শিক্ষকদের স্বাধীনতার খর্ব করার চেষ্টা করা হচ্ছে, তা কোনোভাবেই মেধাবীদের এই শিক্ষকতার পেশায় আসতে উৎসাহিত করবে না।

সরকারি পরামর্শ অবশ্যই থাকতে পারে। কিন্তু তা বিশ্ববিদ্যালয় সম্মান অটুট রেখে করতে হবে। অভিন্ন নীতিমালার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়কে একটি বন্দিশালায় আনা ধ্বংসাত্মক চিন্তা ছাড়া আর কিছুই নয়। আইন যত কঠোরই হোক, তা নির্ধারণ করতে হবে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকদের মাধ্যমে। আর আইনের বেড়াজালে স্কুল-কলেজের রেজাল্টের ভিত্তিতে কিছু শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয় পাস করার আগেই শিক্ষক হওয়ার দৌড় থেকে দূরে রাখা একটা অমানবিক কৌশল ছাড়া আর কিছুই নয়।

সহকারী অধ্যাপক পদের সার্কুলারের লিংক:

১. Pitt›chem›news›department-po...Web resultsDepartment Positions-Department of Chemistry-University of Pittsburgh

২. NatureJournal›naturecareers›jobAssistant/Associate/Full Professor, Molecular Biophysics and-Nature

৩. client=safari&channel=iphone_bm&sxsrf=ACYBGNTbRvdU7nqGPlGF5ZD7dwHn8UvoCg%3A1568119480294&ei=uJp3XdK6Eebm_Qanl58I&q=faculty+positions+circular+in+yale+university&oq=faculty+position+circular+in+Yale+university&gs_l=mobile-gws-wiz-serp.1.0.33i22i29i30.4471.20675..21615...2.0..0.241.4082.30j13j1......0....1.......8..35i362i39j46i362i39i19j35i39j0i131i273j0i273j0i131j0j0i67j0i131i67j0i20i263j0i22i30j33i160j33i299.80kv9USQcUc#fpstate=tldetail&htidocid=ExEqqdiVeQcBvhNrAAAAAA%3D%3D&htiq=faculty%20positions%20circular%20in%20yale%20university&htivrt=jobs

৪. client=safari&channel=iphone_bm&sxsrf=ACYBGNSIBxJJ4d8mY_bcm6ZV12b_5PKdIA%3A1568119762452&ei=0pt3XbmMG6K5ggfK5IA4&q=faculty+positions+circular+in+harvard+yniversity&oq=faculty+positions+circular+in+harvard+yniversity&gs_l=mobile-gws-wiz-serp.3..33i299.2034.10215..11486...0.1..1.323.4155.21j5j5j2......0....1.........0i71j35i39j33i22i29i30j33i160.AhO4ph9W2hI#fpstate=tldetail&htidocid=KIcTJAvQ_SAIsDqwAAAAAA%3D%3D&htiq=faculty%20positions%20circular%20in%20harvard%20university&htivrt=jobs

---

ড. মো. ফজলুল করিম: পোস্টডক্টরাল রিসার্চ ফেলো, পিটার্সবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র এবং সহযোগী অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ।