শূন্য বিন্দুতে নারী - পাঁচ

অলংকরণ: মাসুক হেলাল
অলংকরণ: মাসুক হেলাল

পরদিন সকালে চাচার জন্য নাশতা বানাই। আমি প্লেট, গ্লাস বা কাপ নিয়ে এলে, তিনি প্রতিবার আমার দিকে চোখ তুলে তাকান। কিন্তু প্রতিবারই আমি চোখাচোখি এড়াতে মুখ ঘুরিয়ে নিই।

তিনি বেরিয়ে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করি। তারপর হাঁটু মুড়ে কাঠের কাউচের নিচ থেকে আমার জুতা জোড়া টেনে নিয়ে পায়ে গলাই ও জামা পালটে নিই। ছোট ব্যাগটি খুলে রাতে পরার গাউন ভাঁজ করে রাখি, মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট ও মেধা-সনদটি সেটির ওপর রেখে চেইন টানি। চাচার স্ত্রী তখন রান্নাঘরে রাঁধছেন আর কাজের মেয়ে সাদিয়া পাশের ঘরে বাচ্চাদের খাওয়াচ্ছে।

সবচেয়ে ছোট চাচাতো বোন হালা ওই মুহূর্তে আমার কামরায় চলে আসে। আমার গায়ের জামা, জুতা আর ছোট ব্যাগটি দেখে তার কালো চোখ দুটো বড় বড় হয়ে ওঠে। সে তখনো ঠিকমতো কথা বলতে শেখেনি। ফেরদৌস বলতে পারে না। বলে ‘দৌস’। বাচ্চাদের মধ্যে সেই একমাত্র আমার দিকে তাকিয়ে হাসত। আর আমি আমার কামরায় একা থাকলে, কাউচে আমার পাশে লাফিয়ে উঠে বসে ডাকত।

‘দৌস, দৌস।’

আমি তার চুলে হাত বুলিয়ে বলতাম, ‘বল, হালা।’

‘দৌস দৌস’ তার জবাব, খিলখিল হাসি, আর সেই সঙ্গে তাকে নিয়ে খেলার বায়না। কিন্তু একটু পরেই, পাশের ঘর থেকে মার ডাক শোনা মাত্র সে এক লাফে কাউচ থেকে নেমে ছোট্ট পায়ে টুক টুক করে কামরাটি থেকে বেরিয়ে যেত।

হালার চোখ দুটো আমার জুতা, জুতা থেকে জামা, জামা থেকে ব্যাগে ঘুরপাক খেতে থাকে। সে আমার জামার কোনা ধরে বলতেই থাকে—

‘দৌস, দৌস।’

তার কানে কানে বলি, ‘আমি আবার ফিরে আসব, হালা।’

কিন্তু সে থামে না। আঙুল দিয়ে আমার হাত আঁকড়ে ধরে ডাকতেই থাকে, ‘দৌস, দৌস’।

তাকে ব্যস্ত রাখতে, তার হাতে আমার একটি ছবি ধরিয়ে দিয়ে, ফ্ল্যাটের দরজা খুলে বেরিয়ে আসি। চুপচাপ পেছনের দরজাটা ভেজিয়ে দিই। দরজার ওপাশে সে তখনো ডাকছে:

‘দৌস, দৌস।’

দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে নেমে আসি। কিন্তু সিঁড়ি পেরিয়ে রাস্তায় নামা পর্যন্ত তার কণ্ঠ ধ্বনিত হতে থাকে। রাস্তা ধরে হেঁটে চলার সময়ও যেন পেছনে কোথাও কণ্ঠটি বাজতে থাকে। আমি ঘুরে তাকাই, কিন্তু কিছুই চোখে পড়ে না।

রাস্তা ধরে আগেও বহুবার হেঁটেছি। কিন্তু এবারের অনুভূতি অন্য রকম। এবারের যাত্রা গন্তব্যহীন। সত্যি বলতে, আমার কোনো ধারণাই নেই, পা দুটো আমাকে কোথায় টেনে নিয়ে চলছে। রাস্তাগুলোও যেন প্রথমবারের মতো দেখছি। নতুন এক জগৎ যেন চোখের সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। যে জগৎ আমার অচেনা। হয়তো এর অস্তিত্ব সব সময়ই ছিল কিন্তু আমার চোখে পড়েনি, বুঝতে পারিনি। এই জগৎ এত বছর আমার অগোচরে রইল কেমন করে? মনে হচ্ছে, হঠাৎ করেই আমার কপাল চিরে যেন তৃতীয় নয়নের উদয় হয়েছে।

দেখতে পাই—অগুনতি মানুষের বিরামহীন স্রোত। কেউ চলছে পায়ে হেঁটে, কেউ বা বাসে, কেউ গাড়িতে চড়ে। সবাই যেন ভীষণ ব্যস্ত, ভীষণ তাড়া সবার, আশপাশে কী ঘটছে সেদিকে হুঁশ নেই। আমি যে একা দাঁড়িয়ে, তাও কারও নজরে পড়ে না। আর সবার অগোচরে থাকায়, আমার বরং তাদের খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে সুবিধাই হচ্ছিল। দেখতে পাই—পথচারীদের কারও কারও বেশভূষা মলিন, পায়ে ছেঁড়া জুতা, চেহারা ফ্যাকাশে, চোখের দৃষ্টি নিষ্প্রভ-হাল ছাড়া। উদ্বেগ ও বেদনার ভারে ন্যুব্জ তারা। অন্যদিকে গাড়িতে চড়ে যারা যাচ্ছে, তাদের কাঁধ চওড়া ও পেশিবহুল, গোলগাল চেহারা। সতর্ক, দ্বিধান্বিত ও চোরা চাহনিতে, কাচের জানালা ভেদ করে তারা আশপাশের সবকিছু মাপছে। সেই চাহনি-ছোঁ মারতে উদ্যত, আগ্রাসী, আবার একই সঙ্গে অদ্ভুত রকম ভিতু। বাসে চড়া লোকজনের মুখ-চোখ আলাদাভাবে বোঝার উপায় নেই। শুধু দেখি—কানায় কানায় ভরে থাকা বাসের ভেতরে গাদাগাদি করা, হাতলে ঝুলে থাকা ও ছাদ থেকে উপচে পড়া দলা পাকানো একগাদা পিঠ আর মাথা। বাস কোনো স্টপেজে থামলে বা গতি কমালে, পলকের জন্য চোখে পড়ে হলদেটে, ঘামে চকচকে মুখগুলো—তাদের বিস্ফারিত চোখে কী যেন এক ভয় খেলা করছে।

রাস্তাঘাটে লোকজনের উপচে পড়া ভিড় দেখে হতবাক হই। আরও বেশি হতবাক হই অন্ধের মতো তাদের চলাফেরা দেখে। তারা না দেখে নিজেদের, না দেখে পাশের জনকে। আমিও তাদেরই একজনে পরিণত হয়েছি। হঠাৎ করে সেটি বুঝতে পেরে, আমার বিস্ময় চরমে পৌঁছে। এই অনুভব, আমাকে এমন উত্তেজনায় ভরিয়ে তোলে, যা শুরুতে ভীষণ সুখের হলেও এর স্থায়িত্ব ছিল ক্ষণিকের। সদ্যোজাত শিশু যেমন প্রথম চোখ খুলে চারদিকে কৌতূহল নিয়ে তাকায়। কিন্তু পরক্ষণেই অজানা-অচেনা পরিবেশে নিজেকে আবিষ্কার করে চিৎকার করে ওঠে-অনেকটা তেমন।

অন্ধকার নেমে এলেও, লম্বা রাতটা কাটানোর মতো কোনো জায়গা খুঁজে পাই না। টের পাচ্ছিলাম, কিছু একটা আমার একেবারে ভেতর থেকে আতঙ্কে চিৎকার করছে। আমি তখন ক্লান্তির চরম সীমায়। পেটেও ক্ষুধার জ্বালা। কিছুটা সময় একটা দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চারদিকে তাকাই। দেখি-সামনের প্রশস্ত রাস্তাটি সাগরের মতো দিগন্ত-বিস্তৃত। আমি যেন সেই সাগরে ছুড়ে ফেলা নুড়ি মাত্র। গড়াগড়ি খাচ্ছি-বাসে-গাড়িতে চড়া কিংবা রাস্তায় হেঁটে চলা জনারণ্যে-দৃষ্টিহীনদের মধ্যে, কোনো কিছু দেখতে অক্ষমদের মধ্যে। প্রতি মিনিটে হাজার-জোড়া চোখ আমার সামনে দিয়ে পার হলেও তাদের কাছে আমি অস্তিত্বহীন।

অন্ধকারে হঠাৎ টের পাই কিংবা বলা যায় অনুভব করি, দুটো চোখ খুব আস্তে আস্তে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছে, আরও কাছে। সুযোগসন্ধানী চোখ দুটো দৃষ্টি নামিয়ে, আমার জুতা জোড়ায় কয়েক মুহূর্ত থেমে, তারপর ধীরে ধীরে পা-ঊরু-পেট-স্তন-ঘাড় বেয়ে উঠে, শেষমেশ আমার চোখে স্থির হয়ে এঁটে বসে-সেই একই সুযোগসন্ধানী শীতল দৃষ্টি।

মৃত্যুভয় কিংবা সাক্ষাৎ মৃত্যুর মতো কাঁপুনি আমার শরীর বেয়ে নেমে আসে। কাঁপুনি বন্ধ করতে এবং আমার সমস্ত অস্তিত্ব নাড়িয়ে দেওয়া-আতঙ্ক তাড়াতে, আমি পিঠ ও মুখের পেশি টানটান করি। যত যাই হোক, আমি তো আর ছুরি বা ক্ষুর ধরা-হাত মোকাবিলা করছি না। করছি-দুটো চোখ, দুটো চোখই তো। কষ্টেসৃষ্টে একটা ঢোক গিলে, এক কদম আগাই। চোখ দুটো পেছনে ফেলে কয়েক কদম আগাতে পারলেও পেছনে সেগুলোর উপস্থিতি টের পাই, আমাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করছে। আলো ঝলমলে একটা ছোট দোকান চোখে পড়লে, সেদিকে দ্রুত পা চালাই। দোকানটায় ঢুকে, ছোট্ট জটলায় লুকানোর চেষ্টা করি। কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এসে, সতর্ক দৃষ্টিতে রাস্তার এপাশ-ওপাশ বারবার দেখে নিই। চোখ দুটো নেই নিশ্চিত হলে, রাস্তা ধরে জোরে দৌড় লাগাই। মনে তখন একটাই চিন্তা-কত দ্রুততম সময়ে চাচার বাসায় পৌঁছানো যায়।

–––

ফিরে আসার পর, জানি না কেমন করে চাচার বাসায় মানিয়ে চললাম, আর কেমন করেই বা শেখ মাহমুদের স্ত্রী বনে গেলাম। শুধু এটুকু জানতাম, সেই দুটো চোখের চাহনি মোকাবিলার আতঙ্কের কাছে পৃথিবীর তাবৎ ভয় নস্যি। চাহনিটি মনে পড়লেই আমার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোত নেমে আসত। মনে পড়ে না, চোখ দুটোর রং কী ছিল-সবুজ, কালো, নাকি অন্য কিছু। দেখতে কেমন তাও মনে পড়ে না-বিশাল, আয়ত না সরু। এরপর থেকে দিনে বা রাতে রাস্তায় নামলেই, এমন সাবধানে চারদিকে তাকাতাম, যেন এই বুঝি চোখ দুটো আমার সামনে মাটি ফুঁড়ে উদয় হয়ে তেড়ে আসবে।

অবশেষে চাচার বাসা ছেড়ে শেখ মাহমুদের ঘরে যাওয়ার দিনটি চলে আসে। কাঠের কাউচ ছেড়ে নরম বিছানায় ঘুমানো শুরু হয়। কিন্তু রান্নাবান্না, কাপড়চোপড় ধোয়া, বিশাল বাসার যাবতীয় আসবাব ঝাড়া-মোছার ক্লান্তি নিয়ে যেই-না বিছানায় গা এলিয়েছি, অমনি শেখ মাহমুদের আগমন ঘটত। তার বয়স তখনই ষাটের ওপর, আর আমার উনিশও হয়নি। তার চিবুকে, ঠোঁটের ঠিক নিচটা অনেক ফোলা, মাঝখানে আবার গর্ত। কোনো কোনো দিন গর্তটা থাকত শুকনো, আবার কখনো কখনো পুরোনো জং ধরা কলের মতো তা থেকে রক্তের মতো লালচে বা পুঁজের মতো সাদাটে রস ফোটায় ফোটায় ঝরত।

গর্তটি শুকনো থাকলে, চুমু খেতে দিতাম। তখন ফোলাটা আমার গালে, ঠোঁটে টের পেতাম। মনে হতো, সেটি যেন একটি ছোট্ট পুঁটলি বা ফোড়ার মতো, আঠালো রসে টইটম্বুর। কিন্তু ভেজা থাকলে, গর্তটি থেকে ভুরভুর করে ভেসে আসা পচা-গলা কুকুরের লাশের গন্ধ এড়াতে আমার মুখ-ঠোঁট যতটা সম্ভব অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতাম।

রাতে তার হাত-পা আমার সারা শরীর পেঁচিয়ে ধরত, আর বুড়োটে-কর্কশ হাত দুটো আমার সারা শরীর হাতড়ে বেড়াত। বহুকালের অভুক্ত মানুষ সামনে এক থাল খাবার পেলে যেমন চেটেপুটে সাবাড় করে, হাতের স্পর্শটা অনেকটা সেইরকম।

খুব একটা খেতে পারত না সে। মুখের ফোলাটার কারণে ঠিকমতো চোয়াল নাড়াতে পারত না, আর বুড়ো-চিমসানো পেটে বেশি খাবার গেলে বদহজম হতো। তবে খুব অল্প খেলেও, প্রতিবার খাবারের সময় রুটির শেষ টুকরোটি প্লেটে ঘষতে ঘষতে প্লেট একদম ফকফকা করে দিত। আমি খাওয়ার সময় আমার দিকে চোখ রাখত আর প্লেটে সামান্য কিছুও রয়ে গেলে, সঙ্গে সঙ্গে সেটুকু তুলে নিজের মুখে পুরে গেলার পর, অপচয়ের জন্য আমাকে দুই–চার কথা শুনিয়ে দিত। যদিও সাবান-পানিতে ঘষে ওঠানোর অপেক্ষায় প্লেটে লেগে-থাকা প্রায়-অদৃশ্য দু–একটা দানা ছাড়া নষ্ট করার মতো কিছুই আসলে থাকত না।

হাত-পায়ের বাঁধন শিথিল হয়ে এলে, আমি তার শরীরের নিচ থেকে পিছলে বের হয়ে, পা টিপে টিপে বাথরুমে যেতাম। মুখ, ঠোঁট, হাত, ঊরু ও শরীরের প্রতিটি অঙ্গ, আনাচকানাচ, প্রতিটি ইঞ্চি সাবান-পানি দিয়ে বারবার করে ঘষে ঘষে ধুতাম।

শেখ মাহমুদ তত দিনে কাজ থেকে অবসর নিয়েছে-কাজকর্মহীন, বন্ধুবান্ধবহীন। ঘরের বাইরে যেত না, কোনো কফিশপেও বসত না পাছে কফির পেছনে দুই–চার পয়সা খরচ হয়। সারা দিন আমার সঙ্গে সঙ্গে সারা ঘরে ঘুরঘুর করত-রান্নাবান্না, ধোয়াধুয়ির সময়ও। গুঁড়া সাবানের প্যাকেট কখনো হাত থেকে পড়ে মেঝেতে কয়েকটি দানা গড়ালেই সেরেছে। লাফ দিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে, আমার অসতর্কতার জন্য দুই–চার কথা শুনিয়ে দিত। এবং চামচ একটুখানি বেশি ডুবিয়ে কৌটো থেকে ঘি তুলতে গেলেই, রাগে চেঁচিয়ে উঠে মনে করিয়ে দিত-সময়ের আগেই ঘি ফুরিয়ে যাচ্ছে। ময়লাওয়ালা ময়লার বালতি খালি করতে আসার আগেই, ভালো করে বালতি ঘেঁটে তারপর তা বারান্দায় রাখত। একদিন বালতিতে খুব সামান্য এঁটোকাঁটা পেয়ে আমার সঙ্গে এত তুলকালাম কাণ্ড ঘটায় যে, প্রতিবেশীরাও তা শুনতে পায়। এই ঘটনার পর থেকে সে আমাকে নিয়মিত মারধর শুরু করে, কারণে-অকারণে।

একবার আমাকে আপাদমস্তক জুতাপেটা করলে, আমার মুখ-শরীর ফুলে ওঠে ও কালশিটে পড়ে যায়। সেবারে আমি বাসা ছেড়ে চাচার ওখানে গিয়ে উঠি। কিন্তু চাচা বলেন, সব স্বামীই বউ পেটায়, আর চাচি যোগ করেন, তিনিও নাকি প্রায়ই মার খান। আমি বলি, চাচার মতো ধর্মীয় বিষয়ে বিজ্ঞ একজন সম্মানিত শেখের পেটানোর স্বভাব থাকতেই পারে না। কিন্তু তিনি বলেন, ধর্ম-জ্ঞানওয়ালা পুরুষেরাই বরং বউ পেটায়। ধর্মে এমন শাস্তির অনুমতি আছে। কোনো সতী-সাধ্বী নারীর, স্বামী নিয়ে অভিযোগ থাকতে নেই। তার দায়িত্ব শুধুই-প্রশ্নহীন-একান্ত আনুগত্য।

আমি কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলি। কাজের মেয়ে দুপুরের খাবার টেবিলে দেওয়ার আগেই, চাচা আমাকে আমার স্বামীর ঘরে দিয়ে আসেন। আমরা পৌঁছে দেখি, ততক্ষণে তিনি একাই দুপুরের খাওয়া সেরে ফেলেছেন। দিন গড়িয়ে অন্ধকার নেমে আসে, কিন্তু একবারও জানতে চান না আমার পেটে দানাপানি পড়ল কিনা। আমার সঙ্গে একটি কথাও না বলে চুপচাপ, একা রাতের খাওয়া সেরে ওঠেন। পরদিন সকালে আমি নাশতা বানালে খেতে বসেন ঠিকই, কিন্তু আমার সঙ্গে চোখাচোখি এড়িয়ে যান। আমি নাশতা করতে বসলে তিনি মুখ তোলেন, আমার প্লেটের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন। আমি তখন প্রচণ্ড ক্ষুধার্ত, যা-ই হোক কিছু একটা খাওয়া ভীষণ দরকার আমার।

খাবারের প্রথম গ্রাস মুখে তুলতে না তুলতেই তিনি চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠেন: ‘চাচার ওখান থেকে ফিরলে কেন, হ্যাঁ? কয়েকটা দিনও বুঝি খাওয়াতে পারল না? এইবার বুঝলে তো, আমি ছাড়া তোমার যে আর গতি নাই, তোমাকে খাওয়ানোর কেউ নাই? আমাকে এড়িয়ে চল কেন তাহলে? কেন মুখ ফিরিয়ে নাও? আমি কুৎসিত বুঝি? দুর্গন্ধ? আমি কাছে এলেই সরে যাও কেন?

তিনি খ্যাপা কুকুরের মতো আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। তার ফোড়ার গর্ত থেকে তখন ফোটায় ফোটায় দুর্গন্ধ পুঁজ ঝরছে। এবারে আমি আর মুখ, নাক সরাই না। কোনো রকম প্রতিরোধ ছাড়াই আমার মুখ তাঁর মুখে, আমার অসাড় শরীরটি তাঁর শরীরে ছেড়ে দিই। আমার শরীর থেকে সমস্ত জীবনীশক্তি যেন শুষে নেওয়া হয়েছে। পড়ে আছি-এক টুকরো মরা কাঠ কিংবা অযত্নে পড়ে থাকা পুরোনো আসবাব কিংবা চেয়ারের নিচে ফেলে রেখে ভুলে যাওয়া জুতা-জোড়ার মতো।

একদিন তিনি মোটা লাঠি দিয়ে আমাকে পেটাতে থাকলে, আমার নাক-কান থেকে রক্ত ঝরতে শুরু করে। আমি ঘর ছাড়ি। কিন্তু এবার আর চাচার ওখানে না। ফোলা চোখ আর কালশিটে মুখ নিয়ে রাস্তায় হাঁটতে থাকি, কিন্তু কেউ আমাকে খেয়াল করে না। বাসে, গাড়িতে বা পায়ে হেঁটে সবাই শুধু ছুটছে। সবাই যেন অন্ধ, কিছুই দেখতে পায় না। আমার চোখের সামনে রাস্তাটি যেন অসীম সমুদ্রের মতো বিস্তৃত। আমি এতে ছুড়ে ফেলা এক নুড়ির মতো-ঢেউয়ের আঘাতে আঘাতে জর্জরিত, এদিক-ওদিক ভেসে গড়াতে গড়াতে কোনো এক সৈকতে এসে পড়ে আছি। কিছু সময় পর হেঁটে ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে পড়লে, হঠাৎ সামনে ফুটপাতে একটি খালি চেয়ার পেয়ে বসে পড়ি। নাকে কফির কড়া গন্ধ পাই। টের পাই, আমার জিভ শুকিয়ে খটখটে হয়ে আছে, ক্ষুধাও পেয়েছে ভীষণ। ওয়েটার এসে কী নেব জানতে চাইলে, কাতরভাবে এক গ্লাস পানি চাই।

ওয়েটার আমার দিকে রেগে তাকিয়ে জবাব দেয়, কফি হাউস রাস্তার লোকের জন্য না। আরও বলে, সৈয়দা জয়নব দরগা খুব কাছেই, সেখানে গেলে পানির অভাব হবে না। আমি চোখ তুলে তার দিকে তাকাই। সে একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে, আমার মুখের এই দশা কীভাবে হলো তা জানতে চায়। জবাব দিতে চেষ্টা করি, কিন্তু মুখে কথা ফোটে না। হাতে মুখটি ঢেকে ফোঁপাতে থাকি। সে একমুহূর্ত ইতস্তত করে চলে যায়, কিছুক্ষণ পর এক গ্লাস পানি হাতে ফিরে আসে। কিন্তু পানি ঠোঁটে ছোঁয়াতেই গলায় আটকে যেন বিষম খাওয়ার মতো হয়, আর ঠোঁটের কোনা বেয়ে গড়াতে থাকে। কিছু সময় পর, কফি হাউসের মালিক বেরিয়ে এসে আমার নাম জানতে চান।

জবাব দিই, ‘ফেরদৌস।’

তিনি আরও জিজ্ঞেস করেন, ‘মুখের এই জখমগুলো কিসের? কেউ মেরেছে?’

আবারও বলতে গিয়ে আমার গলা ধরে আসে। শ্বাসকষ্ট হতে থাকে, নাক টানতে থাকি, ঢোক গিলতে থাকি।

তিনি বলেন, ‘কিছুক্ষণ এখানে থাক। বিশ্রাম নাও। এক কাপ গরম চা এনে দিচ্ছি। খিদে পেয়েছে?’

পুরোটা সময় আমার চোখ মাটির দিকে, একটিবারের জন্যও তাঁর দিকে তাকাই না। তাঁর চাপা, ফ্যাসফ্যাসে কণ্ঠস্বর শুনে বাবার কথা মনে পড়ে যায়। বাবা খাওয়াদাওয়া শেষে, মাকে পিটিয়ে শান্ত হলে পর এভাবেই আমাকে জিজ্ঞেস করতেন, ‘খিদে পেয়েছে?’

এই প্রথমবারের মতো হঠাৎ করে মনে হয়, বাবা মানুষটি আসলে ভালোই ছিলেন। অবচেতনে তাঁর জন্য মন কেঁদেছে, নিজের অজান্তে মনের গহিন কোণে তাঁকে ভালোও বেসেছি।

লোকটিকে বলতে শুনি, ‘বাবা বেঁচে আছেন?’

জবাব দিই, ‘না। মারা গেছেন।’ এবং প্রথমবারের মতো বাবার শোকে কাঁদি।

লোকটি আমার কাঁধ চাপড়ে বলেন, ‘সবাইকেই একদিন মরতে হবে, ফেরদৌস। আর মা? বেঁচে আছেন?’

জবাব দিই, ‘না।’

তিনি চাপাচাপি করতেই থাকেন, ‘আত্মীয়স্বজন? ভাই বা চাচা-মামা কেউ?’

আমি মাথা নেড়ে আবারও বলি, ‘না।’ তারপর দ্রুত ছোট্ট ব্যাগটা খুলতে খুলতে বলি, ‘কিন্তু স্কুলের সার্টিফিকেট আছে। আমার এই মাধ্যমিক বা প্রাথমিক স্কুলের সার্টিফিকেট দিয়ে যদি একটা চাকরিবাকরি জোটে আর কী। প্রয়োজনে আমি যেকোনো কাজ করতে রাজি। যে কাজে সার্টিফিকেটের দরকার নেই, তা-ও।’

লোকটির নাম বেইউমি। চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকাই, কিন্তু মনে কোনো রকম ভয় জাগে না। তাঁর নাকটা দেখতে বাবার মতো-বিশাল, গোল। গায়ের রংও বাবার মতোই কালো। চোখের দৃষ্টিতে হাল ছাড়া-শান্ত ভাব। এই চোখ খুনির না। হাত দুটোও বাধ্য-অনুগত, নড়াচড়া ধীর-শিথিল। মনে হলো না, এই হাত দিয়ে মানুষটির পক্ষে হিংস্র বা নিষ্ঠুর কোনো কাজ সম্ভব। বললেন, দুই কামরার বাসায় তিনি থাকেন। কাজ পাওয়া পর্যন্ত একটি কামরায় চাইলে আমি থাকতে পারি।

বাসায় যাওয়ার পথে তিনি ফলের দোকানে থেমে জিজ্ঞেস করেন, ‘কমলা কোন জাতের পছন্দ, বড় না ছোট?’

আমি উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করি কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হয় না। কেউ আমার কাছে কোনো দিন জানতে চায়নি, কোন জাতের কমলা আমার পছন্দ। বাবা তো জীবনে কখনো ফলই কেনেননি। আর চাচা ও স্বামী কিনতেন বটে, কিন্তু কখনো আমার পছন্দ-অপছন্দ জানতে চাননি। সত্যি বলতে, আমি নিজেই কখনো ভেবে দেখিনি, কোন জাতের কমলা আমার বেশি ভালো লাগে। তিনি আবার জিজ্ঞেস করেন,

‘কোনটা নেব, বড় না ছোট?’

এবারে জবাব দিই, ‘ছোট।’ কেনা হলে পরে টের পাই, বড় জাতের কমলাই আমার বেশি পছন্দ, কিন্তু সংকোচে বলতে পারি না। সেগুলোর দাম আবার বেশি কিনা।

সরু গলির ভেতর, বেইউমির দুই কামরার ছোট্ট একটি বাসা। বাসার সামনেই মাছের বাজার। আমি ঘরদোর ঝাড়পোঁছ করতাম আর নিচের বাজার থেকে মাছ, খরগোশ বা মাংস কিনে এনে তাঁর জন্য রাঁধতাম। তিনি সারা দিন কফি হাউসে না খেয়েই একটানা কাজ করতেন আর কাজ শেষে বাড়ি ফিরে একগাদা খেয়ে নিজ কামরায় শুয়ে পড়তেন। আমি অন্য কামরার মেঝেতে, তোশকের ওপর ঘুমাতাম।

প্রথম যেদিন তাঁর বাসায় আসি, তখন শীতকাল। রাতে ভীষণ ঠান্ডা পড়ে। তিনি বলেন, ‘তুমি বিছানায় যাও, আমি বরং মেঝেতে শুই।’

আমি রাজি হই না। মেঝেতেই শুয়ে পড়ি। চোখ লেগে আসে। কিন্তু তিনি কাছে এসে আমাকে হাত ধরে উঠিয়ে বিছানার দিকে আগান। আমি মাথা নিচু করে তাঁর পাশে পাশে যাই। এতটাই সংকোচ বোধ করি যে, বার কয়েক হোঁচট খাই। জীবনে কেউ কখনো আমাকে তার নিজের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়নি। বাবা শীতকালে উনুনের কামরাটি দখল করে আমাকে থাকতে দিতেন কোনার ঠান্ডায়। চাচা নিজে থাকতেন বিছানায় আর আমার জন্য ছিল কাঠের কাউচ। বিয়ের পর, স্বামী নিজে দ্বিগুণ খেলেও, তার চোখ থাকত সব সময় আমার পাতে।

আমি বিছানার পাশে একমুহূর্ত দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে বলি: ‘কিন্তু বিছানায় তো আমি শুতে পারব না।’

তিনি বলেন, ‘আমি যে তোমাকে কিছুতেই মেঝেতে শুতে দিতে পারি না।’

আমার মাথা তখনো নিচে আর তিনি আমার হাত আঁকড়ে ধরে আছেন। আমাকে স্পর্শ করামাত্রই টের পেয়েছিলাম, তাঁর হাত দুটো বিশাল, আঙুলগুলো লম্বা লম্বা-আমার চাচার মতো। আর ওই মুহূর্তে চাচার মতোই আঙুলগুলো কাঁপতে শুরু করে৷ আমি চোখ বুজে ফেলি।

তাঁর আচমকা স্পর্শ যেন সুদূর অতীতের স্বপ্ন কিংবা কোনো আজন্ম-স্মৃতি বয়ে নিয়ে আসে। শরীরময় স্পন্দিত হতে থাকে অচেনা এক সুখানুভূতি কিংবা বেদনা৷ কিন্তু এই বেদনা যন্ত্রণার নয়, সুখের বরং। এই সুখ আমার জন্য একেবারেই নতুন। অন্য জন্মে পেয়ে থাকলেও এ জন্মে যা জোটেনি, অন্য কোনো শরীরে জুটলেও সেই শরীর যেন আমার না।

শেষমেশ পুরো শীতকাল ও পরের গ্রীষ্ম আমার কাটে সেই বিছানায়। তিনি কখনো আমার গায়ে হাত তুলতেন না, খাবার সময়েও পাতে চোখ রাখতেন না। তবু মাছ রাঁধলে পুরোটাই তাঁর পাতে তুলে দিয়ে, নিজের জন্য রাখতাম শুধু মাথা বা লেজটা। আর খরগোশ রাঁধলে পুরোটা তাঁকে দিয়ে, মাথাটুকু আমি চিবুতাম। ক্ষুধা নিয়েই সব সময় টেবিল ছাড়তাম। বাজারে যাওয়ার পথে, রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়া স্কুলের মেয়েদের খেয়াল করতাম আর মনে পড়ত-একসময় আমি তাদেরই একজন ছিলাম, মাধ্যমিক সার্টিফিকেটও পেয়েছিলাম। একদিন ছাত্রীদের একটি দলের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পড়ি। তারা তাচ্ছিল্য ভরে আমাকে আপাদমস্তক মাপে, আমার কাপড়চোপড় থেকে তখন ভুরভুর করে আঁশটে গন্ধ আসছে। তাদের বলি আমার মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেটের কথা। তারা আমাকে নিয়ে হাসাহাসি শুরু করে।

শুনি একজন আরেকজনের কানে কানে বলছে: ‘পাগল নিশ্চয়ই। দেখছিস না কেমন নিজে নিজে কথা বলছে?’

আমি কিন্তু মোটেও নিজে নিজে কথা বলছিলাম না। শুধু তাদের জানাতে চাইছিলাম যে, আমার মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট আছে।

সেই রাতে বেইউমি বাড়ি ফিরলে তাঁকে বলি, ‘আমার তো সার্টিফিকেট আছে, আমি একটা কাজে ঢুকতে চাই।’

তিনি বলেন, ‘প্রতিদিন কফি হাউসে অসংখ্য ছেলেমেয়ে জড়ো হয়। সবাই বেকার, বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্টিফিকেট নিয়ে বসে আছে।’

‘কিন্তু কাজ তো আমাকে করতেই হবে। এভাবে আর পারছি না।’

আমার দিকে মুখ না তুলে তিনি জানতে চান, ‘এভাবে পারছ না মানে? কী বোঝাতে চাইছ?’

‘আপনার বাসায় আর থাকা সম্ভব না,’ তোতলাতে তোতলাতে বলি। ‘আমি একটা মেয়ে আর আপনি পুরুষ। লোকজন কানাঘুষা করছে। তা ছাড়া কথা তো ছিল, আপনি একটা কাজ জোগাড় করা পর্যন্ত শুধু এখানে থাকব।’

তিনি রেগেমেগে বলেন, ‘আমি কী করতে পারি? স্বর্গে ধরনা দেব?’

‘আপনি তো সারা দিন কফি হাউসে ব্যস্ত। চাকরি খোঁজার চেষ্টাটাই বা করলেন কখন! এখন থেকে আমি নিজেই বেরোব।’

নিচু গলায় কথা বলছিলাম, চোখও মাটির দিকে, কিন্তু তারপরও তিনি লাফিয়ে উঠে আমার গালে ঠাস করে চড় কষিয়ে বলেন, ‘এত্ত বড় সাহস, আমার সঙ্গে গলা চড়িয়ে কথা বলে, রাস্তার মেয়েলোক, নষ্ট মেয়েছেলে!’

তাঁর হাত বিশাল আর সবল। মনে হলো, এমন জোরে চড় জীবনেও খাইনি। চড়ের চোটে আমার মাথা এদিক-ওদিক ঘুরে ওঠে। মনে হচ্ছিল, দেয়াল আর মেঝে ভয়ংকরভাবে দুলছে। মাথাটা ঠিকঠাক হওয়া পর্যন্ত দুই হাতে চেপে ধরে রাখি, এরপর চোখ তুলে তার চোখে তাকাই।

রোষে ভরা এই চোখ দুটো যেন আমি প্রথমবারের মতো দেখছি। নিকষ কালো বৃত্ত দুটো, আমার চোখ থেকে সরে গিয়ে যেন অতি ধীরে অনন্তকাল ধরে আমার সারা মুখ ঘুরে, গলা বেয়ে, স্তন হয়ে, পেটে নেমে এসে, তলপেটেরও নিচে-ঊরুসন্ধিতে গিয়ে স্থির হয়। আমার মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল-মৃত্যুর মতো শীতল-কাঁপুনি বয়ে যায়। আমার হাত দুটো স্বয়ংক্রিয়ভাবে নেমে গিয়ে, তাঁর দৃষ্টি থেকে আমার অঙ্গটি ঢাকার চেষ্টা করে। কিন্তু তাঁর বিশাল, সবল হাত দুটো এক ঝটকায় আমার হাত সরিয়ে দেয়। পরমুহূর্তে তিনি আমার পেটে এমন জোরে এক ঘুষি বসান যে, আমি সঙ্গে সঙ্গেই জ্ঞান হারাই।

তিনি তখন থেকে আমাকে তালাবন্দী করে বাইরে বের হতেন। আর আমার ঠাঁই হয় পাশের কামরার মেঝেতে। মাঝরাতে ফিরে তিনি আমার গা থেকে এক টানে চাদর সরিয়ে, গালে কষে এক চড় লাগিয়ে, শরীরের সবটুকু ওজন নিয়ে আমার ওপর চড়াও হতেন। আমি চোখ দুটো বন্ধ করে, নিজের সত্তাকে শরীর থেকে আলাদা করে ফেলতাম। আমার শরীরটি তাঁর শরীরের নিচে নিঃসাড় পড়ে থাকত। কামনাহীন, সুখহীন, এমনকি যন্ত্রণাহীন-পুরোপুরি অনুভূতিহীন যাকে বলে। একটি নিথর দেহ যেন পড়ে আছে, যেখানে প্রাণের লেশমাত্র নেই। এক টুকরো কাঠ বা একটি মোজা, বা এক পাটি জুতার মতো। তারপরে এক রাতে, তাঁর শরীরের ওজন যেন বেশি মনে হলো, শ্বাসপ্রশ্বাসের গন্ধও অন্য রকম ঠেকল। চোখ তুলে দেখি, সামনে ঝুলে থাকা মুখটি বেইউমির না।

জিজ্ঞেস করি, ‘কে তুমি?’

জবাব আসে, ‘বেইউমি।’

আমি প্রতিবাদ করে বলে উঠি, ‘তুমি তো বেইউমি না। কে তুমি?’

‘কী ফারাক তাতে? বেইউমি যা, আমিও তা।’ এরপর জিজ্ঞেস করে, ‘মজা পাচ্ছ তো?’

জানতে চাই, ‘কী বললে?’

সে আবারও জিজ্ঞেস করে, ‘মজা পাচ্ছ তো?’

আমার যে কোনো অনুভূতিই হচ্ছিল না, ভয়ে তা বলতে পারলাম না। তাই আবারও চোখ বুজে বলি, ‘হ্যাঁ।’

সে আমার কাঁধে দাঁত বসিয়ে দেয়। বারবার স্তন আর পেটে কামড়াতে থাকে। একই সঙ্গে বলতে থাকে: ‘খানকি, মাগি।’ তারপর আমার মা তুলে গালাগাল শুরু করে, যা আমি ঠিকমতো খেয়াল করে উঠতে পারি না। কিন্তু সেই রাতের পর গালাগালগুলো বেইউমি ও তাঁর বন্ধুদের কাছ থেকে প্রায়ই শুনতাম। শুনতে শুনতে একসময় সেসবের সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে উঠি। তালাবদ্ধ দরজা খোলার চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে, কখনোসখনো আমার মুখ দিয়েও গালি বেরিয়ে যেত।

দরজা চাপড়াতে চাপড়াতে চিৎকার করে বলতাম: ‘বেইউমি, … এর বাচ্চা।’ বলার ফাঁকে শেষ মুহূর্তে টের পেতাম, গালিটা তাঁর মায়ের ওপরে যাচ্ছে, যা একেবারেই ঠিক হচ্ছে না। তাই শব্দ পালটে তাঁর বাপের ওপর দিয়ে চালিয়ে দিতাম।

একদিন দরজার সঙ্গে দাঁড়িয়ে কান্না করার সময়, জাফরিকাটা দিয়ে এক প্রতিবেশিনী আমাকে দেখে ফেলেন। কী হয়েছে জানতে চাইলে সব খুলে বলি। শুনে তিনি নিজেও আমার সঙ্গে কেঁদে ফেলেন। পুলিশ ডাকার পরামর্শ দেন। কিন্তু আমি পুলিশের নাম শুনেই ঘাবড়ে যাই। তাঁকে বরং কাঠমিস্ত্রি ডেকে আনতে বলি। কিছু সময় পর মিস্ত্রি এসে দরজা ভাঙলে, আমি এক দৌড়ে বেইউমির বাসা ছেড়ে রাস্তায় নেমে আসি। রাস্তাই তখন আমার একমাত্র নিরাপদ ঠাঁই-আমার সমস্ত অস্তিত্বটুকু নিয়ে যেখানে আমি পালিয়ে আশ্রয় নিতে পারি। দৌড়ের ফাঁকে বারবার ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে ফিরে দেখতে থাকি, বেইউমি আমাকে অনুসরণ করছে কিনা। আর প্রতিবার সে আসছে না নিশ্চিত হয়ে, আরও জোরে ছুট লাগাই। (চলবে)

ফারহানা আজিম শিউলী: কানাডার টরন্টোপ্রবাসী।

ধারাবাহিক এই উপন্যাসের আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন: